জ্বলদর্চি

স্মৃতিভেজা পুজো প্রাঙ্গণে /অনিমেষ মন্ডল

বসতবাড়ি


স্মৃতিভেজা পুজো প্রাঙ্গণে


অনিমেষ মন্ডল

"আশ্বিনের শারদ প্রাতে
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির,
ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা,
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত
জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমনবার্তা,..."


এই মোহময় কন্ঠধ্বনির মায়াজালে জড়িয়ে নেই এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। বিশ্বায়নের রথের চাকা আধুনিক থেকে অত্যাধুনিকের দিকে ছুটছে। আমরা যখন আন্তর্জালের মোহে আচ্ছন্ন, তখনও এই সুর হৃদয়ের নিভৃতে আলাদা এক তান তুলে। মুগ্ধতা আনে। জগজ্জননীর আগমনের সঙ্গে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্তোত্রের নিবিড় যোগ শাশ্বত রূপ পেয়েছে। সেই উদাত্ত কন্ঠের সুর শোনার জন্য কান পেতে থাকতাম শৈশব থেকেই। আধোঘুম,আধোনিদ্রার মধ্যে অবগাহন করতাম এক মায়ার জগতে। রাতের শেষ অন্ধকার ধীরে ধীরে মুছে যেত মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনতে শুনতে । শিশির ভেজা শিউলি কুড়োতে কুড়োতে এক তৃপ্ত দিনের উঠোনে পা দিতাম। এখনো নস্টালজিক করে তোলে শৈশব, কৈশোরের সেই দিনগুলো। রেডিওর মহালয়া শোনার মাধ্যমেই আমরা যেন পুজোর আনন্দের প্রথম স্পর্শ পেতাম। সে যেন এক অলৌকিক ভোর।

মন্দির ও দক্ষিণের ভোগ রান্নার ঘর

             মহাকালের পথ ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি।এই মধ্য তারুণ্যের দিনে সেই আবেগ হয়তো অনেকটাই স্তিমিত। তবে আজও সেই ভালোলাগা চেতনার অন্তরাল ছুঁয়ে যায়। স্নিগ্ধতা ছড়ায়। পুজো তো কেবল পাঁচটা দিন আনন্দে মেতে ওঠা নয়। শুধু আড্ডা, প্রতিমা দর্শন,সাজগোজ,প্যান্ডেল হপিং নয়। এ এক আবেগ। এক আবেশে কয়েকমাস আগে থেকেই আমরা ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ি। পুজোর দিন যত কাছে এগিয়ে আসে,এই মোহ আবেশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ওঠে। সময় সেচে শৈশব, কৈশোরের সেই অনাবিল আনন্দ মুঠো ভরে তুলে আনতে মন চায়।হৃদয় পূর্ণ করি সেই উচ্ছ্বাসে। ফিরে যাই কাঁচাসোনা রোদ বিছানো মন্ডলদের পুজো প্রাঙ্গণে।

            পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি শহর থেকে প্রায় ১২ কি মি দূরত্বে ঝাওয়া মান রাউৎ বাড় গ্রাম অবস্থিত। এই গ্রামেরই মন্ডলদের বনেদি দুর্গোপুজো পাশাপাশি এলাকায় সুপ্রসিদ্ধ। মন্ডলদের দুটো শরিকের মধ্যে জগজ্জননী মায়ের দুটি রূপের আরাধনা হয়। এক শরিক শরৎকালে দেবী দুর্গার আবাহনে ব্রতী হন।আর এক শরিকের বংশধররা বসন্তকালে দেবী বাসন্তীর আরাধনায় মেতে ওঠেন। আমাদের পরিবার এই বংশেরই। তবে এখানে দশভুজা দেবী দুর্গা ও তাঁকে কেন্দ্র করে যে স্মৃতি,তাই তুলে ধরবো। মন্ডলদের  পূর্ব পুরুষরা জমিদার ছিলেন। প্রায় সার্ধ শতক বছর ধরে এই পুজো হয়ে আসছে। আজ থেকে ২০ বছর আগেও এলাকার জনপ্রিয় পুজো ছিল। বহু দূর দূরান্ত থেকে পুজো দেখতে লোকেরা পরিজনদের সঙ্গে আসতেন। বহু আগে এই মন্দিরের নির্মাণ হয়েছিল। যা এখন ভগ্নপ্রায়। ইঁটগুলো খসে পড়েছে । মন্দিরের গায়ে ফাটলের ক্ষত। গাছেদের শেকড় সেই ফাটলকে, দ্রুত ত্বরান্বিত করার জন্য সচেষ্ট। দক্ষিণ দিকে মন্দির লাগোয়া দেবীর ভোগ রান্নার জন্য একটা ঘর ছিল। ঘরটির সম্পূর্ণরূপ আর এখন নেই। উত্তর দিকে কয়েকটা ঘর ছিল। যে ঘরগুলোও এখন ভেঙে দিয়ে আবার নতুনভাবে সাজানোর চেষ্টা চলছে।

            পুজোকে কেন্দ্র করে মেলা বসতো ।  জমিদার বাড়ি থেকে অনতিদূরে একটা ছোটো মাঠ আছে। যাকে গ্রামের মানুষেরা 'খলা বাহার' বলে ।'খেলা' থেকে 'খলা' কথাটি এসেছে বোধহয় আর 'বাহার' 'মাঠ' অর্থে ব্যবহার হয়। যাই হোক এই মাঠের একদিকে বড়ো দীঘি। পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে একটা খাল। মাঠে তো দোকান বসতো, খালপাড় ধরে সারি সারি দোকান বসে যেত। দু-তিনদিন আগে থেকেই দোকানিরা এসে জায়গা চাহ্নিত করে যেত। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় কিংবা ষষ্ঠীর সকালে দোকান বাঁধা হতো। তা দেখার জন্য আমরা ছুটোছুটি করতাম। গ্রামের লোকেরাও দোকান দিত। হরেক রকমের দোকান বসতো। মনোহারি,মিষ্টির দোকান অনেকগুলো আসতো। সব থেকে মজা হতো পালেদের মিষ্টি দোকানকে নিয়ে। পালেদের মিষ্টি দোকানের সরাঞ্জম আসতো খালে নৌকা ভাসিয়ে। সেই নৌকা আবার বাঁধা থাকতো খালের পাড়ে। অনেকে আবার সেই নৌকায় উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতো। বকুনি খেয়ে নেমে আসতে হতো। আমি যদিও ও পথ মাড়াতাম না। তবে সেই ছোট্টো নৌকাকে ঘিরে মনের মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ লেগে থাকতো।

          পুজোর প্রতিমা যিনি বানাতেন,তাঁর নাম ছিল হৃষিকেশ। আমার বাবা,কাকু্রা দাদু বলে ডাকতেন। খুব মজার মানুষ ছিলেন। পুজোর প্রায় এক মাস আগে চল আসতেন। এখানেই থাকতেন। কাঠামো বাঁধা যেদিন হতো, তবে থেকেই যেন আমাদের পুজো শুরু হয়ে যেত। তারপর খড় বাঁধা,দোমাটি করা,রঙ দেওয়া ---এসব এক অপার কৌতুহলে দেখতাম। পদ্মের পাঁপড়ি খোলার মতো কিছুদিন অন্তর ধীরে ধীরে সেই কৌতুহলের নিবৃত্তি ঘটতো। তা আর সম্পূর্ণ হতো না। যতদিন পর্যন্ত চক্ষুদান করে,দেবীর অস্ত্রগুলোকে হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় । প্রতিমাগুলোর  মধ্যে সব থেকে বেশি টানতো কার্তিক ঠাকুর আর গণেশের ইঁদুর। প্রতিমা বানানোর সঙ্গে সঙ্গে ছোটো ছোটো পুতুল, ইঁদুর,শিব, পেঁচা,হাঁস ইত্যাদি বানাতেন। সেগুলো বানিয়ে যখন রোদে শুকোতে দিতেন, ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা দাঁড়িয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। আমি মায়ের কাছে  বায়না ধরে দু'একটা পুতুল উনার কাছে বানিয়েও নিতাম। উনি এরকম বহু ধরণের মূর্তি বানাতেন। সেগুলো পুজোর পাঁচদিন মেলায় গিয়ে বিক্রি করতেন। বিক্রিও হতো বেশ।
            
             পুরোহিত মশায় যখন ষষ্ঠীতে ঘট তুলতে দীঘিতে যেতেন,সবাই কাঁসর ,ঘন্টা, শাঁখ বাজাতে বাজাতে পিছুপিছু যেত। পুজোর কদিন ঢাক বাজানোর জন্য ঢাকি আসতো। তারা থাকতো মন্দির লাগোয়া উত্তর দিকের ঘরে । তারা শুধু ঢাক বাজাতো না। বাঁশের পাত দিয়ে বেত, ঝুড়ি ইত্যাদি বানাতো। বাঁশগুলোকে ছিলে শুইয়ে দিতো বড়ো বারান্দায় । আমাদের ঘর পর্যন্ত চলে আসতো। কলা বউ স্নান করাতে গিয়ে একবার এক মজার ঘটনা ঘটলো । পুরোহিত ঠাকুর শ্যাওলা জমে যাওয়া ঘাটের সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে যান। এই দৃশ্য দেখার পর,আমার এক জ্যেঠতুতো দাদা ছবি আঁকে। দীঘির পাশে থাকা বড়ো তুলসীমঞ্চের দেওয়ালে সেই ছবি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আর নীচে লিখে দিল, "সাবধান, দেখে নামবেন" । এরপর শ্যাওলা তোলা হলো। তবুও সবাই ঘাটে নামার সময় ছবিটা দেখে সাবধান হয়ে যেত ।
 
          দীঘি

 পাঁচটা দিন কী করে যে সময় চলে যেত, বুঝতেই পারতাম না। শেষদিন খুব মন খারাপ হতো। মায়ের বিসর্জনের জন্য যেমন মন খারাপ করতো, তেমন মেলা ভেঙে যাওয়ার কষ্টটাও ভারাক্রান্ত করতো। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে সময় কাটানো,বন্দুকের টোটা ফাটানো,সন্ধ্যায় দলবেঁধে অন্যান্য কয়েকটি জায়গায় ঠাকুর দেখতে যাওয়া---এসব কিছু শেষ হয়ে যাবে ভেবে দুঃখ পেতাম। মনে হতো আরো কিছু দিন পুজো হলো না কেন? মাত্র পাঁচটা দিনের জন্য মা আসেন কেন? বিসর্জনের দিন গ্রামের সবাই চলে আসতো মাকে বিদায় দেওয়ার জন্য। দুর্গার দুই সখী ছিল জয়া,বিজয়া। এই দুটি কাঠামো ,প্রধান কাঠামোর থেকে আলাদা আলাদা হতো। জয়া, বিজয়াকে নিয়ে দুজন গ্রামের দাদু নাচত । নাচতে নাচতে কাঁদতো । অনেকক্ষণ ধরে এভাবে চলতো। তারপর প্রতিমাকে ভাসান দিতে যাওয়া হতো খালের জলে । পাশের গ্রামে পন্ডাদের  পুজো হতো। তারা খালের পূর্ব দিকে ভাসাতে আসতো। আমাদের প্রতিমা পশ্চিম দিকে কখনো কখনো এক সঙ্গে আবার কখনো একটু আগে পরে ভাসানো হতো।

           ধীরে ধীরে সব কিছু বদলে গেল। চারপাশে আরো কয়েকটি পারিবারিক পুজো শুরু হলো। বারোয়ারি পুজোর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। বারোয়ারি পুজোর জৌলুস,হুল্লোড়ের কাছে সুপ্রাচীন পুজো যেন ম্লান হয়ে গেল। যে মেলাকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষেরা মেতে উঠতো,সেই মেলার বহরও ধীরে ধীরে কমতে থাকলো। দোকান সংখ্যা অনেকটাই কমে গেল। লোক সমাগমেও ভাটা পড়লো। তবুও এক সুদীর্ঘ সময়ের ঐতিহ্য বহন করে আসছে এই বনেদি পুজো। এখনো গ্রামের মানুষদের কাছে গর্ব। সবার বাড়িতে আত্মীয়রা আসেন। ঘরগুলো আনন্দমুখর হয়ে ওঠে। পাঁচটা দিন চলে যায় নদীর স্রোতের মতো। আর সবাই অপেক্ষা করতে থাকে আবার একটা বছরের জন্য। শিশির ভেজা শিউলি, কিংবা কাশের হিল্লোল, মেঘের ভেলায় কখন আবার আসবে আগমনী বার্তা। শৈশব কৈশোরের সেই আবেগ হয়তো এখন নেই। কিন্তু এক আনন্দ মধুর আবেশ জড়িয়ে রাখে পুজোর দিনগুলো। এখনো নবমীর রাতে বিচ্ছেদের সুর ভারাক্রান্ত করে তোলে। সাধক কবি কমলাকান্তের সুর ধ্বনিত হয় হৃদয় অন্দরে :
"ওরে নবমী নিশি, না হইও রে অবসান।"

পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments