জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির ধারে-১৩/মলয় সরকার

খর্জুর বীথির ধারে

মলয় সরকার
(১৩শ পর্ব ) ত্রয়োদশ পর্ব

আম্মানের হোটেলে ঢুকেই গেলাম ওদের রিসেপসনে। গিয়ে একটা কমপ্লেন করলাম। বললাম, আগের দিন যখন তোমাদের এই হোটেলে ছিলাম। তোমরা আমার বিল অযথা বাড়িয়েছ কেন? ওরা বলে , আপনার লজিং আমরা আপগ্রেড করেছিলাম, আমাদের ফাঁকা ছিল তাই। আপনাকে স্পেশাল সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আমি তো রাগে ফেটে পড়লাম, এ কি তোমাদের খেয়াল খুশি নাকি? তোমরা কি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, আপগ্রেড করবে কি না, বা আমি পছন্দ করছি কি না? তোমাদের ইচ্ছামত, তুমি আমাকে আপগ্রেড করে বেশি চার্জ করতে পারে না। 
ওরা তো তখন তর্ক জুড়ে দিল। আমি বললাম, ডাক তোমাদের ম্যানেজারকে, না হলে আমি হায়ার লেভেলে কমপ্লেন করব। 
ইতঃমধ্যে, এই সব কথা কাটাকাটি শুনে ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন ম্যানেজার। বেশ সৌম্যদর্শন অল্প বয়সী একটি সুবেশ ভদ্রলোক। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে। সব শুনে উনি বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে যান। আমি দেখছি , আপনি আমাদের পুরানো কাস্টমার। হয়ত ওরা ভুল করে করেছে। আমি দেখছি ব্যাপারটা। আপনার সমস্ত বাড়তি টাকা আগামী কালেকের মধ্যেই ফেরত দিয়ে  আপনাকে মেসেজে জানিয়ে দেব।ধন্যবাদ দিয়ে রুমে গেলাম।

পরদিন সকালে আমরা তৈরী হয়ে সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে খেতে গেলাম। ব্রেকফাস্ট করে  রায়েধের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আজই আমাদের জর্ডন ঘোরার শেষদিন।তাই আমরা সমস্ত বাক্সপত্তর একেবারে সঙ্গে নিয়েই বেরোলাম, সেগুলো সারাদিন থাকবে রায়েধের গাড়িতে। সারাদিন দেখার শেষে ওখান থেকেই চলে যাব এয়ারপোর্টে।
বেরোলাম সকাল সকালই। আম্মানের হাওয়া এবং প্রকৃতি তখন অনেক শান্ত এবং ঠাণ্ডা। এখানে সকালটা বেশ মনোরম। সমস্ত বাড়ি গুলো এখানে কেমন যেন বাক্স বাক্স মনে হয় আমার। আমরা পৌঁছালাম শহরের মধ্যেই , একটু দূরের রোমান থিয়েটারে। এই থিয়েটারটি, এ পর্যন্ত যত রোমান থিয়েটার দেখেছি, বিভিন্ন জায়গায় , তার মধ্যে বোধ হয় সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছে। অবশ্য তার কারণও আছে। এটি যদিও তৈরী হয়েছিল দ্বিতীয় শতাব্দীতে (১৩৮-১৬১ সালের মধ্যে) রাজা Antonius Pius এর সময়, এটির উপর ঝড় ঝঞ্ঝা তুলনামূলকভাবে কম গেছে, এবং এটি একটি পাহাড়ের পিছনে হওয়ায় সোজাসুজি ধাক্কা কম লেগেছে। তবে শুনলাম ১৯৫৭ সালে এটিকে সংস্কার করা হয়, এবং এটি এখন বিভিন্ন উৎসবে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক বইমেলা, মিউজিকাল ইভেন্ট (২০১৯) ইত্যাদিতে বেশ ব্যবহার হচ্ছে এটি। কিন্তু বর্তমান সংস্কারে উপযুক্ত জিনিসপত্র দিয়ে সংস্কার না হওয়ায় এটির আসল সৌন্দর্য্য কিছুটা ক্ষুন্ন হয়েছে।প্রাচীনকালে যখন এই থিয়েটারটি তৈরী হয় , তখন এই জায়গাটির নাম ছিল ফিলাডেলফিয়া।

এর সামনের দিকের মোটা মোটা রোমান রীতির কারুকাজ করা স্তম্ভগুলো আজও একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি। এখানে গ্যালারীতে দর্শকাসনে মোট ৪৪ টি ধাপ আছে এবং তাতে ৬০০০ দর্শক বসতে পারতেন। দর্শকাসন তিন ভাগে এবং তিন ধাপে বিভক্ত; রাজা বা প্রধান অতিথিদের জন্য, মিলিটারীদের জন্য ও শেষে সাধারণ দর্শকদের জন্য। তবে এখানে রাজকীয় আসনের উপরে রয়েছে দেবতার আসন, যেটি এখানে সর্বাপেক্ষা ভাল আসন। সেখানে অধিষ্ঠিত ছিলেন দেবী এথেনা।দেবী এথেনাকে আমাদের সরস্বতীর মত স্থান দেওয়া হত।বর্তমানে সেই মূর্তিটি মিউজিয়ামে স্থানান্তরিত।

যাতে ছায়া থাকে এই থিয়েটারে, তাই এটি পূর্ব পশ্চিমে না হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে করা হয়ে ছিল। মঞ্চটি ও দর্শক গ্যালারী ছিল অর্ধবৃত্তাকারে।
রোমানরা, তখনকার দিনে, আজকের চেয়েও হয়ত শব্দবিজ্ঞানে অনেক উন্নত ছিল। মঞ্চের মধ্যে একটা ছোট জায়গা চিহ্নিত করা রয়েছে যেখান থেকে কথা বললে , অতবড় ফাঁকা মুক্তমঞ্চের সমস্ত দর্শক সমানভাবে কথা শুনতে পেত। এই ব্যবস্থা অবশ্য আমি সবজায়গাতেই দেখেছি।  এর দু দিকে দুটি দরজা ছিল, বাদ্যযন্ত্রীদের বসার জায়গা ছিল।সমস্ত মঞ্চই দেখেছি তখন মুক্তমঞ্চ ছিল। রাতে বোধ হয় অভিনয় বা অনুষ্ঠান হত না। তখন তো আর বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিল না।
এর সঙ্গেই রয়েছে দুপাশে দুটি ছোট মিউজিয়াম, যেখানে সেই সময়কার নানা জিনিসপত্র সুন্দরভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে।
এখানে ঢুকে মনে হয় সমস্ত কিছুই তো জীবন্ত, সেই যুগ যেন ফিরে এসেছে, বোধ হয় এখনি শুরু হবে কোন পুরানো দিনের অনুষ্ঠান। 

এখান থেকে আমরা গেলাম আম্মান শহরের উপকণ্ঠেই Amman  Citadel এ। এটি একটি পাহাড়ের উপরে। এটি আম্মানের সর্বোচ পাহাড় জাবেল আল কোয়ালা (Jabel-Al- Qala) র মাথায়,যেটি সমুদ্রতল থেকে ৮৫০ মি উচ্চতায় অবস্থিত।এর চারিদিকে প্রায়  ১৭০০ মি লম্বা প্রাচীর রয়েছে।এটি আসলে ঐ রোমান থিয়েটারের উপরের দিকে পাহাড়ের মাথায়। এখান থেকে চারিদিকে দেখা যায় বিস্তৃত আম্মান শহরের জীবন্ত দৃশ্য। এটি  একটি দূর্গের ধ্বংসাবশেষ। বেশ বড় জায়গা , একটি ছোট শহরের মত।এখানে ছড়ানো ছিটানো রয়েছে নানা হর্ম্য ইমারতের অংশ।তার মধ্যে বেশ কিছু সুউচ্চ এবং কারুকার্য খচিত স্তম্ভ তো রয়েছেই। এই স্তম্ভ গুলো, কেন জানি না, সমস্ত রোমান ধ্বংসাবশেষের মধ্যেও আজও যেন দৃঢ় ভাবে নিজের অস্তিত্ব সদম্ভে ঘোষণা করে চলেছে, তা সে রোম কিংবা তুরস্ক কি অন্য কোথাও।
স্তম্ভ যে দুটি সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে তা প্রায় ৩০ ফুট উঁচু। এরকমই কিছু স্তম্ভ দেখলাম যেগুলি নাকি হারকিউলিসের মন্দিরের অংশ বলে জানলাম। সেই হারকিউলিসের মূর্তি যে কত বড় ছিল , তা একটি বিশাল পড়ে থাকা হাতের আঙ্গলের কিছু অংশ দেখলেই বোঝা যাবে।মন্দিরটি আনুমানিক ১৩ মিটার উঁচু ছিল। এই মন্দিরটি তৈরী হয়েছিল ১৬১-১৮০ খ্রীষ্টাব্দে এর করিয়েছিলেন সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস (Marcus Aurelius)।


এই অঞ্চলটি  সেই ঐতিহাসিক যুগের শুরুর দিকে অর্থাৎ ব্রোঞ্জ যুগে (১৮০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে)  একটি দুর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হত।এর পর এখানে নানা রাজত্বের ছাপ পড়েছে। তার মধ্যে, আসিরীয়, ব্যাবিলনীয়, রোমান, বাইজান্টিয়ান ইত্যাদিদের চিহ্ন ভালই পাওয়া যায়। শেষে সপ্তম শতাব্দীতে উমায়াদ (Umayyad) দের রাজত্বের পর সুদীর্ঘদিন এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। শেষে ১৮৭৮ সালে এটি আবিস্কৃত হয়। এখানে হারকিউলিসের মন্দির, একটি বাইজান্টাইন চার্চ, ও উমায়াদদের একটি প্রাসাদ বেশ ভাল ভাবেই বোঝা যায়।এখানে আশে পাশে হয়ত আরও অনেক কিছুই খনন কার্যের অপেক্ষায় ইতিহাসের আড়ালে লুকিয়ে আছে।
আমরা এখানে দেখলাম, বেশ কিছু পাথরের কফিন বাক্স, যার গায়ে নানা চিত্র খোদাই করা আছে সুন্দর ভাবে।কফিনগুলি আজও অবিকৃত।এছাড়া অনেক স্তম্ভের কারুকার্য করা অংশগুলিও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
আসলে বিভিন্ন রাজত্ব এখানে আধিপত্য করায়, যে যার মত ইমারত বানিয়েছে, সেগুলি খুব যে বিন্যস্ত তা মনে হল না। একটা কুয়োও রয়েছে দেখলাম।সেখান থেকে হয়ত উমায়াদ প্যালেসে জল নিয়ে যাওয়া হত। ছোট খাট কিছু সিঁড়ি , দেওয়ালের অংশ বিশেষ রয়েছে। সেটি ছাড়াও একটি বিশাল জলাধার রয়েছে। মনে হয় বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা ছিল এই পাহাড়ের মাথায়।
 উমায়াদরা এখানে রাজত্ব করেছিল ৬৬১-৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। তাদের তৈরী যে প্রাসাদটি রয়েছে, সেটি সম্ভবতঃ তাদের কোন রাজপুরুষের বাসস্থান ছিল। তবে এটি সম্ভবতঃ ৭৪৯ সালে ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল অনেকখানিই।তার মাথায় একটি ডোম রয়েছে যেটি অবিকৃতই রয়েছে।তার ভিতরে সম্ভবতঃ মানুষেরা জমায়েত হত, কিছু বলার বা শোনার জন্য। ডোমের ভিতরের ছাদে নানা কারুকার্য আজও অবিকৃতই আছে। তার সামনেটা অনেকটাই সেদিনের মতই লাগছে। সামনের আর্চ করা গেট, উঁচু দেওয়াল সবটাই সুন্দর। তবে ভিতরে ঢোকার পর আর বিশেষ কিছু নেই ।সবই ধ্বংস হয়ে গেছে।
এখানে একটি ছোট মিউজিয়াম রয়েছে। সেখানে দেখলাম, একটি ধাতব কামানের টুকরো টুকরো অংশ।এছাড়া রয়েছে কয়েকটি দাঁড় করানো, কফিনের প্রাথমিক বাক্সের মত। এগুলিতে ঢেকে দেওয়ার পর সম্ভবতঃ দেহকে পাথরের বাক্সে ঢোকানো হত। এগুলি একটি মনুষ্য আকৃতির, শক্ত কোন বস্তু দিয়ে তৈরী; যা দিয়ে পুরো দেহটি ঢাকা থাকত। এ ছাড়া রয়েছে একটি প্লাস্টারের তৈরী ফুলের আকৃতি কোন বড় ফোয়ারার তলদেশ বা নিছক সাজানোর জন্যই তৈরী কিছু। তবে তাতে নানা কারুকাজ দেখে বোঝা যায় যেো তারা এসব ব্যাপারেও যথেষ্ট দক্ষ ছিল।তার মধ্যে একটা ফুলের ছবি ও তার  পাপড়ির মাঝে মাঝে ছটি মানুষের মুখের আদল করা আছে। বেশ সুন্দর কাজ।
আকাশে ঝকঝকে রোদ নীচে চলেছে আম্মান শহরের দিন শুরু হয়ে মধ্য সকালের জীবন যাত্রা। চলেছে গাড়ীর সারি। দূরে বাড়িগুলো সব একরঙা বেলে পাথরের রঙের বাক্সের মত । এছাড়া বাড়ির গঠনে কোন বৈচিত্র্য নেই। মাঝে মাঝে শুধু এক একটি উঁচু মসজিদের মিনারেট দেখা যাচ্ছে। 

দেখলাম একটি বাইজান্টাইন চার্চ। সেখানে আপাততঃ কিছু ভাঙ্গা থামের টুকরো এবং মেঝের মোজাইকের কাজ দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে বা বুঝে নিতে হবে সেদিনের সেই বাইজান্টাইন রাজত্বের ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টানদের আরাধনার জায়গাকে। সব মিলিয়ে এই জায়গাটি একটি একসময়ের চলমান জীবনের মৃত এক ধ্বংসস্তুপ যা তার অতীত গরিমাকে সদম্ভে জাহির করে জানাচ্ছে, আমরাও ছিলাম সেদিন, আজ যেমন তোমরা রয়েছ এই সুন্দর পৃথিবীতে।আমরা অতীত আর তোমরা বর্তমান , এই যা তফাত।  
এই অঞ্চলটা জুড়ে শুধু অসংখ্য স্তম্ভের  শুধু তলাটুকু রয়েছে। যার থেকে বোঝা যাচ্ছে এখানে কত বড় বড় ইমারত ছিল। আজ চারিদিকে দেখলাম সোনালী রোদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু চড়াই জাতীয় কিছু পাখী। যারাই এখন এখানে জীবনের প্রতীক হয়ে রয়েছে।

ক্রমশঃ–

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. ঝরঝরে ভাষায় সুন্দর বর্ণনা । পড়তে আনন্দ হয় আবার জ্ঞানও বাড়ে ।

    ReplyDelete