জ্বলদর্চি

রামকুমার মুখোপাধ্যায় /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল হয়েছে তার। বিষয়— আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)

বাংলা গল্পের পালাবদল—১৮  

রামকুমার মুখোপাধ্যায় 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা



সাহিত্যিক রামকুমার মুখোপাধ্যায় (জন্ম-১৯৫৬) সাহিত্যচর্চা শুরু করেন বিশ শতকের সত্তরের বছরগুলিতে। প্রায় শতাধিক গল্প লিখেছেন তিনি। প্রথম প্রকাশিত গল্পসংকলন— ‘মাদলে নতুন বোল’ (১৯৮৪)। তাঁর উচ্চশিক্ষা কলকাতায় এবং হায়দ্রাবাদে। সাহিত্যচর্চাও শহরে। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ আখ্যানের কেন্দ্রে রয়েছে গ্রাম। তাঁর গল্পগুলি গ্রামীণ ভারতবর্ষের অন্য একটি বলয়কে প্রতিভাত করে। 

রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের পূর্ব পুরুষ বিশ শতকের প্রথমদিকে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তাঁর জন্মও কলকাতায়। কিন্তু দেড় বছর বয়স থেকে তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে বাঁকুড়ার একটি গ্রামে। আর তাঁর সময়ের গ্রামের শিশু-কিশোররা শুধু পারিবারিক আবহে বেড়ে উঠত না। তাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে থাকত সমগ্র গ্রামযাপন। এই গ্রামীণ লোকায়ত যাপনের সঙ্গে লগ্ন হয়ে থাকে ঐতিহ্য, দেশজতা, পুরাণভাবনা— আমাদের শিকড়। রাঢ় বাংলার গ্রামীণ সমাজ ও সংস্কৃতি-জাত অধীতবিদ্যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। 

বিচিত্র পেশার গ্রামীণ মানুষদের ভিড় দ্যাখা যায় তাঁর গল্পে। জীবনের সঙ্গে জীবিকার গভীর সম্পর্ক। আর জীবিকার সঙ্গে অর্থনীতির। বেঁচে থাকার জন্য নানান জীবিকাকে বেছে নিতেন গ্রামীণ মানুষ। মনে রাখতে হবে— তখনও বাংলায় সবুজ বিপ্লব ঘটেনি। বছরে একবারই ধানের চাষ হত, বর্ষায়। স্বাভাবিকভাবে ভূমিহীন মানুষদের বেঁচে থাকা কঠিন ছিল তখন। আজকের সমাজ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে এই সমস্যাকে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না।   

পেশাগত সংকট এবং তার থেকে মুক্তিলাভের আমরণ চেষ্টা রামকুমারের বহু গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। ঘরের চাল ছাওয়ার মিস্ত্রী, ফুলুট বাজিয়ে শিল্পী থেকে সাধারণ তাঁতি, জনমজুর, আরও কত কত রকমের পেশার মানুষদের সামগ্রিক সংকট নিয়েই রচিত হয়েছে তাঁর গল্প।  

‘জ্যৈষ্ঠ ১৩৯০, ঘুঘু কিংবা মানুষ’ (‘পরিচয়’, জানুয়ারি ১৯৮৪) গল্পের সুচাঁদ দিনের পর দিন কাজ পায় না। পুকুর কাটার সন্ধান পেয়ে সুচাঁদ আর তার বউ গিয়েছিল আগড়ায়। বিডিও অফিসের স্লিপে সই হয়নি। যারা আগে গিয়েছিল তারা কাজ পেয়েছে। এরা খাঁ-খাঁ রোদ্দুরে ঝুড়ি কোদাল নিয়ে ঘুরছে। রাস্তায় কার খেতে কানা বেগুন চোখে পড়েছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে সুচাঁদের বউ কোলকাপড়ে কুড়িয়ে নিয়েছে। ক-দিন আগে সুচাঁদ একটা ফুটি পেয়েছিল। দুজনে পেট ভরে খেয়েছে। তারপর আর জোটেনি।

এমনিতে সুচাঁদ শান্ত, কিন্তু পেটে দানা না পড়লে জ্ঞানগম্যি থাকে না। বউয়ের উপর রাগ করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। মরবার জন্যই হয়তো বেরিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত বাঁচার রসদ পেয়ে গেলে আর মরা হয় না। একবার সুচাঁদ রাগ করে চলে গিয়েছিল। “পুরুলিয়া ইস্টিসনের কাছে ঘুরছিল ট্রেনে চেপে যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাবে। হঠাৎ দেখে একটা কয়লার মালগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মাল পুরে কাপড়ের সামনেটা বোঁচকা মতো করে গুড়িসুড়ি মেরে সরে পড়ছে। পড়বি তো পড় স্টেশনের মেজবাবুর সামনে। শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে বলে— ‘কয়লা নাই আছে। আমার উখানটা অমনিই বাবু। আবার অপারিশন করে সেপটিক হয়ে গেছে।’ মেজবাবু ভদ্রলোক, কথা শুনে নাক সিটকে সরে গেছে।” 

এবার হয়তো মরতেই গেছে। সুচাঁদের বউ তাই বরকে খুঁজতে যায়। চারদিন পর পূর্ণিমার দিনে ফিরে আসে সে। আর মরা হয়নি তার। ইলেকট্রিকের তারে ঝুলে মরতেই গিয়েছিল— “মরতুম বটে। সাঁওতালডির পোস্টটা ধরে তর তর করে উঠছি। আর একটুন হলেই হাত পাব। তা তারের উপরে একটা ঠ্যাঙা ছিল। এক জোড়া ঘুঘু পিরিত করতে করতে বসলে গিয়ে ঠ্যাঙাতে। ঠিকা গেল তারে তারে। শালা খাঁইচে শক— চিৎপটাং। বলি খিদার জিনিশ ভগবান দেখছেন, মরতে যাব কোন দুঃখে ? তার উপর তুই উপোস করে আছিস বটে।”

উনুন জ্বলে। ঘুঘুর মাংস বসে। গাঁ-সীমায় পৌঁছে বিনে পয়সায় এক বোতল মাল জোগাড় করে সুচাঁদ। পুকুর পাড়ে বসে টানে। তার গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে সুচাঁদের বউ গান ধরে— “ঝিঙ্গালতে কাল্লালতে বাজ লাগলি/ মাইরী বাজ লাগলি/ তোকে লাজ না লাগে লো/ মুচকা হাঁসলি/ মাইরী মুচকা হাঁসলি।”  

এভাবেই এগিয়ে চলে সাধারণ মানুষদের জীবনচর্যা। সার্বিক যন্ত্রণা-সমস্যার ভিতরেও মানুষ বাঁচার খোরাক পেয়ে যায়। মানুষ তো আসলে বাঁচতে চায়। তার জন্য লড়াই চলে সারাক্ষণ। সেই লড়াইয়ের মধ্যেও মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় অন্য এক যাপন। অন্য এক পরশমণি। জীবনটা অন্য রকম হয়ে ওঠে তখন। জীবনের একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। এরই নাম হয়তো জীবনরস। একেই হয়তো আমরা বলি উত্তরণ। একেই বলে জীবনযাপন। এহেন যাপনের রূপকার রামকুমার মুখোপাধ্যায় মানুষের প্রাত্যহিকতা ছেনে বার করেন সেই জীবনরস। এটাই তো লেখকের জীবনদৃষ্টি। এই জীবনদৃষ্টি রামকুমার মুখোপাধ্যায়কে স্বতন্ত্র করেছে।   

ছোটোবেলা থেকে লেখক গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত। পুজোর সময় পালাগান-যাত্রা-নাটকের অভিনয় হত। তিনি লিখছেন— “তুষুগান, বাউল, রামায়ণ, কীর্তন এসব নিয়ে আমার শৈশব এবং কৈশোরের জগৎ। অষ্টম কিংবা চব্বিশ প্রহরের কীর্তনের ধুলোটির যে গ্রাম পরিক্রমা তাতে গোরা হয়ে কতবার ‘নগর ভ্রমণ’ করেছি। কৈশোরের ওই পর্বে, ষাটের দশকে, ভাগচাষী ও কৃষক আন্দোলন দানা বাঁধছে। ক্ষেতে খামারে সংঘর্ষ, পুলিশের আনাগোনা। গোরার ‘নগর ভ্রমণের’ পাশপাশি প্রায় নিত্যদিনের রাজনৈতিক মিছিল। বৈষ্ণবীয় খোল আর মাদল দুটোরই গ্রাম পরিক্রমা চলে। বাদ্যযন্ত্রের বোলের টান এবং কৈশোরের কৌতূহলী আবেগ আমাকে দু মিছিলেই হাঁটিয়েছে”। (১৯৯৩, ভূমিকা, ‘রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের ছোটগল্প’) 
  
বস্তুবাদী এই লেখকের লেখায় কীর্তন-বাউল-কথকতা ইত্যাদি দেশজ সাংস্কৃতিক উপাদান ঘুরেফিরে এসেছে। রূপকথা বা বেতালের গল্পের বহিরঙ্গেও একাধিক গল্প লিখেছেন। এইসব মৌখিক সাহিত্যের আদলের ভিতর দিয়ে লেখক তাঁর নিজস্ব ভাষারীতি তৈরি করতে চেয়েছেন। বিষয়ের সঙ্গে এই দেশজ উপস্থাপনভঙ্গি তাঁর গল্পে অভিনব প্রতিবেশ নির্মাণ করেছে। তবে এই সমস্ত গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে সমসময়। ‘নব রত্নাকরের উপাখ্যান’ (‘দৈনিক বসুমতী’, শারদীয় ১৯৯১) গল্পের নামকরণে উপাখ্যান শব্দের ব্যবহার লক্ষ করবার মতো। এর মধ্যে একটা দেশজতা আছে। লেখক আমাদের দেশজ ভঙ্গিতে দেশজ আখ্যান শুনিয়েছেন। গল্পের শুরুতে লেখক তাঁর পরিচয় দিয়েছেন পাঁচালী-উপাখ্যানের ঢঙে—

“কনক মাতার নাম, পিতা রামাঙ্গ।
বসতি গেলিয়া গ্রাম বাঁকুড়ার অঙ্গ।।
বাস্তুদেবতা গৃহে শ্রীশ্রীসীতারাম।
তাঁহারে স্মরণ করি রামকুমার নাম।। 
সম্প্রতি বাস মোর কলিকাতা নগরে।
একদিন দূত এক, এল মোর দ্বারে।।
বসুমতী সম্পাদক কবি কৃষ্ণ ধর।
তাঁহার আদেশনামা দিল হাতে ’পর।।” 

সম্পাদকের নির্দেশে যে তিনি এই লেখায় হাত দিয়েছেন তাও জানিয়েছেন কাব্য-ভূমিকায়। মূল আখ্যানের সঙ্গে এই ভূমিকার বিষয়ের দিক থেকে প্রত্যক্ষ কোনও যোগাযোগ নেই। কাহিনির কোনও ইঙ্গিতও নেই এখানে। তবুও এইটুকুর প্রয়োজন ছিল বইকি। আধুনিক পাঠককে এভাবেই তিনি নিয়ে গেছেন প্রাগাধুনিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আবহে। রামকুমারের গল্পের এটাই বিশিষ্টতা। এর গদ্যশৈলীও স্বতন্ত্র। তৎসম-বহুল সাধু গদ্যে গল্পটি বর্ণিত।   

আজকের রত্নাকরের কাহিনি শুনিয়েছেন লেখক। রামায়ণের সেই বাল্মীকি লক্ষাধিক বছর পরে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে গিয়ে দ্বিমস্ত বিশিষ্ট একটা ভূর্জ বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এবং “শশী আলোকিত এই নিশীথে বল্মীকগুলি দেখিয়া অকস্মাৎ বাল্মীকি তাঁহার অতীতকে আবিষ্কার করিলেন।” সে প্রসঙ্গও এসেছে গল্পে।

তারপর একজন দস্যু আক্রমণ করে তাঁকে। যদিও হঠাৎ মাথা নামিয়ে নেওয়ায় লাঠির আঘাত থেকে বেঁচে যান তিনি। দস্যুর সঙ্গে কথা বলে জানলেন তার পরিচয়। রত্নাকর তার নাম। পিতা চ্যবন মুনি। সে আরও জানায়, এই নামে বহু দস্যু এসেছে, গিয়েছে। তাদের নামও রত্নাকর ছিল। আদি রত্নাকরের ঐতিহ্য বহন করে নামের এই পরম্পরা। তবে সবার পিতার নাম আলাদা। আদি রত্নাকর আর এই রত্নাকরের নামের মধ্যে কেবল মিল আছে। অঞ্চলের সকলে বলে সাহসে ও বীর্যে আদি রত্নাকরের সঙ্গে তার সাদৃশ্য রয়েছে। 

তারপর সেই একই ঘটনা। বাল্মীকির কথায় রত্নাকর বাড়ি গেল তার পাপের ভাগ কে নেবে জানার জন্য। সঙ্গের লাঠিটা রেখে গেল। অপেক্ষা করতে করতে তিনি ভাবলেন— “কোন পরামর্শ তিনি রত্নাকরকে দান করিবেন। কোন পথে তাহার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যাত্রা করিবে ? রত্নাকরকে আর এক বাল্মীকি করিয়া তুলিতে পারেন, কিন্তু রত্নাকরের বৃদ্ধ মাতা পিতা, পত্নী, কিশোর পুত্রের কী উপায় তিনি করিবেন ? রত্নাকরকে বাল্মীকি করিয়াই বা কী লাভ ? একজন ঋষি কিংবা কবির সংখ্যাবৃদ্ধি মাত্র। সমান্তরাল রত্নাকরের ধারা তো অব্যাহত থাকিবেই। তাহা অপেক্ষা রত্নাকর তাহার নিজস্ব পথ নিজেই খুঁজিয়া লউক। খুঁজিতে খুঁজিতে পথ পাইবে। না পাইলে নতুন পথ তৈয়ারী করিয়া লইবে।” উঠে পড়লেন তিনি। ক্লান্ত বোধ করায় পাশের লাঠিটি তুলে নিলেন। 

রত্নাকর ছুটে এসে মুনিকে খুঁজে পেল না। লাঠিটাও পেল না। রত্নাকর বুঝল মুনিবর আর কখনো আসবে না। তবুও সে কাতর স্বরে ডাকতে লাগল— “মু-নি-ব-র, মু-নি-ব-র।”

আজকের বাল্মীকি মুনি অনেক বাস্তববোধ সম্পন্ন। তাঁরা মুনি তৈরি করতে চান না। আজকের মুনিঋষিরা মনে করেন, অন্যদের পথ দেখিয়ে কাজ নেই, নিজের পথ নিজেই খুঁজুক মানুষ। এভাবেই তো আত্মমুক্তি ঘটবে। এও তো একটা পথের দিশা। লাঠিটি সরিয়ে সেই দিশাই দেখিয়েছেন তিনি। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিজের পথের সন্ধান করতে হয় নিজেকেই। নিজের সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে নিজেকেই। ক্রমশ মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিঃসীম একাকীত্বের মধ্যেও বেঁচে থাকতে হবে, সমুখপানে এগিয়ে যেতে হবে।

রামকুমার সমকালের সঙ্গে শিকড়ের সেতুবন্ধন করেছেন। স্থান-কাল-পাথের ভেদাভেদ রেখা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এভাবে লেখক ধরতে চেয়েছেন সমগ্রকে। লেখকের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি বহু ক্ষেত্রে ম্লান হয়ে গিয়েছে। চরিত্ররা নিজেরাই নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেছেন। তাঁর গল্পের বিন্যাসের মধ্যে রয়েছে মন্তাজধর্মীতা। তাঁর গল্প-নির্মাণ প্রকৃত পক্ষে এক একটি বিনির্মাণ। এক অর্থে তাঁর গল্পগুলি মহাসময় পরিক্রমার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।  

এখানে উল্লেখ করা দরকার তাঁর জোব চার্ণককে নিয়ে লেখা গল্পগুলির কথা। এই ঐতিহাসিক চরিত্রটিকে নিয়ে লেখক অনেকগুলি গল্প লিখেছেন। সব কটি গল্পেই চার্ণক লেখকের বন্ধু। সাহেব বন্ধুর সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডায় এগিয়েছে এই পর্যায়ের গল্পগুলি। স্থান-কাল-পাত্রকে নিজের মতো ব্যবহার করেছেন চমৎকার দক্ষতায়। ‘প্রাণপাখির দেহে ফেরা’ (‘শারদীয়া কৃত্তিবাস মাসিক’, অক্টোবর ২০২০) গল্পের শুরুতে কথক বলেছেন জোবের সঙ্গে কীকরে পরিচয় হল তাঁর। ভোর বেলা কই মাছ ধরতে গিয়ে দ্যাখা তাঁর সঙ্গে। তারপর বন্ধুত্ব। সুতানুটিতে আসার সময় জোবের সঙ্গে তাঁরই প্রথম দ্যাখা হয়েছিল। পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না ইনি কলকাতার আবিষ্কারক জোব চার্নক। পুরনো কলকাতার কথা এসেছে। ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধের জায়গায় তখন সুঁদরি গাছের জঙ্গল ছিল। সুন্দরবনের বাঘ কলকাতায় বিক্রি হত ইত্যাদি। এসেছে ব্রুস বেঙ্গল আর্টিলারির মেজর রবার্ট ব্রুসের কথা। তিনিই প্রথম চা খাইয়েছিলেন মুখুজ্যে আর জোব— দুই বন্ধুকে। তিনি গাছপালার ‘কুষ্ঠি-ঠিকুজি’ খুঁজতেন। “১৮২২ সালে অসমে ঘুরতে গিয়েছিল। ২০২১-এ তার দুশো বছর।” ব্রুসের এই যাত্রার কারণে আমাদের দেশে প্রথম চা আবিষ্কার। তিনসুকিয়ার কাছে শাদিয়ার এক উপজাতি প্রধানের কাছে চা-গাছ সম্পর্কে জানতে পারে। 

দুই বন্ধু দ্বিশত বার্ষিকীতে নদী পথে বেরিয়ে পড়েন। নদী পথে যাত্রার চমৎকার বর্ণনা করেছেন লেখক। পুব-বাংলার বহু জায়গায় কীভাবে আপ্যায়িত হয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গ গল্পের প্রধান আকর্ষণ। যাত্রা পথে একটা কুমিরের দ্যাখা মেলে। কথক এক লাফে কুমিরের ঘাঢ়ের উপর উঠে বসেন। তারপর “কুমিরটাকে ডিঙির নীচে হালকা করে বাঁধা হল। তারপর জোব দাঁড় টানা বন্ধ রেখে ডিঙিতে আরাম করে শুল। শুধু পা দুটো ঝুলিয়ে রাখল ডিঙির সামনের দিকে। কুমিরের মুখের এক হাত আগে সেই জোড়া পা দোলে। সে পায়ে কামড় দিতে কুমির ছোটে আর সে-সঙ্গে পা জোড়াও ছোটে। ব্যস, তিরের গতিতে ডিঙিটা পেরিয়ে গেল চিলমারি, ধুবুড়ি, পাণ্ডু, শিলঘাট আর ডিব্রুগড়ও। চোখ মেলে দেখি পুবের আকাশ লাল আর ডিঙি দাঁড়িয়েছে তিনসুকিয়া জেলার শাদিয়াতে। ঘাটে ডিঙি বেঁধে, কুমিরটাকে একটা পেল্লায় চিতল মাছ খাইয়ে ছেড়ে দিলুম।”

গল্পের শেষদিকে এসেছে করোনার প্রসঙ্গ। চিন থেকে আসা এই উঠকো বিপদের ফলে দলে দলে লোক পালাচ্ছে। তাঁরাও চা নিয়ে বই লেখা মুলতবি রেখে বাড়ি ফেরার কথা ভাবেন। তাঁদের বোট হারিয়ে যাওয়ায় অন্যদের সঙ্গে হাঁটা শুরু করেন। রাস্তায় কথক প্রায় মারা গিয়েছিলেন। তাঁর প্রাণপাখি দেহ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। গুণিন বহু চেষ্টায় ফিরিয়ে এনেছে। শেষ পর্যন্ত জোব নেতা ধোবানির কাছ থেকে কাপট কাচা পাটা নিয়ে নদীতে ভেসে পড়েন। 

এই হল গল্প। এই গল্পের যে কত কত তল। কত কত স্তর। শুধু এই গল্পে নয়, এই পর্যায়ের তাঁর প্রতিটি গল্পে আপাত মজার আড়ালে সমাজ এবং সময় সম্পর্কে গভীর কিছু কথা শুনিয়েছেন লেখক। প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক সময়ের লোকায়ত বিভিন্ন আখ্যানকে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ভাবনার সঙ্গে চমৎকার দক্ষতায় মিশিয়ে দিয়েছেন। সাহেবরা আসার আগেও আমাদের দেশে অন্যভাবে একটা নব জাগরণ হয়েছিল— তার ইঙ্গিত দিয়েছেন লেখক। কখনও-বা প্রাক্‌-ঔপনিবেশিক এবং উপনিবেশিকোত্তর সময়ের মেধা ও সংস্কৃতির দ্বান্দ্বিক স্বরূপটিকে চিহ্নিত করেতে চেয়েছেন।    

সাহিত্য একাদেমির গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের গভীরভাবে পরিচয় রয়েছে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার রচিত বিভিন্ন গল্পের সঙ্গে। দেশের নানান প্রান্তে লোকসমাজে ছড়িয়ে থাকা লোকায়ত আখ্যানের প্রতি বিশেষ আগ্রহ তাঁর। স্মরণীয় তাঁর ‘কথার কথা’ গ্রন্থটির কথা। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোককথা নিয়ে বহু গল্পও লিখেছেন তিনি। যেমন, ‘দা-কাটা’ (‘ভাষাবন্ধন’, শারদ ২০০৭) গল্পটি। এখানে মিজোরামের একটি লোককথা শুনিয়েছেন লেখক। লোককথাটি এরকম— চেমতারতা নামের একজন অসাধারণ দা বানাতে পারত। দূর গাঁ থেকে পাহাড় টপকে মানুষ দা বানাতে আসত তার বাড়ি। কিন্তু একদিন বাজ পড়ে তার দা শান দেওয়ার পাথরটি দু-টুকরো হয়ে যায়। দা বানাতে পারে না সে। লেখক বিস্তারিতভাবে শুনিয়েছেন দায়ের অভাবে কীভাবে অচল হয়ে যায় মানুষের জীবন। সকলে বিভিন্ন রকম পাথর বয়ে আনে। কিন্তু তার কোনওটাই কাজের নয়। শেষ পর্যন্ত চেমতারতার কুকুরটি পাথরের সন্ধান নিয়ে আসে। ভোরবেলা সেখানে গিয়ে দা শানাতে শুরু করে দেয় চেমতারতা। 
সেই ঝোরার গায়ে পাথরের তলায় ছিল গলদা-চিংড়ির পরিবার। চিংড়িটি দেখতে পায় পাথর-চাঁইয়ের উপর একজোড়া ডিমের মতো কী দুলছে। কৌতূহলী হয়ে শুঁড় দিয়ে খোঁচা দেয় সে। চেমতারতা অণ্ডকোষে গলদার খোঁচার যন্ত্রণায় বাঁশের গাছে ঝুলতে থাকে। একসময় বাঁশটি উপড়ে যায়। তার সঙ্গে ছিঁড়ে যায় খায়ুমের গাছ। সে ভেবেছিল বনমোরগ বুঝি বাঁশ গাছ উপড়েছে। একটা ফল দিয়ে মারে মোরগকে। ক্রুদ্ধ মোরগ মাটি খামচায়। মাটির তলায় নিরীহ লালপিঁপড়ের বাসা ছিল। ভেঙে যায়। নিরাশ্রয় পিঁপড়েরা বন-শূকরের গোপন অঙ্গটি আঁকড়ে ধরে। এভাবে চামচিকে, প্যাঁচা, হাতি... সমগ্র জীব জগৎ-প্রকৃতি-পাহাড়, সমগ্র বাস্তুতন্ত্র তছনছ হয়ে যায়। চিংড়িকে ডাকা হয় পঞ্চায়েতে। সে বলে তার জানা ছিল সেখানে হঠাৎ কামার শালা তৈরি হয়েছে। তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। দুটো অণ্ডকোষের জন্য দুরকম শাস্তি। একবার আগুনে পোড়ানো হয়, তারপর জলে।

এই কাহিনি শোনানোর পরে লেখক বলেছেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের আলোচনা সভায় গল্পটি শুনেছিলেন তিনি। কিন্তু এটা গল্প নয়। এই লোক কাহিনি থেকেই প্রকৃত গল্প উঠে এসেছে। এটাই রামকুমারের মুনশিয়ানা। সভাকক্ষের বাইরে চা খেতে খেতে এক বৃদ্ধের সঙ্গে লেখক লোককাহিনিটির মর্মার্থ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি বলেন— “এটাই তো নিয়ম। শিল্পায়ন ছাড়া তো সভ্যতার অগ্রগতি হবে না। আর কলকারখানা তো আকাশে হবে না। জমি, জলা, পাহাড়, উপত্যকাতেই করতে হবে।” বৃদ্ধটি বললেন— “অ, তা হবে। তবে আপনি কলকারখানাটি কাছিমের ঘর, ঢোঁড়ার গর্ত, কাঁকড়ার ভিটেয় করছেন কি না তা তো জানেন না। সেখানেই বিপদ। সেক্ষেত্রে এই গপ্পো থেকে একটি জরুরি শিক্ষা মেলে সেটি হল অণ্ডকোষদুটি সামলে রাখা ভালো। না হলে কখন যে কী হয় কে জানে! কী কাণ্ডটা ঘটল দেখলেন তো!” 

গল্প থেকে গল্প। প্রচলিত গল্পের আধারে মৌলিক একটি গল্প লিখলেন রামকুমার। আর গল্পের ভিতর দিয়ে রাজনীতি-অর্থনীতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশ, শিল্পায়ন-পণ্যায়ন সংক্রান্ত গভীর কিছু বক্তব্যও প্রকাশ করলেন। আর শেষে একটা নিয়ে এলেন সরস ব্যঙ্গ। 

বাংলা হাসির গল্পের ধারাটি ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সরস সাহিত্যের একজন অন্যতম বিশিষ্ট লেখক রামকুমার মুখোপাধ্যায়। তাঁর সরস লেখাগুলিতে রয়েছে ঐতিহ্য, দেশজতা, পুরাণভাবনা, লোকায়ত যাপন। আর সেই সব প্রসঙ্গ এমনভাবে লেখক উপস্থাপন করেন সেখানে হাস্যরসের উদ্ভব ঘটে। 

প্রতিটি মানুষের মধ্যে পরস্পর-বিরোধী কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। এই আপাত স্ববিরোধীতা তাঁর আখ্যানের চরিত্রগুলির মধ্যে দ্যাখা যায়। জীবনের বাঁকে বাঁকে এরকম মানুষদেরই দেখেছেন তিনি। পূর্বে উল্লেখিত ভূমিকায় তিনি এই সম্পর্কে বলেছেন— “তাঁদের নিয়ে কখনোসখনো গল্প লিখি, কারো সঙ্গে আজীবনের বন্ধুত্ব গড়ি। এদের মধ্যে আছে এমন মানুষ যে বাড়ি ছেড়ে, সামাজিক পোশাক ছেড়ে বৈষ্ণব হয়েছে। ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরে, জীবনের খাঁচা থেকে মনকে মুক্ত করার কথা বলে। একই সঙ্গে এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া যাওয়ার মাঝে পঞ্চায়েত কি বিধানসভা নির্বাচনের ভোটটি দিয়ে আসে। পরিচিত মানুষদের মধ্যে আছে সেই আংশিক চাষী এবং আংশিক ওঝা যে বাহাত্তরে জোতদার-ভাগচাষী সংঘর্ষে অংশ নেয়। জোতদারের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেওয়ার কারণে বিষ্ণুপুর জেলে দেড়বছর কাটিয়ে আসে। আছে সেই মুসলমান দম্পতি যারা বেল-কুঁড়চির ধর্মীয় মালা গেঁথে রুজিরোজগার করে, একই সঙ্গে ক্ষেতমজুর আন্দোলনের অংশীদার হয়।” 

এই মানুষেরা, তাঁর গল্পের চরিত্ররা শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি মানুষ হয়ে থাকে না। বৃহত্তর একটা জীবনের ইঙ্গিত দেয়। ‘দুখে কেওড়া’ এবং ‘সম্পাদক মহাশয় করকমলেষু’ সিরিজের আখ্যানগুলি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয়। দুঃখহরণ বা নঙ্গরচন্দ্র নামের এই দরিদ্র-প্রান্তবাসী মানুষ দুটির মুখ দিয়ে লেখক রাষ্ট্র-সমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা গ্রামের মানুষ। কিন্তু তাঁদের বক্তব্যের মধ্যে সমাজসচেতনতার ছাপ চোখে পড়ে। গ্রামের নিগড়ে আটকে থাকে না। সমাজ-রাজনীতির সামগ্রিক সংকটের স্বরূপটিতে আলো ফেলেছেন লেখক। যে স্বরূপ আমাদের মিডিয়া আক্রান্ত চোখে ধরা পড়ে না।             

বাংলার গ্রাম এবং গ্রামীণ অর্থনীতি অঞ্চল ভেদে বদলে বদলে যায়। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক-সংস্কৃতির থেকে বর্ধমান-হুগলীর গ্রামগুলির জীবনসংস্কৃতির বিস্তর ব্যবধান। এই ব্যবধান সম্পর্কে পাঠক-লেখক নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষই সচেতন নয়। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জেলার গ্রাম-মফস্‌সলের নিজস্বতাকে রামকুমার তাঁর লেখায় বারবার তুলে ধরতে চেয়েছেন। দেশের মাটি থেকেই উঠে এসেছে তাঁর গল্প। এখানকার বহু মানুষই এক একটা গল্পের ভাণ্ডার। তাঁর বহুস্বরিক গল্পগুলি ভারতবর্ষের বহুমাত্রিক স্বরূপকে উন্মোচিত করে।

 ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments