জ্বলদর্চি

আকাশপ্রদীপ বা স্বর্গবাতি /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪৪

আকাশপ্রদীপ বা স্বর্গবাতি
               
ভাস্করব্রত পতি


গ্রামবাংলায় কার্তিক মাস জুড়ে আকাশপ্রদীপ বা আকাশদীপ বা স্বর্গবাতি বা স্বর্গপ্রদীপ দেওয়ার তথা জ্বালানোর রীতি চলে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। সৌর কার্তিক মাস হোলো এই আলো জ্বেলে রাখার মাস। আশ্বিনের সংক্রান্তি থেকে কার্তিকের সংক্রান্তি পর্যন্ত একমাস ধরে প্রতি সন্ধ্যায় এই আকাশপ্রদীপ দেওয়ার রীতি এখনও দেখা যায়। হাওড়া, হুগলী, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত কিছু গ্রামে আজও কিছু মানুষ টিমটিম করে বাঁচিয়ে রেখেছেন এই লুপ্তপ্রায় লৌকিক প্রথাটিকে। মানুষের বিশ্বাস, এই আকাশবাতি অমঙ্গল এবং অতিপ্রাকৃত দুষ্ট শক্তিকে প্রতিহত করে থাকে। যদিও আজ আর তেমন চোখে পড়েনা আকাশপ্রদীপ দেওয়ার রেওয়াজ। নিয়ন আলো আর রঙবেরঙের এল ই ডি আলোর চোখ ধাঁধানো রোশনাইতে হারিয়ে গিয়েছে প্রাচীন এইসব রীতিনীতিগুলো। 

কবিগুরুর লেখাতেও পাই আকাশপ্রদীপের ছোঁয়া।১৯৩৮ এর ২৮ শে সেপ্টেম্বর 'আকাশপ্রদীপ' নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন কবিগুরু। ১৯৩৯ সালে তা প্রকাশিত হয় 'আকাশপ্রদীপ' কাব্যগ্রন্থে। রবীন্দ্রকাব্যের "অন্ত্যপর্ব"-এর এই কাব্যগ্রন্থটি তিনি সুধীন্দ্রলাল দত্তকে উৎসর্গ করেছিলেন। কবিতাটি ছিল ---
"গোধূলিতে নামল আঁধার ফুরিয়ে গেল বেলা,
ঘরের মাঝে সাঙ্গ হোলো চেনা মুখের মেলা।
দূরে তাকায় লক্ষ্যহারা নয়ন ছলোছলো,
এবার তবে ঘরের প্রদীপ বাইরে নিয়ে চলো।
মিলনরাতে সাক্ষী ছিল যারা আজো জ্বলে আকাশে সেই তারা।
পাণ্ডু আঁধার বিদায় রাতের শেষে যে তাকাত শিশির-সজল শূন্যতা-উদ্দেশে
সেই তারকাই তেমনি চেয়েই আছে অস্ত লোকের প্রান্ত দ্বারের কাছে।
অকারণে তাই এ প্রদীপ জ্বালাই আকাশ পানে যেখান হতে স্বপ্ন নামে প্রাণে"।।
সন্ধ্যের মুখে একটি লম্বা বাঁশের আগায় রাতভর একটি প্রদীপ বা লন্ঠন জ্বেলে রাখা হয়। মূলতঃ কেরোসিন বা রেঢ়ির তেলে জ্বালানো হয় এই প্রদীপ। কোথাও কোথাও নতুন কেনা মাটির হাঁড়ির মধ্যে প্রদীপ জ্বেলে দড়ি বেঁধে তা বাঁশের উপরে তুলে দেওয়া হয়। ঐ হাঁড়িটি বিশেষভাবে তৈরি করতে হয় কুমোরকে দিয়ে। হাঁড়ির ওপরের দিকে গায়ে বায়ু চলাচলের জন্য অনেক ছিদ্র রাখা হয়। আর একটা নতুন মাটির সরা চাপা দেওয়া হয় হাঁড়ির মুখে। মুখ খোলাও রাখেন অনেকেই। মোট চার ধরনের প্রদীপ জ্বালানোর কথা পাওয়া যায় শাস্ত্রতে। বাড়ির তুলসীমঞ্চ সহ পুকুর নদীর জলে একমুখী প্রদীপ জ্বালানো হয়। দ্বিমুখী প্রদীপ জ্বালানো হয় শ্রীবিষ্ণুর আদি অকৃত্তিম কৃপা এবং দীর্ঘজীবন লাভের জন্য। ত্রিমূখী প্রদীপ জ্বালানো হয় শত্রুর যাবতীয় কুনজর থেকে এড়িয়ে থাকতে। এবং চতুর্মুখী প্রদীপ জ্বালানো হয় সন্তানের এবং পরিবারের সকলের দীর্ঘজীবন কামনা করে।
কেউ কেউ অবশ্য চৌপল জ্বালিয়েও বাঁশের ডোগায় ঝুলিয়ে দেয়। অনেকটা ঠিক পতাকা তোলার মতো করে ঐ দীপদানকে বাঁশের আগায় ওঠানো এবং নামানো হয়। বাঁশের মাথায় গোল রিং করা থাকে। তার মধ্যে দড়ি ঢুকিয়ে দীপাধার ঝোলানো হয়। দড়ির অন্য প্রান্ত থাকে বাঁশের নিচ পর্যন্ত। সেখানে গৃহস্থ দড়ি টেনে ফের তা নিচে নামায় সকালে। আর যে বাঁশটি নেওয়া হয়, তা যেন ২৫ টি পাব বা গাঁটযুক্ত হয়। বাঁশঝাড় থেকে নতুন কেটে আনা ঐ বাঁশের আগার যতটা সম্ভব রাখা হয়।

বাড়ির মেয়ে বৌরা মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাড়িতে সন্ধ্যা দেখানোর সময় ঐ আকাশপ্রদীপ জ্বালায় এবং সে সময় তাঁরা মন্ত্রোচ্চারণ করে বলে, "দামোদরায় নভসি তুলায়াবে লোলয়া সহ প্রদীপন্তে / প্রযচ্ছামি নম অনন্তায় বেধসে"। অর্থাৎ কার্তিকমাসে লক্ষ্মীর সঙ্গে নারায়নকে আমি আকাশে প্রদীপ দিতেছি। বেধা বা বিধিকর্তাকে নমস্কার। এখানে 'দামোদর' হলেন নারায়ণ এবং 'লোলয়া' হলেন লক্ষ্মী। অর্থাৎ লক্ষ্মীনারায়ণের উদ্দেশ্যে দীপদান করার রীতি অনুরণিত হয়। 

এই উপচারের পেছনে আরও অনেক মতবাদ রয়েছে। প্রথমতঃ কার্তিক মাস সূর্যের দক্ষিনায়ণের সময় আসে। এ সময় দিন ছোট আর রাত বড় হয়। ফলে আলোর অভাব মেটাতে গেরস্থালির লোকজন এভাবে আলোর ব্যবস্থা করে। তাছাড়া ক'দিন পরেই ধানকাটার মরসুম এসে যাবে। গ্রামবাসীরা মনে করেন, ধান হোলো লক্ষ্মী। আর সেই গ্রামবাসীরা আরাধ্য দেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের উদ্দেশ্যে আকাশপ্রদীপ জ্বালে তাঁদের গেরস্থালির ঘরটিকে আলোকিত করতে। যাতে লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁদের ঘরবাড়িটিকে স্বর্গ থেকেই চিনে নিতে পারে সহজেই। এরফলে গেরস্থের ঘর লক্ষ্মীনারায়ণের কৃপায় সুখ স্বাচ্ছ্যন্দ এবং মহাসম্পদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে অচিরেই। তাই আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর সময় বলা হয় "আকাশে সলক্ষ্মীক বিষ্ণোস্তোষার্থং দীয়মানে প্রদীপঃ শাকব তৎ"। 

এছাড়া ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে সন্তুষ্ট রাখতে কার্তিকের প্রথম দিন থেকে সংক্রান্তির দিন পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায় মাটির প্রদীপ জ্বালানো হয় ঘি বা তেল দিয়ে। আসলে এই মাসেই ভগবান চারমাসের যোগনিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন। প্রদীপ গুলো উত্তর পূর্ব মুখ করে রেখে জ্বালানো হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু উঁচুতেও রাখা হয়। মানুষের বিশ্বাস যে, এই আকাশপ্রদীপ জ্বালানোর লৌকিক উৎসবটি দেখে প্রীতচিত্তে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ভক্তের যাবতীয় মনস্কামনা পূরণ করে দেন।

আমরা প্রবাদের আঙিনায় প্রায়শই বলে থাকি, 'নাতি স্বর্গে দেবে বাতি'। অর্থাৎ দাদু বা দিদিমার মৃত্যুর পরে তাঁদের অবিনশ্বর আত্মার উদ্দেশ্যে আলো দেখাবে তাঁর নাতি নাতনিরা। কেননা, শাস্ত্রমতে আত্মা অবিনশ্বর। ফলে সেই পূর্বপুরুষদের আত্মার আশীর্বাদ কামনায় বাড়ির ভিটে থেকে একটু উঁচু করে কোনো স্থানে দীপদর্শন করানোর চল বা রীতিই হোলো আকাশপ্রদীপ জ্বালানো। সেইজন্য আকাশকে স্বর্গ ভেবে স্বর্গারোহনের পথে লম্বা বাঁশের আগায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো হয় এই আকাশপ্রদীপ। যা জ্বলে রাতভর।

অনেক আগে দীপাবলীতে উল্কাদানের প্রথা প্রচলিত ছিল। এই উল্কাদান আসলে তাই আকাশপ্রদীপ দানেরই অন্যরূপ। কারো কারো মতে, মহালয়াতে মর্ত্যে যেসব পিতৃপুরুষ আসতেন, তাঁরা এই উল্কাদানের আলোকে পথ দেখে যমলোকে ফিরে যেতেন। আর যাঁদের অপঘাতে মৃত্যু হয়ে সদগতি হয়নি, তাঁরা এই দীপের তাপে দগ্ধ হয়ে উদ্ধার হন। এই উল্কাদানের সময় উচ্চারিত হয়, "অগ্নিদগ্ধাশ্চ যে জীবা যেহপাদগ্ধা কুলে মম / উজ্জ্বল জ্যোতি যাদগ্ধাস্তে যান্তু পরমাং গতিম্"। 

একসময় এই বাতিদানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা নিয়ম ছিল। সেসব এখন পরিবর্তিত। গবেষক চিন্ময় দাশ জানান, "বাড়ির কাছে যেকোনও যজ্ঞীয় কাঠে মানুষের মাপের একটি খুঁটি পুঁতে তাতে যবাঙ্গুলের মাপের একটি  ফুটো করতে হবে। সেই ফুটোয় লাগাতে হবে দুহাত মাপের একটি পটি। সেই পটিতে চারকোনা অষ্টদলাকৃতির একটি কর্ণিকা ঝুলিয়ে তার ভেতরে আলো জ্বেলে দিতে হবে। আর প্রদীপে দেওয়া হবে ঘি অথবা তিলের তেল"। যদিও এখন টুনি বাল্বের ছড়াছড়ি চারিদিকে। আর তেল হিসেবে কেরোসিন তেল, সরষের তেল কিংবা মোমবাতি ব্যবহার হচ্ছে। বলতে গেলে আকাশপ্রদীপের চল বিলুপ্তপ্রায়। 

এছাড়াও এই কার্তিকমাসে ফসল নির্বিঘ্নে তোলার জন্য গৃহস্থের লোকজন শরণাপন্ন হন দেবসেনাপতি কার্তিকের। তাই কার্তিকের মনোরঞ্জনের জন্য ঘরের চালে, উঠোনে এবং আকাশের পানে দীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়। সেই আলোতে দেবসেনাপতি ফসল পাহারা দেন গৃহকর্তার। 
"একটি চড়ুই পাখি ব'সে আছে— অগ্রসর, বড়ো পৃথিবীর বিদ্যুতের সাথে এই সমাচ্ছন্ন ভোরের আলোয় নিমেষের চড়িভাতি — অই দিকে আকাশপ্রদীপ দণ্ডে চ'ড়ে একটি খয়েরি চিল — কোনও এক বেঁটে বিমূঢ়ের গুলতিকে ঈর্ষা করে — তারপর নীলিমার দিকে উড়ে গেল ..." এ কবিতা জীবনানন্দ দাশের। "নির্ঘুম রাতে চাদরের তলায় / নিভে যাওয়া শরীরটা জেগে ওঠে আচমকা। / পাঁজরের খাঁজে খাঁজে / লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণারা বলে যায়, এখনও পাওয়ার কিছু আছে তো বাকি, / সব কিছু হয়নি তো শেষ। / হিমেল রাতের শেষে নিভে যায় আকাশপ্রদীপ, আকাশের নীল সীমানায়। কবি দোলা ভট্টাচার্যের কবিতায় এভাবেই এসেছে আকাশপ্রদীপের কথা। তেমনি কবি সৈকত দত্তের কবিতাতেও এসেছে আকাশপ্রদীপের প্রসঙ্গ -- "বুঝি অবেলার বেলা নাই / এক একটা তারা খসে পড়ে / সকল সম্ভাবনা শেষ করে দেয় / আঁধারের বনবিথিকায় হঠাৎ ঝলকে ওঠা আলো / চিরতরের আলোর সম্ভাবনাকে নিভিয়ে দেয় / আলো মিলিয়ে গেলে সেঁজুতি আশার আকাশপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে"। 

বিজ্ঞানসম্মত একটি কারণেরও খোঁজ মেলে। এই কার্তিক মাস জুড়ে চলে ফসল পাকা এবং তা কাটার মরসুম। তখন অসংখ্য কীটপতঙ্গ বেরিয়ে আসে প্রকৃতিতে। এছাড়া এসময়টায় ঋতু পরিবর্তন ঘটে। নানা রোগজীবাণু ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র। সেইসময় ঘি বা তেলে কিছু জ্বালানো হলে তার ঝাঁঝে পালায় পোকামাকড়ের দল। বিশেষ করে এসময় শ্যামাপোকার প্রাদুর্ভাব বেশি। শ্যামাপূজার সময় দেখা যায় বলে এহেন নাম। আকাশপ্রদীপের মোলায়েম শিখায় আকর্ষিত হয়ে শ্যামাপোকার দল ছুটে আসে এবং মৃত্যুমুখে পড়ে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আরও একটি লেখায় পাই আকাশপ্রদীপের আভাষ। কবিগুরু এই 'আকাশপ্রদীপ' নামের কবিতাটি পতিসরে বসে লিখেছিলেন ১৩৪৪ এর ৮ শ্রাবণ। সেখানে তিনি লিখেছেন ---
"অন্ধকারের সিন্ধুতীরে একলাটি ঐ মেয়ে
আলোর নৌকা ভাসিয়ে দিল আকাশপানে চেয়ে।
মা যে তাহার স্বর্গে গেছে এই কথা সে জানে,
ঐ প্রদীপের খেয়া বেয়ে আসবে ঘরের পানে।
পৃথিবীতে অসংখ্য লোক, অগণ্য তার পথ,
তারই মধ্যে স্বর্গ থেকে ছোট্ট ঘরের কোণ
যায় কি দেখা যেথায় থাকে দুটিতে ভাইবোন।    
মা কি তাদের খুঁজে খুঁজে বেড়ায় অন্ধকারে,
তারায় তারায় পথ হারিয়ে যায় শূন্যের পারে।
মেয়ের হাতের একটি আলো জ্বালিয়ে দিল রেখে,
সেই আলো মা নেবে চিনে অসীম দূরের থেকে।
ঘুমের মধ্যে আসবে ওদের চুমো খাবার তরে
রাতে রাতে মা হারা সেই বিছানাটির পরে"।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments