স্বপ্নের গ্রাম ‘খোয়াবগাঁ’
অর্ণব মিত্র
দিনমজুরির অবসরে ছবি আঁকেন আহির , গোবিন্দ, ভূপতিরা । জঙ্গলে পড়ে থাকা শুকনো গাছের শিকড় -বাকড় দিয়ে বানিয়ে ফেলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত ছোট আকৃতির ‘কুটুম- কাটাম’ শিল্পকর্ম। তাঁদের সন্তানরাও মাটির বাড়ির দেওয়ালে আঁকে ফুল , লতাপাতা ও বিভিন্ন নকশা । যার ফলে গত তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ঝাড়গ্রাম জেলায় শিল্পরসিক ও পর্যটকদের জন্য একটি নতুন ঠিকানা হয়েছে এবং সেটি হল হাতে আঁকা দেওয়াল -চিত্রে ভরা ‘একটি স্বপ্নের গ্রাম’ বা ‘খোয়াবগাঁ’। আর এই স্বপ্নের গ্রামের রুপকার হলেন শিল্পী মৃণাল মণ্ডল।
১
খেটে খাওয়া লোধা জনজাতির বাসিন্দারা বছর তিনেক আগেও সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন। জঙ্গলের ডাল পাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করে ,নয়তো খেতমজুর বা দিনমজুরের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেঁটে এক একদিন চালাতে হত । প্রতিবছর মরশুমে ভিন জেলায় ‘নামাল’ বা খেতমজুরি খাটতে যেতে হত । তাদের দিন- আনি দিন -খাই-এর সংসারে লড়াইটা ছিল খিদের সঙ্গে। সেই রুক্ষ ও অনিশ্চয়তায় ভরা হাতগুলিই এখন বাড়ির দেওয়ালে ছবি আঁকে মনের খিদে মেটাতে। তাদের এই শিল্প-কাজ দেখতে আসেন অন্য জেলার বা কলকাতার মানুষেরা। লোধা -শবর জনজাতির জীবনযাত্রার পালাবদলে জড়িয়ে রয়েছে শিল্পী মৃণাল মণ্ডল-এর তৈরি কলকাতার ‘ চালচিত্র অ্যাকাডেমি’। ‘খোয়াবগাঁ’ এখন স্বপ্ন সফল হওয়ার গ্রাম। আর তাই গ্রাম বদলের কাজে চালচিত্র অ্যাকাডেমির পাশে দাঁড়িয়েছেন দেশ- বিদেশের শিল্পীরা ও শিল্প -উৎসাহীরা।
২
ছোট্য গ্রামটির আসল নাম লালবাজার। ঝাড়গ্রাম শহরের থেকে তিন কিলোমিটার মত গেলে সরু মেঠো পথে শাল, সেগুনে ঘেরা বনপথে কিছুটা গেলেই চোখে পড়বে মাটির দেওয়ালে আঁকা মনোমুগ্ধকর সব ছবি। লোধা মানুষদের তুলির ছোঁয়ায় সেজে ওঠা এই দেওয়াল- চিত্রের টানে আসেন শিল্পরসিকেরা। পর্যটকদের কাছেও এখন অন্যতম এই স্বপ্নের গ্রাম ‘খোয়াবগাঁ’।
গ্রামের পরিবারগুলি মূলত লোধা ও কুরমি পরিবার। অন্যের জমিতে খেতমজুরি , দিনমজুরি বা রাজমিস্ত্রির কাজ করে যারা সংসার চালাতেন সেই মকর আহির, পিন্টু মল্লিক এখন ছবি আঁকেন। জঙ্গলের শুকনো ডাল,শিকড় সংগ্রহ করে এনে ’কুটুম- কাটাম’ তৈরি করেন। গ্রামের কচিকাঁচারাও ছবি আঁকার পাশাপশি,মাটির পুতুল বানায়।
৩
শিল্পী মৃণাল মণ্ডলের জন্ম ১৯৭৭ সালে ঝাড়গ্রাম জেলায় । উচ্চ- মাধ্যমিক অবধি পড়াশুনা এই জেলাতেই । ছোট থেকেই তাঁর ছিল ছবি আঁকার শখ । তাই তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে এসে ভর্তি হন ও এই কলেজ থেকে চিত্রকলা নিয়ে সফল্ভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন ২০০২ সালে । এরপর কলকাতাতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে শিল্পের প্রসারের জন্য উদ্যোগী হন ও তৈরি করেন ‘চালচিত্র অ্যাকাডেমি’। তবে তিনি বর্তমানে কলকাতায় বসবাস করলেও নিজের গ্রাম ও জেলার মানুষকে ভোলেননি।
৪
জঙ্গল লাগোয়া গ্রামে বসবাসকারী মানুষগুলো শিল্পী হয়ে উঠলেন কি ভাবে ?
শিল্পী মৃণাল মণ্ডল মনে করিয়ে দিচ্ছেন লোধা জনজাতির ইতিহাস প্রাচীন। হয়ত ওঁদের কোনো পূর্বপুরুষ আদিম যুগে গুহাচিত্র এঁকে থাকবেন। সহজাত ভাব ও ভাবনা না –থাকলে মাত্র দু-বছরে শিল্পকলায় এ ভাবে হাত পাকিয়ে ফেলাটা সহজ নয়। আসলে তাদের ছবি আঁকা শিখিয়েছেন ‘মৃণাল মাস্টার’। এরফলে তাঁদের রোজকার জীবনেও এসেছে পরিবর্তন। গ্রাম পরিছন্ন রাখেন বাসিন্দারা। গ্রামের খুদেরা পড়াশুনা ও খেলার ফাঁকে দেওয়ালে ও দরজায় ছবি এঁকে ভরিয়ে দেয়। পর্যটকরা গ্রামে এসে কিনে নিয়ে যান লোধা শিল্পীদের তৈরি ‘কুটুম- কাটাম’ শিল্পকর্ম ,মাটির পুতুল ও ছবি । এক সময়ে যে জঙ্গলের মানুষেরা বনজ সম্পদ বিক্রি করে সংসার চালাতেন, এখন তাঁরাই জঙ্গল রক্ষা করেন। দিনমজুরি আর শিল্পচর্চায় মেতে রয়েছেন গ্রামবাসী। চালচিত্র অ্যাকাডেমির উদ্যোগে গ্রামে নানা মরশুমি ফল ও ছায়াদান কারী গাছ লাগিয়ে পরিচর্যা করা হচ্ছে।
ছোট্ট গ্রাম লালবাজারে বসতি গড়ে ওঠার এক ইতিহাস আছে। ঝাড়গ্রামের মল্লদেব রাজাদের চাষের জমি ছিল অর্জুন ডহর, রাজবাধ ও মধুপুর মৌজায়। রাজাদের জমিতে খেতমজুরি করতে এসেছিলেন শবর পরিবারের লোকেরা। পরে রাজপরিবারের তরফে থাকার ঘর দেওয়া হয়। এভাবেই খেতমজুরের কাজে আসা লোধারা রাজার অনুগ্রহে এলাকায় থিতু হয়ে থেকে যান। এভাবেই ১২ টি লোধা পরিবার লালবাজার গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছেন।
গ্রামের ষষ্টিচরণ আহির সেবায়তন স্কুলের ক্লাসের খাতায় কিছু এঁকেছিলেন। তাই দেখে সেবায়তন স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক তাপস খান তাঁদের গ্রাম লালবাজারে আসেন। এসে পরিচিত হন শবর পরিবার গুলোর সাথে। ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ শিক্ষক তাপস খানের মাধ্যমে শিল্পী মৃণাল মণ্ডল এই গ্রামে আসেন।
এমনই একটা গ্রাম খুঁজছিলেন শিল্পী মৃণাল মণ্ডল যেখানে শিল্পচর্চার পরিবেশ তৈরি করে গ্রামের মানুষের জীবনে আর্থ- সামাজিক পরিবর্তন আনা যায় । মৃণাল মণ্ডল গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে দিনরাত কাটিয়ে তাদের বোঝান যে শিল্প দিয়েও জীবনযাত্রার হাল ফেরানো যায়। তার জন্য কয়েকটি বাড়ির দেওয়ালে প্রথমে ছবি আঁকা হয়। বিবর্ণ মাটির বাড়ির দেওয়ালে রঙ দিয়ে আঁকা ছবি বদলে দিতে থাকে শহর থেকে দূরে একান্ত একটি গ্রামের বাহ্যিক চেহারা। বিভিন্ন সহজ লৌকিক শিল্পকলার রুপ ও আকার - আকৃতি রঙের ও রখার সাহায্যে আঁকা হয় দেওয়ালে । পশু , পাখি , গাছ , লতাপাতা, নকশা ও আলপনা দিয়ে ভরানো হয় বিভিন্ন জায়গা।
গ্রামের শিশু, কিশোর- কিশোরীদের ছবি আঁকা শেখানোর জন্য শুরু হোল ক্লাস সপ্তাহে একদিন করে।
৫
এখন এই শহরায়নের যুগে শিল্পেরও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার । মানুষের সমস্ত সাংস্কৃতিক কাজ একটি শহর কেন্দ্রিক কেন হবে !। ইউরোপ ও আমেরিকার ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দেখা যায় শিল্পীরা মুক্ত জায়গায় ‘গ্রাফিটি’ বা দেওয়ালচিত্র আঁকছেন । ইন্টারনেট –এঁর মাধ্যমে এইসব কাজের স্থিরচিত্র ও ভিডিও আমরা দেখেছি। কিন্তু ভারত ও ভারত সংলগ্ন এশিয়ার অন্য দেশগুলিতে এই ধরণের কাজ চোখে পড়ে না। তাই শিল্পী মৃণাল মণ্ডলের এই প্রচেষ্টা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, আমাদের দেশে এক নতুন উদাহরণ তৈরি করবে। আগামী দিনে শিল্পী মৃণাল মণ্ডলের দেখানো পথে শৈল্পিক কর্মকাণ্ড শুধু কলকাতা নয় , গ্রাম - গঞ্জের মানুষের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে এই আশা ও উৎসাহের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামবাংলা ও শহরতলির পথে , বাড়ির দেওয়ালে আমরা আরও এরকম ‘‘খোয়াবগাঁ’ দেখতে পাব । এই স্বপ্ন দেখানোর জন্য আমরা ঋণী শিল্পী মৃণাল মণ্ডলের কাছে।
তথ্যসূত্র – আনন্দবাজার পত্রিকা , সাক্ষ্যাৎকার –শিল্পী মৃণাল মণ্ডল।
1 Comments
salute to Mrinal Mondal
ReplyDelete