জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা উৎসব সংখ্যা ১০৬

 ছোটোবেলা উৎসব সংখ্যা ১০৬

সম্পাদকীয়,
কলকাতার দুর্গোৎসবকে "Intangible Cultural Heritage of Humanity" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে UNESCO।  সেই আনন্দে বাংলার দিকে দিকে আনন্দ অনুষ্ঠান হয়েছে। পুরুলিয়ার একটি বিদ্যালয়ে তেমনই একটি অনুষ্ঠানে ছৌ শিল্পীগণ দুর্গা রূপে নৃত্য পরিবেশন করছে সেই ছবি তুলে পাঠিয়েছে সুদীপ আঙ্কেল। উৎসব মানে শুধু মায়ের মৃণ্ময়ী মূর্তি দর্শন তা তো নয়। এই উৎসবের পিছনে আলো শিল্পী, মৃৎশিল্পী, প্যান্ডেলের কারিগর, সকলের অবদান অনস্বীকার্য। এবার তার সঙ্গে যুক্ত হল ঐতিহাসিক শ্রীমতী তপতী গুহঠাকুরতা এবং তাঁর সহযোগীদের গবেষণা। কারণ তাঁদের গবেষণার ফল স্বরূপ এই স্বীকৃতি। যুগে যুগে তপতী গুহঠাকুরতার মতো মামুষরা ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে চলেছেন। আজ থেকে ৭৫ বছর আগে তেমন একটি কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল যার নাম তেভাগা আন্দোলন। সেই আন্দোলনের কথা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে সৌগত দাদা। মনে করানোর কথা কিন্তু এখানে শেষ নয়। শ্রীকান্ত জেঠু মাঝে মাঝেই আমাদের ছোটোবেলার বন্ধুদের রাঙা পিসির গল্প বলেন। আজ আবার তোমরা রাঙা পিসির গল্প শুনে নাও। আর বিশ্বদীপ আঙ্কেলকেও বলেছিলাম তোমাদের আবার টিটোর গল্প বলতে। মজার কথা তোমাদের বন্ধু টিটোর গল্প রায়ান শুনে একটা ছবি এঁকে পাঠিয়েছে। মনে করা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গৌতম আঙ্কেল কয়েক দশক আগের ছেলেধরাদের নিয়ে একটা জম্পেশ গল্প তোমাদের শুনিয়েছেন। বিশ্বনাথ জেঠু ছোট্ট পাখির ছড়া শুনিয়েছে। কোন ছোট্ট পাখি? পড়ে জেনে নাও। সুতরাং শুধু যে ইতিহাস বইএর পাতায় অতীতের কথা লেখা থাকে তা কিন্তু নয়, গল্পেও কিন্তু পুরোনো ইতিহাস উঠে আসে আর ছোটোবেলার পাতা সেই গল্প তোমাদের জন্য তুলে আনে। এই যেমন তারাপ্রসাদ জেঠু ছড়ায় বাঁকুড়াকে চিনিয়েছেন। আবার বাসবদত্তা আন্টি তোমাদের চেন্নাই বেড়াতে যাবার মিষ্টি একটা গল্প শুনিয়েছে। ওদিকে তপশ্রী আন্টির উপন্যাস তো এবারেই শেষ। বিশাখা বাড়ি ফিরেছে। তারপর? ওদের বাড়িতেও উৎসব। উৎসব শুরু হয়েছিল শরতের আগমণে সেটা কিন্তু ভুললে চলবে না। তাই জয়ন্ত জেঠুর লেখা ছড়া ছোটোবেলার পাতায় কাশ ফুলের ছোঁয়া দিল। সুতরাং উৎসবের শেষেও শরতের হাত ধরে হেমন্তের বাড়ি চলে যাব আমরা। সেই যাত্রায় আমাদের সঙ্গী হয়েছে তোমাদের বন্ধু শুভঙ্কর, স্নেহা আর ঋতব্রতা। বন্ধুরা উৎসব একদিন না একদিন শেষ হয় কিন্তু ছোটোবেলা প্রতি রবিবার প্রকাশ পাবেই। তাই তোমরা তোমাদের লেখা আঁকা পাঠিয়ে দাও। আর তোমাদের সব বন্ধুদের পড়তে বোলো কিন্তু তোমাদের ছোটোবেলার গল্প-ছড়াগুলো।   --- মৌসুমী ঘোষ।



তেভাগা ইতিবৃত্ত  : তেভাগার ৭৫

সৌগত রায়


বাংলার ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলোর দিকে যদি একবার চোখ ঘুরিয়ে তাকানো যায় তাহলে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হিসেবে আমরা পাবো তেভাগা আন্দোলনকে , যাকে অবিভক্ত বাংলার শেষ বড় কৃষক আন্দোলনও বলা চলে। আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে বাংলার ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে যে আন্দোলনের নাম সেটাই হচ্ছে তেভাগা। একবার ভেবে দেখো স্বাধীনতার পঁচাত্তর নিয়ে আমাদের কত্ত মাতামাতি , whatsapp এ status এর পর status এ - "মেরা দেশ মহান" রব আরো কত্ত কিছু। কিন্তু যেসব ছোট ছোট আন্দোলন কর্মকান্ডের পর এই স্বাধীনতা সেগুলোর কথা মানুষ বেমালুম ভুলে গেলো ! এটা করা তো উচিত হবে না। তাই আজ একটু তেভাগা আন্দোলনের গল্প করা যাক।
 গল্পের শুরু মুঘল সাম্রাজ্যে। তখন বাংলায় কৃষকরা জমি চাষ করত নিজেদের মত আর তার একটা ছোট্ট অংশ দিত শাসককে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু ঐ যে সুখ বেশীদিন সয় না।  বাংলায় এল ব্রিটিশ শাসন । বাংলায় চালু হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। মনে করা হয়েছিল যে এই ব্যবস্থা বাংলায় কৃষির বিশাল উন্নতি ঘটাবে । তবে কৃষির কতটা উন্নতি ঘটল সে গল্প আলাদা, কৃষকদের জীবনে এর বাজে প্রভাব খুব তাড়াতাড়িই বোঝা গেল। 
 এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর মাধ্যমে কৃষক তার জমির সম্পূর্ণ মালিকানা হারালো আর সেই মালিকানা পৌঁছল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এক সম্প্রদায় - "জমিদার সম্প্রদায়" এর কাছে। জমিদার নামের মধ্যেই রয়েছে এদের পরিচয়। এরাই হয়ে উঠল কৃষক এর জমির "হত্তা কত্তা বিধাতা"। তার ওপর আরো এক জ্বালা হলো যে কৃষক সেই জমিতে যা ফলাবে তার অর্ধেক দিতে হবে জমিদারকে । মানে কৃষক জমিও হারালো আবার ফসলের অর্ধেক ভাগও। অর্ধেক ভাগের মালিক হওয়ায় কৃষক এর নাম হয়ে গেলো "আধিয়ার" । তোমরা হয়ত এখনও বুঝতে পারছ না যে কত বড় সংকটে পড়ল এই সময়ের কৃষকরা। সহজ করে যদি বলা হয় তাহলে ব্যাপারটা অনেকটা এরম যে তোমার বাড়িতে এসে তোমার কোনো এক ভাই বা বোন তোমারই খেলনা দিয়ে খেলল কিন্তু তুমি ঐ খেলনা ধরতে গেলেই সে চেঁচিয়ে উঠল । তোমার তখন রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক তাই না ! 
 হ্যাঁ এইবার কৃষক সমাজ উঠল ভয়ানক রেগে। সত্যিই তো তাদের জমি অন্য কেউ এসে ছিনিয়ে নেবে, আবার তাদের ভাগের পরিমাণও কমিয়ে দেবে - ধুস এ কিভাবে মেনে নেওয়া যায়। আর তারা মেনে নিলোও না । ছোটখাটো কৃষক আন্দোলন শুরু হলো বাংলার নানা জায়গায় । ১৯২৫ সাল নাগাদ কৃষক আন্দোলনে মিশে গেলো সাম্যবাদী ভাবনা। মানে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সবাই এক এই ভাবনা। এরপর পরপর বেশ কয়েকটি সভা কমিটি গঠন হলো যা বাংলা তথা সমগ্র ভারতের কৃষক সমাজকে জোটবদ্ধ করতে সক্ষম হলো। যেমন ১৯২৫ সালের নিখিল বঙ্গীয় প্রজা (এটাকে সারাবাংলার কৃষক  জোট হিসেবে ভাবতে পারো) গঠন হলো। ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরের এক অধিবেশনে তৈরি হলো ' বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল ' নামের আরেকটি জোট। ১৯৩৬ সালে হলো সর্বভারতীয় কৃষক সভা। দেখছো, একটা আন্দোলনের আগুন কিভাবে ছোট একটা আগুনের ফুলকি থেকে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে ! ১৯৩৮ সালে এই আগুনে ঘি পড়ল। স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউড এর সভাপতিত্বে ভূমি রাজস্ব কমিশন তৈরি হলো। আর এখানেই প্রথম তেভাগা কথা উঠল। আর এই কমিশন এর সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৪০ সালে  ছড়িয়ে পড়ল তেভাগা আন্দোলনের দাবী।
 " আধি নয় , তেভাগা চাই" অর্থাৎ অর্ধেক নয় কৃষকরা চায় ফসলের ২/৩ অংশ ( তিন ভাগের দুই ভাগ) - এই ছিল তেভাগার মূল কথা। আন্দোলন জোড়ালো হয় দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, জলপাইগুড়ি, খুলনা, এবং চবিবশ পরগনা জেলায়। 
  পুলিশ এর দল এলো। যারা আন্দোলন করছে তাদের অনেককে গ্রেফতার করল। গুলি চলল। কতজন প্রাণ হারালো। জমিদাররা দেখল আমরা তো বিপদে পড়লাম! তাই তারাও চরম অত্যাচার চালালো আন্দোলনকারী আর ভাগচাষীদের ওপর। কিন্তু কৃষকদের ভেতরে এত বছরের রাগ, এভাবে কি আটকে রাখা যায়। কৃষকদের পাশে দাঁড়ালেন  বাংলার বহু লেখক - গীতিকাররা। তাঁরা কৃষকদের অবস্থা নিয়ে গান লিখলেন , কবিতা লিখলেন। তোমাদের মধ্যে অনেকেই সলিল চৌধুরী কে চিনে থাকবে। তিনি একদিকে যেমন লেখক , সুরকার, গীতিকার আবার অন্যদিকে তিনিই ছিলেন অন্যতম বিপ্লবী। কৃষকদের প্রেরণা যোগানোর জন্য তিনি গান লিখলেন-
                             হেই সামালো ধান হো
                             কাস্তেটা দাও শাণ হো
                             জান কবুল আর মান কবুল
                             আর দেবনা আর দেবনা
                              রক্তে বোনা ধান মোদের প্রাণ হো।।
     এই গানের প্রত্যেকটা লাইন তেভাগা আন্দোলনের গল্প বলে। যেমন এই গানের শেষের দিকে তিনি বলছেন -" মোরা তুলবনা ধান পরের গোলায় মরবনা আর ক্ষুধার জ্বালায় মরবনা..." 
     নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ আন্দোলন কতটা তীব্র পর্যায়ে চলছে । এরকম আরো বেশ কিছু গান তিনি লিখেছিলেন যা কৃষকদের অবস্থা বর্ননা করে। এছাড়াও চলে উপন্যাস লেখালেখি , ছোটোগল্প-কবিতা ইত্যাদি লেখালেখি। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত শিশিরকুমার দাস এর লেখা ' শৃঙ্খলিত মৃত্তিকা ' নামের উপন্যাসে এই আন্দোলনের ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়।     
     আন্দোলন তো অনেক হলো। এবার জানা যাক এই এত কিছু যে হলো তার কতটুকু সফল হলো। আন্দোলনের প্রায় ৭ বছর হয়ে গেছে । ১৯৪৭ সাল - তোমরা সবাই জানো এই সালে কি হয়েছিল । হ্যাঁ এই সালেই হলো দেশভাগ আর ভারতের স্বাধীনতা। আর দেশভাগ এর পরের দৃশ্য যে কি ভয়ানক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না নিশ্চয়ই। দেশের লোকজন বুঝতেই পারল না তাদের ঠাঁই কোথায় হবে। কৃষকরাও ভাবলো যে জমির জন্য তাঁরা এত কিছু করছে, সেই জমি কি আদৌ তাঁরা পাবে ? কত্ত লোক নিজের জমি হারালো, নিজের বাড়ি হারালো। তাই আন্দোলনের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। শাসকরা তখন একটা খেলা খেলল। তারা এই আন্দোলনকে ক্রমে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় বিদ্রোহ হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরল। সেটাও আবার আলাদা গল্প। কিন্তু শেষমেষ  তেভাগার যতটুকু সাফল্য পাওয়ার কথা ছিল ততটুকু সে পেল না বললেই চলে। তবে আন্দোলন করে কি কিছুই হলো না ? না হয়েছে। এই আন্দোলনের পরেই প্রায় ৪০ শতাংশ কৃষক তাদের জমি ফিরে এলো। তাছাড়া জমিদাররা যে জোর খাটিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করত সেই প্রথার অবসান ঘটল। তাই আন্দোলন একেবারে বিফলে যায়নি। পরে ১৯৪৮-৫০ সাল নাগাদ পূর্ব পাকিস্তানের কিছু জায়গায় তেভাগা আবার জেগেছিল।
     এই ছিল তেভাগা আন্দোলনের গল্প। এরকমই আরো আন্দোলন বাংলার নানান জায়গায় , ভারতের নানান জায়গায় মাথাচাড়া দিয়েছিল। কিছুর ব্যাপারে আমরা অনেক কিছু জানি। কিছুর ব্যাপারে হয়ত বেশি তথ্য নেই আমাদের কাছে। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে এই সব কিছুরই কিছু না কিছু ভূমিকা ছিল। কারণ কথায় আছে বিন্দু বিন্দু জলকনা দিয়েই সমুদ্র তৈরি হয়। তবে অবিভক্ত বাংলার শেষ বড় আন্দোলন তেভাগাকে আমাদের ভুলে গেলে চলবে কেমন করে। যে কৃষক আমাদের রোজের ভাত রুটি এনে দিচ্ছে, যা খেয়ে আমরা বেঁচে আছি, তাদের ইতিহাসটাকে এভাবে কি ভুলে যাওয়া যায়! 
     যাইহোক আজ একটা নতুন বিষয় নিয়ে গল্প বললাম। মাঝে মাঝে ইতিহাসটা পড়তে বা জানতে ভালোই লাগে তাই না! আপাতত এখানেই কলম ছাড়লাম। আবার কোনো একটা নতুন বিষয় নিয়ে গল্প হবে খুব তাড়াতাড়ি। ততক্ষণ তোমরা বন্ধুদের মাঝে ছড়িয়ে দেও তেভাগার এই গল্প ।



ধারাবাহিক উপন্যাস
শয়তানের উঁকি
শেষ পর্ব

তপশ্রী পাল


বিশাখার বাবা মা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যখন রাত সাড়ে বারোটায় প্রোটন নিউট্রন বিশাখাকে নিয়ে পৌঁছে দিলো ওদের বাড়িতে! ওর মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো কাঁদতে লাগলেন। তারপর ওর গায়ে অতো জ্বর দেখে ওকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলেন। প্রোটন নিউট্রন আর কোন কথা না বাড়িয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলো। মা বাবা কাকা কাকীমা সবাই বাড়ির সামনে রাস্তায় পায়চারী করছিলো! বাবা তো কাকাকে বকাবকি করছিলেন “তোর কোন কান্ডজ্ঞান নেই! তোর বন্ধু ঐ পাকড়াশীরও বুদ্ধি নেই! এই বাচ্চা ছেলেদুটোকে ওই বিপদের মধ্যে নিয়ে গেছে!” এমন সময় ওদের দুজনকে পুলিশের গাড়ি থেকে নামতে দেখে নিশ্চিন্ত হলো সবাই!  কাকা বললেন “পাকড়াশী কোথায়?” নিউট্রন সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললো। সেদিন আর কারো কথা বলার ক্ষমতা ছিলো না। 
নবমীর দিন বেশ বেলা করে উঠলো প্রোটন। দেখলো দাদা তখনো ঘুমোচ্ছে। আস্তে আস্তে নেমে টুক করে মায়ের ফোনটা নিয়ে পাকড়াশী আঙ্কলকে একটা ফোন করে ফেললো প্রোটন। বেশ কবার ফোন করার পর মিস্টার পাকড়াশীর ঘুম জড়ানো গলা শোনা গেলো “কাল ভোর চারটেয় ফিরেছি রে! অল টেকন কেয়ার অফ! কাল তোদের বাড়ি যাচ্ছি” বলে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। যাক বাবা নিশ্চিন্ত! আজ বেরোতেই হবে ঠাকুর দেখতে। আজ শেষদিন! ঐশিকাকেও ফোন করতে হবে একটা। মেয়েটা নিশ্চই খুব চিন্তা করছে। ম্যামকেও জানাতে হবে! দুপুরে আজকে পাড়ায় মাংস ভাত! বাবা আজ সবাইকে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাবেন। কাকারা বাইরে থাকে বলে বাবা এবার কলকাতার বনেদী বাড়ির পুজো দেখার ব্যবস্থা করেছেন সবার। বেরোবার আগে ঐশিকাকে ফোন করলো প্রোটন। ঐশিকা তো খুব খুশী বিশাখা ফিরে এসেছে শুনে। গল্প শোনার জন্য ও অস্থির! ম্যামও আশ্চর্য হয়ে গেছেন সব শুনে! মা বললেন বিশাখার মা ফোন করেছিলেন। সবাইকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছেন দশমীর দিন। সেদিন পাকড়াশী আঙ্কল পুরো কান্ডটা বলবেন সবার সামনে। 
সাবর্ণ চৌধুরী বাড়ির পুজো, লাটুবাবু ছাতুবাবুদের বাড়ির পুজো, মার্বল প্যালেসের পুজো, রানী রাসমণীর বাড়ির পুজো, নবকৃষ্ণ দেবদের পুজো সব ঘুরে দেখে কাটলো সারাদিনটা! দেব বাড়িতেই দুপুরের ভোগ খেলো সবাই। নিউট্রন তো অবাক হয়ে গেছে এমন প্রাসাদের মতো বাড়ি আর সেখানকার সাবেকী ঠাকুর দেখে। ওদের মতো বাড়ির ছেলেরা কী সুন্দর ঢাক বাজাচ্ছে! কোথাও দুর্গা ঠাকুরের আট হাত, কোথাও আবার গণেশ কোলে বসে তিনি, কোথাও শিব দুর্গা পাশাপাশি! অসাধারণ আরতি, একটি বাড়িতে পুরুষরা সবাই তাস পাশা খেলছেন বসে! এটাই নাকি বংশের নিয়ম! দেবদের বাড়িতে দুর্গামন্ডপ কী সুন্দর! কী বিশাল ঝাড়লন্ঠন! কাল নাকি নীলকন্ঠ পাখী ওড়ানো হবে যে স্বর্গে গিয়ে শিবকে খবর দেবে যে দুর্গা ছেলে মেয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন! মা বললেন “জানিস, বিশাখার মা বলছিলেন ওদের বাড়িতেও প্রত্যেক বছর সাবেকী দুর্গাপুজো হতো, কিন্তু ওর কাকারা দখল করে বসার পর বন্ধ হয়ে যায় পুজো। এবার ওর মা লক্ষ্মীপুজোটা খুব বড় করে করবেন, বাড়ির লক্ষ্মী ফিরে এসেছে বলে। বাড়ি ফিরে ওরা দেখলো পাড়া থেকে মাংসভাত দিয়ে গেছে। যাক রাত্রের খাওয়াটাও জমে যাবে!
দশমীর দিন বিশাখাদের বাইরের ঘরে মিটিং বসলো। পাকড়াশী আঙ্কল, নাগেরবাজার থানার ও সি নবনীত ঘোষ, বিশাখা আর ওর বাবা মা, নিউট্রন প্রোটন, ওদের বাবা মা, ঐশিকা, অধরা ম্যাম সবাই হাজির বিশাখাদের মস্ত বৈঠকখানা ঘরে। আজ বিশাখার মায়ের মুখে হাসি! তিনি দশমীতে রাধাবল্লভী, ছোলার ডাল, আলুর দম, মাছের চপ আর কতোরকম মিষ্টি যে সাজিয়ে দিলেন তার ঠিক নেই! পাকড়াশী আঙ্কল প্রথমে একটা গরম মাছের চপ খেয়ে লাফাতে লাফাতে বললেন “উঃ কী গরম! দারুণ হয়েছে কিন্তু চপটা!” বিশাখার মা হেসে বললেন “সবে নামালাম তো! আপনি আস্তে আস্তে খান!” একটা আস্ত রাধাবল্লভী আলুর দম দিয়ে মুখে পুরে মিস্টার পাকড়াশী বললেন “এবার কাজের কথায় আসা যাক! ঘটনাটা কিন্তু সাংঘাতিক! আর যাদের জন্য বিশাখা বেঁচে ফিরতে পারলো তারা কিন্তু ওর বন্ধু আরাত্রিক আর তার দাদা! ওরাই এই কান্ডের হিরো!” সবাই প্রোটনের দিকে প্রশংসার চোখে তাকানো মাত্র ওর কেমন গর্ব গর্ব লাগতে লাগলো! মিস্টার পাকড়াশী বললেন 
“প্রথম কথা আরাত্রিক যদি অনলাইন ক্লাসে দুটো বিশাখা না দেখতো আর ওর সন্দেহ না হতো, তাহলে কিন্তু কীভাবে বিশাখাকে ওরা চুরি করে নিয়ে গেলো আমরা জানতেই পারতাম না।“
ম্যাম বললেন “ওরা কারা? কারা বিশাখাকে নিয়ে গিয়েছিলো আর কেনই বা তাই তো বুঝতে পারছি না! আর দুটো বিশাখা লগ-ইন বা করলো কী করে! স্কুল খুললে তো আমাকেই সব জবাব দিতে হবে! আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন!”
মিস্টার পাকড়াশী বললেন “বেশ, তবে শুরু থেকেই বলি! বিশাখার কাকা শ্যামল মজুমদার ফিরে আসা থেকেই এর সূচনা। তার পড়াশোনায় কোনদিনই মন ছিলো না। কুসংসর্গে পড়ে এতো বড় বাড়ির ছেলে অল্প বয়সেই নানা কুকাজ শুরু করে। তার মধ্যে চুরি ডাকাতি, মারদাঙ্গা, চোরাকারবার সবই ছিলো। বেশ কয়েকবার পুলিশের জালে ধরা পড়লেও প্রমাণের অভাবে অল্পদিন জেল খেটে ছাড়া পেয়ে যায়। ছেলেকে কোনভাবে সংশোধন করতে না পেরে, বিশাখার দাদু তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেন এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। তিনি বিশাখার বাবাকেই উইল করে সব দিয়ে যান। শ্যামল মজুমদার এ কথা জানতো না। কুকর্ম করে আর পালিয়ে পালিয়ে নানা রাজ্যে ঘুরে বেরিয়ে লকডাউনের ঠিক আগে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফিরে আসে শ্যামল! এসেই সম্পত্তির অংশ দাবী করে দাদার সংগে প্রবল অশান্তি চেঁচামেচি শুরু করে। পুলিশও পয়সা খেয়ে শ্যামলের বিরূদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বাড়ির একটা অংশ জোর করে দখল করে সে থাকতে শুরু করে। “
এখানে নবনীত ঘোষাল বেশ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন, কারণ থানার ওসি তিনি। মিনমিন করে তিনি বললেন “স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে যে শ্যামলবাবুর প্রচুর দোস্তি ছিলো! আমাদের হাত পা তো বাঁধা স্যার!”
প্রোটন নিউট্রনের এ সব গল্প অতো মাথায় ঢুকছিলো না। ওরা মন দিয়ে বৈঠকখানায় রাখা মস্ত অ্যাকোরিয়ামটা দেখছিলো! কতো সুন্দর সব রঙিন মাছ আর তাদের নিজস্ব জগত! হঠাত আবার পাকড়াশী আঙ্কলের কথায় প্রোটনের মনটা আলোচনায় ফিরে এলো। আঙ্কল বলছেন “শ্যামল এখানে ফিরে এক নতুন এবং অতি সাংঘাতিক কুকাজে জড়িয়ে পড়লো যাতে সহজেই অনেক পয়সা! এখন দুষ্টু লোকেরা গরীব কিশোরী মেয়েদের গ্রামগঞ্জ থেকে চুরি করে ধরে এনে আরব দেশে অথবা নানা খারাপ জায়গায় পাচার করে প্রচুর টাকার বিনিময়ে! অনেক মেয়ের বাবা মা খেতে পায় না বলে তারা মেয়েদের বিক্রি পর্যন্ত করে দেয় এদের কাছে! একে বলে গার্ল ট্রাফিকিং! এ এক চরম অপরাধ! ধরা পড়লে লম্বা জেল! কিন্তু অনেক সময়েই রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্যে সহজেই চলে এই কাজ! শহরের মেয়েরা সাধারণতঃ এই চক্রের খপ্পরে কম পড়ে, কারণ তাদের ওরকম অভাব নেই আর মা বাবারাও অনেক সচেতন! কিন্তু বিশাখার ক্ষেত্রে ঘটলো অন্য ব্যাপার। শ্যামলের কারবারের সূত্রে নানা আজেবাজে লোকজনের আগমন হতে লাগলো বাড়িতে। মাঝে মাঝেই নানা ঝগড়া চিৎকার চলতো রাতবিরেতে। বিশাখার বাবা অমলবাবু বাধ্য হয়ে একদিন মামলা করলেন এবং কোর্টের অর্ডার নিয়ে শ্যামলকে বাড়ি থেকে দূর করে দিলেন। শ্যামলের সব রাগ গিয়ে পড়লো অমলবাবুর ওপর! সে এর বদলা নেবে ঠিক করলো। বিশাখাকে এই ট্রাফিক চক্রের সাহায্যে অপহরণ করে বিক্রি করে দেওয়ার তাল করলো শ্যামল! তাহলেই অমলবাবু চরম জব্দ হবেন এটা সে বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু লকডাউনের জন্য স্কুল বন্ধ। বিশাখাও রাস্তায় বেরোয় না। ক্লাস ইত্যাদি সব অনলাইনে। বাড়িতে সবসময় ওর বাবা মা নইলে কাজের মাসী থাকে! সেই বাইরের লোককে দরজা খোলে! শ্যামল ফন্দী আঁটতে লাগলো কী করে বিশাখাকে বাড়ি থেকে বার করা যায়। প্রথম কথা কাজের মাসীকে সরাতে হবে। দ্বিতীয়ত বিশাখাকে দিয়ে দরজা খোলাতে হবে! বিশাখা কখনোই দরজা খুলবে না যদি নেহাত বাধ্য না হয়! সে কাজের মাসীর থেকে জানতে পারে যে বিশাখা তার মায়ের মোবাইলে অনলাইন ক্লাস অ্যাটেন্ড করে! বিশাখার কাছে স্কুলের কিছু এলে অথবা স্কুলের কোন কাজে বিশাখা বাইরে গেলে ঐ অনলাইন ক্লাসে নিশ্চই আগে সে কথা জানা যাবে! শ্যামল ঠিক করলো বিশাখার অনলাইন ক্লাসে উঁকি মেরে, মানে আড়ি পেতে বিশাখার রুটিন জানতে হবে! বেশ কয়েকদিন আড়ি পাতার জন্য তৈরী ছিলো কিন্তু লাকিলি তাড়াতাড়িই তার কাজ হয়ে গেলো!”



বিশাখা হঠাত এতোক্ষণে কথা বলে উঠলো “আমি বুঝতেই পেরেছিলাম মাম্মির ফোনে কিছু গন্ডগোল! খালি নতুন নতুন উইন্ডো খুলে যেতো!” 
মিস্টার পাকড়াশী বললেন “হ্যাঁ, হ্যাকার বন্ধুর সাহায্য নিয়ে শ্যামল প্রথমেই মিসেস মজুমদারের ফোন হ্যাক করে ফেসবুক প্রোফাইলের থ্রু দিয়ে। আর তার ফলে পুরো ফোনেই কব্জা করে ফেলে সে। পড়তে পারে মেসেজে আসা বিশাখার আই ডি পাসওয়ার্ড! এটা যে সম্ভব সেটা কিন্তু প্রথমে বলেছিলো আরাত্রিকের দাদা সাগ্নিক! আর আরাত্রিকই প্রথম দেখেছিলো দুটো বিশাখাকে একই নামে লগ-ইন করতে! এটা না খেয়াল করলে আমরা বুঝতেই পারতাম না কী করে বিশাখাকে নিয়ে গেলো ওরা আর বিশাখাই বা কেন দরজা খুললো!”
অধরা ম্যাডাম বললেন “মাই গড! কী কান্ড! তাও ভালো যে স্কুলের ওয়েবসাইট হ্যাক হয়নি! স্কুলের ওয়েবসাইট বা মেলবক্স সিকিউরিটিতে কোন প্রবলেম ধরা পড়লে আরো মুশকিল হতো! আমারই খেয়াল করা উচিত ছিলো কজন লগ-ইন করেছে! সেটা খেয়াল করলে এক্সট্রা পারসনকে লগ-আউট করে দিতাম! এরপর থেকে খেয়াল করতেই হবে!”
মিস্টার পাকড়াশী বললেন “যাই হোক শ্যামল জানতে পারে যে স্কুল, পুজোর ছুটির আগে কুরিয়ারে স্টাডি মেটিরিয়াল পাঠাবে বাড়িতে! সেই মেটিরিয়াল নিতে অবশ্যই দরজা খুলবে বিশাখা! কিন্তু তখনই খুলতে বাধ্য হবে যদি সে একা থাকে! কী করে সেটা করা যায়? বিশাখাদের কাজের মাসী প্রায় বছর দুয়েক কাজ করছিলো এই বাড়িতে। সে এমনিতে যথেষ্ট বিশ্বাসী। কিন্তু টাকা দিলে কী না হয়? মাসীকে ট্যাপ করে শ্যামলের লোকেরা, যারা এই পাড়াতেই থাকতো। এরা চুনোপুঁটি! কয়েকটি ছেলে মাসীকে বেশ কিছু টাকা দিয়ে ভয় দেখায় যে এরপরও যদি সে কয়েক ঘন্টার জন্য বাড়ি ছেড়ে না যায় তবে তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হবে! তাদের ওপর ভার ছিলো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার এবং কুরিয়ার এলে বাড়ির ছেলে বলে তার কাছ থেকে ডেলিভারী নিয়ে নেওয়ার। তারপর তারা কুরিয়ার সেজে বাড়িতে আসে। বিশাখা আই-হোল দিয়ে দেখে কুরিয়ার এসেছে। সে জিজ্ঞাসা করে কী আছে? তারা স্কুলের নাম করে বলে ওখান থেকে একটা প্যাকেট আছে বিশাখার নামে! বাধ্য হয়ে বিশাখা দরজা খোলে…!” বিশাখা দরজা খোলা মাত্র এরা তাকে গাড়িতে তুলে এয়ারপোর্টের কাছে একটি ধাবায় ছেড়ে দিয়ে আসে। এখানেই তাদের কাজ শেষ। এর বেশী তারা কিছু জানতো না।“      
প্রোটন বললো “আর এর মধ্যে আমাদের ঐশিকা বললো যে ও একটা অদ্ভুত মেসেজ পেয়েছে অজানা নম্বর থেকে! কেউ লিখেছে ‘আমাকে বাঁচা! সময় নেই!’ লেখার ধরণ দেখে ওর মনে হয় ওটা বিশাখার লেখা। কিন্তু খুব তাড়াহুড়োয় অন্য কারো মোবাইল থেকে আর পুরো কিছু লেখার আগেই সম্ভবতঃ ও ধরা পড়ে যায়!“
বিশাখা বললো “যেদিন তোমরা আমাকে উদ্ধার করলে তার দুদিন আগেই আমাদের এখান থেকে পাচার করে দেওয়ার কথা ছিলো! আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই! লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় খুব ব্যস্ত ছিলো। আমি সেই ফাঁকে একজনের মোবাইল থেকে ঐশিকাকে মেসেজ পাঠাই। বাবা মাকে পাঠাইনি কারণ ওরা তাহলে আরো আপসেট হয়ে পড়তো! সঙ্গে সঙ্গে লোকটা দেখে ফেলে আর আমাকে জোর থাপ্পড় মেরে ফোনটা কেড়ে নেয় আর সিমটা খুলে ফেলে দেয়! আমাকে যার কাছে বিক্রি করার কথা ছিলো সেই লোকটি বিদেশী। তার আসতে দেরী হওয়ায় আমাদের যাওয়া দুদিন পিছিয়ে যায়। নইলে পাকড়াশী আঙ্কল এসে দেখতো সব ফক্কা! অন্য মেয়েগুলোকে পাঠিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু ওরা একদিনেই যা করার করে কদিন গা ঢাকা দিয়ে চুপ করে থাকবে প্ল্যান করেছিলো। কাকাই ছিলো ওদের লিডার! কাকাকে দেখলে আমার ঘেন্না করতো!” 
বিশাখার বাবা বললেন “তারপর তো আপনারা আমাদের বাড়ি এলেন ইনভেস্টিগেট করতে। আর কেসটা যে কিডন্যাপিং নয় সেটা বুঝতে পারলেন, কারণ কেউ ফোন করেনি। আর এটাও বুঝতে পারলেন শত্রু আমাদের ঘরেই আছে। কিন্তু কী করে এদের পাকড়ালেন সেটা এবার বলুন! আর ধৈর্য সইছে না!”
মিস্টার পাকড়াশী বললেন “হুম! এখানেও আরাত্রিক সাগ্নিকের বিরাট কৃতিত্ব! ওরা না থাকলে কারা বিশাখাকে তুলে নিয়ে গেছে জানা এবং তাদের ধরা সম্ভব ছিলো না। আপনাদের বাড়িতে কথা টথা বলে আমরা যখন বেরোই তখন এদিককার একটি বিখ্যাত পুজো প্যান্ডেলে সোনার ঠাকুর হয়েছে দেখে ওরা ঠাকুর দেখতে নামে অল্প সময়ের জন্য। যখন ওরা প্যান্ডেলে, তখন একটি লোক ওদের ঠাকুরের সামনে বেশীক্ষণ না দাঁড়িয়ে সরতে বলে। লোকটি বেশ তোতলাচ্ছিলো।“ 
আরাত্রিক পাকড়াশী আঙ্কলের কথা লুফে নিয়ে বলে “হ্যাঁ, ও মনে হয় আগে আমাদের এই বাড়ি থেকে বেরোতে দেখেছিলো! আর আমি যেই দাদার কানে কানে কিছু বলেছি, ওর মনে ভয় ঢুকে যায়। ও তাড়াতাড়ি প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে সরে পড়তে যায়! আমরাও ওর পিছনে প্রাণপণ ছোটা শুরু করি। তারপর অলিগলি ঘুরে ও পালাতে থাকে। ভাগ্যিস একটা বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে একটা গলি একদম আটকানো ছিলো আর ও ওটার ওপর দিয়ে উঠে পালাতে গিয়ে পা পিছলে আলুর দম! ব্যাস আমরা ধরে ফেললাম ওকে! তারপর পাকড়াশী আঙ্কল ঠিক বার করে নিলো ও কোথায় ছেড়ে দিয়ে এসেছিলো বিশাখাকে!”
মিস্টার পাকড়াশী বললেন “এবার আসল কাহিনী! আমাদের গোয়েন্দা ইন্টেলিজেন্স-এর সূত্রে অনেকদিন থেকেই খবর পাচ্ছিলাম যে এয়ারপোর্টের কাছাকাছি গার্ল ট্রাফিকিং চক্রের একটা ঠেক আছে। কারণ এখান থেকে প্লেনে চড়িয়ে দেওয়া সুবিধা। কিন্তু কোথায় সে ঠেক পুলিশ নির্দিষ্টভাবে খুঁজে পায়নি। যাই হোক, ওরা ওই ধাবার সামনে বিশাখাকে ছেড়ে দিয়েছিলো এর বেশী আমরা কিছুই জানতাম না। ভাবলাম দেখা যাক একবার ওখানে গিয়ে। ওখানে গিয়ে দেখি ধাবাটা বন্ধ। একটা চালু ধাবা হঠাত বন্ধ কেন? এদিক সেদিক ঘুরেও কাউকে দেখতে পেলাম না! উলটো দিকে একটা পানের দোকান ছিলো। কেন যেন মনে হলো ও কিছু দেখে থাকতে পারে বা জানতে পারে। ও বিশাখা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারলো না। কিন্তু বললো যে ঐ ধাবা মাঝে মাঝে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ধাবার পিছনে লড়কীদের রাখা হয়। তারপর বেশী রাতে ভ্যানে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ও মাঝে মাঝে এ সব দেখে। কিন্তু এর মধ্যে অনেক বড় বড় নেতারা আছে। মুখ খুললে ওর দোকান উঠে যাবে, জান চলে যাবে।“        
এরপর অষ্টমীর দিন প্রচুর পুলিশ আলাদা ভাবে আমাদের ফলো করে। আমার গাড়িতে খুব রিস্ক নিয়ে আমি আরাত্রিক আর সাগ্নিককে নিয়ে গেছিলাম। কারণ এবার যাদের মুখোমুখি হওয়ার কথা, তাদের প্রাণে কোন মায়াদয়া নেই এবং সঙ্গে সবসময় অস্ত্র থাকে! বাবা-মাদের জানাইনি কারণ তাঁরা খুব চিন্তায় পড়ে যাবেন। অথচ এমন চালাক চতুর দুটি ছেলেকে আমার বড়োই প্রয়োজন ছিলো। আরাত্রিক তো ডিটেকটিভ গল্পের পোকা আর অভিযান ভালোবাসে, আমাকে বলেইছে! আর সাগ্নিক টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করে। মাথায় খুব বুদ্ধি! যাই হোক আমরা তো লুকিয়ে রইলাম। তারপর অনেক রাতে সেই কালো ভ্যান আসে এবং মেয়েদের সেখানে তোলা হয়। বিশাখা তার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ে! কারণ ও কিছুতেই যাবে না বলে বাধা দিতে যায় আর একটা তাগড়া লোক ওকে প্রচন্ড মারে! সেই নিয়ে ওদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিলো। বিশাখার কাকা লোকটিকে বকাবকি করছিলো । সেই অবসরে আমি গুলি চালাই, ওরা উত্তরে গুলি চালাতে শুরু করে দেয়। এইসবের মাঝে আরাত্রিক আর সাগ্নিক ধাবায় ঢুকে বিশাখাকে উদ্ধার করে জলের ছিটে দিয়ে ওর জ্ঞান ফেরায়। যে লোকটি পাহারায় ছিলো তাকে আমরা অনেক কষ্টে কাবু করি। সে গল্প আরাত্রিক সাগ্নিকের কাছেই শুনবেন! দারুণ সাহসের পরিচয় দেয় ওরা। যাই হোক বিশাখাকে উদ্ধার করতে পারলেও বাকী মেয়েদের নিয়ে কালো ভ্যানে করে পালের গোদা শ্যামল আর ওর অন্য লোকেরা পালায়! তখন বিশাখাকে আরাত্রিক সাগ্নিকের জিম্মায় দিয়ে আমাকে বেরোতে হয় তাদের খোঁজে। আমার সঙ্গে পুলিশের দল অন্য গাড়িতে দূরে রাস্তায় ছিলো। আমার ফোন পেয়ে তারা কালো গাড়িটাকে ইন্টারসেপ্ট করে! প্রচুর গুলির লড়াই হয়। বেশ কজন পুলিশ আহত হয়। আমার সঙ্গে গাড়ি ছিলো না। কিন্তু লাকিলি ধাবার মধ্যে একটা স্কুটি রাখা ছিলো। সেটার চাবি ঝুলছিলো। মনে হয় তাগড়া লোকটা যে মেয়েদের পাহারা দিচ্ছিলো তার স্কুটি! স্কুটি নিয়ে অকুস্থলে যাই! প্রচুর চেষ্টার পর শ্যামল আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গোরা গ্রেপ্তার হয়! এবার ও জেলে ঢুকবে, আর বেরোবে না। প্রচুর প্রমাণ আছে। যাবজ্জীবন জেল হয়ে যাবে! মেয়েগুলোকে উদ্ধার করে হোমে পাঠানো হয়। বেশীরভাগই ক্যানিং গোসাবা অঞ্চলের অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। ওদের বাড়ি ওদের আর ফিরিয়ে নেবে কি না ঠিক নেই।“ 
বিশাখা বললো “কেন? ওদের ফেরত নেবে না কেন? ওদের বাবা মা ওদের ভালোবাসে না?”
বিশাখার মা বললেন “তুমি বুঝবে না মা! একটু বড় হলে বুঝবে কত নাচার হলে বাবা মা এমন করে। ঈশ্বর যেন কাউকে এমন অবস্থায় না ফেলেন! আপনাদের সবাইকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেবো! আমার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর দিন  আসবেন কিন্তু! সেদিন সব্বাই একেবারে ডিনার খেয়ে যাবেন! সাগ্নিক আরাত্রিক আর ঐশিকাকে অনেক আদর। ওরা না থাকলে বিশাখাকে ফেরত পেতামই না! কী যে বিপদ গেলো ওর মাথার ওপর দিয়ে!”

ছড়া

এই শরতে    ||   জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 

শরৎ আসে সবুজ ঘাসে
গাছে-পাতায় হাসি
মেঘের কালো কে সরালো
রাখাল বাজায় বাঁশি।
পদ্ম-শালুক আলোই জ্বালুক
দিনে এবং রাতে
শিউলিতলা ভোরের বেলা
গন্ধ-খেলায় মাতে।
বকের পালক তুষার আলোক
মিশেছে আজ মেঘে
কাশের মুকুল ভরায় দুকূল
ছায়াটি তার জেগে।
ধানের খেতে আঁচল পেতে
পল্লি-মা ওই চায়
হাওয়ার বেগে কাঁপন লেগে
সবুজ চাদর ধায়।
বাতাস জুড়ে নিকট দূরে
পুজোর ছবি আঁকা
অভাব অসুর ছিঁড়েছে সুর
পথঘাট সব ফাঁকা।
অসুর নিধন কাঙ্ক্ষিত ধন
এই শরতে আসুক
মুক্ত প্রাণের খুশি গানের
আনন্দে সব ভাসুক।



টিটো বড় হয়ে কী হতে চায়

বিশ্বদীপ দে

টিটোকে যে প্রশ্ন দুটো সবচেয়ে বেশি শুনতে হয় সেগুলো বোধহয় তোমাদেরও শুনতে হয়। ওহো! প্রশ্নগুলো কী কী, সেটা তো আগে বলা দরকার। প্রথম প্রশ্নটা হল, বাবা না মা, কাকে বেশি ভালোবাসো? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? কি, তোমাদের সঙ্গে মিলে গেল না?
তা প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দিতে টিটোকে খুব একটা ভাবতে হয় না। সে সটান বলে, ‘মা’কে খুবই ভালোবাসি। তবে বাবাকে একটু বেশি।’ বলে আর হাসে। আসলে টিটোকে পড়ায় তার মা। সুতরাং পড়া-টড়া না হলে বকুনি আর একটু আধটু কানমলাও চলে। কিন্তু বাবা মানেই ছাদে গিয়ে ক্যাম্বিস বলে ক্রিকেট। ছুটির দিনে অ্যাভেঞ্জার্সের সিনেমা দেখা। এও ঠিক, মা’কে ছাড়াও টিটোর একবিন্দুও চলে না। তবু বাবা যেহেতু ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’, তাই শেষমেশ বাবার নামটাই সে বলে। এই নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে বেশ মিষ্টিমতো একটা ঝগড়াও হয়। তা দেখে টিটো ফোকলা (সামনের একটা দাঁত পড়ে গেছে বলে হাসলে তাকে আরও দুষ্টু দেখায়) দাঁতে যে কীরকম ফিক ফিক করে হাসে কী বলব!
এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটার কথা। বড় হয়ে কী হতে চায় টিটো? কিছুদিন আগে হলে সে এই প্রশ্নের উত্তরও প্রথম প্রশ্নের মতোই চট করে দিয়ে দিত। চোখ গোল গোল করে বলত, ‘অ্যাস্ট্রোনট।’ এর বাংলাটাও বলে দিত। মহাকাশচারী। তার এমন উত্তর শুনে প্রশ্ন যে করেছে তারও চোখ গোল গোল হয়ে যেত। অ্যাস্ট্রোনট কাকে বলে তা তো তোমরা জানোই। যারা স্পেসে মানে মহাকাশে যায়, চাঁদ বা অন্য গ্রহের মাটিতে নামে তাদের বলে অ্যাস্ট্রোনট। যদিও মানুষ এখনও চাঁদ ছাড়া আর কোনও উপগ্রহ বা গ্রহে যায়নি, তবে শিগগিরি নিশ্চয়ই যাবে। 
যাই হোক, ইদানীং ক্লাস থ্রি-তে ওঠার পর কিন্তু টিটো আর দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর দিতে পারে না। কাউকে কাউকে বলে বটে, ‘অ্যাস্ট্রোনট।’ কিন্তু সেই বলায় ততটা জোর নেই। আর অন্য সময় তো সে সবও বলতে পারে না। মাথা চুলকে বলে দেয়, জানি না। যদিও তার মুখ দেখে বোঝা যায়, সে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলছে না। তোমরা বলতে পারো, টিটোর হলটা কী?
আসলে কয়েকদিন আগে বাবার সঙ্গে বসে সে একটা ভিডিও দেখছিল কম্পিউটারে। মাঝে মাঝেই দেখে। মহাকাশের তিনশো ষাট ডিগ্রি ভিডিও। অর্থাৎ মাউস ঘোরালে ভিডিওর ছবিটাও ঘোরে। মনে হয় যেন ওরা কোনও স্পেসশিপে বসে বসে বাইরেটা দেখছে। এইসব ভিডিও দেখতে টিটো খুবই ভালোবাসে। 
সেদিন একটা অ্যাডভেঞ্চার ভিডিওয় ব্যাপারটা একটু গোলমেলে ঠেকল। ফেলিক্স নামের একজন একটা বেলুনে ভাসতে ভাসতে কেমন লাফ মারল! কিন্তু সে কিছুতেই পৃথিবীর বুকে নেমে আসতে পারছিল না। বনবন করে গোল হয়ে ঘুরেই যাচ্ছিল। বুঝতেই পারছ, ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে। পৃথিবী থেকে যারা তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল, তাদের তো খুব টেনশন হচ্ছিল। আর টিটোও মুখ শুকনো করে বলছিল, ‘ও কেন একা গেল? কেউ সঙ্গে থাকলে তো তাও একটু হেল্প পেত।’ যদিও সেই লোকটা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীতে ফিরে এসেছিল নিরাপদেই। তবু টিটোর মাথায় কেবল ওই বনবনিয়ে ঘোরার ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। 
আসলে এর আগে টিটো বাবার সঙ্গে অনেক সায়েন্স ফিকশন সিনেমা দেখেছে। সেখানেও অ্যাস্ট্রোনটদের নানা বিপদে পড়তে দেখেছে সে। সেই সব অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার দেখেই টিটো ভেবেছিল বড় হয়ে অ্যাস্ট্রোনট হয়ে সে মহাকাশে যাবে। প্রয়োজনে অজানা কোনও গ্রহে নেমে এলিয়েনদের সঙ্গে ফাইটও করবে। এসব ভাবলেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ত। তখন বাবাকেও জোর করে খেলায় নামাত। দু’জনে মিলে খাটটাকে মহাকাশযান বানিয়ে সোজা স্পেসে চলে যেত। তারপর সে যা অ্যাকশন! এই তাদের স্পেসশিপের কাচ ভেঙে পড়ল এলিয়েনদের লেসার পিস্তলের আলোর ঝলকানিতে। ওই টিটো সেখান থেকে লাফ মেরে সোজা উঠে পড়ছে এলিয়েনদের রকেটে। এত তার সাহস! দমাদ্দম ঘুষি মেরে সবাইকে পুরো সেন্সলেস করে দিচ্ছে। আর এই সব সে একাই করত। বাবা তার হেল্পার। কখনও কখনও বাবাকে এলিয়েনরা ইনজিওর্ডও করে দিত। তখন টিটো বাবাকে বাঁচাতে আরও বেশি করে লড়াই করত। 
তা এমন সাহসী টিটো আচমকাই ওই ভিডিওটা দেখে ভয় পেয়ে গেল। এমনিতে কিন্তু মেলা-টেলায় নাগরদোলা চড়তে টিটো হেবি ভালোবাসে। কিন্তু এই ব্যাপারটা সে আগে ভেবে দেখেনি। কোনও ভাবে মহাকাশ থেকে পৃথিবীতে ফিরতে না পারলে কী হবে? ওইভাবে আকাশের গায়ে ঝুলে থাকার কথা ভাবলেই তার কেমন একটা ভয় ভয় লাগে। 
এই নিয়ে নানা কথা ভাবতে ভাবতে অবশেষে টিটো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে অ্যাস্ট্রোনট হবে না। তবে এখনও মুখ ফুটে মা’কে তো না-ই, বাবাকেও বলেনি সেকথা। কিন্তু বাবা কিনা তার বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই আঁকার খাতা দেখে ঠিকই বুঝতে পেরেছে। টিটো এখন খাতার পাতা ভরে মহাকাশের ছবি আঁকছে। আর সেখানে ঝলমল করা তারাদের পাশে হাসিমুখো অ্যাস্ট্রোনটকেও দেখা যাচ্ছে। 
আসলে টিটো ঠিক করেছে বড় হয়ে সে অ্যাস্ট্রোনট হতে পারুক আর নাই পারুক, আঁকার খাতায় ছবি তো আঁকাই যায়। সে জানে, সব কিছু সব সময় চাইলেই পাওয়া যায় না। করে ওঠাও যায় না। কিন্তু কল্পনা করা যায়। ইম্যাজিনেশন। জানলার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কোনও ঝলমলে গ্রহ দেখতে পেলেই টিটো চেঁচামেচি করে বাবাকে ডাকে। আর হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তার মনখারাপও হয়। ওই গ্রহটায় তো সে কোনওদিনও যেতে পারবে না। কিন্তু তারপর সে ভাবতে শুরু করে ওই গ্রহটায় কী কী আছে। ভাবতে ভাবতে গ্রহটা আর দূরে থাকে না। তার আঁকার খাতায় ঢুকে পড়ে। এটাই হল আঁকার ম্যাজিক। 
কিন্তু সে না হয় হল, টিটো বড় হয়ে তাহলে কী হবে? একদম ছোটবেলায় সে চাইত সুপারম্যান হতে। পরে অ্যাস্ট্রোনটের কথা বললেও মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করত ক্রিকেটার হবে। কিংবা সায়েন্টিস্ট হয়ে টাইম মেশিন বানিয়ে বোঁ করে ডাইনোসরদের সময় থেকে ঘুরে আসবে। আবার কোনও কোনও দিন‌ পড়ায় মন বসলে টিটোর টিচার হতেও ইচ্ছা করত। টিচার হয়ে খাটের উপরে রাখা বালিশগুলোকে সে পড়াতে বসত। আরও কিছু কিছু ইচ্ছে তার মাথায় ফ্ল্যাশ করত। এখনও করে হয়তো। তাই আপাতত টিটো ভেবেই চলেছে। অ্যাস্ট্রোনটের বদলে কী হওয়া যায়। আগের অপশনগুলো কি ঝালিয়ে নিচ্ছে? নাকি নতুন কিছু... কে জানে! তোমাদের কারও টিটোর সঙ্গে দেখা হলে জেনে নিও তো। 
যাই হোক, একটা জিনিস টিটো কিন্তু বুঝতে পেরেছে। আঁকার খাতায়, মনের ভিতরে চাইলে কত কী-ই যে হওয়া যায়! বড় হয়ে তোমরা যে যাই হও না কেন, কখনও মনে মনে সেই সব হতে চাওয়াটা বাদ দিও না। লিখো, এঁকো, তাও না সম্ভব হলে মনে মনে একটু ভেবো। তাহলেই বুঝতে পারে, এক জীবনে চাইলে কত কী-ই যে হওয়া যায়!




মাটির ঘোড়া
তারাপ্রসাদ সাঁতরা

মাটির ঘোড়া
মাটির ঘোড়া
তোর বাড়ি কি
সেই বাঁকুড়া!

লাল মাটি
তালের সারি
মানুষ সরল
বন্ধু ভারি।

সূর্য ওঠে
পূব আকাশে
ঘাসের মাথায়
শিশির হাসে।

মাঠে মাঠে
সবুজ ধান
চাষী বৌয়ের
উছল প্রাণ।

মেঠো পথে
হাঁটাহাঁটি
গরুর বাথান
ঝুপড়ি বাটী।

বন জঙ্গল
বিষ্ণুপুর
টেরাকোটা
প্রাচীন সুর।

ধামসা মাদল
ধিতাং তাং
বন-পাহাড়ী
মহুয়া ভাঙ।

টুসু ভাদু
বাউল গান
রাঙা মাটির
সবুজ প্রাণ।

মনসা ঝাপান
মুরগি লড়াই
উৎসবেতে
মেজাজ পায়।

শুশুনিয়ার
পাথর কাটি
বানায় সবাই
থালা বাটি।

কাঁসা পিতল
রেশম গুটি
সিল্ক শাড়ি
পরি-পাটি।

শুনরে কথা
একটু দাঁড়া
যাবার এত
কিসের তাড়া।

মাটির ঘোড়া
মাটির ঘোড়া
তোর বাড়ি কি 
সেই বাঁকুড়া!




মধ্যরাতের নেকড়ে  
শ্রীকান্ত অধিকারী 


 আজ মহানবমী। পুজো শেষ হয়ে গেছে একটু বেলাতে। এখন সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি নামে। পুজোর প্রথম দু’দিন রোদ ঝলমলে থাকলেও নবমীর ভোর থাকতেই জোরে হাওয়া বইছে। মাঝে মাঝে গুড়ুম গুড়ুম করে বাজ পড়ার মতন বিকট আওয়াজ সকাল থেকেই পরিবেশটাকে অন্যরকম জমাট করে তুলেছে। ছেলেমেয়েগুলো ছুটোছুটি বন্ধ করে প্যান্ডেলে চেয়ারে চুপ করে বসে। গল্পের বদলে বেশির ভাগ মোবাইল ঘাঁটছে যে যার মত করে।  
রাঙাপিসি পুজোর সময় অতি ব্যস্ত। সব কাজেই রাঙাপিসিকে চায়। তবে নবমীর তিথি পেরিয়ে এখন দশমীর জন্য আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেই ফাঁকে চেয়ারে এক জায়াগায় চুপ করে বসে। হঠাৎ  কোত্থেকে ওরা দুই ভাইবোনে বড় ছোট মিলে বায়না ধরে একটা গা-ছমছমে গল্প শোনাতে। পিসিও রাজি। একা একা তার ভীষণ খারাপ লাগছে। তবে সে কথা ওদেরকে বুঝতে না দিয়ে ভারি গলায় বলে,--একটা দারুন ভূতের  গল্প বলতে পারি , কিন্তু তার আগে তোদের সবাইকে মোবাইল ফোনে সুইচ অফ করতে হবে।
এমন স্যাঁতসেঁতে সন্ধ্যায় ভূতের গল্পের লোভ কে সামলাতে পারে! মৌমাছির মত ঝাঁক বেঁধে ওরা রাঙাপিসিকে ঘিরে ধরে।  
রাঙাপিসিও বেশ হাসিমুখে বলতে শুরু করে।  
----সেবার তোদের দাদু মানে আমার বাবা পুজো করতে গিয়েছিল দুটো গ্রাম পেরিয়ে তেঁতুলবেড়িয়া গ্রামে। প্রত্যেক বছরের মত সেবারও পুজো শেষ করে নবমীতে মায়ের হোমযজ্ঞি সেরে পোঁটলা-পুটলি বেঁধে ফিরে আসতে  আসতে রাত হয়ে গেছিল। সঙ্গে দুই ভাইপো।খুব বেশি বড় নয়। পুজোর কাজে লাগবে তাই নিয়ে যাওয়া। আর নবমীর পর দশমীর পুজোর ফাঁকে অনেকটা সময়। তাতে একদিন ঘরে ফিরে আসা যায়। নবমীর লুচি মণ্ডা মিঠাই নগদ কিছু টাকা তো আছেই। ও হো বলা হল না, নবমীর বলির প্রসাদ মানে গোটা দুয়েক চোট অর্থাৎ পায়ের অংশটাও ছিল। পাঁঠার মাংস তাও আবার মা দুর্গার প্রসাদ ,আমার ঠাকুমা খুব খুশি হবে---এই আশায় সন্ধে সন্ধেই ওরা বেরিয়ে পড়ে। মাঝে শুধু মাঠ আর মাঠ। চারদিকে কাঁচা ধানগাছ। থরে থরে ধানের থোর ধানগাছের ডগায় ডগায় ঝুলছে। হাতে ছোট হ্যারিকেন। মাঠের সরু আলের ওপর ওরা তিনজন। পাতায় পাতায় শিশির পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না। নিজেদেরও একদম মুখে কোনও কথা নেই। বাহাদুরপুর পেরোতেই হাটকার মাঠ।সবুজ ধানের জমাটবাঁধা বিশাল অংশটাকে ঘন কালো ভয়ঙ্কর প্রেতপুরির মত লাগে। আলপথ। পথের ওপর লম্বা লম্বা ঘাঁস। ওরা নিঃশব্দে হনহন করে হেঁটে আসছে বাড়ির দিকে। হঠাৎ সেই আলপথের ওপর একটা বিশাল নেকড়ে ওদের পথ আটকে দাঁড়ায়। চোখগুলো আগুনের গোলার মত জ্বলছে। 
বাবা ফিসফিসিয়ে বলে স্বপন নবীন সাবধান, নড়িস না। তারপর খুব আসতে আসতে বলে--যা যা । পথ থেকে সরে দাঁড়া--হ্যাট হ্যাট। কিন্তু সামনের সেই ভয়ঙ্কর পশু কথা শুনলে তবে তো। ঠাই ওদের দিকে কট কট করে তাকিয়ে। 
বাবা বলে ,ভয় করিস না। ওরা ঘরে ঢুকে হাঁস মুরগি চুরি করে।
 স্বপন বলে, কাকা হাঁস মুরগি চুরি করে তো খটাস! এ তো অন্য জিনিস! স্বপনের গায়ে কাঁটা দেয়। এই অঞ্চলে নেকড়ে আছে বলে তো জানি না।  
--চল চল তোকে অতশত বুঝতে হবে না। নবীন চাপাস্বরে বলে। 
অগত্যা মাঠে নেমে ওরা পেরিয়ে যায়।
কিছুদূর যেতেই নবগ্রামের বিশাল বাঁশবন। তারপর বাঁয়ে ডানে দুটো দিঘি – শাপুকুর  আর লুরুরজোলা। দিঘির পারে ঘন অর্জুনগাছের সারি। অন্য দিঘিতে আমের বাগান। ভীষণ অন্ধকার। ভালো করে দিঘির জল দেখা যায় না। তখন তো মোবাইল ফোন আসে নি। হাতে হ্যারিকেন নিয়ে চলত। সেই আলোতে ওরা পথ ঠাওরে ঠাওরে যতটা সম্ভব পা চালিয়ে চলল। আমবাগান পেরিয়ে ছোটখাল ধরে আবার যখন মাঠের আলে নেমেছে অমনি স্বপনের পুঁটলি ধরে টান। স্বপন সাপের মত লাফ মেরে বলে , বাপরে।–ভূত! 
সামনে পেছনে কাউকে দেখা গেল না। 
স্বপনের হাতে পাঁঠার মাংস। বাবা বলল,  স্বপন ওটা তোর ঐ মাংসের লোভে এসেছে। দে দেখিনি আমায়,  বলে বাবা লুচি মিষ্টির পুঁটুলিটা স্বপনকে দিয়ে নিজে মাংসের পুঁটুলিটা বেশ শক্ত করে ধরে। -- এবার চল। দেখি কি করে !  
আরেক ভাই নবীনের কাছে হ্যরিকেন। সে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল। মাঝে স্বপন আর বাবা পেছনে। নিজের মনে গজ গজ করে –আমি কিনা আমার ঘরের জন্য নিয়ে যাচ্ছি কত কষ্ট করে কোথাকার কে এসেছে মাংস খেতে। কিছুদূর যেতেই পাশ থেকে এক মিহি নাকি গলায় বলে ওঠে ,-- আমাকে মাংস দে বলছি। নইলে তোদেরকে ঘরে ফিরতে দেব না। 
-- কি করে নিস আমিও দেখছি, বলেই বাবা বুকপকেটে ভরা গঙ্গাজলের কোটো থেকে কিছুটা হাতের গণ্ডুষে নিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে চারদিক ছিটিয়ে দিল। বলল আর কোনও ভয় নেই নবীন স্বপন । সামনে ওই বৈঁচিবনটা একটু সাবধানে আলো দেখিয়ে চলবি। ব্যস ! আর চিন্তা নেই। আমার বাবা দাদুও এমনি করে কত রাতবিরেতে পুজো করে লুচিমিষ্টি মাংস পোলাও নিয়ে আসত। কই ওদেরকে এই প্রেত ফেত নেকড়েভূত বিকড়েভূত কিচ্ছুটি করতে পারে নাই। একটু জোরে জোরেই বলে, --ওরে,  আমরা হলাম ভূততাড়ানো ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের জাত। যজমানের বাড়ি ভূত প্রেত তাড়িয়ে বেড়ায়।  আমার কাছে এসেছে ভয় দেখিয়ে মাল ছিনতাই করতে!  
হঠাৎ বৈঁচিবন থেকে ঝটফটানি শব্দ আর চিঁ চিঁ করে কোনও পাখির আওয়াজ শোনা গেল। 
বাবা বলল, ওই দেখ আমাদের কাছে কিছু না পেয়ে ঘুমন্ত পাখি ধরেছে।  
নবীন বলল, ওটা মনে হয় খ্যাঁকশেয়ালে বা বনবেড়ালে ধরেছে। 
বাবা বলল, না না ওদের শিকার ধরা আমি জানি, ওই পাজি হতচ্ছাড়ার কাজ। মানে মানে এই জোলো মাঠকটা পেরিয়ে গেলেই নিশ্চিন্ত। 
স্বপন একবার মাথা তুলে বাঁদিক ডানদিক দেখে নেয়। যত দূর চোখ যায় অন্ধকার আর অন্ধকার । কোনও আলোর চিহ্ন নেই।  মাঝে মাঝে শরতের ধেনো জমির জলে চ্যাং ঘোড়োয় মাছের  কট কট করে ধানের গোঁড়া চিবানোর শব্দ গভীর নৈশব্দকে কেটে কেটে দেয়। তখনি নবীন স্বপনের বুকটা ছাঁত করে ওঠে।
হঠাৎ আবার সেই ডাক---কীঁরে কথা শুনতে পেলি না। এবার দে বলছি। দে। নইলে ...  সামনে পেছনে কোনও নেকড়ে বা অন্য কোনও জানোয়ার দেখতে পাওয়া গেল ন। 
বাবা বলল – এ তো ভারি জ্বালা। বাবা তখন দুর্গা নাম জপ করতে করতে বলে,--বেশ দেব। আরেকটুকু চল আমাদের সঙ্গে। যেখানে সেখানে পুঁটলি খোলা ঠিক হবে না।  
নবীন চমকে উঠল ,--ওর পাশ দিয়ে কে যেন হি হি করে হাসতে হাসতে ধান ক্ষেতের কাঁচা ধানের ওপর সোঁ করে বেরিয়ে গেল। ধানগাছের পাতাগুলো পর্যন্ত ভয়ে নুইয়ে পড়ল বলে মনে হল ।  
ওরা আরও দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। মুখে কারও কথা নেই। 
কিছুদূর যেতে না যেতেই মাঝে মাঝে সেই মিহিগলার আবদার শোনা গেল– দে। এবার দে বলছি।  
--দেব দেব। আরেকটু চল। তোর কি পায়ে ব্যথা করছে। চল না আমাদের সঙ্গে। বাবা ওর সঙ্গে বেশ ভালো করেই গল্প জুড়ে দিয়েছে। সেই রাতের অন্ধকারে মাঠের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে ওরা চলেছে এক ভূতের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলতে বলতে।এক সময় নবীন স্বপনেরও ভয় যায় ভেঙে। স্বপন বেশ জোরেই বলে বসে ,--কাকা কাকা ঐ দ্যাখো আমাদের ব্রহ্মচারিতলার আলো জ্বলছে। 
এই পুজোকটা দিন এইখানে সারা রাত আলো জ্বালিয়ে রেখে দেয় গ্রামেরই লোক। 
বাবা বলল,-- এবার আরেকটু পা চালা। তারপর দেখাচ্ছি মজা। 
--কীঁরে আমার সঙ্গে ছলনা। জানিস কতগুলো লোকের ঘাড় মটকে তবে আমি একটা ভূত হয়েছি। এবার তোদের মজা দেখাচ্ছি। বলেই সেই মিহি গলার নেকড়েটা চারিদিকে ছুটোছুটি করতে লাগল। সঙ্গে সোঁ সোঁ করে জোরে বাতাস। দপ করে হ্যারিকেনটা নিভিয়ে যেতেই আবার খিক খিক করে হাসি ভেসে এলো ,--এবার ! দে বলছি দে। বলেই বাবার হাতে টান। ঝোলা কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। সে যত টানছে তত বাবাও আঁকড়ে ধরে রয়েছে।-বাবা কিছুতেই ছাড়বে না। ঐ অবস্থায় বাবা টং টং করে লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় গ্রামের কাছে ব্রহ্মচারিতলায় পা দিয়েছে অমনি বিকট চিৎকারে রাতের আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে--দিলি না তো। বেশ। তোর বাবাও একদিন দেয় নি। তোদের যদি একদিন ঘাড় না মটকায় তো আমিও পশুজন্ম ত্যাগ করে দেব বুঝলি –খিক খিক খিক। বলেই ঝপাং করে গোঁ গোঁ করতে করতে পাশের ভদরা পুকুরের জলে ঝাঁপ। গা হিম হয়ে যায় নবীন স্বপন দু ভাইয়ের। 
 বাবা বলে,  চল আর কোনও ভয় নেই। আমিও স্বর্গীয় চন্দ্রধর বাঁড়ুজ্জের ছেলে। অত সহজে হাল ছাড়ি না। পশ্চিম আকাশে হালকা চাঁদের আলো দেখা যায়। ব্রহ্মচারিতলায় প্রণাম করে ওরা তিনজনে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। পথে যেতে যেতে স্বপনের মনে হয় ভদরা পুকুরের জলে এখনও কীসের ঝটপট ঝটপট আওয়াজ আসছে। সে আর পেছনে ফিরে তাকাতে সাহস পায় না।


ছড়া
হামিং বার্ড
বিশ্বনাথ চৌধুরী

আমাদের চেয়ে দৃষ্টি প্রখর
দেখো তুমি বেশি রঙ
চেনো সাথী, খোঁজো রসদ
থাকে না কোনো ঢং।

আমরা যা পাইনা দেখতে
তুমি তা দেখো ভালো
অতি বেগুনি, অতি সবুজ
দেখে নাও বেশি আলো।

কত কিছু দেখো অন্তরে
জানতে পারিনা কিছু
যদি কিছু শিখতে পারি
যাই তাই পিছু পিছু।

যদি " তুমি " হতাম আমি
কী ক্ষতি হতো তাতে
দেখি রঙিন চোখে আজ
দিনে কিংবা রাতে।



ছেলেধরা
গৌতম বাড়ই


"তোরা ভোর হলে সব এক-এক করে হাজির হবি পুবপাড়ার মাঠে"। এটুকু বলে দীপকদা থামল।

এ যে গল্প বলছি সে বেশ কিছু বছর আগেকার। কয়েক দশক। ছোট্ট শহরের আনাচে কানাচে তখন জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছে একদল ছেলেধরা খুব ভোরে আর নির্জন দুপুরে ঐ ছেলেধরতে ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। কখনও শোনা যায় বিবেকপল্লী , আবার কখনও শোনা যায় নেতাজিপাড়া বা শ্রীকলোনী থেকে অল্প বয়সী ছেলে নিখোঁজ। বয়স ঐ ৮ থেকে ১২র মধ্যে। তবে কেউই সঠিকভাবে বলতে পারেনা কার ছেলে ? কোন ক্লাসে  পড়ে? কোন বাড়ির? কোন কিস্যু না। এদিকে বাতাসে জোর গুজব শহরে ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর এই গুজবের ভিত্তিভূমি হল নতুন এক সেতুর নির্মাণ কাজ, ফুলেশ্বরী নদীর উপর যেটি হচ্ছে। পাড়ার সব বালকেরা সেইজন্য গুরুজনদের কড়া নজরে রয়েছি। আর গুরুজনদের কড়া নজরে থাকতে হলে কতটা অসোয়াস্তি হয় বলো? আবার ছেলেধরাদের প্রতি এক ভয়মিশ্রিত অগাধ কৌতূহলও আছে। ব্রীজ তৈরী করতে মোট চারটে পিলার লাগবে। আর চারটে পিলারের জন্য চার- দুগুণে আটটি ছেলে লাগবে । এরকম খবরও আমাদের কানে এসে পৌঁছুলো।

শিপু, দিপু, রিনি ওরা সব নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আমাদের দিকে তাকিয়ে কেমন বাঁকা হাসি দিচ্ছে। কারণ ওরা তো আমাদের বয়সী পাড়ার মেয়ের দল। ভাবখানা এই - দেখ কেমন লাগে। ছেলেধরা বেড়িয়েছে , অতএব মেয়েদের ধরবে না। ভীষণ নিশ্চিত ওরা , তাই ওরা আমাদের ছেলেদের দামালপনা আটকে পড়েছে বলে বেজায় খুশি। আমরা স্কুলে যাচ্ছি দলবেঁধে। ফিরছি দলবেঁধে। খেলার মাঠ ছেড়ে বেপাড়ায় যাচ্ছিনা। রিনিরা মুখে আঙুল দিয়ে তেঁতুল চুষছে। আমি রিনিকে ডেকে বললাম শোন- " ছেলেধরারা এবার থেকে দু- একটা মেয়েও ধরবে। খবর আছে এবং তোর মতন ডেঁপো মেয়েদের।" রিনি মুখ ভেংচিয়ে বলল- " আমরাও জানি, এপাড়া থেকে ছেলেধরাদের টার্গেট তুই। সাবধানে থাকিস। " কী সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! তখনকার দিনেও এরকম সাংঘাতিক সব মেয়েরা গুণতিতে কম হলেও পাড়ায় পাড়ায় এইসব মফস্বল শহরে থাকত। তারা ছেলেদের সাথে চুটিয়ে ডাংগুলি, পিট্টু খেলত। সাইকেল চালাত। পাঁচিলে দৌড়াত। রিনিও তাই। তাই আমি রিনির পেছনে না লেগে মাঠে দৌঁড়ালাম। মাঠে দীপকদা সবাইকে নিয়ে গোল হয়ে বসেছে। দৌঁড়ে গিয়ে সেই গোলে গিয়ে বসলাম।

সেই গোল সভা যে ছেলেধরা নিয়েই হচ্ছে দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। পুরো শহরটাই তো ছেলেধরার গল্পে ভাসছে। স্কুলে বাজারে রাস্তাঘাটে অফিসে সব জায়গায়। তখন এক একটা বাড়িতে কত জায়গা। মাঠ- ঘাট। প্রতিটি বাড়িতে কত- কত লোক। বাবা- কাকা- জ্যাঠা- মাসি- পিসি নিয়ে সব বাড়ি ভরে আছে। যাদের মাসি মামা পিসি কাকা নেই তাদের দুঃখী মনে হত। মাঠে বসে দীপকদার মুখ থেকে শুনলাম- " একটা গোপন সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে পুবপাড়ার বড় মাঠের ধারে প্রতিদিন খুব ভোরে একজনকে ঝোলা কাঁধে দেখা যাচ্ছে। সেই ছেলেধরাদের সর্দার। পুবপাড়ার মাঠ থেকে ফুলেশ্বরীর নতুন ব্রীজ খুব বেশি দূরে নয়, আধ কিলোমিটারও হবেনা। ওরা নদীর ধারে ঝুপড়িতে থাকে। " দীপকদা আমাদের পাড়ার ক্যাপটেন। সমস্ত ব্যাপারে আমরা দীপকদাকে অনুসরণ করে চলি। তখন পাড়ায় পাড়ায় এরকম একটা দুটো দীপকদা থাকতোই। আমরা হা করে কথাগুলো শুনছি বা গিলছি। এরপরে বলল- " আমাদের ঐ ছেলেধরাকে পাকড়াও করতে হবে। এই দুঃসাহসিক অভিযানে নেতৃত্ব দেব আমি আর আমার সঙ্গে থাকবি তোরা ক্লাবের পঁচিশ জন বারো থেকে কুড়িবছর বয়সের মেম্বার। সর্দারকে ধরতে পারলে ছেলেধরাদের খেল খতম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে, মনযোগ দিয়ে শোন, বাড়িতে কেউ বলবি না, প্রথমে রাখী দিদিমণিদের পেয়ারা বাগানের ঝোপে এসে সবাই দাঁড়াবি। ওখান থেকে পুব পাড়ার বড়মাঠটি পরিষ্কার দেখা যায়। যেই নজরে পড়বে ছেলেধরা, আমি তোদের আগেই পেয়ারা বাগানে থাকব লাঠিসোঁটা যোগাড় করে রাখব, আমার নির্দেশ মতন এরপর এগোবি। তবে সাবধান কারুর বাড়িতে যেন না জানে। বড়রা জানলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। আর ছেলেধরাকে ধরতে পারলে আমাদের ক্লাব তুফান সংঘের নাম এই শহরে ছড়িয়ে পড়বে। মনে থাকে যেন সব্বার।" এইভাবে দীপকদা পইপই  করে আমাদের একই কথা মনে করিয়ে দিল। আমরা সন্ধে হবার অনেক আগেই ঘরে ঢুকলাম খেলার মাঠ থেকে। দেখি রিনি ওদের খোলা বারান্দায় বসে দাঁত খিলখিলিয়ে আমায় দেখে হাসছে। আমি একটা মুঠি পাকিয়ে উড়ো ঘুসি দেখালাম। রিনিও তাই করল। পাড়ার এই দস্যি মেয়েটাকে দেখলেই গা জ্বলে যায়। দাঁড়া কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা কর দেখবি ছেলেরা তোদের থেকে কত সাহসী আর বেপরোয়া। এই পাড়ার ছেলেদেরকে গোটা শহরময় চিনবে। পেছন থেকে অনুপ এসে বলল "রিনি মানে তোর বৌটাকে দেখলে আমার খিন্তি মাসির কথা মনে পড়ে।" আমি তো আকাশ থেকে পড়ে বললাম অনুপকে - " ওটা আমার বৌ? ওটা তোর বৌ। " তারপরে দুজন বন্ধু এই করতে করতে সোজা বাড়ি। আসলে বন্ধুদেরতো এরকম একটা জগত থাকেই।

বাড়ি এসে আর এক বিপদজনক কাহিনী শুনলাম বাবার মুখ থেকে। রবীন্দ্রনগরের তারামামার ছেলে নিহারকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে নিহারদাদা তো আমার থেকেও বড়, এই সামনে মাধ্যমিক। নিহারদাদাকে বস্তাবন্দী করে নিয়ে যাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। তারমধ্যে নিহারদাদার চেহারাখানাও বয়স আন্দাজে বেশ বড়সড়। তাহলে কী ছেলেধরার দল এসে ওকে পাকড়াও করে নিয়ে গিয়েছে? বাবা অফিস থেকে বাড়িতে ঢুকেই এ সংবাদটি দিল। এ শুনে একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। তাহলে আগামীকাল ভোরে কী করে যাব একা- একা পেয়ারা বাগানে? তবে যাবই এ দুঃসাহসিক অভিযানে। রিনির নাকটা একটু ঘষে দিতে হবে। খুব দেমাকী। কি যে ভাবে নিজেকে!

বলতে গেলে প্রায় সারারাত জেগে উশখুশ করে কাটিয়েছি। উত্তেজনা। জীবনের প্রথম এডভেঞ্চার। হয়ত কিছুক্ষণ মাত্র ঘুমিয়ে ছিলাম। এইসময় পুজোর আগে আগে ঐ ভোর চারটের পর কিছুটা অন্ধকার গা মাখামাখি করে থাকে বাইরে। একটু শীত শীত ভাবও লাগছে।  ভাই পাশে ঘুমিয়ে, খুব সন্তর্পনে দরজা খুলে বাইরের গেট ডিঙ্গিয়ে রাস্তায় এসে পড়লাম। দুটো বাড়ি পরে শান্তনুদের বাড়ি। দেখি ও আমার আগে হলদে আলোর ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে। তখন বাল্বের আলো স্ট্রীট লাইট হিসেবে ব্যাবহার হত। আমরা রাখী দিদিমণিদের পেয়ারা বাগানে এলাম, নামেই পেয়ারা বাগান , চালতা আতা তেঁতুল আম কাঁঠাল জামরুল কুল কত গাছে দিদিমণিদের বাগান ভর্তি। আর আমরা সারা বছর এন্তার সে পেড়ে পেড়ে খেতাম। দেখলাম ঐ কাকডাকা ভোরে প্রায় সবাই চলে এসেছি। দূর থেকে সবাই পুবপাড়ার মাঠের দিকে লক্ষ্য রাখছি। আরও একটু আলো ফুটতেই সবার মধ্যেই ফিসফিসানি আর শিহরণ খেলে গেল- আরে ঐ তো! একদম সবাই মিলে ঠিক দেখলাম পুবপাড়ার ঐ বড়মাঠের বাঁ- দিক থেকে ইয়া বড় এক কাঁধে বস্তা নিয়ে আবছা চেহারায় একজন মানুষ আমাদের সামনের দিকে আসছে। বাগানের গাছপালার অন্ধকারে হয়ত আমাদের দেখতে পায়নি। এবারে ক্যাপটেন দীপকদার নির্দেশ এসে গেল চাপা গলায় - " যে যা পার নিয়ে আর কিছুটা ঐ ছেলেধরা টা এগিয়ে এলে দুপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে হবে।দরকার পড়লে এই দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলব। "

আমি তো উত্তেজনায় কাঁপছিলাম। সব তো হুবহু মিলে যাচ্ছে। শেষটায় কী হবে ভেবে! হঠাৎ একটা শোরগোল পড়ে গেল শুধু আমরা না তারচেয়েও বেশি লোকের বিকট চীৎকারের মাঝে পড়ে ঐ ছেলেধরা ড্যাবড্যাব করে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে দেখছে। তবে সুবিমল কাকু, মানে অনুপের বাবা সবাইকে হাত নাড়িয়ে থামাচ্ছে যাতে কেউ ছেলেধরাকে আঘাত না করে।

ছেলেধরাটি আর কেউ নয় আমাদের শহরের সবার পরিচিত দ্বারিকমামা। পাগল আধক্ষ্যাপা। বলছে ওর এই বস্তায় সারা পৃথিবীর সমস্ত অঙ্কের বই জমানো আছে। কখনও দু- তিনমাস পাত্তা নেই, আবার কখনও প্রতিদিন দেখা যায় তাকে এই শহরে। কাঁধে বস্তা নিয়ে ঐ পাহাড়ের দিকে ছুটে চলে পা মেপে মেপে নাকি। তখন খোলামেলা প্রকৃতি, শহরও ছোটখাটো, তাই রক্ষে। আজকাল এইভাবে কত সাধারণ মানুষের গুজবের ওপর ভিত্তি করে কী বিপদটাই না ঘটে যায়। আমরা ছোটরা সব চুপিসারে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম , আর আমাদের গুরুজনেরা এই টের পেয়ে দুশ্চিন্তায় সব আমাদের খোঁজে আমাদের পেছনেই ঐ বাগান আর মাঠের ধারে মস্ত সব লাঠিসোঁটা নিয়ে হাজির হয়েছিল, তাই তারস্বরে সেই চীৎকারে পুরো শহরটার হয়ত ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল সেদিন। আর কী আশ্চর্য! এই ঘটনার পর থেকে শহরে সেই ছেলেধরার গল্পও মিলিয়ে যায় বাতাসে।

এখন ফুলেশ্বরীর সেতুর ওপর দাঁড়ালে আশ্বিনের সেই শিরশিরানি বাতাস খেলে না। রাখী দিদিমণিদের বাগান বাড়িও আর নেই। পুবপাড়ার মাঠটি কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। বাড়ি আর বাড়ি।

মনে আছে রিনির সেই ব্যাঙ্গোক্তি- " তোরা নাকি এই মস্ত একটি ছেলেধরাকে ধরেছিস? আমাদের পাড়ার ভীতুর ডিম ছেলেদের দৌড় জানা আছে! একটা ছিঁচকে চোরের কথা শুনলে চৌকির তলায় গিয়ে ঢুকে, তারা ধরবে ছ্যালেধরা?"

তাই ছেলেধরা বলতে এই দ্বারিকমামাই ছবি হয়ে আমার জীবনে সবসময় ফিরে আসে। যখনই ফিরে আসি আমার এই শহরে ঐ কথাগুলো মনে পড়বেই। তোমরা কী এখন ছেলেধরার কথা শুনতে পাও?


ভ্রমণ
দক্ষিণের জানালা
বাসবদত্তা কদম


চেন্নাই এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে পিসাইকে দেখে ধড়ে প্রাণ এলো তিন মক্কেলের।
বাবার মিটিংয়ের গুঁতোতে বেড়ানোটা ক্যানসেল হয়েই গেছিল প্রায়।  
অতঃপর পিসি, ঠামু আর মায়ের দফায় ভিডিও কল। 
শেষ পর্যন্ত পিসাইয়ের কথায় ওদের তিনজনকে একা একা প্লেনে বসানোর সিদ্ধান্ত নিলেন বাবা। 
বাবা মা দমদম এয়ারপোর্টের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে দিতে হাজারবার সাবধান করলেন। তাও ভাগ্যিস প্লেনের পেটের ভিতর বসে জানলা দিয়ে হাত বাড়ানো যায় না। গেলে অবশ্য তিনভাই হাত বাড়িয়ে মেঘ আইসক্রিম খেত। দেখেও নিত আকাশের গায়ে আছে নাকি ‘টক টক গন্ধ’!
এয়ারপোর্টের ভেতর ঢুকতেই ফেস শিল্ড দিল প্লেন কোম্পানি। তা দিয়ে মুখ ঢেকে ক্যামেরায় দেখে নিজেদের একদম স্পেস সায়েন্টিস্ট মনে হচ্ছে। ওমনি একটা গ্রুপফি তুলে পাঠিয়ে দিল সবাইকে। 
এরপর কলকাতা শহরটা ছোট হতে হতে কেমন মিলিয়ে গেল তাই দেখতে মারামারি শুরু হল জানলার সিট নিয়ে। বিমান সেবিকা এসে গম্ভীর হয়ে বলতে, তিনজনেরই বেশ অপমান হল। ক্লাস সেভেন কি ছোট...! 
তারপর তিনজনেই মেঘেদের ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে ঠিক তখনই প্লেনটা ঠং করে মাটি ছুঁলো।
পিসাই দাঁড়িয়ে ছিল এয়ারপোর্টের গেটে। তিনজনকে নিয়ে বাড়ি। সেখানে দশ মিনিট রেস্ট নিয়েই পিসির বাড়ির সামনের বীচ। এলিয়ট বীচ। 
বীচে এসেই বিট্টু আর বুমবুম লাগালো দৌড়। পিছন পিছন ‘এখন না। এখন না।’ করতে করতে পিসাই। দুজনকেই ধরে ফেলল পুলিশ। সন্ধে হয়ে আসছে, এখন আর কাউকে জলের কাছে যেতে দেওয়া হবে না। 
ধন্যবাদ দিয়ে পিসাই ওদের নিয়ে ফিরলেন। 
-বোস এখানে। গল্প করি। সামনের দোকান থেকে পিসি নিয়ে এলো আলুর রিঙ মালা। দারুণ দেখতে।  
খেতে খেতে পিসাইয়ের এর মন্তব্য ভেসে এলো, -নেই তাই খাচ্ছো। থাকলে কোথায় পেতে?       
-নেই মানে কি নেই গো! পিসির কথার উত্তরে পিসাই বলে…
-ইংরেজ নেই! তাই তো এখানে মজাসে বসে খাচ্ছি সবাই। ইংরেজ আমলে আমাদের মতো কোনো বাদামি চামড়ার সাহস ছিল, এই বীচে আসবার! এলেই ফাইন।
-কি অসভ্য আর উদ্ধত জাত। 
-হ্যাঁ তা বলতেই পারো। এভাবেই শাসন চালিয়ে গেছে ওরা বছরের পর বছর। 
বুবলা, বিট্টু, বুমবুম ঐ দিকটা দেখ। ওইদিকে মারিনা বীচ। ওখানে কাল সকালে নিয়ে যাব।
মারিনা বীচ পৃথিবীর সব থেকে লম্বা সৈকতের একটি হলেও হতে পারত। এই বীচের মত চওড়া বীচ এদেশে কোথাও নেই। লম্বায়ও সে বিশাল। মাঝখানে আড়েয়ার নদী হঠাৎ এসে তাকে কেটে দুভাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল বঙ্গোপসাগরে। লম্বায় খাটো হয়ে গেল সে। খাটো হয়েও প্রায় সাড়ে ছয় কিলোমিটার। নাহলে চেন্নাইয়ের বঙ্গোপসাগরের এই সমুদ্র সৈকত, সে হয়ত চলে যেত মুথুকাডু পর্যন্ত।
-মুথুকাড়ু কোথায় পিসাই?  
মহাবলিপুরম যাবার রাস্তায় সমুদের জল ঢুকে পড়েছে মুথুকাডুতে। সেই জায়গাটাকে যদিও চেন্নাই বলা যায় না। ওটা ভূগোলের হিসেবে চেন্নাইয়ের পাশের জেলা কাঞ্চীপুরম। তবে লোকমুখে চেন্নাই।
-বীচের মাঝখানে ঐ বিরাট সাদা রঙের বাড়ি টা কি? বিট্টু আর বমবুম ঝাঁপিয়ে পড়ে পিসাই এর কথার মাঝখানে। ওদের পক্ষে এতক্ষণ চুপ করে কিছু শোনা অসম্ভব ব্যাপার।
বুবলা একমাত্র যে শান্ত হয়ে শুনছিল, পিসাই’এর কথা। -উহুঃ বলে বিরক্তি প্রকাশ করে সে। যার বিরক্ত হবার কথা সেই পিসাই কিন্তু একটুও বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হল না।
-হ্যাঁ এই বীচে এলে ওটা দৃষ্টি কাড়বেই। ওটা একটা স্মৃতিসৌধ। 
একজন ডাচ নাবিক একদিন সকালবেলে বীচে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পান একটি বাচ্চা মেয়ে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে। তিনি জলে ঝাঁপিয়ে সেই বাচ্চাটিকে বাঁচালেন কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি। ১৯৩০ সালের এই ঘটনা। পরে সেই ইংরেজ মেয়েটি এবং তৎকালীন ম্যাড্রাস গভর্নরের উদ্যোগে এটি তৈরি করা হয়। তবে সমুদ্রের নোনা জল আর বীচে আসা লোকজনের মোবাইল ফটোগ্রাফির অত্যাচারে এই স্মৃতিসৌধটিতে ফাটল ধরেছে অনেক জায়গায়।
ডানদিকে দেখ, বলে হাত ঘুরিয়ে পিসাই দেখায়।
পিসি বলে, -বীচের পাশেই দেখ ভেলাঙ্কিনি চার্চ। প্রতিবছর অগাস্ট মাসের শেষে এখানে ভক্তদের ঢল নামে। হাজার হাজার মানুষ উপোস করে, মানত নিয়ে এই চার্চে আসেন। এই রাস্তাটায় তখন পা ফেলার জায়গা থাকে না।
জ্ঞানী বৃদ্ধ বুবলা প্রশ্ন করে, এখানেই তবে সুনামিতে কয়েকশো লোক মারা গেছিল।
-সুনামি চেন্নাইয়ের কম ক্ষতি করেনি; তবে তুই যেটার কথা বলছিস, এটা সেটা নয় সেটা আছে নাগাপটনম জেলায়। এটাকে তার একটা অনুকরণ বলতে পারিস। নাগাপটনমের সেই চার্চ তৈরি হয়েছিল ষোড়শ শতাব্দীতে।  
আর এই বীচ ধরে খানিকটা হেঁটে গেলেই দেখতে পাবি অষ্টলক্ষ্মী মন্দির। এখানে লক্ষীর আটটি রূপের আটটি মুর্তি আছে আর ছোট ছোট সিঁড়ি দিয়ে তাদের কাছে পৌঁছতে হয়। এই মন্দিরের সব থেকে মজার ব্যাপার এর স্থাপত্য। সিঁড়ি দিয়ে যাবার সময় মনে হবে মন্দিরের ওপরতলায় যাচ্ছিস, কিন্তু একটি মন্দিরের ওপরেও আরেকটি মন্দির নেই। সব কটিই আলাদা।
এটা কবে তৈরি হয়েছে? কয়েক শো বছর হবে? বুমবুম প্রশ্ন করে।
না। না। এটা অত পুরনো মন্দির নয়। এখনও একশো বছরও হয় নি এ মন্দিরের।
এবার বাড়ি। কাল ভোরে বেরনো আছে। পিসি তুলে দেয় ওদের।
পরদিন ভোরে পিসিই ভোর হবার আগে ওদের টেনে তোলে। 
মেরিনা বীচে পৌঁছে মুগ্ধ চোখে ওরা সূর্যোদয় দেখে। ভোরবেলাতেও সমুদ্রের ধারে প্রচুর লোক। বীচের একধারে লাইটহাউস। পরে একদিন আসবে ওরা লাইটহাউসে উঠবে। সেদিন মিউজিয়ামেও যাবে। সোমবার বলে আজ এগমোর মিউজিয়াম বন্ধ। গাড়ি থেকেই দেখে চেন্নাই সেন্ট্রাল। চেন্নাই এর হাইকোর্ট। ফেরার পথে একদিকে চলে গেল চেন্নাই পোর্টের রাস্তা আর ওরা ফিরল নেপিয়ার ব্রিজের ওপর দিয়ে। 
-কি সুন্দর ব্রীজটা, বিট্টু বলে।
-এটাও ব্রিটিশদের তৈরি, উদ্দেশ্য ছিল, ফোর্ট সেন্ট জর্জ থেকে শীঘ্র চেন্নাইতে পৌঁছনো। ঐ ফোর্ট দিয়েই চেন্নাইতে ব্রিটিশ ক্ষমতা দেখানোর শুরু বলতে পারিস।     
মেরিনাকে পিছনে ফেলে জুম জুম করে এগিয়ে চলে পিসাইয়ের গাড়ি। পথে মুথুকাড়ুতে থামে। দেখার মত বোট হাউস। অসীম নীল জলরাশি। মনে হয় সমুদ্রই বুঝি বা। পিসাই বলে এটা খাঁড়ি। এখানে প্রচুর মাছ আর তার লোভে শীতকালে আসে প্রচুর পরিযায়ী পাখি। 
এরপর ওরা থামলো ক্রোকোডাইল পার্ক। এশিয়ার অন্যতম কুমির পার্ক এটি লেখা আছে। ঢুকতেই সামনের পুকুর পাড়ে কিলবিল করছে কুমির। দেখে গুনতে শুরু করেছিল বিট্টু কিন্তু গুলিয়ে গেল।
এরপর পার্কের মাঝের রাস্তা ধরে সোজা হাঁটলে দুদিকে আলাদা আলাদা সব কুমির। তখন তাদের সকালের জলখাবার দেওয়া হচ্ছে। একটা কুমিরের হাঁ দেখে ওরা তিনজন আঁক করে চীৎকার করে উঠেছে। খাবার যারা দেয় তাদের যে কি মারাত্মক সাহস!
এরপরের গন্তব্য টাইগার কেভ আর তারপর ওরা গেল মহাবলিপুরমের শোর টেম্পলে। 
টাইগার কেভ থেকে সমুদ্র একটু দূরে কিন্তু শোর টেম্পলের পাশেই গর্জন করছে সমুদ্র। 
-কি সুন্দর! তিনজনেই বলে ওঠে।
-হ্যাঁ, খুব সুন্দর। এ মন্দিরের বয়স বারোশো বছরের কিছু বেশি। চল ভিতরে যাই।
-বা-রো-শো বছর! বিস্মিত তিনজন একে অন্যকে দেখে। 
পিসাই বলতে থাকে, -এর ভিঁত তৈরি হয়েছে অত্যন্ত উন্নত মানের গ্রানাইট পাথরে, যাতে সমুদ্রের নোনা জল এর ক্ষতি না করতে পারে। আর এরা বোধহয় সাত ভাই চম্পা ছিল।
-মানে এরকম আরো সাতটা মন্দির ছিল?
-হ্যাঁ। মার্কো পোলোর লেখায় ‘সেভেন প্যাগোডাস’ সম্ভবত এখানকার সাত মন্দির। সমুদ্র ধেয়ে এসেছিল অনেকদূর পর্যন্ত। সীমানার হিসেবে প্রায় অর্ধেক চেন্নাই শহর তখন সমুদ্রের নীচে চলে গেছিল। যদিও তখন চেন্নাই শহরের জন্ম হয়নি, সে অনেক পরের কথা। 
পল্লব রাজা নরসিমা শুরু করেন এই মন্দির। তারপর তাঁর ছেলেরা। এরপর চোল রাজারা এ স্থাপত্যকে আরো বাড়িয়ে তোলেন। পাশেই আছে পঞ্চ রথ। এর একটু আগে টাইগার কেভস। এসবই সমসাময়িক বলা যায়। এর প্রায় সমসাময়িক হচ্ছে কাঞ্চিপুরমের কৈলাসনাথ মন্দির। শিবের এত বড় মন্দির আর এত নিখুঁত কারুকার্য আমি খুব একটা কোথাও দেখিনি। তবে তোদের সময় এবার বড্ড কম আর কি কি দেখা হয় দেখ।
-কৈলাসনাথ মন্দির আজ যাব না? 
-না রে, সে আবার অনেকটা দূর। কাঞ্চী ছিল পল্লব, চোল আর তারপর পান্ডিয়াদের রাজধানী। 
সেখানেও দেখার অনেক কিছু আছে। তোদের তো কাল আর পরশু দিন সম্বল। কাল ভাবছি দক্ষিণচিত্র আর মিউজিয়ম টা দেখিয়ে দেব।
-দক্ষিণচিত্র কি ছবি?
-না। সে এক অলীক দুনিয়া। আজ থেকে দুশো তিনশো বছর আগে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অধিবাসীদের বাড়িগুলি কিরকম হত, তাঁরা কি বাসনপত্র ব্যবহার করতেন, সেভাবে সাজানো।
দেখলেই মনে হবে এক্ষুণি বুঝি কেউ এসে বসবে এই রান্নাঘরে। বসার ঘরে। কামার কুমোর যন্ত্রপাতি বানাচ্ছে। তারা নড়ে উঠলেই পিছিয়ে যাব সবাই মিলে দুশো তিনশো বছর।
পিসাই এত সুন্দর করে বলে...। পিসির লা জবাব রান্না। রেস্টুরেন্টের কলাপাতার সাইজের দোসা। প্লেটের সাইজের কাঁকড়া। এছাড়া আর আরো কত কিছু যে রয়ে গেল দেখবার দক্ষিণ ভারতে। বাবা কিছুদিন দক্ষিণ দেশে চাকরি করলেও তো পারে। এইসব আলোচনা করতে করতে বেশ অনেকটা মন খারাপ আর সঙ্গে মাইসোর পাক নিয়ে ওরা কলকাতার প্লেনে বসলো।


পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments