জ্বলদর্চি

সোহাগ মাখানো স্মৃতি /সুলতা পাত্র

সোহাগ মাখানো স্মৃতি 

 সুলতা পাত্র

        
সুমিতার বাবা সুদীপবাবু, উলুবেড়িয়া বয়েজ হাই স্কুলের সাইন্সের টিচার ছিলেন। পৈতৃক বাড়ি খড়্গপুর। স্কুল কম্পাউন্ডে থাকতেন, দুই মেয়ে, এক ছেলে,ও স্ত্রীকে নিয়ে। ছেলে উনার স্কুলে পড়াশোনা করতো। মেয়েরা পড়তো গার্লস স্কুলে। 

        সুদীপবাবুর  স্কুলে সরস্বতী পুজোর বিশাল আয়োজন হতো। যেহেতু স্কুল কম্পাউন্ডের মধ্যে থাকতেন,স্কুলের ঠাকুরের মন্ডপে ভাইবোনেরা সকলে মিলে পুষ্পাঞ্জলী দিতো। পুজোর ইনচার্জ থাকতেন তিনি। স্কুলের পুজো মণ্ডপে সুমিতার আলাপ হয় বাবার এক ছাত্রের সাথে।.............. 
        সত্যজিৎ এর যখন ক্লাস ইলেভেন,  সুমিতার ক্লাস নাইন। প্রথম আলাপে সত্যজিৎ জিজ্ঞেস করেছিলো, -'তোমার নাম কি? তুমি কোন স্কুলে পড়ো'? 
         সুমিতা নিজের নাম ও স্কুলের নাম বলার পর সত্যজিৎ বলেছিলো, - 'তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি গান শেখো'। 
         সুমিতা উত্তর দেয়,  'হ্যাঁ শিখি'।  
         - ' তুমি সাইন্স নিয়ে পড়ো নিশ্চয়ই ' ? 
         - ' আমি আর্টস নিয়ে পড়ি,অংকের বই দেখলে আমার কেমন জ্বর- জ্বর লাগে '। 
        - ' সেকি স্যার কত ভালো অংক বোঝান আমাদের,জানো স্যার আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন'। 
        ' তুমি নিশ্চয়ই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে '? 
       সত্যজিৎ জানায় -'দেখা যাক '। 
       সুদীপ বাবুকে পুজোমণ্ডপে দেখতে পেয়ে ওরা কথা বলা বন্ধ করে দেয়।সত্যজিৎ এর বাড়ি স্কুলের কাছাকাছি,বাবা পোস্টমাস্টার। খুব ভাল ছাত্র ছিল প্রতি ক্লাসে ফার্স্ট হতো সত্যজিৎ। 

       স্কুল কম্পাউন্ডে অনেক ছেলে খেলতে আসতো। সত্যজিৎ মাঝে মাঝে ছুটির দিনে খেলতো। আলাপ হবার পর কোয়ার্টার  এর ব্যালকনি থেকে সুমিতা দেখতো সত্যজিৎকে। সত্যজিৎ সেটা বুঝতে পারতো কথা বলার সুযোগ কোথায়?............... 
       দুর্গাপুজোর ঠিক এক মাস আগে সুদীপবাবুর মা গত হন খড়্গপুরের বাড়িতে।  বাবা অনেক বছর আগে পৃথিবী ত্যাগ করেছেন। ছোট ছেলেকে খুব ভালোবাসতেন মা, প্রায় তাই সুদীপবাবুর কাছে এসে থাকতেন তিনি। ছেলে, বৌমা, নাতি, নাতনি, এত বিশাল স্কুল কম্পাউন্ড,ভীষণ প্রিয় ছিল তাঁর। এইবারে বাড়ি যাবার এক মাসের মধ্যে স্ট্রোক হয়। 
       মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে সপরিবারে সুদীপবাবু খড়্গপুরের বাড়িতে যান।কাজকর্ম শেষ হলে ওখান থেকে ফিরে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। হয়তো মেনে নিতে পারেননি মায়ের চলে যাওয়া,স্কুলে যাননি আজ পনেরো দিন। 
       স্কুল কম্পাউন্ডের দারোয়ান নাম বাহাদুর,সে বাজার, ঔষধ, এনে দিতো। সত্যজিৎ সাহস করে একদিন সুদীপবাবুর সাথে দেখা করতে এলে, কাকিমা অর্থাৎ সুমিতার মায়ের কাছ থেকে সব জানতে পারে। 
       সত্যজিৎ পুরো সংসারের দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের কাঁধে। স্যার কত ভালবাসেন  তাকে, স্যারের এই বিপদের দিনে সে পাশে থাকবে না, কে থাকবে তাহলে ? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। 
       বাড়িতে সব শুনে সত্যজিতের মা আপত্তি করেন। মা বলেন, -'তোর পড়াশুনার ক্ষতি হবে খোকা।তোকে যে ডাক্তার হতেই হবে, তুই তো জানিস তোকে আমি বাড়িতে কিছুই করতে দেই না'। 
       বাবা বলেন,-' কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার ও যাক ওকে বারণ করনা। স্যারদের অবদান কি ভোলা যায়? ভগবানকে ডাকো উনি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যান, আমাদের খোকা ঠিক ভাল রেজাল্ট করবে তুমি দেখো'। 
       সত্যজিৎ স্কুল ছুটির পর তার স্যারের বাড়িতে আসে। কাকিমার কাছ থেকে জেনে নেয়,কি ঔষধ, বাজার,আনতে হবে। সুদীপবাবু কে ডাক্তার দেখানোর দায়িত্ব ও  সত্যজিৎ নিয়েছে।সুমিতার একটা ভালোলাগা তৈরি হয়,সত্যজিৎএর কর্তব্যপরায়ণতা, পড়াশুনাতে একনিষ্ঠতা দেখে।সেই ভালোলাগা ভালোবাসা তে পরিণত হয় একদিন,কিন্তু মুখ ফুটিয়ে কোনদিন বলতে পারেনি সত্যজিৎ কে। সুদীপবাবু আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠছেন,সামনের সপ্তাহে স্কুলে জয়েন করবেন। 
       সত্যজিৎ সুমিতার বাড়িতে যখন আসে, কাকিমা টিফিন না খাইয়ে ছাড়ে না। সুমিতার বাবা তার প্রিয় ছাত্রকে একদিন ডেকে বলেন,-'তুমি ছিলে বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম বাবা। আমার ছেলে মেয়েরা সবাই ছোট, আমার বিপদে তুমি যা করেছ, তোমার কাছে তোমার বাবা-মায়ের কাছে আমি চির ঋণী হয়ে রইলাম'। 
       সত্যজিৎ মাথা নীচু করে বলে,-'ও কথা বলবেন না স্যার, আপনি আশীর্বাদ করুন আমি যেন প্রথমে একজন ভালো মানুষ হতে পারি '। 
       -' আমি সর্বান্তকরণে আশীর্বাদ করি বাবা তুমি সর্বক্ষেত্রে জয়ী হও।  সুখী হও, তোমার পড়াশোনার প্রতি খেয়াল রেখো। যদি কখনো অংক বুঝতে অসুবিধা হয় তাহলে ক্লাস ছুটির পরে আমাকে বলো আমি দেখিয়ে দেব'।..................... 
       ধৈর্য থাকলে জীবনে চলার পথ অনেক সহজ হয়।  আর ভালোবাসা থাকলে বিশ্বকে জয় করা যায়। 
       ক্লাস টুয়েলভ এর ফাইনাল পরীক্ষাতে সত্যজিৎ স্টার, এবং  জয়েন্ট এর রেজাল্টে ডাক্তারিতে চান্স পেয়েছে।খুশির খবর দিতে সুদীপ বাবুর বাড়িতে আসে।  কাকিমাকে এবং স্যারকে প্রণাম করে জানায় সব কথা। 
       সুদীপবাবু বলেন,- 'তুমি তো বাবা আমাদের স্কুল ছেড়ে চলে যাবে,এই স্কুলকে কিন্তু ভুলে যেও না।মাঝে মাঝে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে এসো, তোমরাই তো আমাদের স্কুলের গর্ব '।
      -'নিশ্চয়ই আসব স্যার'। 
      কাকিমা ও স্যারকে প্রণাম করার পর, বাড়ি যাবার সময় সত্যজিৎ দেখে, সুমিতা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। 
      সত্যজিৎ বলে, - 'মন দিয়ে পড়াশোনা করো। আজ রাতে ফোন করবে, ল্যান্ডফোন তো তোমাদের ড্রইংরুমে থাকে, অনেক কথা আছে'। 
      রাতে সকলে ঘুমিয়ে গেলে সুমিতা ফোন করে।  সত্যজিৎ এতদিন পর বলে, -'আমি তোমাকে ভালোবাসি সুমিতা।পড়ার জন্য আমাকে কোলকাতা যেতে হবে। বাড়ি এলেই স্যারের কাছে আসবো, তখন দেখা হবে। মাঝে মাঝে হোস্টেলের ল্যান্ডফোনে কথা বলো,তুমি কিন্তু মন দিয়ে পড়াশোনা করবে কেমন'? 
      সুমিতা তার সত্যজিৎ এর কাছে জানতে চেয়েছিলো, - 'ভুলে যাবে নাতো আমায়'? 
      সত্যজিৎ উত্তরে জানিয়েছিলো,-'যতদিন নিঃশ্বাস চলবে,এক অন্তহীন ভাবে তুমিও থাকবে আমার মনে'। 
      কেউ যদি মন থেকে কিছু চায়,  সে জয়ী হয়। মহাবিশ্ব তাকে সাহায্য করার জন্যে সবসময় প্রস্তুত। কেটে গেছে অনেকগুলো বছর,সত্যজিৎ আমেরিকা থেকে এফ.আর.সি.এস.করেছে। সে এখন নামি একটি নার্সিংহোমে হার্ট সার্জেন।সুমিতা একটি কলেজের প্রফেসার। 

      কেউ ভুলে যায়নি কাউকে,আজ তারা সুখী দম্পতি।  একটি মিষ্টি মেয়ে আছে ওদের। সুদীপবাবু কল্পনাও করতে পারেননি, তার প্রিয় ছাত্র একদিন বাড়ির জামাই হবে। এখনো রিটায়ার করেননি তিনি। ছেলেমেয়েরা সকলে ওয়েল এস্টাব্লিশড। শত ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতিবছর বাবার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে,একমাত্র মেয়ে ও সত্যজিৎকে নিয়ে সুমিতা বাবা- মায়ের পাশে বসে অনুষ্ঠান দেখে। স্মৃতিগুলো আজও রাখা আছে হৃদয়ের ক্যানভাসে, যদিও সেই দিন গুলো আর ফিরে আসবেনা। 

      ভালোবাসার আরেক নাম পদ্ম পাতায় জল।  সহজ নয় ধরে রাখা, এই সুন্দর সম্পর্ক গুলোকে। ওদের জীবনে স্বপ্নগুলো যেন চলে না যায়, সুখের যে পরশ পেয়েছে, তা যেন মুছে না যায়। আমরা সকলে কামনা করি ঈশ্বরের কাছে ওরা যেন সুখী হয়।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments