জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৪৩/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

  পর্ব ৪৩

হোটেল থেকে ফিরে শাড়ি ছেড়ে সবে চুল শুকোতে বসেছি, দরজায় কে যেন নক করছে। খুলে দেখি বনি, ও নিচে গল্প করছিল, এখন কিছুতেই রুম নাম্বার মনে করতে পারছে না। তিন নাম্বার রুমে নক করেছিল, কেউ খলেনি। খান সাহেব বললেন, ওদের রুম নাম্বার পাঁচ।  তবুও উনি তমালকে ফোন করলেন। বনি তারপরেও আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে গেল। মেয়েটা গল্প করতে ভীষণ ভালবাসে। চুল শুকিয়ে, আগামী কালের ড্রেস বের করে রাখলাম। ক্যামেরা, ফোন চার্জে বসিয়ে যখন বিছানায় যাব, তখন জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে  দেখি এখনো পুরোপুরি অন্ধকার নামেনি। বহুদুরে পাহাড়ের মাথার ওপর একটা হেলিকপ্টার পাক খাচ্ছে। 

      সকালে ওনার ডাকে ঘুম ভাঙ্গতে উঠে দেখি, ওনার স্নান, চা-পান সব হয়ে গেছে। আমিও সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চা নিয়ে বসলাম। ঘড়ি দেখে জানলাম, এখন সময় ৫টা তিরিশ। তার মানে উনি ভুল দেখেছেন। কারণ আমাকে বলছিলেন ৬টা বেজে গেছে। যাক, ভালই হয়েছে, সময় নিয়ে তৈরি হওয়া যাবে।  আজকের জন্য কালো বালুচরি বের করে রেখেছি। কিছুক্ষণ পরে শাড়ি পরে রেডি হলাম। যদি বেশি ঠাণ্ডা হয়? তাই অফ হোয়াইট জ্যাকেটটা ব্যাগে নিলাম। ৭টার 
সময় তমালদের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করলাম, দরজা খুলল না। ফিরে  এসে দেখি, খান সাহেব রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী  হল?- আর বোলনা তুমি ঠিক যাচ্ছ কিনা দেখার জন্য বেরিয়ে ছিলাম, দরজা অটমেটিক লক হয়ে গেছে। চাবি তো ভিতরে! কি আর করা যাবে? নিচে এসে রিসেপ্সনে থাকা মেয়েটিকে চাবির কথা বললাম। ব্রেকফাস্ট কোথায় হচ্ছে তাও জানতে চাইলাম। মেয়েটি কোনদিকে রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে দিয়ে বলল, আপনারা ব্রেকফাস্ট করে আসুন, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে রুম খুলে দেওয়া হবে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমাদের কাউকে দেখতে পেলাম না। কয়েকটি জাপানি মেয়ে  ছিটিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে। আর দুটি  এশিয়ান মেয়ে রয়েছে, ভারতীয়ও হতে পারে।  আমাকে টোস্টারে রুটি দিতে দেখে, একটি মেয়ে বলল, অন্য খাবার নিয়ে তেবিলে গিয়ে বসুন। আমরা কিছু কেক, ডিম,মধু, বাটার ও ফলের রস নিয়ে টেবিলে  বসলাম। মেয়েটি আমাদের রুটি টোস্ট করে দিয়ে গেল। এখনও আমাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। মেয়েটি আবার এসে জিজ্ঞেস করল আমরা কী নেব? চা না কফি? কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটা কী? উনি তমালকে ফোন করলেন। তমাল জানাল আজ ৯টার  সময় চেক আউট। গতকাল নাকি বাসে বলে দেওয়া হয়েছিল। আমরা আবার ওপরে গিয়ে দেখি, একটি মেয়ে চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চাবি খুলে দিতে আমরা আবার নিচে এলাম। হাতে অনেক সময়, তাই এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। প্রথমে স্টেশনে ঢুকলাম, তারপর ফুটপাত ধরে হাঁটলাম কিছুটা। সাড়ে আটটায় হোটেলে ফিরে ব্যাগ, স্যুটকেশ নিয়ে রিসেপ্সনে এসে বসলাম। ঠিক ৯টায় বাসের সীটে বসে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, সপিং সেন্টার খুলেছে। তখনও সবাই বাসে ওঠেনি। আমার খুব ইচ্ছে করছিল নেমে গিয়ে কিছু একটা কিনে নিয়ে আসতে। কিন্তু রাস্তা ক্রস করতে হবে বলে খান সাহেব নামতে দিলেন না। আসলে  সব জায়গা থেকেই কিছু না কিছু কিনেছি, এখানেই কিছু কেনা হল না। তাই মুখ ভার করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। আরও মিনিট কুড়ি পরে বাস রওনা দিল।
      শহরের মধ্যে ছবি তোলার মত অনেককিছু থাকলেও ক্যামেরা বন্দি করা যাচ্ছে না। শহর ছাড়িয়ে বাস ছুটে চলেছে প্রকৃতির কোলে। কোথাও সবুজ প্রান্তরে সাদা ভেড়ার পাল চরছে। কোথাও সবুজ জঙ্গল। কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণার জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করা গেলেও বেশিরভাগই ক্যামেরা অন করার আগেই সরে যাচ্ছে। সাড়ে এগারোটার দিকে বাস এসে দাঁড়ালো যেখানে, তার নাম পটলিচেরি। গাইড বললেন, আখানে সস্তায় উল পাওয়া যায়। উলের পোশাকও পাওয়া যায়। আমাদের দেড়ঘণ্টা মত সময় দেওয়া হল।এখানেই লাঞ্চ  সেরে নিতে হবে। একমাত্র এখানেই দেখছি টয়লেট যেতে হলে ৩০ পেনি দিতে হচ্ছে। আমরা দুজনে একটা সপিং কমপ্লেক্সে ঢুকলাম, কিন্তু জিনিসের দাম খুব বেশি। একটা পুতুল দেখে খুব পছন্দ হয়েছিল। লাল-সাদা-সবুজ চেক স্কারট, দুই বিনুনি করা চুল। কিন্তু পুতুলটা কেমন নোংরা মনে হল, তাই নিলাম না। ওখান থেকে বেরিয়ে পাশের টাতে ঢুকব ভাবছি, বনি দূর থেকে ডাক দিল, কাছে যেতে বলল, কাকিমা এখানে একটা নদী ও একটা ড্যাম আছে। বেশি দূরে নয়, চলুন দেখে আসি। যাচ্ছিলাম, কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। তমালও সোয়েটার পরেনি। আমরা দুজন বাস থেকে ড্রেস নিতে এলাম। সাদা জ্যাকেট পরে আমি তমাল যখন ওদের কাছে ফিরছি, বনি দূর থেকে দেখেই আমাদের দাঁড়াতে বলে ছবি তুলল। কাছে যেতে বনি বলল, কাকিমা তোমার জ্যাকেটটা খুব সুন্দর। আমি পরে ছবি তুলব। তারপর জিজ্ঞেস করল  কোথায় কিনেছি? কত দাম?
      যাইহোক, আমরা ৫জন হাঁটতে শুরু করলাম। একজন স্থানীয় ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, আমরা এগিয়ে চলে এসেছি, ওনার সঙ্গে ব্যাক করে একটা  ঢালু রাস্তা দিয়ে নামতে লাগলাম। ডানদিকে একটা রেস্টুরেন্ট, তার সঙ্গে বাচ্চাদের মজার কিছু রাইড রয়েছে। কিছুটা এগিয়ে আরও একটা রেস্টুরেন্ট দেখতে পাচ্ছি।আরও কিছুটা নামার পর ডানদিকে একটা রাস্তা পেলাম এই রাস্তার ডানদিকে একটা লেক দেখা যাচ্ছে। আমরা জলের কাছে যাওয়ার জন্য কিছুটা ঢাল বেয়ে ঘাসবনের ওপর দিয়ে লেকের জলের কাছে গেলাম। সামান্য উঁচু পাড়ে একটা নাম না জানা গাছ, আর জলের ধারে কয়েকটা পাথর দেখে গ্রামের পুকুরপাড় মনে পড়ে গেল। মনে হল, কোনো গ্রাম্যবধূ এইমাত্র স্নান সেরে কলসিতে জল ভরে ঘরে ফিরে গেছে। হঠাৎ দেখি নোংরা ছেঁড়া ড্রেস পরা, ছেড়া ছাতা মাথায় একটা রোগা লোক লেকের পাড়ের জঙ্গলে ঢুকে গেল। মুখটা দেখতে পেলাম না। আমরা আবার রাস্তায় উঠে এলাম। আরও কিছুটা গিয়ে নদী আর ড্যামের দেখা পেলাম। নদীর বাঁধের ওপর চড়ে কিছুটা টানেলের মধ্যে দিয়ে ওপারে গেলাম। একদিকে নদীর স্রোত ক্ষীণ। আর একদিকে বাঁধের সাহায্যে জলটা বেঁধে রাখা হয়েছে।তাই বাঁধের একদিকে নদীর স্রোত ক্ষীণ। অপর দিকে নদী বেশ প্রসস্থ, জলও গভীর। এখানে  মাছ ধরার ‘ফিস ল্যাডার’ রয়েছে। আমরা ছাড়া ২/৩ জন সাহেবকে দেখছি। খুব নির্জন, খান সাহেব বললেন, এখানে দেরি করা ঠিক হবে না। আমরা কাউকে বলে আসিনি, খুঁজতে পারে। তাই ফেরার পথ ধরলাম। বনি এক জায়গায় আমার জ্যাকেট পরে ছবি তুলল। ১০ মিনিট আগেই আমরা বাসের কাছে পৌঁছালাম। গাইড বুক থেকে জানলাম এই নদীটির নাম ‘টুমেল’। লেকের নাম ‘ফ্যাসকলি’।

      এখন আমরা এডিনবারা ক্যাসেল দেখতে চলেছি। এডিনবারা স্কটল্যান্ডের রাজধানী। দুপুর প্রায় দুটোর দিকে  আমারা এডিনবারার ফোরথ রিভার(Forth River)ক্রস করলাম। আমি যে দিকে বসে ছিলাম, তার বিপরীত দিকে এডিনবারার দর্শনীয় ফোরথ রেলব্রিজ দেখা যাচ্ছিল। সবাই ছুটন্ত বাস থেকে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। আমি তখন আমার পেছনের গ্লাস দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। ভাল ছবি উঠল। রোড ব্রিজের ও ছবি তুললাম। এটা আরো ভাল ছবি হল। আড়াইটার সময় বাস এসে দাঁড়াল এডিন বারা ক্যাসেলের সামনে। আমাদের নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বাস নিয়ে চলে গেলেন কার পার্কে। গাইড আমাদের দাঁড়াতে বলে গাইড টিকিট কাটতে গেলেন।(ক্রমশ)

ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments