জ্বলদর্চি

রমানাথ রায় /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১৩  

রমানাথ রায় 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা



বিশ শতকের ষাটের বছরগুলির অন্যতম প্রধান গল্পকার রমানাথ রায় (১৯৪০-২০২১)। জন্ম যশোর জেলার গোগা গ্রামে। উল্লেখ করা যেতে পারে ইছামতী নদীর তীরের এই গ্রামের শৈশবস্মৃতি ধরা আছে তাঁর ‘গোগা’ নামের একটি গল্পে। বছর দশেক বয়স থেকে কলকাতায়। সিটি কলেজিয়েট স্কুল, সিটি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো। ক্লাস এইটে পড়ার সময় অঙ্কের শিক্ষকের নির্দেশে প্রথম গল্প। তারপর মনের আনন্দে একটার পর একটা গল্প। কিন্তু সে সব গল্প তিনি জমিয়ে রাখতেন না। কলেজে পড়ার সময় গোগ্রাসে গিলেছেন বিশ্ব সাহিত্য। দস্তইয়েভ্‌স্কি, চেখভ, মোপাসাঁ, ফ্লোব্যের, ডিকেন্স, মার্ক টোয়েন, এডগার অ্যালান পো-এ আচ্ছন্ন হয়ে বুঝেছিলেন এতদিন যা লিখেছেন সব অর্থহীন। 

এম-এ পড়তে পড়তে নতুন করে লেখার কথা ভাবলেন। “গল্প মানে তো শুধু একটা গল্প নয়। গল্পের ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার ভাষা, জড়িয়ে আছে তার রচনারীতি।” তিনিও নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব রচনারীতি খুঁজে বেড়ালেন। দ্রুত খুঁজে পেলেন সেই ভাষা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ এবং ফ্রানৎস কাফকার ‘দ্য মেটামরফসিস’ পড়ে চমকে উঠেছিলেন। তাঁর লেখক-জীবনের প্রেরণা এই দুটো লেখা। বাস্তব আর অবাস্তবের চমৎকার মিলন এর আগে কখনও দ্যাখেননি। তাঁর গল্পে তারই প্রভাব, —বাস্তব আর স্বপ্নের আশ্চর্য মিলন। 

তেরো-চোদ্দটা উপন্যাস এবং প্রায় আড়াইশো ছোটোগল্প লিখেছেন। তাছাড়াও বহু প্রবন্ধ। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘ক্ষত ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৬৪)। প্রথম উপন্যাস ‘ছবির সঙ্গে দেখা’ (১৯৮০)। রমাপদ চৌধুরীর অনুরোধে তিনি উপন্যাস লিখেছেন। রহস্য উপন্যাসও।

সাহিত্য তাঁর কাছে “শুধু বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয় নয়, জীবন যুদ্ধে টিকে থাকারও একমাত্র অস্ত্র।” তাই কৈশোর থেকে সাহিত্য ছাড়া অন্য কাউকে তাঁর সঙ্গী করেননি। সাহিত্য ছাড়া অন্য কিছু তিনি ভাবেনন না, ভাবতে আনন্দও পান না। “ধার্মিকের কাছে যেমন ঈশ্বর, আমার কাছে তেমনি সাহিত্য। সাহিত্য না থাকলে আমার জীবন দুর্বহ হয়ে উঠত। আমাকে আত্মবিনাশের কোন পথ বেছে নিতে হত। কারণ কৈশোর থেকে যে ভয়ংকর রুক্ষ্ণ পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছি, আমাকে অবিরত যে মানসিক দুঃখ পেতে হয়েছে তাতে আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল না। একমাত্র সাহিত্যই সেই প্রতিকূল পরিবেশে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।” (‘মহাদিগন্ত’, জানুয়ারি ৮৩)   

তাঁর গল্পের আদর্শ ইন্টিগ্রিটি। তিনি মনে করেন, গল্প-উপন্যাসের মধ্যে ইন্টিগ্রিটি না থাকলে তা মানুষকে স্পর্শ করে না। স্বপ্ন এবং বাস্তবের মিলনে বিন্যস্ত তাঁর গল্পগুলির আকর্ষণের মূলেও রয়েছে সেই ইন্টিগ্রিটি। আর সেই ইন্টিগ্রিটি রয়েছে তাঁর গল্পের আঙ্গিকের মধ্যে। যেমন ‘বারো নম্বর ঘর’। হোটেলের একটি ঘর নিয়ে রচিত এই গল্প। 

লেখক হোটেলে একটা ঘর বুক করেছিলেন। ম্যানেজারবাবু চিঠিতে জানিয়েছিল বিশেষভাবে সাজানো থাকবে ঘরটি। তার তিনটে জানলা আছে। তার একটা দিয়ে নদী দ্যাখা যাবে, একটা দিয়ে পাহাড় দ্যাখা যাবে...। কিন্তু হোটেলে এসে দেখলেন ম্যানেজারের কথার সঙ্গে কোনও রকম মিল নেই। ম্যানেজার বাইরে। হোটেলের বয়ের সঙ্গে কথোপকথনে এগিয়েছে গল্প। পুরো গল্পটাই সংলাপ-নির্ভর। ম্যানেজারের অপেক্ষায় ঘুপচি ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করেন লেখক। কিছু পরে হোটেলের বয় একটি মহিলাকে নিয়ে আসে সেই ঘরে। তাঁর জন্যেও নির্দিষ্ট করা রয়েছে এই ঘর। বয়টি একই রকম বিনীতভাবে কথা বলে। ম্যানেজারবাবু মহিলাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ঘরে একটা ড্রেসিং টেবিল থাকবে, একটা চমৎকার খাট থাকবে...। 

দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পরে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করেন। মামুলি সংলাপ—

“—কাল ভোরবেলা উঠতে হবে। 
—আমাকেও উঠতে হবে।
—আমি কাল দূরে ঝরনা দেখতে যাব।
—আমি কাল দূরে বাজার দেখতে যাব।
—মঙ্গলবার আমি এখানকার মেলা দেখতে যাব। 
—মঙ্গলবার আমি সিনেমা দেখতে যাব।
—বুধবার আমি পাহাড়ে উঠব।    
—বুধবার আমি মন্দির যাব।
—বৃহস্পতিবার আমি নানা রঙের নুড়ি কুড়োব।
—বৃহস্পতিবার আমি শাড়ি কিনব। এখানকার শাড়ি খুব বিখ্যাত।”

এরকম নানান কথাবার্তা। প্রায় একই সুরে একই স্বরে একই রকম কথা। দুজনে সুটকেস খুলে দেখেন, কেউ চিরুনি বা সাবান বা পায়জামা আনেননি, কেউ গন্ধতেল বা নেলপালিশ আনেননি। তাঁদের ঘুম পায়। কিন্তু খাট নেই ঘরে। এমন সময় ম্যানেজারবাবু ঘরে ঢুকে জানতে চান কেন ডাকা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু বিশেষ কী দরকারে ডাকা হয়েছিল তা আর মনে পড়ে না। তারপর মনে করে দুজনে একে একে বলেন, তোয়ালে, চিরুনি, সাবান, নেলপলিশ, পায়জামা দরকার। ম্যানেজারবাবু জানতে চান “আর কিছু ?” আর কিছু লাগবে না জেনে চলে যান তিনি। 

আর তখনই মনে হল আসল কথাটাই বলা হয়নি। লেখকের চিৎকার করে ডাকায় ফিরে এলেন ম্যানেজারবাবু। কিন্তু আসল কথাটা মনেই পড়ে না আর। শেষে মেয়েটি মনে করিয়ে দিলেন “একটা খাট চাই।” ম্যানেজারবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পরে আবারও ডাকলেন। বিরক্ত হয়ে ফিরে আর কী লাগবে জানতে চাইলেন। কিন্তু কথাটা কিছুতেই মনে পড়ে না। মেয়েটি মনে করিয়ে দেন, ভীষণ খিদে পেয়েছে, তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করতে। বাইরে কাজ আছে, আর তাঁকে ডাকলে পাওয়া যাবে বলে বেরিয়ে যান তিনি। দুজনে বসে মনে করার চেষ্টা করতে থাকেন আসল কথাটা। হঠাত মনে পড়ে, “ঘরটা বদলাতে হবে।” মেয়েটিও বলে ওঠেন, “ঠিক।”
 
“—কিন্তু একটা কথা...
—কী ?                    
—আমরা দুজনে কী এক ঘরে থাকব ? নাকি...
—আপনি কী চান ? আপনি যদি বলেন...আমি কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করি। আর...
—আর কী ?
—একা থাকতে আমার ভালো লাগে না।
—আমারও ভালো লাগে না।
তারপর আমরা একসঙ্গে চিৎকার করে ডাকতে লাগলাম, ম্যানেজারবাবু... ম্যানেজারবাবু... ম্যানেজারবাবু...”  

ক্রমশ চাহিদাগুলো বদলে গেল দুজনের। প্রথম থেকে যাকে প্রবল সমস্যা বলে মনে হয়েছিল, তা আর সমস্যাই রইল না! কিন্তু একটা অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে আটকে রইলেন দুজনে। এই অসহায়তা থেকে তাঁদের যেন মুক্তি নেই আর! অসহায়তার মধ্যেও কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন, আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কিন্তু পারছেন না কিছুতেই! এটাই তো জীবনের একটা বড়ো সমস্যা, বড়ো বাস্তবতাও। তাঁর বহু গল্পে ভিন্ন ভিন্নভাবে উঠে এসেছে ব্যক্তিসত্তার অসহায়তার বয়ান।  

শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন রমানাথ রায়। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বোঝাতে গিয়ে লিখলেন— “ছোটগল্প আজ থেকে সমস্ত শর্তের বিরুদ্ধে। সমালোচকের সমস্ত শর্তের বিরুদ্ধে। সমালোচকের সংজ্ঞার বেড়ি ভেঙে সে বেরিয়ে এসেছে। ছোটগল্প এখন কবিতার মতোই স্বাধীন এবং মুক্ত। আমরা যা লিখব, যেমন করে লিখব তাই ছোটগল্প।” বাংলা সাহিত্যের বাস্তববাদী লেখালেখিকে অবান্তর মনে হয়েছিল তাঁর। শাস্ত্রবিরোধী ছোটোগল্প আন্দোলনের মুখপত্র ‘এই দশক’ (১৯৬৬) পত্রিকায় লিখেছিলেন— “সময় হয়েছে যা কিছু পুরনো তাকে বর্জন করবার, সময় হয়েছে যা কিছু নতুন তার জন্য প্রস্তুত হবার। আলমারি থেকে সব বই নামিয়ে ফেলো। আমাদের জন্য এবার একে একে তাকগুলো খালি করে দাও। তথাকথিত মহৎ উপন্যাস এবং গল্পগুলোকে তাড়াতাড়ি ট্রাঙ্কে পুরে ফেলো। ওগুলো আর দরকার নেই। ওগুলো এখন আবেদনহীন এবং বিরক্তিকর।” 

তথাকথিত মহৎ আখ্যান তিনি লিখতে চাননি। তিনি চেয়েছেন একেবারে নতুন কিছু করতে। নতুনভাবে লিখতে। আর সেই নতুন লেখার ভিতর দিয়েই তিনি প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই খুঁজে বেড়াতে থাকলেন। নিজের অস্তিত্ব অন্বেষণ করতে চাইলেন। এই অন্বেষণই তো তাঁর গল্প। 
যেমন ‘ধন্যবাদ চুমকি’। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে প্রেম। কিন্তু প্রচলিত প্রেমের গল্পের সংজ্ঞায় চিনে নেওয়া যায় না। গল্পের কথক চুমকির প্রেমে পড়েছিলেন। শ্যামলা রঙ, কোঁকড়া চুল, পটলচেরা চোখ। বছর খানেক ঘুরে বেড়ালেন। চুমুও খেলেন। কিন্তু তাকে বিয়ে করার কথা ভাবতেন না। কারণ তার শ্যামলা রঙ। তলে তলে ফর্সা মেয়ে খুঁজে বেড়াতেন। একদিন পায়েল নামের এক ফর্সা মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। প্রেমও। চুমকির জন্য মন খারাপ হত। তিনি ঠিক করলেন দুজনের সঙ্গে প্রেম করবেন। তবে ধরা পড়ার ভয় থেকে গেল। ধরা পড়লে দুজনকেই হারাবেন। দুজনেই তার জীবনকে নরক করে তুলবে। “মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। তারা কী করে যেন সব টের পেয়ে যায়। আসলে মেয়েরা খুব সন্দেহপ্রবণ।”

এরপর একদিন চুমকিকে নিয়ে কফি হাউসে বসেছেন। সেইসময় এল পায়েলের ফোন। কথক বেরিয়ে গিয়ে ফোন ধরলেন। পায়েলকে মিথ্যে বললেন যে, তিনি শ্যামবাজারে ইলেকট্রিকের বিল জমা দিতে এসেছেন। আজকে তার বাড়ি যেতে পারবেন না। কিন্তু চুমকি সন্দেহ করে। মোবাইল দেখতে চায়। কথক মোবাইল দিতে না চাইলে চুমকি বেরিয়ে চলে যায়। কথক খানিকটা স্বস্তি পেলেন— “আমি তো চুমকির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে চেয়েছিলাম। এত সহজে সেটা হয়ে গেল দেখে খুশি হলাম। আমি এখন নিশ্চিন্ত। চুমকি আর আমাকে ফোন করবে না। আমিও আর চুমকিকে ফোন করব না। চুমকি আস্তে আস্তে আমাকে ভুলে যাবে। আমিও চুমকিকে ভুলে যাব। ফলে পায়েলের সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে আমার আর অসুবিধে হবে না।”

কিন্তু পরের দিন চুমকির মায়ের ফোন। চুমকি আত্মহত্যা করেছে। খবরটা পেয়ে কথক উদ্বিগ্ন হয়ে প্রথমে জানতে চান, কিছু লিখে রেখে গেছে কিনা। কিন্তু না, চুমকি তাঁকে দায়ী করে যায়নি বলে খুশি হলেন। 

কয়েক মাস পরে পায়েলের বাবা কথককে ডেকে পাঠালেন। হয়তো বিয়ের কথা বলবেন বলে। যেদিন পায়েলের বাবার কাছে যাবেন তার আগের রাতে ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙে গেল। একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে পাশে। ছায়া মূর্তি জানাল, সে চুমকি। পায়েলকে বিয়ে করতে না বলল— “মেয়েটা ভালো না। ... আগে ওর দু-বার বিয়ে হয়েছিল। একটা ছেলেও আছে।” তারপর ছায়া মূর্তি মিলিয়ে গেল।

পরদিন কথক পায়েলের বাড়ি গেলেন না। পায়েলের সব কিছু জানতে গোয়েন্দা লাগালেন। গোয়েন্দা জানাল সত্যি দু-বার বিয়ে হয়েছিল। ডিভোর্স হয়ে গেছে। একটা ছেলেও আছে। ডিভোর্সের বিনিময়ে মোটা টাকা আদায়ও করেছে। ক্ষিপ্ত হয়ে ফোন করলেন পায়েলকে। সব শুনে পায়েল উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল। কথক মনে মনে ধন্যবাদ দিলেন চুমকিকে। 

“এবার চুমকির জন্যে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চুমকির প্রতি আমি যে অন্যায় করেছি তার জন্য দুঃখ হতে লাগল। চোখ ফেটে জল চলে এল। ক-দিন ভালো করে খেতে পারলাম না। রাত্রির অন্ধকারে রোজ বলতে লাগলাম, চুমকি! আমাকে একবার দেখা দাও। আমি অন্যায় করেছি ক্ষমা করো।

একদিন রাত্রে চুমকির ছায়ামূর্তি আমার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি তাকে ধরতে গেলাম। চুমকি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। তারপর সে আর দেখা দেয়নি।”      

স্বপ্ন এবং বাস্তব একাকার হয়ে গেছে এখানে। অবচেতনের অনুষঙ্গ রয়েছে গল্পে। আর সব কিছুকে ছাড়িয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে লেখকের একাকীত্ব। অদ্ভুত একটা ইয়াংনেস, স্মার্টনেস আছে আশি-উর্ধ্ব এই স্পষ্ট বক্তা যুবকের শরীরে-মনে ও লেখায়। তাঁর আখ্যানের চরিত্রদের বয়স বাড়েনি। তাঁর লেখা বারবার আমাদের হতচকিত করেছে। বিষয়কে কখনোই গুরুত্ব দেননি। তাঁর আখ্যান এবং চরিত্র কার্য-কারণ সূত্রে গ্রথিত হয়নি। তাই আপাত অলৌকিক-বাস্তব ঘটনার ভিড় দ্যাখা যায় তাঁর রচনায়। আখ্যানকে বাস্তবের পৃথিবী থেকে নিয়ে গেছেন অবাস্তবের পৃথিবীতে। তাঁর লেখায় বাস্তব হয়ে ওঠে স্বপ্নের মতো। আর স্বপ্ন হয়ে ওঠে বাস্তবের মতো। বাস্তব ও স্বপ্নের বিভেদ মুছে দিয়েছেন। আর তা করতে গিয়ে নানা রকম আঙ্গিকের ব্যবহার করেছেন। তাঁর গল্পে আঙ্গিকের বিবর্তন ঘটেছে বারবার। স্টাইলের জন্যই রমানাথ রায় স্বমহিম। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং ব্যতিক্রমী একজন লেখক। 

অতি সাধারণ, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কিছু মুহূর্ত, যা আমরা জীবনে ধর্তব্যের মধ্যেও আনি না, সেইসব মুহূর্ত থেকে উঠে আসে তাঁর গল্প। যেমন ‘আমি কীভাবে বাড়ি ফিরি’। লেখকের বাড়ি ফেরার গল্প। তিনি ছুতোর পাড়া লেনে থাকেন। এখান থেকে বহু রাস্তা বেরিয়েছে— “অর্থাৎ আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে, সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে, কলেজ স্ট্রিট থেকে, বউবাজার স্ট্রিট থেকে ছুতার পাড়া লেনে আসা যায়। অর্থাৎ ছুতার পাড়া লেন থেকে বেরিয়ে যতগুলো রাস্তা আছে ফিরে আসারও ততগুলো আছে।” 

উত্তম পুরুষে লেখা এই গল্পে এরপর লেখক বিভিন্ন রুটের বাস-ট্রামের ডিটেলস দিয়েছেন। কোনও রাস্তায় জল জমে গেলে বা যানজট হলে অন্য রাস্তা দিয়ে লেখক বাড়ি ফিরতে পারেন। গল্পের শেষে দেখি কোনও যানজট নেই। চারিদিক খোলা। ট্রাম-বাস চলছে সব দিক দিয়ে। “আমি ইচ্ছে করলে আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে বা সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে বা কলেজ স্ট্রিট থেকে বা বউবাজার স্ট্রিট থেকে যে কোনও গলিতে ঢুকে পড়তে পারি। আর সেটাই এখন আমার কাছে একটা ভীষণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে সূর্য সেন স্ট্রিটে যাই, সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে কলেজ স্ট্রিট যাই, কলেজ স্ট্রিট থেকে বউবাজার যাই। আবার বউ বাজার স্ট্রিট থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিট যাই, আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে ... আমার সব গোলমাল হয়ে যায়। চারদিকে ঘুরতে থাকি।” 

পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। নিজেকেও খুঁজে পাচ্ছেন না। এটাই তো মানুষের প্রকৃত সমস্যা। জীবনের বাস্তবতা। সাহিত্যের বাস্তবতা সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য— “কোনটা বাস্তব ? কোনটা অবাস্তব ? কোনটা সত্যি ? কোনটা মিথ্যে ? একজন কৃষকের সমস্যাকে তুলে ধরলেই বাস্তব হবে, আর আমার নিজের সমস্যাকে তুলে ধরলে অবাস্তব হবে কেন ? কোন যুক্তিতে ? আমার কাছে সমস্যা যতখানি তীব্র ও বাস্তব, একজন কৃষকের সমস্যা কি ততখানি তীব্র ও বাস্তব ? কখনই নয়। যদি বলি, হ্যাঁ তাহলে সেটা হবে ভণ্ডামি। আস্তে আস্তে টের পাই আমি নিজেই একটা অন্তত বিষয় হয়ে উঠতে পারি। আমার ভিতর দিয়েই বেরিয়ে আসতে পারে আজকের মানুষের সত্যিকারের সমস্যা ও সংকট। লেখবার সময় আমি শুধুমাত্র ব্যক্তি আমি থাকি না, হয়ে উঠি সর্বজনীন আমি।” (‘মহাদিগন্ত’, জানুয়ারি ৮৩) 

হ্যাঁ, রমানাথ বারবার নিজেই তাঁর গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তি সমস্যা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে সর্বজনীন সমস্যা। আসলে এও তাঁর সময়কে চিনিয়ে দেয় বইকি। রমানাথ রায়ের একটি গল্পের নাম ‘একটি আধুনিক রূপকথা’। সাধারণত তাঁর গল্পগুলি উত্তম পুরুষে লেখা। কিন্তু এই আধুনিক সময়ের রূপকথার গল্প শুনিয়েছেন প্রথম পুরুষের জবানীতে। 

গল্পের নায়ক একদিন বাড়ি ফিরে দ্যাখে সদর দরজা খোলা। ভিতরে ঢুকে আরও অবাক হয়। শুধু তার নিজের ঘর নয়, বাড়ির সব কটা ঘরের দরজা খোলা। সকলে বাড়িতে রয়েছে। কিন্তু কারও কোনও শব্দ নেই। নিজের ঘরে ঢুকে দ্যাখে বিছানায় শুয়ে আছে স্ত্রী। কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বালিশটাকে সরিয়ে দিল। তবুও কোনও চেতনা নেই তার। তবে বেঁচে আছে। বুক ধকধক করছে। মায়ের ঘরে ঢুকে দ্যাখে আলো জ্বলছে। বাবা ইজি চেয়ারে বসে আছেন। মা সামনে একটা চেয়ারে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। ডেকে সাড়া পাওয়া গেল না। দাদা বউদি দুজনে ঘরে আছে। তাদেরও ডাক দিয়ে সাড়া পাওয়া গেল না। ভাইবোনের ঘরে ঢুকে দেখল, দুজনেই পড়ার টেবিলে। বই খোলা। বোনের হাতে কলম। চোখ খাতার দিকে। নায়কের ডাকে সাড়া দিল না। বোনকে ঝাঁকানি দিয়েও লাভ হল না। 

লেখকের মন্তব্য— “বাড়ির সবাই এখন সেই বিখ্যাত রূপকথার গল্পের মতো ঘুমিয়ে আছে। সেই গল্পটার নাম কী ? তার মনে পড়ল। গল্পটার নাম : দ্য স্লিপিং বিউটি।”

সে কী করবে বুঝতে পারে না। বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকে। কিন্তু কতক্ষণ বসে থাকা যায়! “বাড়ির প্রতিটি মানুষ একটা দুর্ভেদ্য কঠিন দূরত্ব নিয়ে আলাদা হয়ে আছে।” এখন কেউ তাকে চেনে না। বাবা-মা-ভাই-বোন-দাদা-বউদি কারও সঙ্গে তার কোনও পরিচয় নেই। বাড়ি ছেড়ে, সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু কার কাছে যাবে, কোথায় যাবে বুঝতে পারল না। ভয় পেয়ে গেল সে। বাবা-মা-ভাই-বোন সবাইকে ডাকল। কিন্তু তার চিৎকার শুনে কেউ ঘর থেকে বেরিয়ে এল না। 

“সে আবার চিৎকার করে ডাকতে গেল, বাবা! মা!...। তবে তার ডাক শেষ হল না। তার আগেই তার কথা আটকে গেল। তার মুখ দিয়ে আর শব্দ বেরোল না। সে বোবা হয়ে গেল। তার মনে হল সে বাড়ির আর পাঁচজনের মতো কঠিন হয়ে গেছে, স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার আর করার কিছু নেই। এখন তাকে অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে রূপকথার রাজপুত্রের জন্যে। সে এসে তাদের নতুন জীবন দেবে। নতুন স্বপ্ন দেবে। কিন্তু সে কবে আসবে ? কবে ?” 

একটি প্রশ্ন দিয়ে শেষ হল গল্প। গল্পটির কাহিনি অংশকে একটা লাইনে বলা সম্ভব। কিন্তু কাহিনি নয়, রমানাথের গল্পের মূল আকর্ষণ তার আঙ্গিক, বিন্যাস, শৈলী। কখনও কখনও আঙ্গিকটাই হয়ে ওঠে তাঁর গল্পের বিষয়। স্বপ্ন-জাদু বাস্তবতা যেমন তাঁর লেখার বাস্তবতায় অনায়াসে ঢুকে পড়ে, তেমনি রূপকথার অনুষঙ্গও চলে আসে তাঁর গল্পে। তবে সেই রূপকথা তাঁর কলমের জাদুতে আধুনিক হয়ে ওঠে।

ছোটো ছোটো সহজ সরল নিরলংকার বাক্যে জীবনের গভীর সত্যকে তুলে ধরেছেন তিনি। দীর্ঘ জটিল বাক্যকে সচেতনভাবে পরিহার করেছেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-কৌতুক-বেদনা-রাগ-ঝাঁজে পূর্ণ তাঁর গদ্য। এই তীর্যক স্মার্ট গদ্যে একটা অ্যাবসার্ডিটি আছে। সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’-কে আশ্চর্য গ্রন্থ মনে করেন। মাঝে মাঝে ছেদ চিহ্নকে তুলে দিয়েছেন। কখনও-বা চরিত্রদের নামও দেননি। একই বাক্যকে বারবার ব্যবহার করেছেন মন্ত্রের মতো। ছোটোবেলা গ্রামে কাটলেও গ্রাম তাঁর লেখায় একেবারে গুরুত্ব পায়নি। নগর-জীবনের নানান সমস্যা নিয়েই তাঁর আখ্যান। প্রেম-রাজনীতি-একাকীত্বের বিচিত্র-বর্ণিল স্বর তাঁর সাহিত্যের পাতায় পাতায় ধ্বনিত। 

তাঁর অধিকাংশ গল্পের নায়ক লেখক নিজে। অধিকাংশ গল্প সংলাপ-নির্ভর। রমানাথ রায় শেষ পর্যন্ত স্থির ছিলেন তাঁর স্টাইলে। তাঁর সহযাত্রী লেখকেরা সরে এলেও, তিনি সরে আসেননি সেই শাস্ত্রবিরোধী ঘরানা থেকে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে ছোটোদের জন্যও লিখেছেন। ‘ভালোবাসা চাই’ ‘কাঁকন’ ‘দেশপ্রেমিক’ ‘কর্ণ কাহিনী’ ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’ ‘সুখ শান্তি ভালোবাসা’ ইত্যাদির মতো স্মরণীয় উপন্যাস এবং ‘সংসার-সাগরে গোপীনাথ’ ‘জ্যান্ত পুতুল’ ‘ঘর সংসার’ ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ ‘কমলালেবুর গাছ’ ‘ভগবানের লীলাখেলা’ ‘অশ্রুবিন্দু’ ‘বাবা বলেছিল’ ‘জাদুকর ক্লিন্টন’-এর মতো বহু গল্প বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। আজ আর তিনি আমাদের মধ্যে নেই। রয়ে গেছে তাঁর অসামান্য সব গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ। আর তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার অজস্র সুন্দর মহূর্ত।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে রমানাথ রায়কে একেবারে অন্য ধারার গল্পকার বলতেই হয়। গতানুগতিক ছকের বাইরে অভিনব আঙ্গিক এর উপস্থাপন ওঁর গল্পকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। আলোচকের পর্যবেক্ষণ দক্ষতা প্রশংসা দাবী করে। অধিকাংশ গল্পের কথক নায়ক তিনিই। গল্প বলতে বলতে তিনি কখন নিজেই একজন চরিত্র হয়ে উঠছেন। বিশ্বজিতের চোখ দিয়ে গল্পগুলোকে আর একবার দেখে দু একটা ভাবনা বদলে গেল। ওঁকে ধন্যবাদ।
    নির্মল চট্টোপাধ্যায়

    ReplyDelete