জ্বলদর্চি

ভান করে বাঁচা..../নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান-১৯

ভান করে বাঁচা....

নিশান চ্যাটার্জী


নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য সাজগোজ পছন্দ করেন না এরকম মানুষের সংখ্যা নেহাতই নগন্য। মানুষ সর্বদাই সুন্দরের পূজারী। তবে সাজ যে কেবলমাত্র সুন্দর দেখানোর তাগিদেই ঘটে তা কিন্তু নয়। মানুষ অনেক সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখতেও সেজে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেন। অবশ্য সেই সাজকে আমরা "ভান" বলে কটাক্ষ করে থাকি। যেমন ধরুন কেউ নেহাতই কৃপণ হয়েও দানী সাজার ভান করে। আবার কেউ কেউ অযোগ্যতা ঢাকতে অন্যকে বিদ্রুপ করে যোগ্য সাজার ভান করে, আবার কেউ কেউ নিজে চুরি করে অন্যকে চোর বলে গালিগালাজ করে নিজে সাধুর ভান করে। আসলে মানুষ এসব কিছুই করে তার নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য। আজকাল রাজনীতির ময়দানেও এই "ভানের" বেশ চল রয়েছে। তবে শুধু রাজনৈতিক নয় সামাজিক জীবনযাত্রাতেও " ভানের" প্রচলন অনেক আগে থেকেই রয়েছে। পাঠককূলের মনে হতেই পারে কথাগুলো অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু এর পেছনেও রয়েছে বিজ্ঞানের হাতছানি। মানুষের মতো আমাদের রহস্যময় জীবজগতের জীবকূলও এই "ভান" করে থাকাকে হাতিয়ার করেই তাদের জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যায়। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে মিমিক্রি। আবার কখনো কখনো কালারেশান নামক ঘটনাও দেখা যায়। আজকের আলোচনায় এই দুটি বিষয়ের প্রাকৃতিক উদাহরণ গুলিকেই মুখ্য বিষয় হিসেবে খন্ডচিত্রের সাহায্যে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।  প্রথমেই কালারেশানের কথায় আশা যাক। 
"রঙ দিয়ে আজ রঙিন হবো, থাকবো তোমার পাশে,
স্বল্প রঙের ধূসর দিনেও, হাতটি থাকুক হাতে"। 

রঙ যেমনই হোক না কেন, তা যেমন প্রিয়জনকে পাশে আগলে রাখে, ঠিক তেমনি সামুদ্রিক ছোট ছোট মাছের ডিমে রজ্ঞক বা pigment কম থাকে এবং তা স্বচ্ছ হয় যাতে সমুদ্রের তলদেশের ভূমির সাথে মিশে থাকতে পারে। ফলে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পায় সহজে। এভাবেই পরিবেশ তাদের আগলে রাখে। এই ধরণের পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বর্ণ সৃষ্টির ঘটনাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়  camouflage ( কেমোফ্ল্যাজ)। আবার কিছু কিছু প্রজাতির প্রাণী তাদের দেহে এমন অদ্ভুত চিত্র বিচিত্র দাগ সৃষ্টি করে, যা দেখে তাদের বিপজ্জনক মনে হলেও তারা নেহাতই সাদামাটা। এই ধরণের কালারেশানকে বলে warning colouration। ভার্জিনিয়ান হরিণের ক্ষেত্রে দেখা যায়- তাদের বিশেষ রঙ যুক্ত লেজটা তারা যখন তুলে ধরে ওপরের দিকে, তখন অন্য হরিণদের কাছে তা বিপদের সঙ্কেত বহন করে। এই ঘটনাকে বলে signal marking colouration। কিছু প্রজাতির মাকড়সা অনেক সময় পতঙ্গদের আকৃষ্ট করার জন্য এমন বর্ণ ধারণ করে যে, পতঙ্গ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ধরা দেয়। এই প্রকার colourationকে বলে Alluring colouration বা সম্মোহন কালারেশান। অন্যদিকে কোনো প্রাণী যখন নিজেকে পরিবেশের মধ্যে লুকিয়ে না রেখে, ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে তখন তাকে বলা হয় মিমিক্রি। কিছু ক্যাটারপিলার জাতীয় প্রাণী এমনভাবে প্রকৃতিতে অবস্থান করে- যে তাদের শুকনো গাছের ডাল মনে হয় এবং এইভাবেই তারা ছদ্মবেশে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পায় এই ধরনের মিমিক্রি কে বলা হয় protective মিমিক্রি। আবার কিছু কিছু মথের ডানায় এমন কালো চিহ্নিত করা থাকে যে আপাতদৃষ্টিতে ওগুলো তাদের চোখ বলে মনে হয় এবং তাদের চোখ খোলা  আছে বলে ভুল করে শত্রুরা বিভ্রান্ত হয়। এই ঘটনাকে বলে cryptic মিমিক্রি। সুতরাং বিজ্ঞান এই শিক্ষাই দিচ্ছে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হলে প্রকৃতিতে বা সমাজে রঙে মিশে অথবা ভান করে থাকাই শ্রেয়। তবে অবশ্যই তা শত্রুর সাথে মোকাবিলার জন্য, অন্যের ক্ষতির তাগিদে নয়।  আবার মনে করিয়ে দেয় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সেই অমর কথা " কখনো কখনো  ছোবল না মারলেও ফোঁস করতে হয়"।   এখানেই বিজ্ঞানের সার্থকতা, এখানেই জীবনের গভীরে বিজ্ঞান।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments