জ্বলদর্চি

পাখির সম্পদ পালক /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান-১৮
পাখির সম্পদ পালক
নিশান চ্যাটার্জী


পাখির পালক প্রকৃতির এক অনবদ্য অবদান। এটি একদিকে যেমন জীব বিবর্তনের সাক্ষ বহন করে তেমনি সুন্দর দৃশ্যের অবতারণা ঘটায়। এত অপূর্ব বাহারের সমাবেশ পৃথিবীর অন্য কোনো প্রাণীর অঙ্গে নেই বললেই চলে। রামধনুর সাতটি রঙই পাখির পালকে নানা মিশ্রণে নানা গভীরতায় পাওয়া যায়। আবার রামধনুতে যে রং অর্থাৎ কালো রং নেই, তাও পাখির পালকে থাকে। কালো রঙের জন্য দায়ী রাসায়নিক উপাদান হল মেলানিন। এই মেলানিন উদ্ভিদজগতে থাকেনা কিন্তু প্রাণী জগতে উপস্থিত। পাখির পরিচয় তার পালকের রংই বহন করে। 

পালকের রং ও আকার থেকে অনেক সময় পাখির নাম জানা যায়, তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করতে সুবিধা হয়। বিবর্তনের ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায় সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকেই পাখির আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সরীসৃপ এবং পাখির মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী প্রাণী হল আর্কিওপটেরিক্স। এরা একদিকে যেমন সরীসৃপের কিছু বৈশিষ্ট্য বহন করতো তেমনি পাখির বৈশিষ্ট্য ও বহন করতো। তাই এদের প্রথম পাখিও বলা চলে। এটি মনে করা হয় যে সরীসৃপের দেহের Scale থেকেই পালকের বিবর্তন ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হল, একটি পাখির দেহে কত রকমের পালক থাকতে পারে? বিশেষজ্ঞরা বলেন তিন রকমের। বাইরে থেকে দেখা যায় যে পালক,  যেমন ডানার পালক যা উড়তে সাহায্য করে বা লেজের পালক যা দিক পরিবর্তনে সাহায্য করে এদের বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় "কনট্যুর ফেদার বা পিনি"। এই কনট্যুরের তলার যে নরম সূক্ষ্ম পালক থাকে তাকে তাকে "প্লুমিউল" বলে। অনেক পাখির বাচ্চা পশমের মতো দেখতে হওয়ার কারণ হল এই প্লুমিউল। 

পরবর্তীতে এইগুলো কারো কারো ঝরে পড়ে আবার কারো কারো সারাজীবন থেকে যায়। এছাড়াও আরেক ধরনের পালক দেখা যায় যা চুলের মতো সরু এবং শক্ত এদের বলা হয় " ফিলোপ্লুম"। অন্য সমস্ত পালক তুলে না ফেললে এই ফিলোপ্লুম দেখাই যায় না। আবার প্রশ্ন আসতেই পারে সব পাখিদের দেহে কি সমান সংখ্যক পালক রয়েছে? উত্তর হবে না। তাহলে কোন পাখির দেহে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পালক আছে?- রাজহাঁসের দেহে। রাজহাঁসের দেহে পালকের সংখ্যা প্রায় ২৫,২০৬। অধিকাংশ পাখিরই, পালক প্রতি বছর ঝরে পড়ে আবার নতুন করে গজায়, এর জন্য পাখির প্রচুর শক্তি ব্যয় হয়। অষ্ট্রেলিয়ার লায়ার বার্ড, নিউগিনির বার্ড অফ প্যারাডাইস এবং আমাদের দেশের ময়ূরের পেখমের সৌন্দর্যের কোনো তুলনা হয়না। কিন্তু শুধু পুরুষ পাখিরাই এই সৌন্দর্যের অধিকারী। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে পেখম কিন্তু ময়ূরের লেজ নয়, এগুলো পিঠের পালক মাত্র। পাখির পালক আশ্চর্য এক রাসায়নিক উপাদানে তৈরি, আয়তনের তুলনায় অতি হালকা, পাখির গড় ওজনের ছয় শতাংশ মাত্র। পালক গুলি শীত,তাপ ও জলনিরোধক উপাদানে তৈরি। হিমমন্ডলের মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অথবা উষ্ণমন্ডলের ষাট ডিগ্রি  সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পাখিদের কোনো অসুবিধা হয়না। পাখিরা গরমে ঘামেনা, কারণ তাদের কোনো ঘর্মগ্রন্থি থাকেনা। কিন্তু তৈল গ্রন্থি আছে। এই গ্রন্থি থেকে নির্গত নির্যাস, পাখিরা তাদের ঠোঁটে করে সারা শরীরে মেখে শরীরকে জলনিরোধক করে তোলে। 

পাখিরা জানে পালক তাদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তাই সারা সময়েই ব্যস্ত থাকে পালকের পরিচর্যায়। পাখিদের এই পালক যদি মাইট জাতীয় সূক্ষ্ম পোকা দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে এরা মজার ঘটনা ঘটায়।  এরা তখন পিঁপড়ের ঢিবি দেখলেই ঠোঁট দিয়ে তাদের উত্তেজিত করে, ফলে পিঁপড়েরা তখন দলে দলে বেরিয়ে আসে, পাখিরাও ডানা খুলে দেয় তাদের সামনে, পিঁপড়েরা পালকের মধ্যে ঢুকে ফরমিক আ্যসিড ছড়িয়ে সেখানকার ক্ষতিকারক পোকা গুলো মেরে ফেলে।  স্টার্লিং জাতীয় পাখিরা ঠোঁট দিয়ে বড়ো বড়ো ডেয়ো পিঁপড়ে ধরে ডানার ভেতরে ঢুকিয়ে নেয় একই কাজের জন্য। পক্ষীবিশারদরা এই বিষয়টির নাম দিয়েছেন "Anting"। পৃথিবীতে মানবসভ্যতার সূচনায় পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ যখন লেখনীর প্রয়োজন বোধ করল তখন পাখির পালককেই লেখনী হিসেবে তুলে নিয়েছিল। একটি ছোট্ট পালকের প্রতিকূল পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বিস্ময়কর হলেও অসীম নয়। তাই বর্তমানে সমুদ্রের তৈল দূষণ এবং কীটনাশকের বহুল ব্যবহার পালকের অস্তিত্বকে ক্রমেই অনিশ্চিত করে তুলেছে।।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments