জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৩৭/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৩৭

সমগ্র ইউরোপে বাংলাদেশীরাই যে  বাংলাভাষার, বাংলা সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে, এদেশে না এলে জানতে পারতাম না। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, আবার গর্বিতও হই। ওরা বেলজিয়াম, ইতালি, উত্তর আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বিভিন্ন স্থানে, গোটা বৈশাখ মাস ধরে বিভিন্ন দিনে নববর্ষ পালন করে, রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তী পালন করে। বাংলাদেশীরা নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতিকে কতখানি ভালোবাসে তা এদেশে  এসে বুঝতে পারলাম। ওদের নিজস্ব টিভি চ্যানেল রয়েছে। সেখান থেকে বেশিরভাগ অনুষ্ঠান মহিলাদের সমস্যা ও আইনি সমস্যা নিয়ে। আসলে প্রচুর মানুষ বাংলাদেশ থেকে আসে কাজের খোঁজে, বাংলাদেশের রেস্টুরেন্টগুলোতে কাজও পেয়ে যায়, সমস্যা হয় ভিসা নিয়ে। ৬ মাসের বেশি এরা ভিসা দেয় না। ৬ মাসের ভিসা  ফুরিয়ে গেলে দেশে ফিরতে চায় না। ভিসা বাড়ানোর জন্য পথে নেমে আন্দোলন করে। আইনি পরামর্শ নেয়।  তাদের জন্যই বাংলাদেশ টিভিতে আইনজীবী প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে সমাধানের পথ বাতলে দেন। এদের যেটা আমার খুব ভাল লেগেছে, সেটা হল ওরা বাংলায় যখন কথা বলেন তখন যে যার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। আর যখন ইংলিশে কথা বলেন, তখন একেবারে ব্রিটিশদের টোনে বলেন। বাংলাদেশে এক এক অঞ্চলের বাংলা এক এক রকম, ঢাকার ভাষা এক রকম, সিলেটের বাংলা সব থেকে  দুর্বোধ্য। ওঁরা কিন্তু ব্রিটেনে বসে এই ভাষায় কথা বলে। আমরা তা করিনা,বা পারিনা। যে যার গ্রামে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও শহরে এসে শহরের মানুষের মত কথা বলার চেষ্টা করি। আবার কলকাতা গেলে তাদের ভাষা টিকেই  শুদ্ধ ভাষা বলে মনে করে সে ভাবে কথা চেষ্টা করা হয়। এছাড়া আর একটি আজব ব্যপার হল, আমাদের রাজ্যে নানা ভাষার মানুষ  বাস করেন।  কোনও অবাঙ্গালি মানুষ সহজে বাংলা বলে না। আমরাই তাদের সঙ্গে তাদের ভাষায়, মানে হিন্দিতে কথা বলি। তাদের রাজ্যে গেলে তো বলতেই হয়। তবে আমাদের দেশে দক্ষিণীরা হিন্দি ভাষা ব্যবহার করে না। দক্ষিণী ভাষাতেই কথা বলে,অপরপক্ষ না বুঝলে ইংলিশে কথা বলে।
    কথায় কথায় আমি কোথাই চলে গেছলাম! লন্ডনের একটি ময়দানে বাংলাদেশী বাঙ্গালিদের ১লা বৈশাখ পালন উৎসব টিভিতে দেখেছিলাম। ময়দান লোকে লোকারণ্য। তাঁদের মধ্যে ব্রিটিশরাও রয়েছেন। বাংলাদেশীরা কাঁধে ঢেঁকি, মাথায় টোকা পরে কৃষক সেজে ঘুরছে। অনেকের গায়ের টিশার্টে, কপালে ও বাহুতে বাঁধা ফেট্টিতে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা রয়েছে। কেউ কেউ কপালে, গালে মানচিত্রের লাল সূর্য এঁকেছে। গান ভেসে আসছে,এ’বাজেরে বাজেরে ঢাক / এল পহেলা বৈশাখ’। শুধু এটুকুই নয়, ময়দানের একপাশে মঞ্চ তৈরি হয়েছে। সেখানে  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। সঞ্চালনা করছেন যেদুটি তরুণ তরুণী তাদের নামদুটি খুব সুন্দর! সজীব আর তটিনী। দুজনেই বাঙালির সাজে সেজেছেন। তরুণ পরেছেন ধুতি-পাঞ্জাবি, তরুণীর পরনে আটপৌরে করে পরা ঢাকাই জামদানি। কোমরে রূপোর বিছে ও অন্যান্য গহনা। ছোট ছেলে মেয়েরা রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতির সঙ্গে মানানসই পোশাক পরে নাচছে। খেলাধুলোও হচ্ছে। এককথায় মনে হচ্ছে একটুকরো বাংলাদেশকে যেন তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। শুনেছি লন্ডনের একটা অংশে এত বেশি সংখ্যক বাংলাদেশীদের বাস যে ওই এলাকাটিকে মিনি বাংলাদেশ বলা হয়।

    আজ সকাল থেকে ওয়েদার খুব খারাপ, বৃষ্টি হচ্ছে। টেম্পারেচার ৮.৯ এ নেমে গেছে। তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করলাম। মৌরলা মাছের ঝাল, ফুলকপির ডালনা, ডাল আর চাটনি। আসলে আজ একটা ক্যাসেল দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাজে ওয়েদারের জন্য ক্যানসেল করা হয়েছে। আজ হেলথ ভিজিটর এসেছিল, জারার ওজন ভালই বাড়ছে। বাবলিকে ,কিছু প্রশ্ন করে্‌, কি সব বুঝিয়ে চলে গেনেন। বাবলি এখনও জিপির আন্ডারে আছে। বেবির ঠিকমত গ্রোথ হলে তবেই বাবলিকে রিলিজ করবে।

      দুপুরে মায়ের সঙ্গে কথা হল, ওখানেও খুব ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে।তবুও খুব গরম। কবে গরম কমবে, কে জানে। এদেশে সারাবছর ঠাণ্ডা, শীতে বেশি ঠাণ্ডা।  তখন তো মাঝে মাঝেই সব বরফে ঢাকা পড়ে যায়। এখানের মানুষ এতেই  অভস্থ। এখানকার ২/১টা জিনিস বাদ দিলে এদেশে সবই সুন্দর। তবুও নিজের দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য  খুব মনখারাপ হয়, তা সে যত গরিবই হোক না কেন। নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে এই দূরদেশে না এলে উপলব্ধি করতে পারতাম  না,নিজের দেশের প্রতি কি অপরিসীম টান ও ভালবাসা রয়েছে মনের মধ্যে। দেহটা এদেশে আছে ঠিকই, কিন্তু মনটা মাঝে মাঝেই উড়ে যায় সেই সুদূরের কাদায়ভরা মেঠো পথ ধরে বঁইচি আর বুনোকুলের বনে। যেখানে ফুটে থাকে মিষ্টি গন্ধে ভরা সাদা দাদা ঘেঁটুফুল। মাঠে চরে বেড়ায় গরু-মহিষের পাল, উঠোনে ছুটে বেড়ায় হাঁস-মুরগির ছানা। জারার কান্নার শব্দে সম্বিৎ ফেরে। আবার ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠি।

    মে মাসে একদিন ঠিক হল আমরা সবাই মিলে লন্ডন যাব। হোটেল বুক  করে বাসে টিকিত কেটে ছোট্ট জারাকে কারসিটে শুইয়ে লন্ডন রওনা হলাম। এদেশের বাসে কোনও কষ্ট হয়না। রাস্তা ও দুপাশের মন ভোলান দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। বাসের ভিতরে টয়লেট আছে, আছে গরম কফি পানের ব্যবস্থা । দাম দিয়ে নিজেকেই কাপে ভরে নিতে হবে। দুপুরর দিকে লন্ডন পৌঁছালাম। ট্যাক্সি করে হোটেলে পৌঁছে  আমাদের  রুমে রেখে দীপ খাবারের খোঁজে বের হল।  হোটেলের নিচে রেস্টুরেন্ট রয়েছে, কিন্তু সে তো ব্রিটিশ খাবার, আমরা খেতে  পারবনা। আমাদের রুমের জানলা দিয়ে ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ লেখা দেখতে পাচ্ছি। ওটা নিশ্চয় রেস্টুরেন্ট। কিছুক্ষন পর দীপ খাবার নিয়ে ফিরল। ওই রেস্টুরেন্ট থেকেই খাবার এনেছে। রেস্টুরেন্টের মালিক একজন বাংলাদেশী ভদ্রলোক। বাঙালি দেখে খুশি হয়ে একটা বাড়তি পদ দিয়েছে। খাওয়া শেষ করেই বাবলি ও জারাকে হোটেলে রেখে দীপ আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পায়ে হেঁটে কিংক্রস স্টেশনে পৌঁছে সারাদিনের টিকিট কাটা হল। এই এক টিকিটেই বাস, ট্রেন, মেট্রোতে ভ্রমণ করা যাবে।আমরা মেট্রোতে চড়ে মাঝে একবার ট্রেন বদলে টেমস নদীর ধারে পৌঁছালাম। লন্ডন আই এ চড়ার জন্য আগেই ইন্টারনেটে টিকিট বুক করা হয়েছিল। এখন চড়ার জন্য লাইন দিলাম। লন্ডন আই হচ্ছে একটা মস্ত বড় নাগরদোলা। এতে চড়ে পুরো লন্ডন শহরটা দেখা যাচ্ছিল। টেমস এর ওপারে বিগবেন দাঁড়িয়ে আছে। টেমস নদীর ব্রিজগুলো ওপর থেকে দারুণ দেখাচ্ছে। এখান  থেকে বেরিয়ে আবার মেট্রোরেলে চড়লাম। লন্ডন শহরে মাটির নিচে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থা বহু পুরনো। এখানে বিভিন্ন তলায় ট্রেন চলে। চলমান সিঁড়িগুলি এত দীর্ঘ যে নিচে তাকাতে ভয় করছিল। এবার আমরা বেকার স্ট্রিটে পৌঁছালাম। এখানে ম্যাডাম তুসোর মিউজিয়াম রয়েছে। শো-পিসের স্টল থেকে ছোট ছোট কিছু গিফট  কিনে  ম্যাডাম তুসোর মিউজিয়ামে ঢুকলাম। ২০০৮ এ ফোনে এরকম ক্যামেরা ছিলনা। ডিজিটাল ক্যামেরাতে ছবি তুলতে তুলতে হঠাৎ বিগড়ে গেল। দুই বাংলার অনেক বাঙালি ছিল। তারা ঐশ্বর্যা রাই, সলমন খান, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে ভিড় করে ছবি তুলছে। আমরাও ছবি তুললাম। তারপর অন্যকিছু না দেখে জগৎজোড়া নাম যাঁদের সেইসব বিখ্যাত জীবিত ও মৃত মানুষদের মোমের মূর্তি দেখতে লাগলাম। কে নেই এখানে? অমিতাভ, ঐশ্বর্যা, সাহারুখ, সলমন্ রয়েছেন এক জায়গায়, ইন্দিরা গান্ধী,বেনজির ভুট্টো দাঁড়িয়ে আছেন এক জায়গাতে, পেলের পাশে রাখা আছে একগাদা ফুটবল। মাইকেল জ্যাকসন, সাদ্দাম হুসেন, মহম্মদ  আলি,ইয়েসার আরাফত, দলাইলামা ও আরও অনেকের মোমের মূর্তি রয়েছে।সবার নাম উল্লেখ করা যাচ্ছে না। ভিতরে টয়ট্রেনও আছে। চড়তে হলে আলাদা টিকিট কাটতে হবে। এতে চড়লে ইউরোপের বিশেষ বিশেষ সময়ের ইতিহাস দেখা যাবে ছবির মাধ্যমে। এছাড়াও আছে ভয়ঙ্কর ও বীভৎস কিছু মূর্তি ও ছবি। এতটাই বীভৎস ও ভয়ঙ্কর যে ১১ বছরের নিচে যাদের বয়স, গর্ভবতী মহিলা ও হার্টের রোগীদের এখানে প্রবেশ নিষেধ। ভিতরে কিছুটা ঢুকে ছিলাম, হাত-পা-মাথা কাটা রক্তমাখা মূর্তি দেখে বেরিয়ে এসেছিলাম। আরকিছু দেখার সাহস ছিলনা। এর পর ফেরার পালা। আবার মেট্রো ধরে কিংক্রস স্টেশনে এসে নামলাম। ২০০৫ সালে  লন্ডনের টিউব রেলে যে বিস্ফোরণ হয়েছিল, এই ষ্টেশনে্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। প্রচুর মানুষ মারা গেছলেন।

                                    ক্রমশ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments