জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের সাঁওতালি সমাজ ও সংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ বাহাপরব /আশিস কুমার সাহু


জঙ্গলমহলের সাঁওতালি সমাজ ও সংস্কৃতির বিশেষ অঙ্গ বাহাপরব
                          

আশিস কুমার সাহু  
              
'বাহা’ সাঁওতালি সমাজের এক অতি পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। ‘বাহা’ শব্দের অর্থ ফুল এবং ‘পরব’ শব্দের অর্থ হল উৎসব অর্থাৎ ‘শালুই পূজা’ বা ‘বাহা পরব’ হল ফুল উৎসব। মূলত বনভূমির উদ্দেশ্যে শালগাছকে কেন্দ্র করে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষে বিশেষ করে পূর্ণিমার দু’দিন আগে অর্থাৎ  দ্বাদশী তিথি থেকে বাহা বোংগা বা বাহাপরব বা শালুই পুজা শুরু হয়। আবার কোনও কোনও গ্রামে ফাল্গুন মাসের পাঁচদিন থেকে পনের দিনের মধ্যেই এই পূজা হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামে যদি কোনও সন্তানের জন্ম হয় কিংবা কোন মানুষের মৃত্যু হয় তাহলে গ্রাম অশুদ্ধ হয়ে যায় ফলে নির্দিষ্ট দিনে পূজা বন্ধ থাকে, সেক্ষেত্রে পূজার দিন বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথি পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হয়। এরই মধ্যে যার পরিবার অশুদ্ধ ছিল সামাজিক নিয়ম মেনে তারা শুদ্ধ হয়। পরিবারটি শুদ্ধ হয়ে গেলে গ্রামটিও আর অশুদ্ধ থাকে না। পরিবার ও গ্রাম শুদ্ধ হয়ে গেলে সেই বছরের বাহাপরবের জন্য প্রস্তুতি চলে। সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত জাহের পূজা বা শালুই পুজা বা বাহাপরব শেষ না হওয়া পর্যন্ত নুতন পাতার থালা বা বাটিতে কোনও কিছু খাওয়া যাবে না। নতুন ফুল- ফল খাওয়া যাবে না। মেয়েরা শাল ফুল ব্যবহার করে না। বাহাপরব শেষ না হওয়া পর্যন্ত  সাঁওতাল সমাজের পুরোহিত কারো বাড়িতে কোনও সামাজিক সমস্যা থাকলে তার বাড়িতে যাওয়া-আসা বা খাবার গ্রহণ করেন না। পূজার একদিন আগে পূজার নির্দিষ্ট স্থান পরিস্কারের পাশাপাশি গ্রামের মাঝিবাবা, গড়েৎ বাবা, জগমাঝি বাবাসহ অন্যান্য পদাধিকারী ব্যক্তিরা নিজের নিজের ঘরবাড়িও পরিষ্কার করে নেয়। পূজার ডালি ও যন্ত্রপাতি সব ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। ঐ দিন  জাহের থানে খড়ের তৈরি তিনটি ছোট ছোট চালাঘর তৈরি করা হয়। বর্তমানে অবশ্য কোথাও কোথাও প্যাণ্ডেল তৈরি হয়ে থাকে। সবথেকে বড় কুটিরটিতে পূজিত হন দেবতা ‘বাবা মারাং বুরু’(সাঁওতালি সমাজের প্রধান দেবতা), দ্বিতীয় কুটিরে পূজিত হন দেবী জাহের আয়ো(জাহের থানের দেবী), এবং তিন নম্বর কুটিরে পূজিত হন ‘মঁড়েকো-তুরুইকো’(ভালো বৃষ্টি, ভালো চাষ-বাস ও বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে গ্রামের মানুষ রক্ষা পাওয়ার জন্য ‘মঁড়েকো-তুরুইকো’র পূজা করে থাকে)। 


    বাহাপরব বা শালুই পূজা মূলত দু’ধরনের হয়ে থাকে।  সাধারণ পূজা ও যাত্রাপূজা। সাধারণ পূজা মূলত  কম বাজেটের মধ্যে হয়ে থাকে। সেই পূজার ক্ষেত্রে আড়ম্বর থাকে না। ধামসা মাদল বাজিয়ে নাচ গান হয় না। অন্য দিকে যাত্রাপূজার ক্ষেত্রে বাজেট বেশি থাকে। তিন দিন ধরে আড়ম্বর সহকারে পুজা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে তিন দিন ধামসা মাদলের তালে তালে নাচ গানের মধ্য দিয়ে দেব-দেবীদের আহ্বানের মধ্য দিয়ে আড়ম্বর সহকারে বাহাপরব অনুষ্ঠিত হয়। 
 প্রথম দিন :  প্রথম দিন মাঝিবাবার ঘরে রাত দশটার দিকে গ্রামবাসীরা সকলে মিলিত হয়ে ধামসা মাদলের  তালে তালে নাচ গানের মধ্য দিয়ে স্বর্গের দেবতাদের আহ্বান জানাতে থাকে। এইসময় ধামসা মাদলের বোল, নাচ-গান ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। গ্রামবাসীরা করুণ সুরে তাদের জীবনের দুঃখ-বেদনার কথা জানানোর পাশাপাশি দেবদেবীদের নাম জপ করে থাকে। করুণ সুরে অসহায় মানুষের আহ্বান শুনে স্বর্গের দেবদেবীর দেবাত্মা একে একে গ্রামবাসীদের মধ্যে তিনজন মানুষের শরীরে ভর করে গ্রামবাসীদের মাঝে  নেমে আসেন। যে মানুষের শরীরে দেবদেবীর দেবাত্মা ভর করেছেন, তাদের শরীরে তুলসি ও মেথিজল ছিঁটিয়ে দেয় মাঝিবাবা বা পুরোহিত। এরপর যাদের শরীরে দেবদেবী ভর করেছেন তাদের সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকা মানুষের বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথন শুরু হয়। মাঝিবাবা বা পুরোহিত একে একে ভর করা দেবদেবীদের পরিচয় জানতে চায়। মাঝিবাবা বা পুরোহিত পরিচয় জানতে চাইলে দেবদেবীরা একে একে  তাঁদের পরিচয় দান করেন। দেবদেবীদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের সুখদুঃখের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বিনিময় হয়। মাঝিবাবা বা পুরোহিত দেবদেবীর কাছে নিবেদন করে যে, তারা তো সাধারণ অবোধ অজ্ঞান অন্ধ মানুষ। দেখতে পায় না কিছুই। সুখের সময় আনন্দ আর দুঃখের সময় কষ্ট পায়। ঠাকুর যেন নিজগুণে বলে দেন তাঁদের পুজোয় কোন ত্রুটি থেকে যাচ্ছে কি না। এই কথোপকথন শেষে দেব-দেবীর সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকা গ্রামবাসীরা ধামসা মাদলের তালে তালে নাচ গানে মেতে ওঠে। নাচগান শেষ হলে সেদিনের মতো দেবদেবীদের বিদায়ের পালা। দেবদেবীর আত্মাকে কপালে দুটি কানে ও গলায় সিঁদুরের ফোঁটা ও দেবতাকে  বালা ও দেবীকে চুড়ি পরিয়ে সে দিনের মতো স্বর্গের উদ্দেশ্যে তাঁদের বিদায় জানানো হয়।  
   দেবদেবীকে বিদায় জানানোর পর গভীর রাতে সেখানে উপস্থিত থাকা মানুষজন খাবার হিসেবে নিরামিষ ভাত ও হাঁড়িয়া খেয়ে সেদিনের মতো বিশ্রাম করে অর্থাৎ প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয়।    
 দ্বিতীয় দিন : দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় ভোর সকাল থেকে। দ্বিতীয় দিনের শুরুতে গ্রামের মানুষ  আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে একত্রিত হয়ে বলি দেওয়ার জন্য মুরগি, পাঁঠাসহ পূজার অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ধামসা মাদলের তালে তালে নাচ গান করতে করতে জাহের থানে উপস্থিত হয়। জাহের থানে উপস্থিত হয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে ধামসা মাদলের তালে তালে নাচ গান করতে করতে জাহেরথানের চারপাশে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ  করা হয়। মাঝিবাবা বা পুরোহিত দেবদেবীর উদ্দেশে বলির জানা নিয়ে আসা মুরগী, পাঁঠা ভোগ হিসেবে দেবদেবীর কাছে নিবেদন করেন। দেবদেবীর দেবাত্মা  মানুষের শরীরে ভর করে স্বয়ং ঠাকুরই প্রথম বলি প্রদত্ত পাঁঠাকে তিরবিদ্ধ করেন এবং মুহূর্তের মধ্যে আবার টাঙ্গি দিয়ে গলা কেটে দিয়ে তার কাঁচা রক্ত দেবদেবীরা সকলে ভাগ করে খেয়ে নেন। খাওয়ার পর দেবাত্মা ভর করা মানুষের মুখে লেগে থাকা রক্তকে জল দিয়ে ধুয়ে দেয় মাঝিবাবা বা পুরোহিত। এই সময় নাচগান বন্ধ থাকে। এই পর্ব শেষ হলে আবার নাচ গান শুরু হয়। জাহের থানে বৃত্তাকারে তিনবার প্রদক্ষিণের পর নাচগান বন্ধ হয়। শুরু হয় বলি দেওয়া পাঁঠা মুরগীর মাংস দিয়ে প্রসাদ রান্না করা। দুপুরে জাহের থানে রান্না করা মাংস প্রসাদ খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত জাহের থানে ধামসা মাদলের তালে তালে চলে নাচ গান। গানের সুরে সুরে ঠাকুরকে ডাকা হয় বাড়ি ফেরার জন্য। গ্রামবাসীদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেবাত্মা আবারও মানুষের শরীরে ভর করেন। দেবাত্মা ভর করা মানুষকে  সঙ্গে নিয়েই ধামসা মাদলের তালে তালে নাচতে নাচতে মাঝিবাবা বা পুরোহিত গ্রামবাসীদের সঙ্গে বাড়ির  উদ্দেশে রওনা দেয়। মাঝিবাবার বাড়িতে পৌঁছে জল দিয়ে ঠাকুরের পা ধুয়ে ঘরে ঢুকানো হয়। মাঝিবাবার বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত নাচ গান হয়ে সেদিনের মতো অনুষ্ঠান শেষ হয়। 
তৃতীয় দিন : তৃতীয় দিন সকাল আটটার দিকে গ্রামবাসীরা সকলে আবার মাঝিবাবার বাড়িতে সমবেত হয়। পূর্বের দু’দিনের ন্যায় তৃতীয় দিনও মাঝিবাবার বাড়ির উঠোনে ধামসা মাদলের তালে তালে চলে নাচ গান। গানের সুরে আহ্বান জানান হয় ঠাকুরকে। দেবাত্মা গ্রামবাসীদের তিনজনের শরীরে ভর করে গ্রামবাসীদের সামনে উপস্থিত হন। দেবাত্মা উপস্থিত হয়ে পূজার দিন যে ধনুকে পাঁঠাকে তীরবিদ্ধ করা হয়েছিল সেই ধনুকের ছিলা খুলে দেন। তখন গ্রামের ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখ আপদ-বিপদ সম্পর্কে দেবাত্মাকে জানতে চাওয়া  হয়। এই সময় কিছু মানুষ ঠাকুরের কাছে মনে মনে বিভিন্ন বাসনা করে মানত করে। বাসনা পূরণ হলে পরের পূজায় সেই মানত পূর্ণ করে। সব শেষে ঠাকুরকে বিদায় দিয়ে সেই বছরেরে মতো অনুষ্ঠানের শেষ হয়।  

‘বাহাপরব’ সাঁওতালি সমাজের একটি বৃহত্তম উৎসব। একে বসন্ত বরণ বা বর্ষবরণের উৎসবও বলা হয়ে  থাকে। এটি মূলত ধর্মীয় উৎসব হলেও এই উৎসবের পরতে পরতে উদ্ভাসিত হয়েছে সাঁওতালি সমাজ সংস্কৃতির অভ্যন্তরীণ দিকগুলি। বনভূমিকে কেন্দ্র করে এই আদিম নৃ-গোষ্ঠীর অরণ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ পরিলক্ষিত হয় এই বাহাপরব বা ফুল উৎসবের মধ্য দিয়ে। 

তথ্য সংগ্রহ ও ঋণস্বীকার - লক্ষীন্দর মাণ্ডি (গ্রাম- পাথরনাসা; ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত গ্রাম)

ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments