জ্বলদর্চি

ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল হয়েছে তার। বিষয়— আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১২ 
ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

সুন্দরবন— দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বাদা অঞ্চলের রূপকার কথাশিল্পী ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় (জন্ম-১৯৪৮)। এই অঞ্চলের প্রকৃতি-পরিবেশ, সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি সবই আলাদা। এখানে বসবাসকারী মানুষদের প্রতিনিয়ত যেমন প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে হয়, তেমনি লড়াই করতে হয় দারিদ্র্যের সঙ্গেও। বস্তুত বাদা অঞ্চলের মানুষেরা জীবন যাপন করেন না, জীবন যুদ্ধে মগ্ন হয়ে থাকেন। এই লড়াকু মানুষদের প্রাত্যহিকতায় লগ্ন হয়ে রয়েছে প্রকৃতি-পরিবেশ। সময়ের হাত ধরে বদলে যাওয়া পরিবেশের বিপন্নতাও সম্পৃক্ত হয়ে রয়েছে তাঁদের যাপনে। উপকূল অঞ্চলের মাটি এবং মানুষ এবং সেই যাপন লগ্ন হয়ে আছে তাঁর সাহিত্যের মধ্যে।

ছোটোবেলায় থেকে বাড়িতে লেখাপড়ার মোটামুটি একটা আবহ পেয়েছিলেন। লেখকের দাদাও লিখতেন। ঝড়েশ্বরের প্রথম গল্প ‘ভগ্নচর’ প্রকাশিত হয় ব্রজেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সাপ্তাহিক ‘প্রতিশ্রুতি’ পত্রিকায়, সত্তরের গোড়ার দিকে। এই প্রথম গল্পের জন্য তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামাঙ্কিত পুরস্কার পেয়েছিলেন। দেবেশ রায়ের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। এক সময় ‘পরিচয়’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। ‘পরিচয়’-এ প্রকাশিত প্রথম গল্প ‘নোনা’ (১৯৭৯)। ‘তিন রমণীর গল্প’ ‘গল্পপত্র’ দ্বিতীয় পর্যায়, প্রথম সংখ্যা ১৯৮৮। প্রথম উপন্যাস ‘রামপদর অশন-ব্যসন’-ও প্রকাশিত হয়েছিল আশির দশকের প্রথম দিকে ‘পরিচয়’-এ। উপন্যাসটির নামকরণ করেছিলেন দেবেশ রায় নিজেই। 

ঝড়েশ্বর মনে করেন, কাহিনি মাত্রেই গল্প নয়। কাহিনিকে অতিক্রম করে গল্পে যেতে হয়। সর্বকালে একই রকম সত্য থেকে যায়, গল্প। তাই তো চার-পাঁচ দশক আগে লেখা তাঁর গল্পগুলিও বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় আজও। আজকে বিশ্বজোড়া দূষণের প্রেক্ষাপটে তাঁর কত কত গল্প প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যেমন ‘চিমনি’ (‘প্রতিক্ষণ’, ১৯৮৯) গল্পটি।

গল্পের কেন্দ্রে আছে কারখানার দূষণ-জনিত সমস্যা। সুন্দরবন অঞ্চলে উর্বর চাষের জমিতে ফসফেট আর সালফিউরিক অ্যাসিডের কারখানা তৈরির জন্য জমি কিনছে কোম্পানি। দেশের শিল্প কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বিপজ্জনক শিল্পের আয়তায় পড়ে ফসফেট কারখানা। বেশি দাম পেয়ে কখনো-বা বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করেছে কৃষকেরা। তারা শুনেছে পুকুর কাটা হবে, কারখানা হবে। বহু মানুষ চাকরি পাবে। বাদার দেশে এই প্রথম কারখানা। দশ কোটি টাকার প্রোজেক্ট। তারা কারখানার দূষণ সম্পর্কে এতটা সচেতন নয়। ‘সুন্দরবন ফসফেট অ্যান্ড কেমিক্যালস কোম্পানি’-র বিষ জল ও কালি নিমাই বাঁকির খাল বেয়ে গাঙের দিকে গেলে নষ্ট হবে বাগদার মীন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানীরা এসে সচেতন করেন এলাকার মানুষদের— “তারপর হবে অ্যাসিড রেন...এই আর কি অম্বল হলে বুক জ্বালা বদ হজম। শরীর আস্তে আস্তে দড়ি পাকায়— পাকায় তো ? বাতাসের দ্বারা মাটি, যে মাটিতে ঢেঁড়স ধান কুমড়ো চাষ করছেন সে মাটির অম্বল হবে— সে মাটি আর এ মাটির থাকবে না। তার তখন অম্বল বুক জ্বালা— সে মাটির শরীর-ক্ষমতা সব শেষ হয়ে যাবে— আর চারা পুঁতলে ধান ফলতে চাইবে না। কুমড়োটা হতে চাইবে না... তখন কি করবেন আপনারা ? চাষের জন্যে ওই কারখানায় ছুটবেন সারের বস্তা কিনতে। রাসায়নিক সার— এভাবে আপনাদের মেরে আপনাদের শুষবে। বেশিদিন এ সার ছড়ালে মাটি আর কদিন ফলন দেবে ?”

সার কারখানার বিষ জল আপাতত জমা রাখা হবে পুকুরে। বর্ষায় পুকুর উপচে জল চলে আসবে ধান জমি, আলপথ হয়ে গ্রামের মধ্যে। নোনা জলের ভেটকি ট্যাংরা থেকে শুরু করে সুন্দরবনের গরান কাঠ সব ধ্বংস হয়ে যাবে। বর্ষাকালের শোল-ল্যাঠাও পাওয়া যাবে না। বিষজল যেখানে পড়বে সেখানে পুড়ে যাবে সব। চিমনি দিয়ে বেরোনো বিষ গ্যাসে আকাশ বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাবে।  

গল্পের আখ্যানে লেখক একটি প্রেম কাহিনি এনেছেন। কারখানার অঞ্চলের টুনার সঙ্গে বসিরহাটের সন্তোষের প্রেম। বিয়ের পরে বসিরহাট চলে যাবে সে। এই কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া তাকে ছুঁতে পারবে না। এক সন্ধ্যায় রাস্তায় আশ্লেষঘন মুহূর্তে টের পায় দুজনে— “নিঃশ্বাসে ভীষণ উষ্ণতা। হঠাৎ বুক তোলপাড় করে শ্বাসকষ্ট। স্লাইডের চিমনি দিয়ে গলগল বিষ ধোঁয়াটা এখানেও, বাতাসে।” বিহ্বল চোখে সন্তোষ দ্যাখে আকাশটা অন্ধকার হয়ে গেছে। যে আকাশ ছুঁয়ে আছে বসিরহাটকে। কোথাও পালানোর উপায় নেই। সারা সুন্দরবনে ছেয়ে গেছে দূষণ। পরিবেশ বিষাক্ত এখন। মানুষের প্রেমও দূষিত হয়ে যাচ্ছে। 

আমাদের দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের আইনকে ক্রমশ শিথিল করে দেওয়া হচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২০’-র খসড়া। সংশোধনগুলি পাশ হয়ে গেলে বহু দূষণকারী কারখানার আর পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র লাগবে না। স্থানীয় মানুষদের মত নেওয়ারও প্রয়োজন থাকবে না। তারা দূষণ ছড়িয়েও পার পেয়ে যাবে। এরকম উন্নয়ন শেষ করে দেবে আমাদের দেশকে। (তিয়াসা আঢ্য, ‘ছাই হয়ে গেল শিশু পাখিরা’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৪ জুলাই ২০২০) 

গত শতকের শেষ তিন দশকে দ্রুত বদলেছে বাংলার সমাজ-রাজনৈতিক মানচিত্র। সেই বদলগুলিকে গল্পের বিষয় করে তুলেছেন ঝড়েশ্বর। ঝড়েশ্বর ভূমি সংস্কার দপ্তরে চাকরি করতেন। কাজের সূত্রে বর্গা রেকর্ডিং-এর সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কাছ থেকে দেখেছেন। একসময় বামফ্রন্ট আমলে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে ত্রিশ শতাংশ মহিলা সদস্য নির্দিষ্ট করা হয়। তখন থেকেই মহিলা পঞ্চায়েত সদস্যের সংখ্যা বেড়ে যায়। এতদিন যে বউয়েরা সংসার সামলেছেন তাঁদের অনেকেই প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দ্যাখা গিয়েছে তাঁদের পূর্ব নির্ধারিত বাড়ির কাজ কমেনি। সংসারের নানাবিধ কাজ সামলানোর পরে সামান্য যে অবসরটুকু ছিল, তাও চলে যায়। ‘মহিলা সদস্য’ (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, রবিবাসরীয়, ১৯৯৫) গল্পের মাধ্যমিক পাশ শ্যামলী পাত্র বাড়ির ছোটো বউ। নির্বাচনে জিতে পঞ্চায়েত সদস্য হয়েছেন। তাঁদের গ্রামে দুজন পঞ্চায়েত। একজন পুরুষ, একজন মহিলা। কিন্তু দরকারে বেশিরভাগ মানুষ তাঁর কাছেই আসেন। কত জনের কত ধরনের আবদার। কত রকমের সরকারি প্রকল্পের আবেদনে সই করতে হয় তাঁকে। কিন্তু শুধু সই-সিল টুকু দিলে তো হয় না। অধিকাংশ মানুষের ফর্মও ফিলাপ করে দিতে হয়। লিখে দিতে হয় সুপারিশ পত্র বা আবেদন পত্র ইত্যাদি।
 
তাঁর বর দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাড়ির রান্না-বান্না, বাসন মাজা, ঘরদোর পরিষ্কার সবই করতে হয় শ্যামলীকে। সেই সঙ্গে ছেলেদুটিকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে ইউনিফর্ম পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হয়। আর তারই মধ্যে পঞ্চায়েতের এই মহিলা সদস্যের কাছে আসেন মানুষজন। রান্না করতে করতে খুন্তি হাতে চলে বাইরে চলে আসেন তিনি। মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। বিরক্ত হয়। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারেন না। ক্লান্ত হয়ে পড়েন। গল্পের শেষে লেখক দেখিয়েছেন এই তিরিশ শতাংশের নিয়মের মধ্যে পড়ে মেয়েদেরও কীভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। গ্রামের মেয়ে সদ্য বিবাহিত ছন্দা র‍্যাশন কার্ড বদলের আবেদনে সই করিয়ে নেওয়ার পরে শ্যামলীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। “সামাজিক প্রতিষ্ঠায় আচমকা উঠে দাঁড়ায় শ্যামলী। ক্লান্ত মুখচোখ চকিতে ধুয়ে উজ্জ্বল।” ছন্দা-রুকসানাদের সঙ্গে আন্তরিক হয়ে ওঠে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়। তারাও “মন ভরে দেখে শ্যামলীকে...সদস্যার কণ্ঠ দিয়ে নিকট-আত্মীয়া নারী মুখ।” 

ছেলেদের নিজে খাওয়াতে পারেননি বলে একটু আগে যার পারিবারিক মূল্যবোধ, মাতৃত্ব জেগে উঠেছিল, তাঁর সামাজিক মূল্যও প্রকট হয়ে উঠল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার হাত ধরে বদলে গিয়েছে গ্রামীণ নারীদের যাপন। তাঁরাও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। 

তাঁর লেখায় ব্যক্তি নয়, সমষ্টি প্রাধান্য পেয়েছে অধিকাংশ সময়। এই গল্পে পঞ্চায়েতের মহিলা সদস্য শ্যামলী প্রকৃত পক্ষে একক কোনও নারী নন, সমগ্র গ্রামীণ মহিলা সদস্যদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন। তাঁর পরিবেশ-কেন্দ্রিক গল্পগুলিতেও পরিবেশের যে সংকটের চেহারা আলোকিত হয়েছে, তাও সমগ্র মানব সভ্যতার সংকটকে ব্যঞ্জিত করেছে।
     
জল-বায়ু-আকাশ-বাতাস-মাটি-নদী-সমুদ্র সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে সভ্যতার দূষণ। এর অনিবার্য প্রভাব পড়েছে ঋতু পরিবর্তনে। রোদ-বৃষ্টি, শীত-গরম সবই এখন প্রকৃতির খেয়ালে। ক্যালেন্ডারের নিয়ম মেনে নয়। শরৎ-হেমন্ত-বসন্ত কখন আসে, কখন যে যায়— তা আর টের পাই না আমরা। শীতকাল ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে। প্রকৃতির খেয়াল খুশি মতো বৃষ্টি হয়, বর্ষাকালে নয়। গ্রীষ্মকালের ব্যাপ্তি বেড়েছে। এখন যারা কিশোর-যুবক তাদের জন্ম হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন শুরু হওয়ার পরে। তাই তারা ষড়-ঋতুর স্বতন্ত্র ঐশ্বর্য অনুধাবন করতে পারবে না। বিশ্ব-উষ্ণায়ন এবং দূষণ তছনছ করে দিয়েছে ঋতু মানচিত্র, বাস্তুতন্ত্র, খাদ্য-শৃঙ্খল এবং জীব-বৈচিত্র্যকে। ঋতু মানচিত্র বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে একটি অঞ্চলের আবহাওয়া, জলবায়ু।  

ঋতু-মানচিত্র বদলে যাওয়ায়, আবহাওয়া খামখেয়ালি হয়ে উঠেছে। দূষণ এবং উষ্ণায়নের ফলে প্রাকৃতিক হাওয়ায়ও টান পড়েছে। এখন সমুদ্রেও আগের মতো হাওয়া বয় না। বকখালি গেলে চোখে পড়ে চারখানা কংক্রিট পিলারের মাথায় চার পা গেঁথে উইন্ড-মিলের টাওয়ার। টাওয়ারের ডগায় ফাইবারের মস্ত বড়ো তিনটে ব্লেড। প্রাকৃতিক বাতাসে এই ব্লেডগুলো ঘোরে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ তৈরি করে গ্রিডে দেওয়া হয়। তাপবিদ্যুতের মতো পরিবেশের ক্ষতি হয় না এই হাওয়া-বিদ্যুৎ উৎপাদনে। সম্পূর্ণতই পরিবেশ-বান্ধব এই বিদ্যুৎ। কিন্তু এখন টান পড়েছে হাওয়ায়। সমুদ্র-উপকূলেও হাওয়া দেয় না তেমন। এই নিয়েই ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘হাওয়া চাষ’ (‘কালান্তর’ শারদসংখ্যা, ২০১৬)। এখানে দেখছি সমুদ্রের জলে ছোটো বড়ো তরঙ্গ জাগলেও ফাইবার ব্লেড হাওয়ায় নড়ে না। একশো ছত্রিশ-সাঁইত্রিশ ফুট উঁচুতে সাত চল্লিশ ফুট লম্বা সাদা ব্লেড তিনটে নীল মেঘের গায়ে চিকে চিহ্ন হয়ে চুপচাপ। সমুদ্রের ঢেউ বইলেও জলের তোড় নেই এখন। 

জাভেদদের সাত কাঠা জমি ছিল। সেই জমিতেই তৈরি হয়েছে হাওয়া কল। জাভেদের বাবা জমি দিতে চায়নি। বাধ্য হয়ে দিয়েছে। বিনিময়ে সামান্য টাকার নাইট গার্ডের চাকরি দিয়েছে ছেলেকে। পঞ্চায়েত প্রধান বুঝিয়েছিল— দেশে বাতাস থেকে বিদ্যুৎ হবে, দ্বীপের মানুষের উপকার হবে। দ্বীপের মানুষের উপকারের জন্য নিজেদের বাড়িসহ চাষের জমি দিয়েছিল। জাভেদের বউ আসমার বিশ্বাস, একদিন যে বাবুলোকরা তাদের ঠকিয়ে জমি নিয়েছিল, সামনের সমুদ্র তার শোধ নেবে।
আয়লার ঝড়ে একটা ফাইবার ব্লেড ভেঙে পড়েছিল। জাভেদ সেই ভাঙা ব্লেড পেতে ঘাট বানিয়েছে। নামাজের আগে গোসল করতে সে নামে সাদা ফাইবারের ঘাটে। সেখান থেকে তাকিয়ে দ্যাখে বায়ু কোণ বরাবর সাত-আটটা হাওয়া বিদ্যুতের টাওয়ার মাথায় মাথায় তিনখানা করে ফাইবারের ব্লেড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তখনই মাস্টার মশাই এসে জানান, এই হাওয়া-বিদ্যুতের আয়ু বেশিদিন নেই। অর্থাৎ তার সামান্য চাকুরিটিও শেষ হবে এবার। তিনি বলেন— “আমাদের এ সমুদ্রের দিকে হাওয়ার ভেলোসিটি... বায়ুর গতিবেগ কমে গেছে।” তাই ফাল্গুন মাসেও ব্লেড ঘুরছে। অথচ ব্লেড ঘুরলেই যেন দুধ থেকে মাখন বেরত। ব্লেড একবার পাল দিলে মোটর ঊনচল্লিশবার ঘোরে। সেই বিদ্যুৎ নীচে কন্ট্রোল বক্সে আসে। এখন সব বন্ধ।

জাভেদ নতুন পেশায় যায়। সপরিবারে বাঁচার জন্য এখন সমুদ্রে হাওয়া খেতে আসা মানুষদের ঘন্টা হিসেবে চেয়ার ভাড়া দেয়। একসময় নিজেদের জমিতে চাষ করত। সেই জমি গেল হাওয়া কলে। চাষি থেকে হয়েছিল তিন হাজার টাকার নাইট গার্ড। আর এখন সে নিজেই হাওয়া-কারবার করছে। সামুদ্রিক হাওয়া কমে যাওয়ায় তার পেশা হারিয়েছে। পরিবেশের বিপন্নতা, প্রকৃতির পরিবর্তন তার পেশাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আবার হাওয়াকেই এখন পেশা করেছে। চেয়ার ভাড়া দিয়ে হাওয়া খাওয়াচ্ছে মানুষদের। সেই হাওয়াও কদিন থাকবে কে-জানে! তার পেশার বদলের মূলেও রয়েছে পরিবেশ। 

বিপন্ন পরিবেশ, বিপন্ন মানুষের পেশা, বিপন্ন মানুষের যাপন। পরিবেশের নির্মম প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রাত্যহিকতায়। পরিবেশের এই সমস্যার কথা অন্য কোনও গল্প-উপন্যাস, এমনকি প্রবন্ধেও উঠে আসেনি। সেদিক থেকে ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের এই গল্প হয়ে উঠেছে অভিনব পরিবেশবাদী নির্মাণ। এই গল্পের সূত্রে বাংলা সাহিত্যে পরিবেশচর্চায়ও নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে।  
  
সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জীবনের অনিবার্য অঙ্গ ঘুর্ণিঝড়। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ঘুর্ণি ঝড়কে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আয়লা-ফনি-বুলবুল-আমফান-ইয়াস ইত্যাদি ঘুর্ণিঝড়গুলি তছনছ করে দিচ্ছে সব। ক্রমশ এর প্রভাব বাড়ছে। বঙ্গোপসাগরে উষ্ণতার তারতম্য সবচেয়ে বেশি দ্যাখা যায় মে, অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে। এই সময় বেশি ঝড় হয়। ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ঘুর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। আগে এত সামুদ্রিক ঝড় হত না। দূষণ এবং বিশ্বউষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের উপরিতলের তাপমাত্রা বাড়ছে। জলের বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। এখান থেকেই সমুদ্রে তৈরি হচ্ছে নিম্নচাপ। প্রকৃতির নিয়মে সেই নিম্নচাপের শূন্যস্থান ভরাট করতে আশপাশ থেকে ছুটে আসছে ঠান্ডা হাওয়া। নিজের শক্তিকে বাড়িয়ে নিয়ে নিম্নচাপ পরিণত হচ্ছে সাইক্লোন থেকে সুপার সাইক্লোনে। (সুপ্রতিম কর্মকার, ‘তাঁর সতর্কবার্তা কানে তোলেনি কেউ’, রবিবাসরীয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, (৬ জুন ২০২১) 

সেই ঘুর্ণিঝড়কে বিষয় করে লেখা গল্প ‘লাল চুল নীল চোখ’ (‘লেখা-জোকা’, শারদীয়া ১৪২৮)। ২০২১ –এর মে মাসে ইয়াস ঝড়ে তীব্র তাণ্ডবে জলের তলায় চলে গিয়েছিল সুন্দরবনের বহু দ্বীপাঞ্চল। খেয়াঘাটা নষ্ট করে মানুষের দ্বীপে ঢুকে পড়েছিল সেই ঝড়। বিছানা-কাঁথা বাণ্ডিল করে যে যার মতো পালিয়ে গিয়েছিল একটু উঁচু জায়গায়। নোনা জলের মত্ত গড়ানিতে ভেসে যায় গাদি খসানো খড়ের আঁটি, হাঁড়িকুঁড়ি সব। সমুদ্র এগিয়ে আসে। আসুধা-বরকতরা ঘর ছাড়ে। এক হাতে মোরগ-মুরগী ছাগলের দড়ি। পোয়াতি ছাগল ভেসে যায়। জলের তোড়ে নখ খসে যায়। তারা ভেবেছিল, “বাবা কপিল মুনি আর কোটগোড়ার পির সাহেব আগে কত বড়ো বড়ো ঝড় ঝাপটা ভিনদেশে বাঁকিয়ে” তাদের বাঁচাত। এবারও হয়তো সেভাবে...। কিন্তু হয়নি। কিছুটা এগিয়ে পায়ের পাতায় তারা টের পায় উঁচু ঢিবির আভাস। মাইতি মাস্টারের বাস্তু। মাস্টারের উঁচু তিনতলা বাড়িতে যায় তারা। ভিতরে ঢুকতে চায়নি। দাওয়ায় আশ্রয় নিতে চেয়েছিল শুধু। কিন্তু মাস্টার ত্রাণ শিবিরে যেতে বলেন। মুড়ির ভিজে পোঁটলা দেখিয়ে বলে খাবার চায় না তারা, শুধু একটু আশ্রয়। লাল চুল নীল চোখের ছয়-সাত বছরের মেয়েটাও জলে ভিজে কাঁপছে। কিন্তু তাও হয় না। উল্টে তাদের হাতের মুরগী দেখে মাস্টারের বউ চ্যাঁচায়— “মোরগ বেচবে...ও ভাই ও ছেলে কত দাম...।” মুরগী দুটোকে মাস্টারের বাড়ির গেটের ফাঁক দিয়ে ঠেলে দেয়।       

তারা চলে যাওয়ার পরে মেয়েটার কথা জানতে চায় মাস্টারের মেয়ে। তিনি মেয়েকে শোনান দ্বীপের জন্মের পুরাণ-মহাভারতের কাহিনি। সমুদ্র বেয়ে চারশো-সাড়ে চারশো বছর আগে পালতোলা জাহাজে নৌবাণিজ্যে আসত পর্তুগাল-স্পেনের সাহেব নাবিকেরা। কয়েক ঘর তখন গাঙ পাড়ে বাস করত। খটিতে শুঁটকি মাছের বাছাই কাজের মজুরেরা জাহাজিদের সঙ্গে চলে যেত। ওই ফরসা মেয়েদের বউ পূর্বের ঠাকুমার ঠাকুমা...ও ছিল সেই দলে। তারই স্মৃতি বহন করছে মেয়েটি। 

সেই ট্র্যাডিশন চলছে আজও।   

এই গল্পে দ্বীপের অন্য এক জগতের কথা বলেছেন লেখক। গাঙ পাড়ে টুরিস্টবাবুদের তাঁবুতে বহু মহিলা বাবুদের খাটিয়ায় ঢুকে পড়ে। তাদের বরেরা কেরালা, বোম্বাই, চেন্নাই বা দুবাইতে আছে কাজের সূত্রে।

গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ— “খণ্ড খণ্ড দ্বীপমালা...। গায়ে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ... সে ঢেউ... ভারত মহাসাগরের জলকণা উত্তমাশা...কেপটাউনে আটলান্টিকের ফেনায় ফেনায় ফেনাপুঞ্জ ক্রমে ঘনীভূত হয়ে জিব্রাল্টারের পাকনা জলের তোড়ে ফেনা পিণ্ড লিসবনের...নীল পাড়ে...”   
আয়লায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পাথর প্রতিমার অচিন্ত্যনগর দ্বীপ। লোহাচরা, সুপারিভাঙা দ্বীপগুলোকে গ্রাস করেছে বঙ্গোপসাগর। ভাঙনের মুখে ঘোড়ামারা দ্বীপ। দুধের সর চাল আর মিঠে পাতা পানের জন্য বিখ্যাত সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপ। কিন্তু বিপন্ন এই দ্বীপ। ২০০১ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ঘোড়ামারাকে ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এখনও কয়েক হাজার মানুষ থেকে গেছেন এই দ্বীপে। তাঁদের জরুরি কাগজপত্র, মূল্যবান সম্পদ হয়তো তাঁরা রেখেছেন নামখানা-কাকদ্বীপে কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে। আর বাধ্য হয়েই থেকে গিয়েছেন এই দ্বীপে। প্রহর গুনছেন বিপদের। এই দ্বীপের মানুষেরা জলবায়ু উদ্বাস্তু, পরিবেশ উদ্বাস্তু হয়ে গিয়েছেন। ইয়াসে সম্পূর্ণ জলের তলায় চলে গেছে, লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ভাঙন কবলিত মৌসুনি দ্বীপ। ইয়াসের কয়েকদিন পর ঘোড়ামারা দ্বীপের ভাঙা নদীবাঁধের পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একজন বলছিলেন— “একসময় লোহাচরায় থাকতাম। সমুদ্র গিলে খেয়েছে সেই দ্বীপটাকে। সেখান থেকে সুপারিভাঙ্গাচরায় উঠে আসি। সেটা তলিয়ে গেলে চলে আসি ঘোড়ামারায়। এই দ্বীপও আর বেশিদিন টিকবে না। এরপর কোথায় যাব জানি না।” (বরুণ প্রামাণিক, চল্লিশ বছর ; ‘এই দ্বীপও মনে হয় বেশি দিন টিকবে না’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৪ জুন ২০২১) শুধু সুন্দরবন নয়, পৃথিবীর সমস্ত দ্বীপগুলিই এখন বিপন্ন। যাদের সামর্থ আছে তারা বসবাস গুটিয়ে অন্যত্র চলে আসার ব্যবস্থা করছেন। বহু দ্বীপে কোনও পাহাড় বা উঁচু জায়গা নেই। বন্যা বা অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে দ্বীপবাসীদের পালানোর উপায় নেই, সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া। (জয়ন্ত বসু, ‘সুন্দরবন না বাঁচলে কলকাতাও মরবে’ ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ৬ জুন ২০১৪) 

ইয়াসে বাংলার কোটি মানুষ দুর্গত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব নেই। ম্যনাগ্রোভ অরণ্য বারবার রক্ষা করেছে সুন্দরবনকে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভকে ধ্বংস করেছি আমরা। অপরিকল্পিত বাঁধ রক্ষা করতে পারছে না উপকূলবর্তী অঞ্চলকে। দিঘা-শঙ্করপুর-মন্দারমণি-তাজপুর-উদয়পুর-এর ঝাউবন ধ্বংস করে তৈরি করা হয়েছিল হোটেল। আর সেই সব হোটেল রিসর্ট তছনছ হয়ে গেছে ইয়াসে। যেখানে ঝাউয়ের বেড় থাকার কথা ছিল সেখানে কংক্রিটের রাস্তা। বালিয়াড়ি আর ম্যানগ্রোভ নষ্টের খেসারত এই ক্ষয়ক্ষতি। ইয়াসের এক সপ্তাহ পরেও সুন্দরবনের বহু রাস্তায় জোয়ার ভাটা খেলেছে।    

বাদা অঞ্চলের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে। এই অঞ্চলের আপামর মানুষ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সেই সমস্যাগুলির শরিক হয়েই বেঁচে থাকেন। নানা পেশার দরিদ্র-নিম্ন মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষদের সম্পর্ক এবং সংঘাতকে তাঁর গল্পে তুলে ধরেছেন লেখক। প্রাকৃতিক ও সামাজিক সমস্যার আধুনিক বিশ্লেষণাত্মক রূপায়ন তাঁর গল্প। লাট অঞ্চলকে বাংলা গল্পে একটা সর্ব শক্তিমান চরিত্র করে তুলেছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. নির্মম চট্টোপাধ্যায়
    ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের আলোচনা পড়তে পড়তে আলোচকের পরিবেশ ভাবনাশ্রিত প্রবন্ধ সংকলনের কয়েকটি লেখার কথা মনে এল। পরিবেশের বিপন্নতাকে কেন্দ্রে রেখে ঝড়েশ্বর যে আখ্যান নির্মাণ করেছেন, তা সত্যিই উদ্বেগের! একেবারে মাটি ঘেঁষা বাস্তবতা ওঁর গল্পগুলিকে আকর্যণীয় করে তুলেছে।
    বিশ্বজিৎ কে অভিনন্দন জানাই।

    ReplyDelete