জ্বলদর্চি

সর্বজয়া আচার্য নন্দের 'স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি' নিয়ে আলোচনা করলেন কবি অনিন্দিতা শাসমল

সর্বজয়া আচার্য নন্দের 'স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি' নিয়ে আলোচনা করলেন কবি অনিন্দিতা শাসমল


পত্রিকার পাশাপাশি জ্বলদর্চির প্রকাশনায় এত ভালো ভালো বই প্রকাশিত হয় প্রতি বছর, সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখে ,কিছুটা পড়ে আলোচনার লোভ সামলাতে পারি না। সঙ্গে কিছু উপহারও থাকে -- জ্বলদর্চি দপ্তরের নাম ঠিকানা লেখা সুন্দর খাম ,প্যাড  আর  জ্বলদর্চি প্রকাশনার কাব্যগ্রন্থ ; হয় কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠীর অথবা অন্য কোনো কবির। এবারে সেই প্রাপ্তির ঝুলিতে জমা হল, জ্বলদর্চি থেকে প্রকাশিত কবি সর্বজয়া আচার্য নন্দের কাব্যগ্রন্থ --স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি। প্রকাশকাল--শুভ অক্ষয় তৃতীয়া , ১৪২৯। 

কবির সঙ্গে আমার পরিচয় নেই , তবুও কাব্যগ্রন্থের নামটি পড়েই মনে হল-- কুসুমের অঞ্জলি দিয়ে  কবিতার পরতে পরতে যে স্মৃতিচারণা, তা নিশ্চয়ই হৃদয় স্পর্শ করবে। পাতা উল্টে উৎসর্গ পত্রের লেখাটিতে এসে স্তব্ধ হলাম।খুব কাছের মানুষের বিয়োগব্যথায় , হৃদয় উৎসারিত কথাগুলো এইভাবেই মনের মাধুরী মিশে কবিতা হয়ে যায় বুঝি! 

"অন্তহীন যাত্রাপথে
 ‌     ক্ষণিকের সংসার বন্ধন--
প্রীতির সুবাস ল'য়ে
        হবে কালজয়ী চিরন্তন;
স্মৃতির শিশিরে সিক্ত
       প্রীতি সুরভিত শত কলি--
শাশ্বত সত্তার তরে
     এ আমার শেষের অঞ্জলি।"

      ‌              সদ্য প্রয়াত স্বামী প্রফুল্ল কুমার নন্দ মহোদয়ের বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ তাঁর এই কবিতা।

তারপর 'উৎসর্গ কথা' তে সবসময় পাশে থাকা তাঁর সহমর্মী ও সহযোগী মানুষটির কথা লিখতে গিয়ে, অন্তরের যে বেদনাময় আর্তি‌ ও গভীরতম অনুভব ফুটে উঠেছে , তাতে কবি ও তাঁর প্রয়াত স্বামী দুজনের প্রতিই শ্রদ্ধায় অবনত হলাম। কবির 'জীবন পাত্র উচ্ছ্বলিয়া ' যিনি মাধুরী দান করেছিলেন,তাঁকে নিয়ে লেখা এই কাব্যগ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতাই পাঠকহৃদয়কে অশ্রুসিক্ত করেছে। জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কত স্মৃতিকথা লেখা কবিতার অঙ্গে অঙ্গে!  'ব্যথিত প্রণয়' কবিতায় তিনি লিখছেন--

'সে মালঞ্চ ছিল মুখরিত
    বিকশিত কুসুমে--কোরকে,
মধুপের গুঞ্জন সেথা
    কত গান গেয়েছ পুলকে।"
আবার 'চিহ্ন নয়' কবিতায় লিখছেন--
"বেদনার বিবর্ণ কুসুমে
   যে মালা বিরলে ব'সে গাঁথি--
সে ফুল শিশির সিক্ত নয়
   সে আজ অশ্রুতে সিক্ত হয়,"

গভীরতম বোধ থেকে কবি 'তারাদের দল ' কবিতায় লিখেছেন--

"নিঃশব্দ নিশুতি রাত--
নিঃসাড় পৃথিবীকে দূরে ঠেলে রেখে
নিদ্রাহীন ক'রে আমার অস্তিত্বকে 
নিয়ে যায় অজ্ঞাত লোকে--অজ্ঞাত পথে--
দূরে--বহুদূরে--মহাশূন্যে--
আলোর জগতে--অগণিত নক্ষত্রের মাঝে।"

এই কাব্যগ্রন্থের মুখবন্ধে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সন্তোষ কুমার পড়্যা ও সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠী যে কথা লিখেছেন, তাঁদের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলবো--কবি তাঁর বেদনা- বিধুর হৃদয়ের যে বিষাদের সুরকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন , যে কবিতার মালা গেঁথেছেন এই কাব্যগ্রন্থে -- তা প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকহৃদয়কে স্পর্শ করবে । আর এখানেই কবির সার্থকতা। এখানেই কলমের জয়,কবিতার জয়, কাব্যগ্রন্থের জয়,প্রকাশকের জয়।

'স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি' কাব্যগ্রন্থে সূচিপত্রের বিন্যাসে অভিনবত্ব দেখে ভালো লাগলো। প্রথমে এগারো পৃষ্ঠায় ও পরে ছেচল্লিশ ও ছিয়াশি পৃষ্ঠায় মোট তিনটি পৃথক সূচিপত্র করে সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি সাজানো হয়েছে তিনটি পর্বে ভাগ করে। প্রথম পর্বের (১৩ থেকে ৪৫ পৃষ্ঠা) আগে ,চার লাইন কবিতা দিয়ে লেখা--"স্মৃতির ছিন্ন পাতা " এবং দ্বিতীয় পর্বের (৪৭ থেকে ৮৫ পৃষ্ঠা ) কবিতাগুলির আগে আবার চার লাইন কবিতা সহযোগে লেখা আছে--"স্বজন বিয়োগ ব্যথা", তৃতীয় পর্বের(৮৬পৃষ্ঠা)কবিতাগুলির(৮৭ থেকে ১০৪ পৃষ্ঠা)আগে দুলাইন কবিতাসহ লেখা--"শ্বাশ্বত সত্তা"।
কবির মস্তিষ্কপ্রসূত এই ভাবনা নিঃসন্দেহে আধুনিকতার পরিচয়।

সুন্দর প্রচ্ছদ ও ভালো মানের মুদ্রণসহ এমন সুন্দর একটি  হৃদয়মথিত বিষাদ-স্নিগ্ধ  কাব্যগ্রন্থ হাতে পেয়ে আমার যেমন ভালো লেগেছে, তেমন সকলের ভালো লাগবে আশা রাখছি।

স্মৃতি কুসুমাঞ্জলি / সর্বজয়া আচার্য নন্দ/ জ্বলদর্চি /১০০/-
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments