জ্বলদর্চি

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা উৎসব সংখ্যা ১০২

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা উৎসব সংখ্যা ১০২

সম্পাদকীয়,
আজ মহালয়া। লোককথায় বলা হয় এই মহালয়ার দিনেই কৈলাস পর্বত থেকে মর্ত্যধামে বাপের বাড়িতে যাত্রা শুরু করেন দেবী দুর্গা। আর তাঁর সঙ্গে থাকে তাঁর সন্তানেরা –গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী আর সরস্বতী। এই সময় বিভিন্ন বাহনে চড়ে উমা আসেন পিতৃগৃহে। দেবীর এই বাহন মূলত চার রকমের হয়ে থাকে – পালকি, নৌকা, হাতি এবং ঘোড়া। এই বছর দেবী দুর্গার আগমন গজে অর্থাৎ হাতিতে, যার অর্থ শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। ছোটোবন্ধু সৌমী আর শুভঙ্কর উমা মায়ের সেই ঘরে ফেরার ছবি এঁকে পাঠিয়েছে। অদ্রিজা দিদি তার ছড়ায় লিখেছে তাঁর আসার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে।  শুধু কি উমা আসে শরতকালে? পুজোর ছুটিতে কত কত মানুষ ঘরে ফেরে জানো? চুমকি আন্টি লিখেছে, ছোটুর ছোটকা আসছে বিদেশ থেকে। ছোটুর তো দারুণ মজা। ওদিকে আবার সুহাসের গল্প শুনতে শুনতে তোমরা সব ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? সুকুমার জেঠু কিন্তু খুব রাগী। তোমরা সব পাতা এনেছো তো? - হ্যাঁ। বাহ, ভারী লক্ষ্মী তো তোমরা। মা আসছে এই আনন্দে এসো আমরা বুবুন আর গুগলির মতো নেচে নিই। তারা কারা? জানতে হলে রামকিশোর জেঠুর ছড়া পড়ে নাও। মজার কথা কী জানো? এবারের সংখ্যায় দু-দুজন বুবুন আছে। এক বুবুন নাচে আর এক বুবুন গল্প শোনে। কার গল্প? গল্পকাকুর গল্প যেটা শ্যামলী আন্টির লেখা গল্পে আছে। এত অল্পে কিন্তু শেষ নয় উৎসব সংখ্যা ২    আরো অনেক পদ্মফুলের আরো শত শত পাপড়ি ছড়ানো আছে। উমা মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তির ছবি এঁকে পাঠিয়েছে, ইলোরা মাসি। আর আর আর কী আছে? কেন? তোমাদের মনে নেই প্রোটনদের বন্ধু বিশাখা হারিয়ে গেছে? না গো এখনও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। কী করে জানলাম? তপশ্রী আন্টি লিখেছে তো। তোমাদের নিশ্চয়ই আমার মতো মন খারাপ হয়ে গেল। মন ভালো আর আলো করতে এসো  আমাদের আর আলোজীবদের নিয়ে দেবজ্যোতি জেঠুর লেখা ছড়া পড়ে নিই। কি মন ভাল হল কিনা? মন আরো ভালো আর আলো করতে বন্দনা পিসির লেখা ভুতুর গল্পও পড়ে নিতে পারো কিন্তু । ভূত টুত তোমরা তো আবার আজকালকার বিজ্ঞানের যুগের ছেলেপুলেরা মানো টানো না। বেশ, তবে যুগান্তর আঙ্কেলের লেখা কল্প বিজ্ঞানের গল্প পড়ে নাও। আনন্দের কথা এবার  প্রমিতের আর প্রবাহনীলের অপূর্ব আঁকা দুটো উৎসব সংখ্যাকে সাজতে দারুণ সাহায্য করেছে তা তোমরা দেখলেই বুঝতে পারবে। আর অনুশ্রুতির আঁকা মায়ের রঙীন মুখশ্রী দেখে আমার তো তর সইছে না প্যান্ডেলে যেতে। না গো না, আমি কী ভুলতে পারি আজ মহালয়া!  সুব্রত আঙ্কেল তো তাঁর ছড়ায় মহালয়ার চন্ডীপাঠের কথা বলেছেন। কেন জানো? মহালয়া মানেই আমাদের কাছে ভোরবেলায় রেডিওতে শোনা চন্ডীপাঠ। আমাদের ছোটোবেলার এই মহালয়ার দিনটি কেমন ছিল তা অসাধারণ ভাবে লিখে পাঠিয়েছে তোমাদের বিতস্তা আন্টি। বিতস্তা আন্টির লেখায় যে রেডিওটার কথা আছে, সেটা এখন আর তোমরা ঘরে ঘরে দেখতে পাবে না। তাতে কী? অরিত্র আঙ্কেল আমাদের সেই রেডিওটা হাতে এক ছোট্ট বন্ধুর অসাধারণ ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটা দেখেই আমি তো চমকে উঠেছি। ছোট্ট বন্ধু রূপে উমা মা ছোটোবেলার দপ্তরে এসে গেল যে। এসো মা 🙏     মৌসুমী ঘোষ।

স্মৃতিকথা

আলো মাখা নীল সাদা ভেলার সেই দিনগুলো
বিতস্তা ঘোষাল

১৯৫২ সাল। মুক্তি পেল পৃথিবী বিখ্যাত এক চলচিত্র – পথের পাঁচালী। মনের কোনে সকলেরই সেই স্মৃতিটা নিশ্চয়ই অক্ষুণ্ণ- এক শরতের সকালে অপু আর তার দিদি কাশবনের ফাঁক দিয়ে রেললাইনের কাছ থেকে প্রথম ট্রেন দেখছে। আমার ছোটোবেলায় শরত কাল বলতেই তেমনই এক ট্রেন কিংবা সাদা একটা  অ্যাম্বাসডার, হাইওয়ে, কাশবন, গ্রামের পথ আর মাঝখানে কৃষ্ণনগরের পান্থতীর্থ হোটেল একাত্ম হয়ে আছে। চোখ বুজলেই এখনো সেই অপু দুর্গার মতো বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখতে পাই সেসব আলোমাখা দিনগুলো।
সেই কাঁচা বয়সে ২২ শে শ্রাবণ মিটে যাওয়া মাত্র মন উরুউরু শুরু হয়ে যেত। কারণ এর মাস দুয়েকের মধ্যেই আমাদের পাড়ায় ব্রহ্মলোক থেকে এক বিশেষ অতিথি আসবেন, তাঁর জন্য নানান  আয়োজন, প্রধান আকর্ষণ মহিষাসুরমর্দিনি নৃত্যনাট্য কিম্বা শরতের গান নিয়ে কোনো আলেখ্য। প্রতিদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি পড়াশোনা সেরে রিহার্সালে।বিশ্বকর্মা পুজোর রাত থেকে শুরু কাউন্ট ডাউন। যে পাড়াগুলো এতদিন সন্ধ্যের পর নিশ্চুপ হয়ে ছিল হঠাৎ তারা সব আলসেমী ছেড়ে ব্যস্ত।রাস্তা পরিস্কার, বাড়ির বাইরেটা রঙ, বাড়ি বাড়ি দাদা কাকুদের পরিভ্রমণ, ঘন ঘন বৈঠক। সব মিলিয়ে পাড়া জমজমাট।
অবশেষে এল মহালয়ার আগের রাত। তখন টি ভি ছিল না। ঘরে ঘরে রেডিও ঠিক করে রাখা। বার বার ব্যাটারি পরীক্ষা করে দেখা। সারারাত উত্তেজনা। প্রায় জেগে থাকা। পাছে মাহেন্দ্রক্ষণ পেরিয়ে যায়। ঘুম না ভাঙে। অবশেষে কাকভোরে স্নান করে মা কাকিমারা যেই রেডিও অন করলেন শুরু হয়ে গেল ইয়া দেবী... বীরেন্দ্রকিশোর ভদ্র আর জাগো দূর্গা গানের সাথে সত্যিই যেন মা এসে গেলেন মর্তলোকে । উলু আর শঙ্খ ধ্বনির মাঝে সেই সূর্যের অল্প আলোয় মা চলে এলেন সবার ঘরে ঘরে। এবার জামা কাপড় কেনার শুরু, বাঁশ পোঁতাও যেটা এখন খুঁটি পুজো সেটাও সেই ভোরেই। দীর্ঘদিন ধরে প্যান্ডেল তৈরি তখনো অজানাই ছিল।
আমাদের কাছে তখন আটচালার মা বড়জোর আলাদা আলাদা করে দেব-দেবীর একই মঞ্চে অবতরণ অনেক বেশি আনন্দের ছিল। আমরা অনুসন্ধান করতাম কোন পুকুর পাড়ে, কোন খোলা মাঠে কাশের গুচ্ছ হাওয়ায় নাচছে, সাদা মেঘের পানসি কিভাবে আকাশে ভেসে চলেছে। এগুলোই ছিল মা’দূর্গার আগমনী বার্তার আগাম সংকেত।
এগুলোর সাথেই মা শোনাতেন দেবীর মর্তে আগমনের ইতিহাস। অসুরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সব দেবতা মিলে তৈরি করলেন অপরূপা এক দেবীকে। নানা অস্ত্র দিয়ে তাঁকে সজ্জিত করা হল অসুরকে বধ করার জন্য। সেই দেবী মূর্তিই হলেন মা দুর্গা। রামচন্দ্র রাবন বধের আগে অকালে শরত কালে দেবীর আরাধনা করেছিলেন তার শক্তি ও আশির্বাদ প্রার্থনা করে।এমনকি নীল পদ্ম না পেয়ে নিজের চোখ উপড়ে দেবীর পুজো করতে গেছিলেন। তখন দেবী প্রসন্ন হয়ে দেখা দেন এই শরত কালেই। তাই তখন থেকে মা দুর্গা এই সময়ই মর্তে আসেন।
আমরা পাড়ার ছেলে মেয়েরা যখন মার এই গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে কল্পনা করতাম -এক নারী মূর্তির ধীরে ধীরে দেবী হবার চিত্র, চোখের সামনে দেখতে পেতাম মহিষের পেট চিড়ে বেরিয়ে আসছে অসুর, তাঁকে মেরে তাঁর বুকে পা রাখছেন সেই দেবী, তখন কতবার সেই সাজে মনে মনে নিজেকে সাজিয়ে মহিষাসুরমর্দিনি হয়ে উঠেছি আর কল্পলোকের অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেছি সেই বয়সের অপছন্দের মানুষকে তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না।
অন্য দিকে বাবা শোনাতেন, নারীর দেবী হয়ে ওঠার অন্য গল্প। বাবা বলতেন ,ভারতবর্ষ ছিল মাতৃ কেন্দ্রিক সভ্যতা। এদেশের মানুষ বিশ্বাস করতেন সৃষ্টির মূলে মাতৃশক্তি।তাই যুগের প্রয়োজনে অসুর বিনাশে ও ধর্ম প্রতিস্থাপনে বারবার মার আরাধনা।আদিম যুগে বনচারী মানুষ মাতৃ্তান্ত্রিক গোষ্ঠীজীবনে অভ্যস্ত ছিল। এই সময় মায়েরাই ছিলেন সমাজের নিয়ন্ত্রক।তারাই প্রজা তৈরি করতেন বল বৃদ্ধির জন্য। শস্যর আবিষ্কার ও কৃষির সূচনাও তাদের হাত ধরেই। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ লাগলে নারীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধে যেতেন।সেই সময় এদেশে প্রচুর মহিষের উৎপাত ছিল।মহিলারা আত্মরক্ষার্থে তাদের বধ করতেন।তাদের এই  দুইরূপই একত্রিত হয়ে ক্রমশ  গড়ে উঠল শক্তিশালী মা, দেবী দূর্গা। বাবা আরো বলতেন, আগে ভারতে বাঘ প্রধান পশু ছিল ,তাই বাঘের পিঠে দেবীকে বসানো হত, তারপর সিংহ জাতীয় পশু হওয়ায় সর্বত্র সিংহ বাহিনী দূর্গা।
পুরানে, রামায়ণ, মহাভারতে, বেদে এভাবেই লৌকিক অলৌকিক প্রাক আর্য, আর্য, বৈদিকযুগের সকল মাতৃদেবতা মিলে মা হলেন মহিষাসুরমর্দিনী। তিনি অযোনী সম্ভূতা।সেই দূর্গাই প্রতি বছর নিয়ম করে বাপের বাড়ি আসেন।এখনকার মত তখন মেয়েরা রোজ রোজ বাপের বাড়ি আসতে পারত না।তাই বাঙালি মা তার সন্তানকে বছরে একবার নিজের কাছে আনেন এভাবেই।
মা’র গল্পে যে রূপকথা মিশে থাকত ইতিহাসের শিক্ষক বাবার গল্পে তা পেতাম না। কিন্তু মন জুড়ে যেভাবেই হোক না কেন দেবী যে সাধারণ থেকেই অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন সেই কাহিনী আলোড়ন তুলত।
 অপেক্ষায় থাকতাম চতুর্থী অবধি। পঞ্চমীর দিন থেকে আর স্কুল নেই, পড়াশোনাও বন্ধ। কেবল মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা ক’টা দিন যেন জীবনে শুধুই আনন্দ ,বাকি সব মিথ্যে। ভোরবেলা কলা বৌ আনা দিয়ে শুরু হত,চক্ষু দান, প্রাণদান এগুলোর সময় মৃন্ময়ী মা চিন্ময়ী হয়ে উঠতেন ঠাকুরমশাইয়ের মন্ত্র উচ্চারনের সাথে। পাড়ার সব মা কাকিমা জ্যেঠিমা দিদিমারা উলু দিতেন,শঙ্খ বাজাতেন। আমরা ছোটো আর মাঝারি বাচ্চারা কাঁসর বাজাতাম। সেই কয়েকটা দিন যেন সত্যি করে আকাশের দেবী নেমে আসতেন মাটিতে বাপের বাড়িতে। সারা পাড়া তখন একটাই পরিবার।
তখন এত আলোর রোশনাই ছিল না, ছিল না বিশাল প্যান্ডেল, এত এডভারটাইসমেন্টের হুড়োহুড়ি। পাড়ার বাইরে বড় পুজোগুলোতেও ছিল সাবেকিয়ানার ছোঁয়া। উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই প্রায় একই সাজের প্রতিমা। কোথাও খালি ডাকের সাজ, কোথাও অজন্তা স্টাইল, কিম্বা এক চালার ঠাকুর। তবে মুখের আদল পাল্টাচ্ছিল উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে। উত্তরে যেখানে নিটোল বাঙালি ঘরের মেয়ের মুখ সেখানে দক্ষিনে সদ্যবিখ্যাত কোনো নায়িকার মুখের আদলে তৈরি দেবী। অসুরের মুখ কোনো হিন্দি ছবির ভিলেনের অনুকরণে। তবে দুদিকেইএকটা বিষয়ে মিল ছিল। যেখানেই যে প্যান্ডেলেই যাওয়া হোক না কেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হেমন্ত, মান্না, মানবেন্দ্র, কিশোর, লতা, আশা, ভূপেন হাজারিকা, অরুন্ধতী প্রভৃতি শিল্পীদের সদ্য প্রকাশিত গানের ক্যাসেট ও নিয়ম করে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতোই। মনে পড়ে না সেভাবে হিন্দি গান বাজতো ওই ক’টা দিন। একটা জিনিস দেখতাম  প্রায় প্রত্যেকটি পুজো কমিটিই কোনো না কোনো দুঃস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য করছেন নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী। 
 নবমীর ভোরে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হত। এর আগেই মায়ের শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখা বাক্স, যারা সেই গরমের ছুটির পর থেকে নিশ্চুপ হয়ে পড়েছিল আলমারির মাথার উপর, নেমে আসত খাটে। ভরে উঠত জামা কাপড়ে। তবে বেশিরভাগ সময়ই সপ্তমী তিথিতেই যেতাম।কলকাতা ছাড়িয়ে গাড়ি ন্যাশানাল হাইওয়েতে পড়া মাত্র আমাদের পাগলামি বাড়ত বাবার প্রশ্রয়ে।সারা বছর যে বাবাকে একটু ভয় পেতাম, সেই বাবাই তখন শিবের মতো দিল খোলা। কাশ বন, গ্রামের আলপথ, ধাবায় যে কত বার আমাদের গাড়ি থামত! গাড়ির চালক অঘোষিত অভিভাবক কালিচরণ কাকু বলতেন, এই হারে চললে রাত বারোটাতেও পৌঁছাতে পারব না আজিমগঞ্জ। এই তো রাস্তার হাল!
কিন্তু মেঠো পথ, শরতের আকাশ, দূরে দূরে একটা করে সাদা-লাল কাপড় দিয়ে তৈরি মণ্ডপ দেখলেই থেমে যেত গাড়ি। আমরা এক ছুটে ঠাকুরের সামনে। পেছনে বাবা। খিচুড়ি, ল্যা্বড়া আর কোথাও বা আলুভাজা বেগুন ভাজা - আহা! অমৃত যেন - খেতেই হবে। নইলে এই পুজোর দিন বৃথা, এই শরত কাল মিছে। কালিচরণ কাকু বলতেন - দেখে মনে হচ্ছে সাত জন্মে খিচুরি খায়নি। বৌদি খাবার নিয়ে গাড়িতে বসে, আর এদের দেখো যা পাচ্ছে খাচ্ছে। (আমরা জানতাম মা খাবার বানিয়েছেন তাঁর দেওর, শ্বশুর, শাশুড়ি শুদ্ধু সকলের জন্য।নাড়ু থেকে মোয়া,পরটা থেকে মাংসের কিমা, মাছ ভাজা থেকে মাছের টক… সব চলেছে বিমলানন্দ নিকেতনে।)
বাবা ধমক দিয়ে বলতেন- তুই কেবল খাওয়াটাই দেখছিস? এদের আতিথেয়তা, খুশি এগুলো তোর নজরে পড়ল না? বলে আবার সেই পুজো মণ্ডপের মানুষগুলোর সঙ্গে গল্পে মগ্ন হয়ে যেতেন। আমাদেরও জুটে যেত বন্ধু। তখন ভুলেই যেতাম আমরা আদ্যন্ত কলকাতার শহুরে মানুষ। মনে হত আজন্ম বুঝি এদের সঙ্গেই আমাদের বেড়ে ওঠা। 
বাবা প্রতিবার আজিমগঞ্জের মানুষদের জন্য প্রচুর শাড়ি জামা কাপড় ধুতি কিনে নিয়ে যেতেন। সেই পোটলার পাশেই আরেকটা বড়ো পোটলা থাকত, যা খোলা হতে এরকম মণ্ডপগুলোতে। যাদের পরনে বড়োই মলিন পোশাক, গায়ে ছেঁড়া জামা তাদের জন্য সেখান থেকে বেরিয়ে আসত নতুন পোশাক। মা বলতেন- আলাদীনের আশ্চর্য পোটলা। আমাদের হয়তো সর্বসাকুল্যে থান কেটে মায়ের বানানো তিনখানা জামা হয়েছে, কখনো কখনো মা সেখান থেকেও আবার একটা দিয়ে দিতেন সাইজে হলে। একবারও মনে হত না – মা কেন দিল? বরং মন ভরে যেত খুশিতে।( অনেক বড় হয়ে জেনেছি এই সব পুজোর অনেকটা খরচাই বাবা স্বেচ্ছায় নিজেই বহন করতেন। সে জানাও কাকতালীয়, পরে কখনো সুযোগ পেলে বলব)
মাঝ রাস্তায় দেখতাম পশ্চিমের আকাশ লাল করে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। বাবা আবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে সেদিকে তাকিয়ে সিগারেত ধরাতেন। আর সেই ফাঁকে আমরাও আবার রাস্তায়।
সত্যি সত্যি প্রায় মাঝ রাতে যখন আজিমগঞ্জ পৌঁছাতাম তখন গ্রাম নিশ্চুপ। কিন্তু  বড়দা আসছে বলে বারোদুয়ারির পুজো মন্ডপে তখনো কিছু মানুষ না খেয়ে অপেক্ষায়। আমাদের তখন চোখ জুড়ে ঘুম।তবু আনন্দ।এ কদিন আমরা  মুক্ত বিহঙ্গ। বারোদুয়ারির জৈন মন্দির, একপাশে বাঁধানো মঞ্চে দুর্গার আগমণ, পাশেই মুসলমানের মসজিদ, পীরবাবার সমাধী, -  বাবা বলতেন- সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের এত বড়ো তীর্থ ক্ষেত্র কোথাও পাবি না। মা এখানেই শান্তিতে বিরাজ করছেন।
মা কোথায় আছেন, ধর্ম, জাত, উঁচু নিচু, গরিব বড়োলোক সব ভুলে সে ক’দিন আমাদের গায়ে লেগে থাকত মাটির সোঁদা গন্ধ। তবে মায়ের জন্য রাতে ঘরে ফিরে মন খারাপ করত। সেই যে গাড়ি থেকে নেমে রাতে ঘুমিয়েছিল, তার পর দিন ভোর থেকে একান্নবর্তী পরিবারের বড়ো বউ আর রান্না ঘরের বাইরে বেড়বার অবকাশ পাননি। মা তখন নিজেই দশভূজা।     
পেছন ফিরে তাকালে ভাবি পোশাকের বৈচিত্র্য, আলোর রোশনাই আর থিম পুজোর ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে আদি অকৃত্তিম সেই আটচালার টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, স্নেহময়ী মায়ের মুখ আর তার হাসির উষ্ণ ছোঁয়া। এখন আর বাড়ির বাইরে যেতে মন চায় না। নিজেদের বাড়িতেই পুজো নিয়ে মেতে থাকি। মা আসেন তার মতো করে। সকাল থেকে রাত অবধি ব্যস্ত থাকি ঠাকুর দালানেই। শুধু বিসর্জনের বাদ্যি বাজলে বুকের মধ্যে এখনো সেই ছোটো বেলার মত এক একক শূন্যতা ছেয়ে যায়।মনে মনে উচ্চরণ করি, আসছে বছর আবার এসো মা...


নাচ
রামকিশোর ভট্টাচার্য

বুবুন নাকি নাচতে পারে ইংরেজি সুর তালে,
মায়ের তাতে গর্ব ভীষণ -
ইউ টিউবে তাই সারাক্ষণ
চালিয়ে রাখেন সুর যত সব প্রত্যহ সক্কালে।


বুবুন থাকে মস্ত ফ্ল্যাটে, পা দিয়েছে ছয়ে।
সালসা নাচে ম্যাম্বো নাচে,
ক্রসবডি সব লিডসও নাচে,
এনড্রয়েডে লোড থাকে সব, হারিয়ে যাবার ভয়ে।

এই পাড়ারই ছোট্টো মেয়ে গুগলি নামে ডাকি,
মুখখানা তার পদ্মপানা
নেই মোবাইল,তাইরে নানা,
জোছনা ছড়ায় তার হাসিটি, মুগ্ধ হয়েই থাকি।

নাচ শেখাতে যায়না নিয়ে মা-বাবা যে তার,
খাবার পেতেই দিন চলে যায়
পড়ার খরচ মামাই চালায়,
নাচ শেখে সে ঢেউয়ের কাছে একাই বারংবার।

এই তো সেদিন গুগলি বুবুন বন্ধু দুটো এসে,
বৃষ্টিতালে নাচলো তা থই,
তফাৎ তাদের বুঝলাম কই!
একমুঠো তাই বকুল তাদের দিলাম ভালোবেসে।



ছোটকার প্রিয় খাবার
চুমকি চট্টোপাধ্যায়

পাঁচ বছর পর বিদেশ থেকে ছোটকা বাড়ি আসছে। সে কি আনন্দ সব্বার। জেঠু, জেঠিন, দাদাভাই, বাবা, মা, দিদিভাই  সবাই খুব খুব খুশি। আমার কথা আর কী বলি! ছোটকার আসার দিনের অপেক্ষায় রোজই খাতায় দাগ কাটছি।

প্রায় প্রতিদিনই রাতে খাবার টেবিলে খাওয়া হয়ে গেলে মিটিং চালু হচ্ছে। সবার হাত শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে যাচ্ছে তাও কেউ উঠে হাত ধুয়ে বসছে না। কীসের অ্যাতো জরুরি মিটিং? নাড়ু আসছে, তার জন্যে কী কী আয়োজন হবে সেই নিয়ে মিটিং।

আমার ছোটকার ভালো নাম সাত্যকি, ডাক নাম নাড়ু। ছোটবেলায় মাথার ওপরে চুলের ঝুঁটি বেঁধে দিত ঠাম, তাতে  নাকি একদম নাড়ুগোপালের মতো লাগত ছোটকাকে। সেই থেকে নাড়ু বলে ডাকে সবাই।

ছোটকা পড়াশোনায় বরাবরই তুখোড়। তুখোড় শব্দটা বাবার কাছ থেকে আমি শিখেছি। বাবা বলে, ' নাড়ু ছিল সবেতে চ্যাম্পিয়ন। লেখাপড়া, খেলাধুলো, গান, বাজনা, আবৃত্তি, নাটক, বিতর্ক -- যেখানে যাকিছু হত, নাড়ু ঠিক যোগ দিত আর প্রাইজ নিয়ে আসত। আমরা কেউ ওর মতো সাহসী নই। জুয়েল ভাই আমাদের।'

কলেজের পড়া শেষ করে ছোটকা পি এইচ ডি করতে আমেরিকা চলে গেল। আমি তখন একটু ছোটই ছিলাম। ছোটকা আমাকে নিয়ে খুব খেলা করত মনে আছে। কাঁধে নিয়ে ঘুরত। ছোটকা চলে যেতে আমি নাকি খুঁজে বেড়াতাম। বাবারা ছোটকাকে এই কথাটা যখন ফোনে বলত, খুব কষ্ট পেত ছোটকা। বলত, ' আমি যখন দেশে ফিরব, ছোটুর জন্য স্পেশাল কিছু নিয়ে যাব। '

ছোটকা আসছে, আমার জন্যে কী আনছে ভেবে খুব উত্তেজনা হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। রোজ রোজ বড়দের যে আলোচনা চলছে বাড়িতে তা হল, ছোটকাকে কী কী খাওয়ানো হবে। যা যা খেতে ছোটকা ভালোবাসত, সেসব আনার ব্যবস্থা করছে জেঠু আর বাবা। দাদাভাইকেও কিছু জিনিস আনার দায়িত্ব দিয়েছে। কেমন একটা পুজো পুজো ভাব বাড়িতে।


ছোটকা এসে গেছে। গাড়ি নিয়ে আদরের ছোট ভাইকে আনতে চলল জেঠু, বাবা আর দিদিভাই। দাদাভাইয়েরও যাবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কলেজ থাকায় যেতে পারল না। আমি সবে স্কুল থেকে ফিরেছি তাই আর গেলাম না।

ছোটকার ঘরটা পরিষ্কার করেছে মা আর জেঠিন মিলে। বিছানায় সুন্দর বেডকভার পাতা হয়েছে, টেবিলে নতুন টেবিল ক্লথ, মাঝখানে বাহারি ফুলদানিতে এক গোছা ফুল, জানলায় নতুন পর্দা, আরো কত কিছু করেছে জেঠিন আর মা। মোট কথা, ঘরটা দারুণ সুন্দর লাগছে।

মা জেঠিনের একটা ব্যাপারে চিন্তা হচ্ছে। নাড়ু পালটে যায়নি তো! বাংলায় কথা বলে তো নাকি ইংরেজিতে বলে। পাক্কা পাঁচ বছর সাহেবদের সঙ্গে ওঠাবসা করে বাঙালি আছে তো সে!

কথাটা আমারও মনে হয়েছিল। ছোটকা পালটে যায়নি তো! এত সব চিন্তাভাবনার মধ্যে বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। দাদাভাই চেঁচিয়ে উঠল, ' এসে গেছে, এসে গেছে। ' আমরা সবাই দুদ্দাড় করে ছুটলাম বাইরে।

গাড়ি থেকে নেমেই ছোটকা চিল্লিয়ে বলে উঠল, ' ম্যায় আ গয়া! ' আমি অবাক হলাম। ইংরেজি না, বাংলা না, ছোটকা হিন্দি বলছে কেন! ছোটকা কিন্তু একই রকম আছে দেখতে।

' বড় বৌদি, মেজ বৌদি তোমরা কেমন আছ। ' জেঠি আর মাকে প্রণাম করল ছোটকা। দাদাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ' আরে গুবলু, তুই কত্ত বড় হয়ে গেছিস রে! এবার ফাইনাল ইয়ার তো কলেজের? ' দাদাভাই ছোটকাকে প্রণাম করে বলল, ' হ্যাঁ ছোটকা। ' ছোটকা বলল,  ' গ্রেট! '।

আমার কান্না কান্না পাচ্ছিল। সবার সঙ্গে কথা বলছে ছোটকা কেবল আমাকে দেখছেই না। আমি দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

মা বলল, ' ভেতরে চলো নাড়ু। এখানে গরম লাগবে। এসো।' বাবা  জেঠু আর দাদাভাই মিলে ছোটকার লাগেজ নামিয়ে নিয়েছে গাড়ি থেকে। হঠাৎ ছোটকা বলে উঠল, ' আমার ছোট ভাইপো কই? অ্যাই ছোটকু কোথায় তুই? '

আমি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ছোটকার সামনে। ওব্বাবা, তুইও তো কত লম্বা হয়ে গেছিস রে! আর তোকে কাঁধে নিয়ে ঘোরাতে পারব না। দাঁড়া, আগে হাত ধুয়ে নিই, তারপর কোলাকুলি করব তোর সঙ্গে। '

ড্রইং রুমে ছোটকা বসেছে। তাকে ঘিরে আমরা সবাই বসেছি। জেঠু, বাবা, দাদাভাই, মা, দিদিভাই অনেক প্রশ্ন করছে, নানা কিছু জানতে চাইছে। জেঠিন শুধু শুনছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। আমি অপেক্ষা করছি ছোটকা আমার জন্য কী এনেছে সেটা দেখার।

আমার দিকে তাকিয়ে ছোটকা বলল, ' ছোটু, আমার ঘরে নীল রঙের একটা ব্যাগ আছে দেখ। ওটা নিয়ে আয়। পারবি তো? সামান্য ভারী আছে। '

' হ্যাঁ পারব। ' বলে ছুট লাগিয়েছি আমি। ব্যাগটা এনে ছোটকার পাশে রাখলাম। ছোটকা বলল, ' ছোটু বাড়ির কনিষ্ঠ সদস্য তাই ওর উপহার আগে দেব। ঠিক হ্যায়?'

ব্যাগ থেকে একটা বড় সাইজের বাক্স বের করল ছোটকা। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ' ছোটু, এটার নাম অ্যাবট। এর ভেতরে যে পার্টসগুলো আছে, সেগুলো জুড়ে রোবট বানাতে হবে । সেই রোবট তোর কথা শুনবে। তুই যা কম্যান্ড দিবি, শুনবে। নে, ধর। প্রথমে ইন্সট্রাকশন লিফলেটটা ভালো করে পড়ে নিস। কোনো অসুবিধে হলে আমাকে বলিস।'

বাকিদেরও নানারকম উপহার দিল ছোটকা। আমার আর সেদিকে নজর ছিল না। মহা খুশি আমি। আমার জন্যে দারুণ জিনিস এনেছে ছোটকা। সোজা ঘরে চলে গেলাম।

রাত্রে খাবার টেবিলে সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছি। অন্যদিন আমি আর দিদিভাই আগে খেয়ে নিই। আজ কেউ রাজি হইনি আগে খেতে। ছোটকার গল্প শুনব।

খেতে খেতে আমেরিকার ভালো মন্দ নিয়ে কথা বলছিল ছোটকা। মাঝে কথা থামিয়ে বলল, ' করেছ কী তোমরা! এত খাবার কোনো মানুষ খেতে পারে। বাপরে! মাছ মাংস একসঙ্গে কোর না গো। আমি এখন এক মাস আছি, সবই খাব তবে ধীরেসুস্থে।

' কাল তোকে ফ্রেশ পাবদা মাছ খাওয়াব। ' বাবা বলল। ছোটকা খুশি হয়ে বলল, ' তাহলে শুধু পাবদা মাছের পাতলা ঝোল খাব। আর কোনো মাছ কোর না কিন্তু।'

' এ মা, শুধু পাবদা খাবে, আর এক রকম মাছ খাও। ভালো ভেটকি আছে, খাবে তো?  ' জেঠিন বলল।
' না গো বড় বৌদি। কাল অনেকগুলো পাবদা মাছ খাব। তাই দুরকম মাছ কোর না। '

' আচ্ছা, ঠিক আছে, তাই হবে।  এবার বলো জলখাবারে কি খাবে? লুচি খাবে না আলুর পরোটা? তুমি তো ডালপুরিও ভালোবাস, তাই না?'

' একটা আবদার করব তোমাদের কাছে, রাখবে? ' মা জেঠিনের দিকে তাকিয়ে ছোটকা বলল।

' ও মা, সে কী কথা? তোমার আবদার রাখব না!  বলো শুনি তোমার কী আবদার! '

' লোফ পাঁউরুটর মাথা খাব বৌদিরা। সেই কালচে মতো মাথা আর তেলতেলে পেছনের দিকটা, উফ! জিভে জল এসে যাচ্ছে। আমেরিকায় হাজার ডলার খরচা করলেও এ জিনিস পাওয়া যায় না গো। প্লিজ, তোমরা কাল জলখাবারে আমাকে পাঁউরুটির মাথা আর ল্যাজ খাওয়াও। অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি, কবে বাড়ি যাব আর পাঁউরুটির মাথা খাব। রীতিমতো স্বপ্ন দেখতাম ওখানে।'

হঠাৎ ডাইনিং হলটা নিঃশব্দ হয়ে গেল। তারপরেই হোহো করে সবাই জোরে হেসে উঠল। সব খাবার ছেড়ে কিনা পাঁউরুটির মাথা আর ল্যাজা! হ্যাঁ, এখানে থাকতে পাঁউরুটির মাথা ওই খেত বটে তাই বলে এখনও! বিলেত ফেরত নাড়ুর এ কী অবস্থা! 

পরের দিন এক পাউন্ড পাঁউরুটি আনা হল। তার পোড়া মাথা আর তেলতেলে ল্যাজা তারিয়ে তারিয়ে খেল ছোটকা। বলল, ' এর লোভেই আমি দেশে ফিরে আসব। '

আবার এক প্রস্থ হাসির রোল উঠল ঘরে। জেঠু বলল, ' নাড়ুটা একটুও বদলায়নি। '


আমরা ওরা
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


এই পৃথিবীতে আমরা, বস্তু দিয়ে তৈরি জীবরা যেমন থাকি, তেমনই থাকে আলোয় গড়া আলোজীবের দলও। আমরা ওদের দেখি, ওরাও আমাদের দেখে। কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। কেমন মজার ব্যাপার!

মানুষের কথা

"মাথার ওপর রাতের আকাশ 
মেরুজ্যোতির আলো
ও মা,আমার লাগছে ভারী ভালো
ওরা কী সেই গল্পে পড়া 
আলোয় গড়া পরী?"
"মুখ্যু  মেয়ে তোকে নিয়ে
বল দেখি কী করি?
দেখতে যতই লাগুক ওদের ভালো
মানুষ তো নয়, পরীও নয়,
ওরা শুধুই আলো"
তোমার মতন ইচ্ছে হলেই
এদেশ বিদেশ যাওয়া
পেটটি পুরে খাওয়া,
কিছুই পারে না যে,
রাত্রে কেবল আকাশ সাজায় 
নতুন নতুন সাজে"

*****

আলোজীবদের কথা

"বলো না মা, বস্তু দিয়ে গড়া
কারা ওসব? পায়ের নীচে 
করছে নড়াচড়া?"
নীলরঙা সেই মেরুজ্যোতি 
ঝলসে উঠল শুনে
আলোর ভাষায় জবাব দিল, 
"ওদের বলে মানুষ, পাখি
বৃক্ষলতাপাতা।
কূল পাবি না গুনে
তোমার মতন ওদের আছে প্রাণ
তোমার মতন ওরাও সবাই 
সূর্যদেবের দান।
তবু দু:খী তারা ভারী
আলোকজীবের মত
আপন ইচ্ছেমত
পায় না দিতে যখনতখন।


ছোটদের জন্য উপন্যাসিকা

ধানের শীষে শিশিরবিন্দু 
পর্ব - ২
সুকুমার রুজ  


তিন
  তোমরা সবাই এসে গেছ? গাছের পাতা নিয়ে এসেছ তো? 
  ঠিক আছে, গল্প বলার শেষে পাতাগুলো দেখবো। এখন সরাসরি গল্পে চলে যাই। কাল কদ্দুর বলেছিলাম যেন!
  হ্যাঁ,  ঠিক বলেছ! ক্যান্সারের ওষুধ বিষয়ক সুহাসের স্কুলবেলার একটা ঘটনা। সুহাস তখন কোন ক্লাসে পড়ে বলেছি?
  হ্যাঁ, ক্লাস সেভেনে পড়ে। সেবার ওর অ্যানুয়াল পরীক্ষা। সে সময় ওর বাবার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ওর মন খুব খারাপ। কিন্তু পরীক্ষা তো দিতেই হবে। সেদিন বিজ্ঞানের পরীক্ষা। সব প্রশ্নের উত্তর ওর লেখা হয়ে গিয়েছে। তারপর শেষের দিকে পাতা বেঁচে যাওয়ায় ও মনের ইচ্ছে মতো অনেক কিছু লিখেছে। তারপর সেসব ভুলেও গিয়েছে। 
  মাসখানেক পর অ্যানুয়াল পরীক্ষার ফল প্রকাশ। সুহাসদের ক্লাসে টানটান উত্তেজনা। ক্লাস-টিচার ঢুকেই রোল-কল সেরে নেন। তারপর বলেন, 'এই ক্লাসে আজকে তোমাদের শেষ রোল-কল। আশা করব, প্রত্যেকেই প্রমোশন পেয়ে নতুন ক্লাসে বসবে।'     
   হঠাৎ ক্লাসে ঢোকেন হেডস্যার ও গেমস-টিচার। সকলে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হেডস্যারের গম্ভীর গলা — বস তোমরা! প্রথমে আমি প্রথম-দ্বিতীয়দের নাম ঘোষণা করব। তারপর যারা ভালোভাবে পাস করেছ, তাদের নাম ঘোষণা করবেন ক্লাস-টিচার।  
   গেমস-টিচারের হাত থেকে কাগজ নিয়ে হেডস্যার একটু গলা ঝেড়ে নেন। তারপর শুরু করেন —  প্রথম হয়েছ ...!  
  এটুকু বলেই হেডস্যার একটু থামেন। ফার্স্ট-বেঞ্চের ছাত্রগুলোর মুখে চোখ বুলিয়ে নেন। সকলে জানে, এর পরের কথাটা হবে 'সুহাস মণ্ডল'। তাই সবাই সুহাসের দিকে তাকায়। হেডস্যার বলেন — প্রথম হয়েছ সৃজন সেন। দ্বিতীয় হয়েছ ঋজু দত্ত। আর যারা পাস করেছ, তাদের নাম বলবেন তোমাদের শ্রেণি-শিক্ষক।         
  হেডস্যারের শেষের দিকের কথাগুলো সুহাসের কানে ঢোকে না। ও এখন যেন ক্লাসে নেই! যেন এক গভীর কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছে! ওর কানে শুধু খলবল জলের শব্দ! নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেছে! অন্যান্য ছেলেরা অবাক হয়! প্রত্যেকবার সুহাস  ফার্স্ট হয়, অথচ ...!    
  হেডস্যার বলেন —  সুহাস, তুমি একটু পরে আমার সঙ্গে দেখা করবে। তোমার 'গার্জেন-কল' লেটারটা নিয়ে যাবে।  
  এর মধ্যে সুহাসের চোখ দুটো জল-টলটলে হয়ে উঠেছে। কারও দিকে তাকাতে পারছে না। হেডস্যার ও গেমস-টিচার চলে যান। সুহাসের চোখ ফাঁকা ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে। সবাই কেমন চুপচাপ! এমনকি ক্লাস টিচারও! সুহাস চোখ না তুলেই বুঝতে পারে, ওকে সবাই দেখছে। ওর ইচ্ছে করছে অদৃশ্য হয়ে যেতে। সেই বিদেশি গল্পের বইয়ে পড়া গল্প 'ইনভিজিবল ম্যান'-এর রসায়নটা যদি জানা থাকতো, তাহলে এখনি তা প্রয়োগ করে অদৃশ্য হয়ে লজ্জার হাত থেকে বাঁচত।       
  ক্লাস-টিচার সান্ত্বনা দেন —  মন খারাপ করো না! তোমার রেজাল্ট ভালই হয়েছে। লেখাপড়ায় আরও মনোযোগী হও। তোমার ভালোর জন্যই প্রধান শিক্ষক তোমার গার্জেনকে দেখা করতে বলবেন। আর শোনো, তোমরা গোলমাল করবে না। একটু পরেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হবে। আমি তোমাদের মার্কশিট নিয়ে আসি।   
  স্যার বেরিয়ে যেতেই রাতুল, সৃজন, রনি, সুহাসের কাছে এসে বসে। সমবেদনা জানায়। সৃজন বলে — আমি ফার্স্ট হবো ভাবিনি, তুই ফার্স্ট হয়েছিস। তোর নামে কমপ্লেন থাকার জন্য হয়তো...!      
  সুহাসের চোখের কোণে মুক্তোদানা। এবার তা বেঞ্চির উপর ঝরে পড়ে। ওর দুঃখে বন্ধুরাও কাঁদো-কাঁদো হয়ে যায়। ওকে সকলে দারুন ভালবাসে যে!     
  রনি বলে — তুই নিশ্চয়ই থার্ড হয়েছিস! দেখলি না, থার্ড হয়েছে যে, হেডস্যার তার নাম বললেন না।    
  সকলে সায় দেয় — ঠিক বলেছিস! দু'এক নম্বর কম দিয়ে ওকে থার্ড করে দিয়েছে।  
  সুহাস নিজের মনে বিড়বিড় করছে — বিজ্ঞানের স্যার শহরের মানুষ তো! গাছগাছড়া তেমন চেনেন না। তাই আমার আবিষ্কারটা বুঝতে পারেননি। একটু বুঝিয়ে বললে...!        
  ওকে বিড়বিড় করতে দেখে ঋজু বলে — কী বিড়বিড় করছিস? আবিষ্কার টাবিষ্কার কীসব বলছিস!    
  আবিষ্কারের কথাটা তোদেরকে বলি। তোরা তো জানিস, সাপের বিষ দিয়ে সাপে-কাটা রোগের ওষুধ তৈরি হয়, সেদিনই স্যার বলেছিলেন।    
  সবাই সুহাসকে সমর্থন করে। সুহাস উৎসাহ পেয়ে বলতে থাকে, আর আমার বাবা প্রায়ই বলেন —  'বিষে বিষে বিষক্ষয়'।
এই দুটো কথা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে ক্যান্সার রোগের ওষুধ আবিষ্কার করতে।        
  সকলে এক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তারপর হইহই করে ওঠে — বলিস কী রে! ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করেছিস তুই!    
  না, আবিষ্কার এখনো হয়নি। মানে, পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রমাণিত হয়নি যে, ওটা ক্যান্সারের ওষুধ। তবে উৎসটা পেয়েছি। সেটাই তো পরীক্ষার খাতায়...। 
  পরীক্ষার খাতা ছাড় এখন। আগে তুই এই আবিষ্কারের কথাটা বল।   
  সুহাসের গলায় বেশ জোর এসেছে —  তোরা তো শুনেছিস, ক্যান্সার হলো এক ধরনের ঘা বা ক্ষত, যা শরীরের বাইরে কিংবা ভেতরে হতে পারে এবং তা কখনো সারে না। 
  সকলে বলে ওঠে —  হ্যাঁ ক্যান্সার তো তাই-ই!        
  এখন ঘটনাটা হয়েছে কী, আমি তো মাঝে মাঝে মিত্তিরদের জঙ্গলে যাই। ওই জঙ্গলে নানারকম গাছপালা আছে। ওই জঙ্গলের চারপাশে রাংচিতার বেড়াও আছে। রাংচিতা গাছ চিনিস তো তোরা? কালচে সবুজ রং। কোনও কোনও গাছে আবার সাদা ছোপ ছোপ। দেখলেই গা শিরশির করে। মা বলেন, 'রাংচিতার আঠা খুব খারাপ জিনিস! চোখে আঠা লাগলে অন্ধ হয়ে যায়। গায়ে লাগলে বিষাক্ত ঘা হয়। বাড়তেই থাকে, সারতে চায় না।' এবারে বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা?          
  সবাই হতভম্ব! কিছুই মাথায় ঢোকে না। সুহাস ওদেরকে বলে —  বুঝতে পারলি না! রাংচিতার আঠা লাগলে ঘা হয় এবং তা সারে না, অর্থাৎ ক্যান্সার। এবার বাবার কথাটা ভাব! 'বিষে বিষে বিষক্ষয়'। অর্থাৎ এই রাংচিতা হল বিষ, তাহলে তা থেকেই পাওয়া যেতে পারে ক্যান্সারের ওষুধ। আমি বিজ্ঞান খাতার শেষ পাতায় ...।    
  এমন সময় মার্কশিটের বান্ডিল নিয়ে ক্লাস-টিচার আসেন। সুহাসকে বলেন — হেডস্যার ডাকছেন।     
  সুহাস এগোয় পায়ে পায়ে। দুরুদুরু বুকে ও হেডস্যারের ঘরে ঢোকে। হেডস্যার বিজ্ঞান খাতাটা বের করে বলেন — পরীক্ষার খাতায় এসব কী লিখেছ! এভাবে ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করা যায়? এসব আবোল তাবোল লেখার জন্য তোমার পাঁচনম্বর কেটে নেওয়া হয়েছে। তা না হলে তুমি ফার্স্ট হতে। নম্বর কাটা যাওয়ায় থার্ড হয়েছ। শোনো, অনুসন্ধিৎসা থাকা ভালো। তাতে নতুন নতুন আবিষ্কার হয়। তবে তার আগে পড়াশোনা করে নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয়। আগে আবিষ্কার করার যোগ্যতা অর্জন করো। লেখাপড়ায় মন দাও। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। আগে সে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করো। তারপর এইসব ...।এই চিঠিটা ধরো। তোমার বাবাকে দেবে। আর ক্লাসে গিয়ে মার্কশিট নিয়ে নাও।     
  সুহাস ঘাড় হেলিয়ে বেরিয়ে যায়। ওর মনের মধ্যে পাক খায় হেডস্যারের কথা — 'যোগ্যতা অর্জন করো, আগে যোগ্যতা অর্জন করো!'          
 এই হল সুহাসের স্কুল-জীবনের একটা ঘটনা। না না, পরীক্ষার খাতায় ও এইসব লিখেছে ব'লে তোমরা হেসো না! সুহাসের সেসময়ের মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো। ওর বাবা ক্যান্সারের রোগী, যার কোন ওষুধ নেই। ওর মনের মধ্যে বয়ে চলেছে বাবাকে সুস্থ করে তোলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তা থেকেই ও খাতার পাতায় ওইসব লিখেছে। সেটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কে বলতে পারে, যে রাংচিতার আঠা থেকে ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার হবে না!   
  কিন্তু তখনও তো ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। সুহাসের এইটের ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই ওর বাবা মারা গেল। ওর  আর স্কুলে যাওয়া হলো না। গ্রামের মানুষের সাহায্য নিয়ে বাবার সৎকার করা হলো। কিন্তু তারপরেই চিন্তা হল, মা, বোন আর ও মিলে তিনজনের সংসার কী করে চলবে? বাবাই তো চাষবাসের কাজ ক'রে যেটুকু উপার্জন করত। ঘরে সঞ্চয় বলতে আর কিছু ছিল না। কেননা, সুহাসের বাবা অনেকদিন ধরে এই রোগে ভোগার জন্য কাজে যেতে পারেনি। এখান থেকেই শুরু হল সুহাসের কষ্টের দিন। থাক, আজ আর তোমাদের কাছে কষ্টের কথা ব'লে তোমাদের মনে কষ্ট দেবো না। আগামীকাল বলব ওর কষ্টের কথা। আজ ছুটি। সবাই আস্তে আস্তে বেরিয়ে বাড়ি চলে যাও। অ্যাই! কে চিৎকার করছ? মোটেও গোলমাল নয়, একে একে চুপচাপ ক্লাস থেকে বেরোবে।


চার 
  
আজ যেন কয়েকজন কম এসেছ মনে হচ্ছে! দুঃখের কাহিনি শুনতে ভালো লাগবে না ব'লে কেউ কেউ আসেনি নাকি! যাই হোক, যারা এসেছ, তারাই শোনো মন দিয়ে। কাল তোমাদের বলেছি, সুহাসের বাবা, মারা গেলেন। ওদের বেঁচে থাকাটাই খুব সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। নিরুপায় হয়ে ওর মা অন্য বাড়িতে কাজ করার জন্য গেল। ওর মা তো আর চাষবাসের কাজ জানে না। জানে শুধু ভাত রাঁধতে, মুড়ি ভাজতে, ধানসিদ্ধ করতে। আর বড়জোর ধান ঝাড়াই-বাছাই করতে জানে। গ্রামের মানুষেরা প্রত্যেকেই এসব কাজ নিজেরাই করে। তাদের কাজের লোকের দরকার হয় না। তবুও তারা অন্যের কষ্ট বোঝে, তাই সুহাসের মাকে মুড়িভাজা, ধানসিদ্ধ করার কাজ দেয়। যাতে ওদের সংসারটা বাঁচে। কিন্তু টাকা খুবই কম! প্রয়োজনের তুলনায় উপার্জন নগণ্য। 
  তাই সুহাসকে কাজের সন্ধানে বেরোতেই হয়। কিন্তু ওইটুকু ছেলেকে কে আর কাজ দেবে! ওর তো তখন স্কুলে যাওয়া আর খেলে বেড়ানোর কথা। কিন্তু সুহাসের তো কাজের দরকার। টাকা রোজগার করা দরকার। তাই ও ভোরবেলায় মাঠে বেরিয়ে পড়ে। চাষিরা নিজের নিজের জমিতে কাজ শুরু করেছে। ও তাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ঘুরতে ঘুরতে দেখে, কোনও জমিতে জল ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু কাঁকড়াতে আলে গর্ত করে দেওয়ায় হু হু করে সে জমির জল বেরিয়ে যাচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি গিয়ে কাদা দিয়ে সে গর্ত বন্ধ করে দেয়। জল বেরিয়ে যাওয়া আটকায়। জমির মালিক জমিতে আসতেই অন্য চাষিরা বলে সুহাসের উপকার করার কথা। সুহাস তখন উৎসাহ পেয়ে, একটা এনামেলের থালায় করে নিচু জায়গা থেকে জল সেঁচে উঁচু জমিটাতে দিতে থাকে। তা দেখে জমির মালিক খুশি হয়। ওকে কিছু মজুরি দেয়। 
  এভাবে বেশ কিছুদিন পেরোনোর পর ওর কাজের প্রতি নিষ্ঠা ও সততা দেখে ওকে এখন অনেকেই কাজে নিতে চায়।  তাছাড়া ও বাচ্চাছেলে ব'লে ওকে টাকাও কম দেওয়া যায়। কিন্তু ওর কাছে সেটাই অনেক! এভাবে ও আস্তে আস্তে সমস্ত চাষের কাজ শিখে ফেলে।      
  এর মধ্যে একদিন সুহাসের ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ও দু'জন সহকারী শিক্ষক ওর খোঁজ নিতে ওদের বাড়িতে এসেছেন। তখন ওর মা অন্য বাড়িতে কাজকর্ম সেরে এসে সবে রান্না বসিয়েছে। সুহাসের মা তো ভেবে পায় না ওদের কোথায় বসতে দেবে, কীভাবে আপ্যায়ন করবে। ঘরে তো দেওয়ার মতো কিছুই নেই। শুধু স্টিলের গ্লাসে তিন গ্লাস জল নিয়ে এসে দেয়। তারপর দাওয়ায় মাদুর পেতে দিয়ে বলে — দয়া করে আপনারা বসুন! আমি চা তৈরি করে দিই। শিক্ষক মশাইরা আনন্দের সঙ্গে সে জল খেয়ে বলেন — আমাদের এখন চা খাওয়ার সময় নেই। আমরা সুহাসের খোঁজ নিতে এলাম।  
  সুহাসের বাবার কথা, সুহাসের স্কুলে না যাওয়ার কারণ, টাকা রোজগার করার জন্য ওর মুনিশ খাটার কথা, এসব বলতে বলতে সুহাসের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। শিক্ষকমশাইরা মনে খুব কষ্ট পেয়ে চলে যান। যাওয়ার আগে বলেন — সুহাসকে একদিন স্কুলে যেতে বলবেন। ও খুব ভালো ছাত্র ছিল। লেখাপড়াটা করতে পারলে ও স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করতো।      
  কী হলো! তোমরা সব চুপচাপ হয়ে গেলে কেন? সুহাসের জন্য মনে কষ্ট হচ্ছে? শুনতে পাচ্ছি, কে আবার ফিঁচফিঁচ করে  নাক টানছো! এই যে তোমরা সুহাসের সমব্যথী হলে, এটাই হচ্ছে মনুষ্যত্বের বিকাশের প্রথম ধাপ। এখন মানুষের কষ্টে  নিজে কষ্ট পাওয়া, আর একটু বড় হলে কষ্টের কারণ খোঁজার চেষ্টা করা ও অন্যের কষ্ট কমানোর চেষ্টা করা, এসব হলো প্রকৃত মানুষের কাজ। তোমরা প্রকৃত মানুষ হবে, সে পথেই এগোচ্ছ। আমার খুব ভালো লাগছে। তোমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই মনুষ্যত্বের বীজগুলো একদম তরতাজা রয়েছে। সেখানে একটু জল-হাওয়া-রোদ্দুর পড়লেই ধীরে ধীরে বৃক্ষ, বৃক্ষ থেকে মহীরুহে পরিণত হবে। শুধু বিদ্যাসাগর, হাজি মোহাম্মদ মহসিন বা আব্রাহাম লিঙ্কন নিয়ে গর্ব করা নয়, নিজেদেরকেও ওইরকম মহীরুহে পরিণত করতে হবে।    
  তোমরা হয়তো ভাবছো, স্যার গ্যাস খাওয়াচ্ছে আর জ্ঞান দিচ্ছে। এটাকে জ্ঞান দেওয়া বলে না, উৎসাহিত করা বলে। যাই হোক, আজকের মতো গল্প শোনানো এখানে শেষ। কেন না, তোমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। আর আজ সময়ও নেই।  তোমাদের যে সুহাসের জীবনকথা শুনতে বেশ ভালো লাগছে, তা তোমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। আগামীকাল বলব সুহাসের বোনের কথা, সুহাসের জীবনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কথা। তোমরাও সে অভিজ্ঞতা শুনে নিজেদেরকে তৈরি করতে পারবে। জীবনযুদ্ধের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারবে। 
  কী হল! 'জীবনযুদ্ধ' কথাটা শুনে তোমরা ঘাবড়ে গেলে দেখি! আরে না না, ওটা কথার কথা। জীবনটাকে যুদ্ধ না ভেবে একটা সুন্দর খেলাও ভাবতে পারো। খেলাতে যেমন হার-জিত থাকে, ডজ-ড্রিবলিং থাকে, ছক্কা থাকে, আউটও থাকে, র‍্যালি থাকে, ড্রপিং থাকে, সেরকম জীবনের খেলাতেও হার-জিত থাকে। সেই হার-জিতের কথা কাল বলব। এতে তোমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে।   
(ক্রমশ)

শারদ শব্দছক – নির্মাতা সুব্রত দেব

অর্ধচন্দ্রাকৃতি : অন্য নামে দেবী, প্রথম চারে নগাধিরাজ,শেষ তিনে কন্যা

পাশাপাশি: ১) তিথি বিশেষ, এর পরেই দেবীপক্ষ শুরু ৫) অমল —- পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া
৭) দশহরা বা দশেরা উৎসব পালিত হয় শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক —--- বধ স্মরণ করে
৯) 'মহিষ', দেবীর পদতলে যা ছিন্নস্কন্ধ
১১) দেবমূর্তি,বিগ্রহ
১২) হস্ত পরিচয়ে দেবী দুর্গা
১৩) দেবীকে 'রত্নহার' প্রদানকারী কুবের, লম্বা বাঁকানো ঠোঁটের পাখি
১৪) শিব যখন কার্তিক বাহন ময়ূর
উপরনিচ : ২) ভুঁড়ো গণেশ
 ৩) দেবীর জাগরণ ক্রিয়া,উদ্বোধন 
৪) সমুদ্রজাত লক্ষ্মী   ৬) শ্রী রামচন্দ্র কর্তৃক শরৎকালীন পূজা ৮)  —-- পত্রিকা/ রাত্রি
১০) শরতের প্রতীক
১১) দেবীকে 'কমন্ডলু' প্রদানকারী ব্রহ্মা
১২) পূজার শেষ দিন

( সমাধান উৎসব সংখ্যার শেষ দিন দেওয়া হবে।)


পিউকন গ্যালাক্সি ও পলাশ 
যুগান্তর মিত্র

একটা নীল স্ক্রিনে নানা রঙের বৃষ্টিফোঁটার মতো আলোক বিন্দু ফুটে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। সেই স্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে জে-ফোর উচ্চারণ করল ‘নাইন-সেভেন-থ্রি-থ্রি-ফাইভ-সেভেন-ডট’। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিন থেকে এক টুকরো উজ্জ্বল নীল আলো বেরিয়ে মিশে গেল জে-র শরীরে। তারপর দুবার বিপ-বিপ শব্দ, আবার বৃষ্টিফোঁটা দেখা গেল স্ক্রিনে। 
আমরা এখন আছি ওয়ান-নাইন-এইট-নাইন-ডট-থ্রি অ্যারোনটিক্যাল ডিগ্রিতে। নাইন-সেভেন-থ্রি-থ্রি-ফাইভ-সেভেন-ডট অ্যারোনটিক্যাল ডিগ্রিতে আমাদের যেতে হবে। 
কেন আমরা সেখানে যাচ্ছি? 
সেসব বলতে পারব না। আমাদের সুপার পাওয়ার টি-সিক্স-ডটের নির্দেশে যাচ্ছি। তাকে কোনও প্রশ্ন করা যায় না। যেমন নির্দেশ আসে, তেমনই পৌঁছে যেতে হয়। 
এই সুপার পাওয়ার সবাইকেই নির্দেশ দেয়? 
না, সবাইকে নয়, আমাদের টিমের নাইন থাউজেন্ডস সহকারীকেই শুধু নির্দেশ দিতে পারে। 
বাকিরা কোথায়? 
আমি তাও জানি না। আমার এসব প্রশ্ন করার অধিকার নেই। 
টিম লিডার কি নিজের ইচ্ছেমতো নির্দেশ দিতে পারে? 
না, পারে না। তার ওপরে আছে আর-একজন লিডার। তার ওপর আরও একজন। এইভাবে একের পর এক লিডার থাকে। তবে এর শেষ কোথায় আমি জানি না। 
পলাশের বয়স এখন বারো বছর। ক্লাশ সিক্সে পড়ে। দিন তিনেক হল সারাদিনই তার ঘুম-ঘুম পাচ্ছে। স্কুলেও নিশ্চুপ বসে থাকে। বাড়িতে পড়ার চেষ্টা করলেও মাথায় কিছুই ঢুকছে না। গতকাল মধ্যরাতে কেন যেন আচমকা ঘুম ভেঙে গেল পলাশের। কোনও এক অদৃশ্য শক্তি তার পা যেন টেনে নিয়ে গেল দোতলার একচিলতে বারান্দায়। খানিকটা দূরে তীব্র লাল বিন্দুর মতো আলো চোখে পড়ল তার। ধীরে ধীরে বিন্দুটা তার দিকে এগিয়ে এল, আর সঙ্গে সঙ্গেই পলাশের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ গোলাকার বলের থেকে বেরিয়ে এসে একটা অদ্ভুত প্রাণী অবিকল মানুষের গলায় বলল, ‘নমস্কার মিস্টার পলাশ, আমার নাম জে-ফোর।’ 
পলাশ জুলজুল চোখে তাকিয়ে দেখল রোবটের মতো চেহারার জে-ফোরকে। ধূসর রঙের মাথায় চুলের বদলে অজস্র সাদা রেখা। ছুঁচলো মুখে কালচে দাঁত। কোটরের মধ্যে গোল গোল উজ্জ্বল সবুজ চোখ। চ্যাপ্টা নাক। দেখে ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও পলাশ ভয় পেল না। বরং প্রশ্ন করল, ‘তুমি, সরি আপনি কে?’ 
আপনি নয় মিস্টার পলাশ। আমাকে তুমি করেই বলবে। আমি জে-ফোর। পিউকন গ্যালাক্সির সিগমা নাইন-ফোর-সিক্স নক্ষত্র থেকে তোমার কাছে এসেছি। 
আমার কাছে? বিস্ময়ে পলাশের মুখ হাঁ হয়ে গেল। এইরকম কোনও নক্ষত্রের নামও সে শোনেনি আগে। 
হ্যাঁ, তোমার কাছে। আমাদের জে-সিরিজ পৃথিবীর মানুষের ওপর রিসার্চ করছে। 
জে-সিরিজ মানে কী? 
আলফাবেটিক্যাল আর নিউম্যারিক্যাল অর্ডার আমরা আগে জানতাম না। পৃথিবীর ওপর রিসার্চ করে এফ-থ্রি সিরিজ এসব শিখেছে। তাদের থেকেই আমরাও শিখেছি। তাছাড়া পৃথিবীর নয়শো উনচল্লিশটা ভাষাও আমরা শিখতে পেরেছি এফ-থ্রি সিরিজের জন্যই। এখন আমাদের রিসার্চ টিমের নাম দেওয়া হয় আলফাবেটিক্যাল বা নিউম্যারিক্যাল অর্ডারে। আমি জে-সিরিজের চার নম্বর। তোমাকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছে। অন্যান্য সিরিজও আলাদা আলাদা গ্রহ-উপগ্রহকে নিয়ে রিসার্চ করছে। 
আমাকে নিয়ে যাবে? কোথায়? 
পৃথিবীর হিসাবে বাহাত্তর ঘণ্টা এগারো মিনিট তেরো সেকেন্ড আগে সাইলেন্ট ভিজিট করে জে-থ্রি-নাইন  ছোট্ট একটা চিপ তোমার মাথার পিছনে ইঞ্জেক্ট করে দিয়েছে। এবার তোমাকে আমি নিয়ে যাব টিম লিডারের কাছে। তার নির্দেশে সেখানে চিপটা খুলে পরীক্ষানিরীক্ষা করবে আমাদের তিনজন। 
আমার মাথায়... চিপ...? কিছুই তো বুঝতে পারিনি! ভাবল পলাশ। রিসার্চ করার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল সে। 
ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাইরে থেকেই মাইক্রো সিস্টেম অ্যানালিসিসের মাধ্যমে চিপ বের করা হবে। তুমি বুঝতেই পারবে না। তোমাকে স্পর্শও করা হবে না। 
এরা কি আমাকে আর ফিরতে দেবে না? ওখানেই রেখে দেবে? 
না না। এইসব কাজের জন্য তোমাদের হিসাবে মাত্রই বারো মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ড সময় লাগবে। তারপরই তোমাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসব। 
অবাক হয় পলাশ। সে মনে মনে যা ভেবেছে, তার জবাব দিয়ে দিল জে-ফোর? 
তোমার মাথায় থাকা মাইক্রো চিপ তোমার মনের সব সংকেত আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। তাই জানতে পারছি তুমি কী ভাবছ বা কী করতে চাইছ। 
হঠাৎই পলাশ আবিষ্কার করে কখন আর কীভাবে যেন সে মহাকাশযানে ঢুকে পড়েছে। সেটা চলাচল করছে কিনা বুঝতে পারছে না। আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে ফেলে। চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ চুপ করে বসেছিল মনে নেই তার। বিচিত্র কিছু শব্দ শুনে চোখ খুলে দেখতে পেল একটা গোলাকার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তাদের মহাকাশযান। নিজে থেকেই খুলে গেল দরজা। যেন কোনও শক্তিশালী চুম্বকের টানে পলাশ সেখান থেকে বেরিয়ে বসে পড়ল একটা নরম তুলতুলে চেয়ারে। তার সামনে জে-ফোরের মতোই তিনজন বসে আছে। পাশের চেয়ারে বসে পড়ল জে-ফোর। ঘরটাতে অনেকগুলো ছোটো ছোটো যন্ত্র ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। পলাশের ভাবতে থাকল, জে-ফোর বলেছিল বারো মিনিট মতো লাগবে। কখন শুরু করবে রিসার্চ? চিপটাই বা কখন বের করবে? 
আচমকা পলাশের ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হল। তাকে কেন্দ্র করে গোলাকার বৃত্তের মতো ভয়ংকর হাওয়া যেন বয়ে চলেছে। কিছুক্ষণ পরেই সে টের পেল আবার মহাকাশযানের মধ্যে এসে বসেছে। তার পাশে বসে আছে জে-ফোর। 
একরাশ ক্লান্তি পলাশকে ঘিরে ধরল। ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল সে। গরর্ গরর্ শব্দ কানে ভেসে আসতেই এক ঝটকায় ঘুমটা ভেঙে গেল তার। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় দেখতে পেল তাদের বাগানে দুটো বেড়াল পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিচ্ছে। সে বারান্দায় টুলে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই মনে হল সে কি স্বপ্ন দেখছিল? তাহলে জে-ফোর… 
না, তুমি স্বপ্ন দেখছিলে না। সব সত্যি! 
কোথা থেকে কথা বলছে জে? সে কি থেকেই গেল আমাদের পৃথিবীতে? ভাবে পলাশ। 
আমি আমাদের পিউকন গ্যালাক্সির সিগমা নাইন-ফোর-সিক্স নক্ষত্রের মধ্যেই আছি। তোমার মাথায় আর-একটা চিপ রাখা হয়েছে। সেটার জন্যই তোমার কথা, গতিবিধি সব আমরা নজরদারি করছি। 
কেন আমার ওপর নজরদারি করছ তোমরা? বিরক্ত পলাশ চিৎকার করে ওঠে। 
পৃথিবীর মানুষের ওপর আমাদের গবেষণার কাজ চলছে। তুমি আমাদের সেই কাজে সাহায্য করছ। 
আমি চাই না তোমাদের কাজে সাহায্য করতে!  
এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। পৃথিবীর হিসাবে আর মাত্র তেরো সেকেন্ড তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে। তারপর জে-ফিফটিন তোমার দায়িত্ব নেবে। 
বিস্মিত পলাশ ঘরের চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। সব আগের মতোই আছে। ‘গুড বাই মিস্টার পলাশ’ কথাটা তার কানে ভেসে আসে। মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে পলাশের। 
ইতিমধ্যেই বাবা ঘুম থেকে উঠে অভ্যেস মতো স্নানও সেরে নিয়েছেন। আজ বাবার ছুটি। এখন চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নীচের ঘরের বারান্দায় বসবেন ঘণ্টাখানেক। তারপর বাজারে যাবেন। প্রতি রবিবার বাবার এটাই রুটিন। 
পলাশ এক ছুটে নীচের ঘরে চলে গেল। দোতলায় সে একাই ঘুমোয়। বাবাকে গিয়ে বলল, আজ বাজারে যাওয়ার দরকার নেই বাবা। একটু বাদেই তোমাকে বেরোতে হবে। ভূষণকাকু মারা গেছেন তার সংবাদ আসবে ফোনে। 
এসব কী বলছিস তুই? ভূষণ… 
হ্যাঁ বাবা। ভূষণকাকু রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন কাল রাতে। 
তুই কী করে জানলি? 
আমি সব জানি বাবা। কিন্তু কীভাবে জানতে পারছি বলতে পারব না। কে যেন আমাকে দিয়ে সব বলিয়ে নিচ্ছে। তোমার পকেটে এখন ছশো সাতান্ন টাকা আছে। তাও আমি জানি। 
পলাশের বাবা চরম বিস্ময়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন। পলাশের মাও বাবার পাশে এসে দাঁড়ান। তাঁর চোখেও অপার বিস্ময়। পলাশের কানে ভেসে আসে ‘গুডমর্নিং মিস্টার পলাশ। আমি পিউকন গ্যালাক্সির সিগমা নাইন-ফোর-সিক্স থেকে জে-ফিফটিন বলছি। এখন থেকে তুমি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’ 
‘আমরা এখন উনিশ-ডট-থ্রি-থ্রি-সিক্স অ্যারোনেটিক্যাল ডিগ্রিতে অবস্থান করছি বাবা। পৃথিবী ঘুরছে। এই ঘোরার সঙ্গে সঙ্গেই এই অবস্থানও পাল্টে যেতে থাকবে। আমি পিউকন গ্যালাক্সির সিগমা নাইন-ফোর-সিক্স নক্ষত্রের অধীনে আছি।’ 
সুধীনবাবু মাথা ধরে বসে পড়েন মেঝেতে। ছেলেটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? মোবাইল বেজে ওঠে। ‘হ্যালো সুধীন। আমি অরূপ বলছি। কাল রাতে সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের ভূষণ…’ 
সুধীনবাবুর মনে হল পৃথিবীটা কি একটু দুলে উঠল? পলাশের দিকে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। পলাশ তখন ঘোরের মধ্যে বিজাতীয় ভাষায় কীসব কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে তার ঘরের দিকে। সিগমা নাইন-ফোর-সিক্স-থ্রি-ডট-ডট-ফাইভ-নাইন-ডট...।


 বুবুন ও বাবুই পাখি

 শ্যামলী রক্ষিত

মা তুমি জোনাকি পোকা দেখেছো?
ওমা সে আবার দেখব না? কত দেখেছি। ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে  বর্ষাকালে থোকা থোকা জোনাকি পোকা উড়ে বেড়াত। ঘোর বর্ষা দিনে, ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ত যখন!  মন্টুকাকা আমাদের বড়ো দুয়ারে বসে গল্প বলত। চায়ের আসর বসত সন্ধ্যে বেলায়। আদা ভেলি গুড় দিয়ে দুধ চা বানাত মা! ছাগল দুধের চা! কি অপূর্ব যে লাগত সেই চা। ভুর ভুর করে গন্ধ ছুটত সারা বাড়ি! 
ছাগল দুধ আবার খায় নাকি মা? 
খাবে না কেন খুব খায়! তখন তো গ্রামের মানুষ ঘরে ঘরে ছাগল পুষত সবাই! কোনো ছাগল এত বেশি দুধ দিত যে বাচ্চারা খেয়ে শেষ করতে পারত না। হর হর করে দুধ গড়িয়ে পড়ে যেত ছাগলের বাঁট থেকে!
বুবুন খুব অবাক হয়ে শুনছিল মায়ের কথা! আচ্ছা ঠিক আছে তুমি জোনাকি নিয়ে গল্পটা বলো!
গল্প আর কি! তখন গ্রামের লোকের জীবনটা তো এরকমই ছিল! সেই বর্ষণ মুখরিত সন্ধ্যে বেলায় আমরা চা মুড়ি খেতে খেতে ,সবাই মিলে বড়ো দুয়ারে গোল হয়ে বসে গল্প শুনতাম! কত রকম গল্প যে জানত মন্টুকাকা। এক একটা গল্প আবার এত বড়ো  ছিল, যে একদিনে শেষ হত না। কত পর্যন্ত বলেছে কাজ, সেটা আমাদের মনে রেখে বলতে হত , না হলে সে গল্প আর বলবে না কাকা। তাই প্রাণপণে মনে রাখার চেষ্টা করতে হত  সবাইকে। কেউ না কেউ পরের দিন মন্টু কাকাকে খেই ধরিয়ে দিতে হত। তার পর থেকে আবার শুরু হত সেদিন।এইভাবে দিনের পর দিন আমাদের গল্পদাদুর আসর বসত।
গল্প দাদুর আসর কেন। তোমাদের তো গল্প বলত কাকা! তাহলে গল্পকাকার আসর বলো !     
ধুস তাই  হয় নাকি?
কেন হয় না কেন ? কাকাই তো গল্প বলত মা । তাহলে গল্পদাদুর হতে যাবে কোন দুঃখে ।
মৌ এবার চুপ করে গেল । বুবুনের কথার যুক্তি আছে। কিন্তু গল্পদাদুর আসর একটা আলাদা ব্যাপার। সেখানে গল্পকাকার আসর কেমন যেন শুনতে লাগছে। 
কী হলো মা?
তোর কথাটাই ভাবছি বুবুন। তুই হয়ত ঠিকই বলেছিস, কিন্তু সব কিছু ঠিক আক্ষরিক অর্থ দিয়ে ব্যক্ত করা যায় না বাবা!
তার পর বলো না কী করতে।
বলছি বাবা, সবুর কর। দুধটা নামিয়ে আসি। দুধ নামিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে বসল মৌ, বুবুনের মুখোমুখি। বুবুন তখনও  চাউ খেয়ে যাচ্ছে। খেতে বড্ড দেরি করে ছেলেটা। কত কাজ আছে এখনো। একটু তো তাড়াতাড়ি খেতে মাখতে শিখতে হবে। কি করে যে কী করবে ছেলেটা কে জানে!  ভেতরে ভেতরে বুবুনের জন্যে খুব টেনশন হয় মৌয়ের। রেগে যেতে গিয়েও সামলে নিল নিজেকে। বলল বুবুন তাড়াতাড়ি করো। ওই টুকু খেতে কত সময় লাগে বাবা। তোমার এখনো কত পড়া বাকি বলো তো।
বুবুন আতঙ্কিত হলো। এখুনি মা যদি রেগে যায়, মুড অফ হবে।আবার সেই বকাবকি। চেঁচামেছি। সমস্ত ভালো লাগাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সে তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, তুমি গল্পটা শেষ করো আমি পড়া করে নিচ্ছি। 
ঠিক আছে শোন, তখন গ্রামের দিকের বর্ষা মানে একেবারে অন্যরকম অনুভূতি বুঝলি। চারি দিকে গাঢ় অন্ধকার। সন্ধ্যের পর থেকে রাস্তায় লোক জন থাকত না। যে যার বাড়িতেই বসে থাকত। আর মালির পারের আমবাগানে থোকা থোকা জোনাকি যেন তোদের এই টুনি বাল্পের মত  জ্বলত নিভত। তারাভরা আকাশটাই যেন, নেমে আসত ওই মালির বাগানের  আমগাছের মাথায়। অদ্ভূত সুন্দর লাগত  দেখতে জানিস। এক এক দিন আবার একটা আধটা দলছুট জোনাকি পোকা উড়ে আসত,  আমাদের গল্পের আসরে। তখন হৈ হৈ পড়ে যেত আমাদের মধ্যে। কে ধরতে পারে সেই জোনাকি পোকাকে। তারপর তাকে কাচের  শিশির মধ্যে  ঢুকিয়ে রাখা হত।
বুবুন খুব মজা পাচ্ছে, মায়ের এই ছোটবেলার গল্প শুনতে। এখন এই মুহূর্তে ছোট বেলার গল্প বলতে  বলতে মাও কেমন বদলে গেছে যেন। সেই রাগী, বড় বড় চোখ করা অদ্ভুত ভয়ংকর মানুষটা কোন জাদু বলে একটা ছোট্ট পুট পুটে  বাচ্চা শিশু হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।  মায়ের সারা মুখে একটা অদ্ভুত খুশির আবেশ লেগে আছে। আস্তে আস্তে বুবুন বুঝতে শিখেছে, মায়ের ছোটবেলাটা খুব আনন্দদায়ক ছিল। লেখাপড়ার এত চাপ ছিল না। এখানে সেখানে  ঘুরে বেড়ানো ছিল ,গল্প করা ছিল, ডাংগুলি খেলা, মার্বেল খেলা,আর ছিল গাছের ডালে  দোলনা দোলা দুপুর। মা এসব বলতে বলতে ভেতরে ভেতরে কী খুশি যে হয়। অথচ তার জন্য কেন যে  বরাদ্দ হলো না সে সব। সব সময় কেবল বুবুন পড়তে বসো, বুবুন তোমার হোমটাস্ক বাকি আছে। কাল তোমার ক্লাস টেস্ট। এমন বলতে থাকে, যেন পড়া শোনা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই জীবনে? অথচ  নিজের শৈশবের কথা বলতে গেলে বেলুনের মতো হালকা হয়ে যেন নীল দিগন্তে উড়ে বেড়াতে থাকে তার মা। কেন যে  তার জন্য এতোটুকু ছাড় নেই। তার ভাল লাগেনা এত চাপ।      

      পড়াশোনা নিয়ে সব সময় এই শাসন,  মারপিট,  দাঙ্গা হাঙ্গামা এসব তার  একদম পছন্দ নয়। ভালো  লাগে না এই পড়া পড়া আর পড়া। সারা দিন গাধার মত ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুল যাওয়া, টিউশন যাওয়া বাড়িতে এসে পড়তে বসা। প্রতিটা  দিন এভাবে কারুর ভালো লাগে? সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে পালাতে ইচ্ছা করে তার! আর যখনই পালাবার কথা মনে হয়, তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই পাহাড়ি নির্জন নিসঙ্গ গ্রামটার কথা। উত্তরাখণ্ডের সেই সুন্দর শিশুর মত ফুট ফুটে সারিগ্রাম। দুদিকে উঁচু পর্বত। মাঝ খানে গভীর গিরিখাত।ঝুন ঝুন করে কী যেন একটা নদী বয়ে  গেছে। তারই গা বেয়ে উপত্যকা ঘিরে ছোট ছোট কাঠের ঘর। রাত্রি বেলায়  চারিদিকে যখন গভীর অন্ধকার নেমে আসত। আকাশে উজ্জ্বল বড় বড় তারাগুলো যেন জেগে থেকে পাহারা দিত সেই গ্রামকে। বহু দূর দূরান্ত থেকে ছেলে মেয়েরা পড়তে আসে, সেই গ্রামের জুনিয়ার হই স্কুলে। কি সুন্দর মুখভর হাসি তাদের! ওদের পড়াশোনার কোনো চাপ নেই। মারা বকাও খেতে হয় না। আর সব চেয়ে  বড় কথা, ওদের জন্যে ওদের বাবা মায়ের কোনো ঝামেলাও হয় না কোনোদিন।
কি হলো রে, বুবুন? এমন ভাবে হাঁ করে বসে  আছিস যে।
বুবুন তাড়াতাড়ি বলল, আচ্ছা মা তোমাদের সেই মালির বাগানটা  অমন ফাঁকা হয়ে গেলে কি করে? এখন তো ওখানে একটাও গাছ নেই আর। কেবল বাড়ি আর বাড়ি। পুকুরটার চারিদিকে  কোনো গাছই তো নেই! ঈশান কোণে একটা শুধু বেল গাছ  আছে। আর কিচ্ছু নেই। এরকম হল কেন?
সাধে কী আর হয়েছে বাবা? যাদের গাছ তারা সারা বছর কিচ্ছু পেত না। অত গুলো আম গাছ!  এক ঝুড়ি আমও বাড়ি নিয়ে যেতে পারত না  কোনোদিন। সমস্ত গাছের আম উজাড় করে পেরে নিত। আম  বড় হবার আগেই সব গাছ ফাঁকা। দুটো নারকেল গাছ আছে। তার  থেকেও একটা নারকেল কোনো দিন তারা পেত না। পুকুরে মাছ চাষ করে , কোনোদিন মাছ ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে পারত না তারা। তার আগেই গ্রামের লোক চুরি করে সব খেয়ে নিত। এত অত্যাচার সইবে কেন?  তাই রাগ করে ভাইয়ে ভাইয়ে যুক্তি করে সব দিলে বিক্রি করে। গাছ কেটে বিক্রি করে দিল,  পুকুর বিক্রি করে দিল, পুকুরের পাড় বিক্রি করে দিল। এখন মালিরবাগান নামেই মালির বাগান। কিচ্ছু অবশিষ্ঠ নেই আর।
ও বাগানে মালি থাকত নাকি মা? 
হ্যাঁ থাকত তো। আম হলে একজন মালি  কুঁড়েঘর তৈরি  করে থাকত।  কিন্তু মালিকে মানতো না কেউ। সবাই মিলে কী জ্বালানো জ্বালাতো তাকে। টিকি বাঁধা উড়ে বলে উদ্ব্যাস্ত করত। সে বেচারা মারধর, গালাগালি খেয়েও  পড়ে থাকত। তবু গাছে একটা আম থাকত না। সাধে কী আর নেড়া করে ফেলেছে বাগানটা?
তাই বলে গাছ বিক্রি করে দেবে  মা?
হ্যাঁ দেবে!
তাহলে যে গাছ বাঁচাও, সবুজ ফিরাও, সুস্থ থাকো, সুন্দর হও এইসব পরিবেশ রক্ষার জন্য কত কিছু আন্দোলন হচ্ছে তার কি হবে?
তার আর কী হবে? যারা জীবনকে নিয়ে পৃথিবীকে  নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবে ,তারা এসব ভাববে। ওদের এসব ভেবে কোন কাজ নেই। ওরা জানে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। কাজেই এসব নিয়ে ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
বুবুন আবার চুপচাপ হয়ে গেল। গতকাল তার জিওগ্রাফি ক্লাসে  এস এম ম্যাম গ্লোবালাইজেশন  পড়াচ্ছিলেন। পৃথিবী একদিন এইভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে । বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রের জলতল  নেমে যাচ্ছে হুহু করে। বেড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণায়ন। এভাবে বেশিদিন পৃথিবী কে টিকিয়ে রাখা যাবে না। মানুষ যদি এখন থেকে সচেতন না হয়, তাহলে অচিরেই মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপরে বুবুনের খুব মন খারাপ হয়ে গেছিলো। এত সুন্দর পৃথিবীটা, এত মানুষ এত সম্পদ এই সভ্যতা বিজ্ঞানের এই চরম উন্নতি এসব যদি ধ্বংস হয়ে যায়, কি হবে তাহলে! সে এই নিয়ে বসে বসে অনেক ভেবেছে! কিছু কি করা যায়?  পৃথিবীতে এত বড় বড় বিজ্ঞানী আছেন তারা কি কোন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেন না?  সত্যিই ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু! এই প্রশ্ন বুবুনকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে  যেন। কেমন একটা বিষন্ন ভাব মনের মধ্যে তার ঘনীভূত হচ্ছে তার। বুবুন মনে মনে ঠিক করে নিজেকেও এবার থেকে সচেতন হতে হবে। তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সে আগে ততটুকুই করবে, তারপর বড় হলে ভাববে কি করা যেতে পারে! 
কিরে আবার ভ্যাবলার মত  বসে আছিস যে। পড়তে বস গে  যা। কালকে তোর ক্লাস টেস্ট আছে না সাইন্সের। ফেল করবি যে। এরকম পড়াশোনা করলে কেউ পাস করতে পারে না বাবা। ভালো রেজাল্ট করা তো চুলোয় যাক। 
তোমার চিন্তা নেই মা, দেখো আমি ঠিক ভালো রেজাল্টই  করব। তুমি এখন সেই গল্পটা শেষ করো? এ গল্পের শেষ  আছে নাকি?
ওই যে জোনাকি পোকাটাকে  কাঁচের শিশির মধ্যে নিয়ে,  তারপর কী করতে বলবে তো।  
অন্ধকার রাত্রে যখন ঘুমোতাম , তখন মাথায়  কাছে  রেখে শুয়ে পড়তাম। গোটা ঘরে একটা আলোর আভা ফুটে  উঠত। 
ও মাই গড! একবারে বাবুই পাখির মত, তো।
কেন,বাবুই পাখি আবার কি করল? তুমি জানো না , বাবুই পাখিরা জোনাকি পোকা ধরে এনে বাসার মধ্যে গোবর রেখে তার উপরে আটকে রাখে। তাদের অন্ধকার বাসায় আলো হয়।
ওমা তাই নাকি! বাঃ খুব সুন্দর তো।
হ্যাঁ ওটা পড়তে পড়তেই তো তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম। জানতে চাইলাম জোনাকি পোকা তুমি দেখেছ কি না? 
তাই নাকি? তাহলে দেখছিস একটা অতটুকু পাখি তারও কত বুদ্ধি!  তার বাসার মধ্যে আলো ঢোকে না। আলোকিত করার জন্য জোনাকি পোকা ধরে নিয়ে গিয়ে গোবরের উপর রেখে দিচ্ছে। আর আমরা মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাণি, কত কিছু করতে পারি বলত?
হ্যাঁ পারিত মা। অনেক কিছু করতে পারি। বিশ্বজগতের এত কিছু তো মানুষই করছে।
আমি বিশ্বজগৎ জানিনা বাবা , আমি  তোর কথা বলছি , তুই কি করছিস বল তো? 
কেন  আমি  তো সবই করছি মা। একজন  কুলির মতো ভারী ব্যাগ পিঠে নিয়ে, সারাদিন দৌড়ে বেড়াচ্ছি। টিউশন, ছবি আঁকা, সুইমিং যাওয়া, আবৃত্তি শেখা কতকিছু! সারাদিনে এতো টুকু সময় নেই , যেটা নিজের ভাললাগার মত করে কাটাতে পারি। তুমি আমাকে  বাবুই পাখির কথা বলছিলে না মা? আমাকে ওরকম করে বাঁচতে দাও না মা প্লিজ। প্রত্যেকটা দিন ঘুম থেকে উঠে রাত্রি পর্যন্ত আমি আমার মতো করে বাঁচবো। তোমাদের কারোর কথায় উঠব বসব না। যেমন এই বাবুই পাখিটা, নিজের ইচ্ছামত সারাদিন নীল আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়। খিদে পেলে গাছের ডালে বসে খেয়ে নেয়। আবার উড়তে  থাকে। উড়তে উড়তে সে, এই অন্ধকার কে আলোকিত করতে শিখেছে। আর আমরা মানে আমি সব দেখি তোমাদের চোখে, সব ভাবি তোমাদের ভাবনায়। আমার উপর তো তোমাদের কোনো আশা 
ভরসাই নেই। সত্যি করে  বলো তো মা, তুমি আমাকে ওই বাবুই পাখি আর জোনাকি পোকার মতো নিজের খুশিতে বাঁচতে দেবে? 
মৌ একবারে স্তব্দ হয়ে গেল। এই প্রশ্নের উত্তর তো  তার জানা নেই। বুবুনের কষ্ট, বুবুনের অনুভব তাকে ভাবায়, কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। বিশ্ব চরাচর ইদুর দৌড় করছে। সে কী করে কোন ভরসায় থেমে যেতে দেবে বুবুনকে। দলছুট বুবুনকে নিয়ে সে কী ভাবে চলবে? সে রাস্তা তো তার জানা নেই। তাই বুবুনকেও এই ইদুর দৌড়ের সামিল হতে হবে । এটাই  ভবিতব্য। এছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই তার   - - - -


পদধ্বনি

অদ্রিজা সাঁতরা

শরৎ মানে বর্ষা শেষে
শিশির ধোওয়া সোঁদা মাটি
ভোরের আলোয়, নরম ঘাসে
শিউলি ফুলের শীতলপাটি।

শরৎ আসে সঙ্গে নিয়ে
উদাস করা বাঁশির সুর--
খুশির খেয়ায় ভাসিয়ে আমায় 
যায় নিয়ে কোন অচিনপুর।

বুকের মাঝে উমা মায়ের
বাজছে যেন আগমনী
মেঘমুলুকে আকাশ জুড়ে
ঐ শুনি তাঁর পদধ্বনি।

মা আসবেন, তাই তো এমন
খুশির নেশা হাওয়ায় ভাসে
উৎসবে আজ মাতল সবাই
দুঃখ ভুলে সবাই হাসে।

মা গো, তুমি শক্তিরূপা
নাশ করো সব অসুর যত
তোমার ছোঁওয়ায় উঠুক সেরে
এই পৃথিবীর সকল ক্ষত।

স্নিগ্ধ-শ্যামল প্রকৃতি ঐ
সাজায় মায়ের অর্ঘ্যডালি
মুছিয়ে আঁধার এসো রে আজ
মায়ের পূজার প্রদীপ জ্বালি।


ধারাবাহিক উপন্যাস

শয়তানের উঁকি
তপশ্রী পাল


বিকেলে ঐশিকা ফোন করলো প্রোটনকে। ঐশিকা বিশাখার খুব বন্ধু! দুজনে সবসময় এক বেঞ্চে বসতো, টিফিন ভাগ করে খেতো। ঐশিকা অবশ্য বিশাখার মতো চুপচাপ না। ও সবার সঙ্গেই প্রচুর কথা বলে। প্রোটনের সঙ্গেও বকবক করে পারলেই। ঐশিকার গলা আজ খুব ম্রিয়মান। বললো “জানিস প্রোটন, বিশাখার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি! ওদের বাড়ি কাল পুলিশ এসেছিলো! ও আর আমি পুজোয় একসাথে বেরোবো ঠিক করেছিলাম! ওর মা ফোনেই কান্নাকাটি করছিলেন, আমার মায়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে – কোথায় যেতে পারে বলতো? 
কিডন্যাপিং নয় তো?
সে কী রে?
টাকার জন্য ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে হয়তো কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। এবার ওদের ফোন করবে! ওর বাবা টাকা দিলে তবে ছেড়ে দেবে ওকে।    
কিন্তু – যতদূর জানি ও তো প্রায় পাঁচদিন হলো মিসিং – ওদের বাড়ি কেউ ফোন করেনি তো! 
করেও থাকতে পারে – এ সব কেউ বাইরে জানায় না। পুলিশকেও জানানো মানা। তাহলে কিডন্যাপাররা ওকে মেরে ফেলতে পারে! চুপিচুপি আঙ্কল হয়তো টাকা দিয়ে আসবে! তবে অনেক টাকা চায় ওরা! 
তুই এতো জানলি কী করে রে?
বা রে, আমি তো ডিটেকটিভ গল্প গুলে খেয়েছি! ইংরেজী বাংলা সব! 
তাহলে তো খুব ভয়ের কথা রে! 
দেখ ওয়েট করে, যদি কাল পরশুর মধ্যে ফিরে আসে – সাধারণতঃ কিডন্যাপাররা বেশীদিন রাখে না। হয় মেরে ফেলে নয় ফিরিয়ে দেয় টাকা পেলে। আচ্ছা তুই বিশাখাদের ফোন নম্বরটা একবার বল তো। মাকে বলবো একবার ওর মায়ের সাথে কথা বলতে।
দাঁড়া বলছি। এই নে।
বিশাখাদের বাড়ির ফোন নম্বরটা নিয়ে নিলো প্রোটন!  
সন্ধেবেলা মনটা একদম ভালো লাগছিলো না প্রোটনের। শত হলেও ওরই ক্লাসের বন্ধু বিশাখা। মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো প্রোটন। মা এই সময় রান্নাঘরে বিকেলের জলখাবার বানান। দূর থেকে কচুরি ভাজার গন্ধ পেলো প্রোটন! আঃ গরম গরম কড়াইশুটির কচুরি আর আলুর দম খুব প্রিয় প্রোটনের! মায়ের গায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মা বললেন “দেখ তো একটা খেয়ে কেমন হয়েছে!” কচুরিতে কামড় দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো প্রোটন। মা বললেন “কী রে? কী হলো? কেমন হয়েছে বললি না তো!” “খুব ভালো! কিন্তু মা –“ “কিছু বলবি? কদিন ধরেই দেখছি কী সব ভেবে চলেছিস! বিশাখার কী খবর রে? কিছু জানা গেলো?” “নাঃ, আজ ঐশিকা ফোন করেছিলো। ওর মা খুব কান্নাকাটি করছেন! ওকে মনে হয় কেউ কিডন্যাপ করেছে মা! তুমি একবার আজ ফোন করবে ওর মা কে? জিজ্ঞাসা করবে কোন অচেনা লোক ওদের ফোন করেছিলো কি না?” “আমাকে তো ওরা চেনেই না! তবু তুই যখন বলছিস – একবার নাহয় ফোন করে খবর নেবো। দিস ফোন নম্বরটা!” মা কে ফোন নম্বর দিলো প্রোটন। রাতে খাওয়ার সময় মা বেশ গম্ভীর হয়ে ছিলেন। প্রোটন বললো “ফোন করেছিলে মা?” “হুম, ওর মা তো কথাই বলতে পারছেন না। শুধু কাঁদছেন! ওদের বাড়িতে কেউ ফোন করেনি। পুলিশও কোন খবর দিতে পারেনি এখনো! কী যে হলো মেয়েটার! পুলিশ ওদের কাজের মাসীকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে গেছে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে।“
প্রোটনের চিন্তা আরো বেড়ে গেলো! তবে কি যা ভাবছে ও তা নয়? ম্যামকে একবার বলতেই হবে অনলাইন ক্লাসের কথাটা! মনটা খুঁতখুঁত করছে! রাত প্রায় সাড়ে দশটা! এখন ম্যামকে ফোন করবে? কিন্তু সময় চলে যাচ্ছে! মেয়েটা কোথায় আছে কীভাবে আছে কে জানে? সাত পাঁচ ভেবে অধরা ম্যামকে ফোন করে বসলো প্রোটন “ম্যাম, আই অ্যাম ডিসটার্বিং ইউ অ্যাট দিস আওয়ার!” “হু ইস দিস?” “আই অ্যাম আরাত্রিক ম্যাম। আই হ্যাভ সামথিং টু টেল অ্যাবাউট বিশাখা!” “ওকে, প্লিস টেল” “ম্যাম, যেদিন ও মিসিং হলো, তার কয়েকদিন আগে, অনলাইন ক্লাসে একটা ব্যাপার হয়েছিলো ম্যাম! আমি দুটো উইনডোতে বিশাখাকে দেখেছিলাম। একই নামে লগ-ইন! ম্যাম একটা থেকে ও প্রেসেন্স দিয়েছিলো, কিন্তু অন্যটার ভিডিও অফই ছিলো! আমি বুঝতে পারিনি কী করে এটা হলো! “হোয়াট! হোয়াই ডিড ইউ নট টেল বিফোর! বাট আমার মনে হচ্ছে তুমি ভুল দেখেছো। একজন তো দুবার লগ-ইন করতে পারবে না! আর শুধু যাদের লিঙ্ক দেওয়া আছে, যারা পাসওয়ার্ড জানে তারাই লগ-ইন করতে পারে স্কুলের জুম কলে!” “না ম্যাম, আমি ভুল দেখিনি! আমি চেক করেছিলাম!” “জানি না কোন সফটওয়ার এরর কি না। আই উইল গেট ইট চেকড। কিন্তু সেটা ছুটির পর ছাড়া তো হবে না। এখন সব বন্ধ। কিন্তু তার সঙ্গে বিশাখার মিসিং হওয়ার কী যোগ আছে?” “সেটাই তো বুঝতে পারছি না ম্যাম।“ “ঠিক আছে, আর কিছু জানতে পারলে বোলো আমাকে। কিচ্ছু লুকিয়ে রাখবে না! এখন গুড নাইট।“
ফোনটা রেখে দেয় প্রোটন। যা ভেবেছিলো, ম্যাম বিশ্বাসই করছেন না যে ও সত্যিই দেখেছে! নাঃ এখন একমাত্র ভরসা দাদা। কাল কাকারা আসছে! 
পঞ্চমীর দিন ভোরবেলার ফ্লাইটে এসেছে কাকারা আর সঙ্গে নিউট্রন দাদা! ভোরবেলা পাঁচটার সময় উঠে বাবার সঙ্গে এয়ারপোর্ট গেলো প্রোটন। হইহই করে বাড়ি ফিরলো সবাই। নিউট্রন দাদা কতোটা লম্বা হয়ে গেছে! প্রোটনের মাথার ওপর প্রায় ছ ইঞ্চি! প্রোটনের জন্য কী সুন্দর একটা রোবোটিক কিট নিয়ে এসেছে দাদা! নানারকম ছোট ছোট রোবট বানানো যাবে এগুলো দিয়ে! এগুলো ঠিক করে আসেমবল করতে হবে, প্রোগ্রাম করতে হবে। সে সব শিখিয়ে দেবে দাদা! প্রোটনের তো খুশী ধরে না!। 
এদিকে রাত্রে পাড়ায় ঠাকুর এসে গেলো। বাবারা সবাই গেছিলেন ঠাকুর আনতে! রাত্তির থেকে প্যান্ডেলে মাইক লেগে গেছে! উত্তেজনায় সারা রাত ঘুম হলো না প্রোটনের। আজ ষষ্ঠী! সকাল থেকে নতুন জামা পরা শুরু! 
কিন্তু সকাল হতেই একটা ফোন এলো যেটা প্রোটন মনটা একেবারে খারাপ করে দিলো। শুধু তাই না, এবার বেশ ভয় ভয় করতে লাগলো ওর! ফোনটা ছিলো ঐশিকার! ওর ফোনে নাকি একটা মেসেজ এসেছে অজানা নম্বর থেকে! ঐশিকার ধারণা মেসেজটা বিশাখাই কোনভাবে তাড়াহুড়ো করে লুকিয়ে কারো মোবাইল থেকে করেছে! তাতে লেখা আছে “আমাকে বাঁচা! সময় নেই!” মেসেজটা অসম্পূর্ণ! মনে হয় লিখতে লিখতে কেউ এসে গেছে বা ফোনটা হাত থেকে চলে গেছে। ঐ নম্বর নাকি তারপর থেকে অফ। কোনভাবেই আর কোন যোগাযোগ করতে পারেনি ঐশিকা! বিশাখার মা বাবাকে বলেছিলো। তাঁরা বলছেন ওই মেসেজ যে বিশাখার তার প্রমাণ কী? বিশাখা হলে তো মা বাবাকেই আগে মেসেজ করতো! সে কথাও ঠিক! হাতে একেবারে সময় নেই! অনেকগুলো দিন পেরিয়ে গেছে। প্রোটন ঠিক করলো দাদাকে প্রথম থেকে সব আজই খুলে বলবে।
বাইরে ষষ্ঠীর ঢাক বাজছে। দাদা কিন্তু ল্যাপটপ খুলে কী করে চলেছে খুটখুট করে। বাবা আর কাকা প্যান্ডেলে। মা আর কাকিমা রান্নাঘরে ব্যস্ত। লুকিয়ে কিছু বলতে হলে এই সময়। প্রোটন ঘরে ঢুকে বললো
“দাদা, বেরোবি না?”
“দাঁড়া একটা নতুন অ্যাপ লেখার চেষ্টা করছি। এই প্রোগ্রামটা শেষ করে নিই – বিকেলে বেরোলেই হবে এখন!”
“শোন না, দাদা, তোর সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিলো”
নিউট্রন অবাক হয়ে মাথা তুলে বললো “বল”
প্রোটন সংক্ষেপে গোটা ব্যাপারটা বললো দাদাকে, অনলাইন ক্লাসে দুটো বিশাখার কথাটাও বাদ দিলো না। শুনে দাদা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বললো “বলিস কী! ওটা দুটো বিশাখা নয়, কেউ বিশাখার আই ডি দিয়ে স্কুলের জুম মিটিং এ ঢুকেছিলো! এটা এক ধরণের হ্যাকিং! যে করেছে সে জুম নিয়ে পড়াশোনা করেই ঢুকেছে! জুম কলে একসঙ্গে তিনটে ডিভাইস থেকে একই আই ডি দিয়ে ঢোকা যায়, তবে তিনটে তিনরকম ডিভাইস হতে হবে। একটা মোবাইল হলে, অন্য দুটো ট্যাব আর কম্পিউটার হতে হবে! একইরকম দুটো ডিভাইস থেকে এক আই ডি দিয়ে ঢুকলে অটোম্যাটিকালি প্রথম যে লগ-ইন করেছে সে লগ-আউট হয়ে যাবে! 
“কিন্তু দাদা, আমাদের ক্লাস এইটের অনলাইন ক্লাসে কেউ শুধু শুধু ঢুকবে কেন আর সে বিশাখার লগ-ইন আই-ডি, পাসওয়ার্ড পেলোই বা কী করে? স্কুল তো শুধু আমাদেরই ওগুলো শেয়ার করেছিলো, তাও হোয়াটস-অ্যাপে!”
“ওখানেই তো হ্যাকারদের কৃতিত্ব! আমার মনে হয় ওর ফোনটা হ্যাক করা হয়।“
“ওটা তো ওর মায়ের ফোন ছিলো!”
“তাহলে সেটাই হ্যাক হয়েছে!”
“কেউ ওটার নম্বর জানলো কী করে?”
“হ্যাক করতে হলে নম্বর জানার দরকার হয় না। সোশ্যাল সাইট থেকেই প্রোফাইলে ঢুকে হ্যাক করা হয়। তারপর সেখান থেকে অন্য সব ইনফো, যেমন নম্বর বার করে নেওয়া যায়। নিশ্চই ওর মায়ের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই হ্যাকিং হয়েছে!”
“সে কী রে দাদা! কিন্তু বিশাখাকে কেউ কেন টারগেট করবে?”
“সেটা তো ইনভেস্টিগেট করতে হবে!” বেশ ডিটেকটিভের মতো গলা করে বললো দাদা। তারপর মুখটা আরো গম্ভীর করে বললো “তুই তো বলছিস প্রায় সাত দিন হয়ে গেছে ও মিসিং, অথচ কোন কল আসেনি এখনো! তার মানে টাকার জন্য কিডন্যাপিং নয়! তাহলে কেন? উহু হাতে আর একদম সময় নেই! জানি না পুলিশ আর ওর বাড়ির লোক কী করছে! ওর কিন্তু খুব বিপদ মনে হচ্ছে!”
(ক্রমশ)

এই শরতে 
সুব্রত দেব

মেঘের দল গেছে ফিরে-
    বাদল আর নাই।
 নীল আকাশে রূপোলি রোদ,
      আলোর রোশনাই।
কাশ ফুল আজ দোদুল দুল,
    পদ্ম, দিঘির জলে।
ফুল কুড়োয় ঐ পল্লীবালা
     আজকে শিউলি তলে। 
   কুমোরপাড়ায় ঠাকুর গড়ে,
         দূরে চণ্ডীপাঠ।
   স্কুল আপিসে ছুটির ঘন্টা
       - মনে খুশির হাট !
ঢ্যাং কুরকুর ঢ্যাং কুরকুর
     -বাদ্যি বাজে দূরে,
   দুগ্গা মা আসছে যে ফের
         আগমনী সুরে।

   প্রশ্ন - উত্তর - সুব্রত দেব 

বল তো মা তুই দেখি
    – শক্তি বেশি কার-
  মহিষাসুর না মা দুর্গার?

 বাছা, -এ কেমন প্রশ্ন তোর 
        মা দুর্গার কাছে অসুর
      নিতান্ত কম জোর।

-অসুরের লাফালাফি, আস্ফালনই
        সার, ওর সাথে কী  হয়
     তুলনা মা দুর্গার।

-অতই যদি শক্তি তবে মা
      লড়ে কেন দশ হাতে 
        অসুরের সাথে?

অসম যুদ্ধে জিতে কিনা
         বীর হল দুর্গা মা!
   কী করে হয় তা?

– বাছা তুই বলছিস যা 
      হয়তো তা ঠিক
 আসলে (দুর্গা) মা এক প্রতীক।

-  দশ হাতে দশ অস্ত্রে মা-
    করেন দুষ্ট দমন
  তাই তো এই অকালবোধন


আলো

বন্দনা সেনগুপ্ত

"ধপ্"

আওয়াজের সাথে মাথায় একটা ঠোকা খেয়ে জেগে উঠল ভুতু। ডালের উপর হাত পা ছেড়ে দিয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছিলো, হটাৎ পড়ে গিয়ে জেগে উঠে কিছু বোঝার আগেই খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়লো শাঁকচুন্নি দিদি। ওফফ্! দিদিটা একটু ঘুমোতেও দেয় না।

ভুতু সদ্য সদ্য এসেছে এই ভূত পাড়ায়। এখনো গা থেকে মানুষ মানুষ গন্ধ যায় নি। বড্ড মিস করে সে নিজের বাড়িটাকে, বিশেষ করে মাকে। মরার মোটেই ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে কি যে খেয়েছিলো, আর বাঁচতেই পারলো না। 

ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে এদিকে আসার পর এই শাঁকচুন্নি দিদিই তাকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছিল। থাকার জায়গা করে দিয়েছিলো শ্যাওড়া গাছের একটা নিচু ডালে, ভুতুর যে বড্ড পড়ে যাওয়ার ভয়! এই মোটা ডালে সে উপুড় হয়ে শুয়ে হাত পা দিয়ে ডাল জড়িয়ে থাকে। ঘুমের ঘোরে বাঁধন খুলে গেলেও ও আর পড়ে যায় না। তা ছাড়া ভূত সমাজের নিয়ম কানুনও তো ওই শিখিয়েছে। এখনও তো সেই জন্যেই ডাকতে আসা। সন্ধ্যে ঘন হয়ে এসেছে। ব্রহ্মদত্যি দাদু এসে যদি দেখে এখনো ঘুমোচ্ছে, তাহলে আর রক্ষা রাখবে না! তাঁর কড়া নিয়মে শুধু রাতটুকুই ওদের চরা করার সময়। সকাল হতে না হতেই ফিরে আসতে হয়।

এখন ওদের খেলার সময়। খেতে পারে না বলে ওদের দুজনেরই কষ্ট হয়। হাবি জাবি খেয়েই তো ওরা দুজনে এখানে এসেছে, কিন্তু লোভ যায় নি এখনো। গাঁয়ের ঘরে ঘরে ছুঁক ছুঁক করে বেড়ায় শাঁকচুন্নি। আর, সেই ফাঁকে ভুতু চলে যায় নিজের বাড়ি। ওর মা এখনও ভুতুর মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি। কান্না কাটি লেগেই থাকে। ভুতু গিয়ে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে। দেখতে না পেলেও, স্পর্শ করতে না পারলেও, সেই সময়টুকু কিন্তু ওর মাও শান্ত হয়ে থাকেন।

এই ভাবে ব্রহ্মদত্যি দাদুর নিয়ম শৃংখলায় ভূতে মানুষে দিব্যি কাল কাটাচ্ছিল, বাদ সাধল বেপাড়ার কিছু ভূত। তারা মস্তি করতে ভালোবাসে, যেটা কিনা মানুষের ভাষায় "ভূতের উপদ্রব"। কিছুদিন সহ্য করে তারা নিয়ে এলো চামুন্ডি বাবাকে। সে বেশ জ্ঞানী আর ক্ষমতাশালী সাধু। তার পুজো আর যজ্ঞের ঠেলায় শুধু দুষ্টু ভূতগুলিই নয়, পুরো ভূত পাড়াকে দেশান্তরী হতে হলো।

কিছুকাল তো কেটে গেল নতুন একটা থাকার জায়গা বেছে বার করতে। আগের ভূত পাড়ার সবাই এক জায়গায় পৌঁছতে পারে নি। ভাগ্যি ভালো যে শাঁকচুন্নি দিদি আর ভুতুর ছাড়াছাড়ি হয় নি! দিদি তো হারিয়ে ফেলার ভয়ে ভাইকে কোলে নিয়ে ছুট দিয়েছিলো, তাই দুজনে এক সাথেই আছে। একটা থাকার জায়গাও পেয়েছে। কিন্তু, এটা যে কোন জায়গা, আগের জায়গা থেকে কত দূরে, তা ওরা কিছুই বুঝতে পারে না। অবশ্য ভুতু ছাড়া আর কারুর বোঝার অত গরজও তো নেই! ভুতুর আর যাওয়া হয় না মার কাছে। ওর কষ্ট হয়, কান্না পায়।

যাই হোক দিন তো কেটে যেতে থাকে। কিন্তু, কিছু দিন বাদে শাঁকচুন্নি দিদি বলে ও একটা সাদা আলো দেখতে পাচ্ছে। ভুতু কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। দিন দিন আলোটা তীব্র হতে থাকে। আর, শাঁকচুন্নির মনে হয় আলোটা যেন তাকে টানছে, কেমন যেন একটা আকর্ষণ বোধ করে সে। কিছু বুঝতে না পেরে তারা ব্রহ্মদত্যি দাদুর কাছে যায়। বলে সব। শুনে দাদু হাসেন। বুঝিয়ে দেন, "ওরে দিদি, তোর যে আবার জন্ম নেবার সময় এসে গেছে। একদিন ওই আলোই তোকে টেনে নেবে নতুন জন্মের দিকে। খুব খুশি হলাম দিদি। যা। নতুন জন্ম নিয়ে খুব ভালো থাকিস। আমার আশীর্বাদ রইলো তোর সাথে"। শাঁকচুন্নি আনন্দে আর ভয়ে থাকে, কিন্তু ভুতুর জন্য থাকে শুধুই কান্না! মাকে ছেড়ে এসে এই দিদিকে পেয়েছিলো আর এখন তো ওর কাছে কেউই থাকবে না। 

এক দিন সেই তীব্র আলোর মধ্যে শাঁকচুন্নি হারিয়ে যায়, তাকে আর দেখা যায় না। 

ভুতু কিছুদিন একা একা খুব মনমরা হয়ে কাটায়। তার পর সে একা একাই ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করে। উদ্দেশ্য, যদি মাকে খুঁজে পাওয়া যায়।

কথায় বলে, খুঁজলে ভগবান মেলে। আর, মা খুঁজে পাওয়া যাবে না!

অনেক ঘুরে ঘুরে ভুতু কিছু কিছু পরিচিত জায়গা খুঁজে পেল। পুকুর, যেখানে সবাই চান করতে আসতো। বুড়ো বট গাছ, যার তলায় বসে গাঁয়ের বুড়োরা গল্প করতো। তার আশে পাশের জঙ্গল। ও এমনকি সেই গাছটাও খুঁজে পেলো, সেই লাল টুকটুকে ফলগুলি, যা খেয়ে আজ ওর এই দশা। এবার তো আর ওর বাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধে নেই। হুশ্ করে সে পৌঁছে গেলো "নিজের" বাড়ি। ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। ঠাম্মা কত্ত বুড়ো হয়ে গেছেন! বাবারও তো মাথায় কত পাকা চুল। কাকাই কই? দেখছি না তো! অন্যদের কথা বার্তায় জানতে পারলো ও না থাকায় মন খারাপ থেকে মার নাকি কি একটা অসুখই হয়ে পড়েছে। বড় বড় ডাক্তার দেখাতে হয়। অনেক খরচ। তাই জন্যে কাকাই শহরেই বাড়ি নিয়ে থাকেন আর বাবা মাকে নিয়ে গিয়ে গিয়ে, থেকে থেকে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসেন।

কিন্তু মা কই?

একটা নতুন বড় ঘর করা হয়েছে। বড় বড় জানালা, দরজা। অনেক হাওয়া বাতাস। দেওয়ালে সুন্দর হালকা নীল আর গোলাপী রঙের ডিজাইন করা। সাদা কালোর ছককাটা মেঝে। অনেক সুন্দর সুন্দর বেবি আর কৃষ্ণ ঠাকুরের ছবি সাজানো দেওয়ালে। মাঝে বড় খাটে আধ শোওয়া মা। চুপ করে থাকলেও মনের মধ্যে তো শুধুই তাঁর হারিয়ে যাওয়া পলাশ। খুব দুষ্টু। একটুও কথা শুনতো না। সারা দিন খাই খাই। তাই জন্যেই তো কি না কি খেয়ে একেবারে চলেই গেলো। আর, তিনি? ঘরের কাজে এতো ব্যস্ত যে একমাত্র ছেলেটার খেয়ালও রাখতে পারলেন না!

"ওরে পলাশ, ফিরে আয় বাবা। ফিরে আয়।"

চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন তিনি। ভুতু গিয়ে জড়িয়ে ধরে তার মাকে। কি বোঝেন তিনিই জানেন, কিন্তু শান্ত হয়ে যান।

হটাৎ এক তীব্র সাদা আলোর ঘূর্ণিঝড় ভুতুকে ঘিরে ধরে। ওর মাকেও। কি তীব্র সেই আলো। আরো তীব্র তার আকর্ষণ! সেই টানে ভুতু ঢুকে যায় তার মার পেটের মধ্যে। সেখানে গিয়ে নরমে গরমে আরামে অনেক দিন পরে ভুতু সুখের ঘুম ঘুমিয়ে পড়ে। আর, সেই সঙ্গেই ভুলে যায় আগের সব কথা। 

আলোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় একটি নতুন জীবনের গল্প।।


পেজে লাইক দিন👇



Post a Comment

0 Comments