জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১০৩

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ১০৩ 

সম্পাদকীয়,
আব্দুল আঙ্কেলের তোলা ছবির লক্ষ্মীছানা তিনটি পদ্মপুকুর থেকে পদ্ম তুলে এনে এক গাল হেসে বলছে, এসো মা লক্ষ্মী। কারণ আজ কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো যে। 'কো -জাগরী... কে আছো জেগে? কে আছো অন্ধ চেতনার বন্ধ দুয়ার খুলে অপেক্ষায়?' - এই বাক্য দুটি জয়তী আন্টির লেখা। হ্যাঁ গো জয়তী আন্টি এবারের তোমাদের জন্য সুপারম্যানের গল্প বলেছেন। কে সেই সুপারম্যান জানতে হলে পড়ে নাও গল্পটি। তবে শোনো, প্রচ্ছদের তিনজনকে লক্ষ্মীছানা বলেছি বলেই যে সব ছানারাই লক্ষ্মী হয়, তা কিন্তু একদমই নয়। পুটুং, ডোডো, গোল্ডী এরা কিন্তু দুষ্টুছানা। এরা কারা? সে তো সৌমী আন্টি বলবে। শুধু কী ওরা? বুবলাইও তো কম দুষ্টু নয়। বুবলাই কে চেনো তো? ঐ যে, যে নতুন হাফ প্যাডেল সাইকেল চালাতে শিখেছে। তাতে কী হল? বলব না। আর বললে অমিতাভ আঙ্কেল আমাকে বকবে। তোমরা কি জানো, কেউ কেউ দুষ্টু আর কেউ কেউ লক্ষ্মী হয় কেন? আমিও জানিনা। ভাবছি মুক্তি জেঠুকে জিজ্ঞেস করব। মুক্তি জেঠুই তো বলেছেন, আমাদের বুদ্ধি কম বেশি হয় কেন তার গল্প। বুদ্ধি যাদের বেশি তারা আবার গোয়েন্দা হয়। নিউটন, প্রোটনের মতো গোয়েন্দা। নিউটন-প্রোটন কে তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। তপশ্রী আন্টির থ্রিলার উপন্যাসের দৌলতে, ওরা এতদিনে আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে, তাই না? আজ তোমরা শুধু যে লক্ষ্মী ছানা আর দুষ্টু ছানাদের গল্প শুনেই ঘুমিয়ে পরবে তা কিন্তু ভেবো না। আজ সুকুমার জেঠু তোমাদের রাঙীর দুই ছানা জকি আর রকির গল্প বলে তাঁর উপন্যাস শেষ করবেন। আর রাখী পিসিমণি ভিজে মেঘ ছানাদের ছড়া শোনাবে। কি মজার না? মজা আরো বেড়ে যাবে, যখন ভজন আঙ্কেলের ছড়ার একটার পর একটা খেলার নাম জানতে পারবে। তবে এটা জেনে রেখো, মজার আর এক ভাই কিন্তু দুখু। সেই দুখু নামে লোকটার কথা জানতে বিপ্লব জেঠুর ছড়া পড়ে নিও। দুখুর কথা শুনে মিমির মতো চোখ জলে ভরে গেলে তৃষ্ণা আন্টির আর  তথাগত দাদার ছড়া পড়তে ভুলো না। মিমি কে? ঐ যে যার মা পরী হয়ে গেছে। মানসী আন্টি সেই মিমির গল্প বলেছে তো। তবে যে মিমি পরীর ডানায় চেপে আকাশে ঘুরতে গেছে সেই মিমি কিন্তু আলাদা সর্বাণী পিসিমণির গল্পের ম্যাও মিমির থেকে। কি মজা না, মানুষের নামও মিমি আবার বেড়ালের নামও মিমি? মিমি বেড়াতে গেছে শুনে তোমাদেরও খুব ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাইনা? তাই তো মলয় জেঠু বিশ্বের বিষ্ময় দেখার গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। ছবিও দিয়েছেন সেখানকার। এবারের ছোটোবেলায় প্রতিবারের মতো ইলোরা মাসিমণি একটি ছবি এঁকে তোমাদের উপহার দিয়েছে।লক্ষ্মী ছানারা, লক্ষ্মী ঠাকুরের পেসাদ খেয়েই পড়তে বসে যাও, আর অন্য বন্ধুদেরও পড়ে শোনাও মজার মজার এই সব গল্প ছড়া আর ভ্রমণের কথা। আমার কথা কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। শুরু করেছিলাম, আব্দুল আঙ্কেলের তোলা ছবির তিন লক্ষ্মীছানার কথা দিয়ে শেষ করব, নন্দিনী, শুভশ্রী আর সপ্তর্ষির মতো আরো তিন লক্ষ্মীছানার আঁকার কথা বলে। ওরা আমাদের ছোটোবেলাকে রঙীন করে দিয়েছে বলে আজকের প্রচ্ছদের তিনটি পদ্ম ওদের জন্য পাঠালাম। কি খুশি তো? - মৌসুমী ঘোষ।


সুপারম্যান ভীমসেন

জয়তী রায়


রায়বাড়িতে আড্ডা জমে প্রায়ই। ফ্ল্যাট কালচারের এমন রম রম বাজারেও , রায়কর্তার আছে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। একতলার রান্না আর বসার ঘর বাদে দোতলার শোবার ঘরের লাগোয়া লাল সিমেন্টের টানা বারান্দায় বসে আড্ডা। 
বাড়ির সদস্য সংখ্যায় সাত। রিটায়ার রায় বাবু । বয়স সত্তর। বড় পুত্র সমরেশ। বৌমা অদিতি। তাদের একমাত্র পুত্র রিক। পড়ে ক্লাস ফাইভে। ছোট পুত্র অমিত। আইটি সেক্টরে কাজ করে। ব্যাচলার। আর সবসময়ের কাজের মাসী মিনতি।
  শুক্কুরবার এই সব আড্ডায় রিকের দু তিন জন বন্ধু এসে 
    পড়ে। আশে পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। এক সঙ্গে এক স্কুলের সহপাঠী বলে বাবা মাও নিশ্চিন্ত। টুম্পা জয় তিন্নি ---এদের সবার বাবা মার ধারণা, রায়বাবুর বাড়ি এলে  বাচ্চাগুলো একটু ভালো গল্প শুনবে! না হলে, শুক্রবার এলেই, এদের মোবাইল গেম খেলা ভীষণ বেড়ে যায়! 
   টুম্পা র মা , মৌমিতা আফসোস করে বলে---অদিতি, তোমার দ্যাওর এত ভালো গল্প বলে, যে আমাদের বাচ্চারা ওই গেম গুলো খেলতে চায় না! 
তিন্নির মা রিঞ্জিনি, একমাত্র মেয়ের বাংলা জ্ঞান নিয়ে খুব শঙ্কিত। বাংলা শিখছে না। সে কাতর গলায় বলে ---
 অদিতি। তোমাদের বাড়ির বাংলা গল্প শুনে শুনে আমার তিন্নি এখন বাংলায় ভালো নম্বর পায়।
        প্রায় প্রতি শুক্রবার তাই আড্ডার আসর জমে ওঠে। 
অদিতি আর মিনতি মিলে চা, চপ, মুড়ি মাখা সাপ্লাই দিতে থাকে। অমিত ওরফে বাচ্চাদের প্রিয় ছোটকা, হল আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু। অমিত নিজেও বাচ্চাগুলোকে ভালোবাসে। এদের শৈশব যন্ত্র দানবের হাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য সে উদ্যোগী হয়ে গল্পের ঝুলি নিয়ে বসে। এক এক শুক্কুরবার এক এক প্রাচীন কালের কাহিনী। শুরুতে  শুনতে না চাইলেও ধীরে ধীরে গল্পের মায়াজালে পড়ে যায়। তর্ক করে, অন্য গল্প শুনতে চায় কিন্তু কেমন করে যেন পথ হারিয়ে আবার ঢুকে যায় মহাভারতের গল্পের অরণ্যে। 

সে যাই হোক,  চপে কামড় দিয়ে ছোটকার মুখে নেমে এল স্বর্গীয় আভা। চোখ বুজে বললে--আহা! এমন সুখাদ্য ভীমসেন পেলে আর রক্ষে থাকত না। 

----ভীমসেন? মানে সেই মহাভারতের? ছোটকা! প্লীজ। পুরোনো গল্প করো না।’ জয় কাতর গলায় বলল। 
___ছোটকা! 
রাগের গলায় টুম্পা বলে ওঠে__এই হ্যারি পটারের যুগে তুমি মহাভারত নিয়ে বসলে। too old you are!  ভীমসেন টিভি সিরিয়ালে অনেক দেখেছি! 
  ছোটকা অমিত, একটুও দমে যায় না। আইটি সেক্টরে কাজ করে। তুখোড় স্মার্ট । সবে সাতাশ। সে কখনো এই সব চুনোপুঁটি কে ভয় পায়? 

---পুরোনো? ধুর বোকা! ভীমসেন তো চিরকালের সুপারম্যান। কাউকে ভয় পেতনা নিজের মনে থাকত। কিন্তু তাকে রাগিয়ে দিলে বা চ্যালেঞ্জ জানালে, ভীমসেন গুঁড়িয়ে দিত তাঁকে। একবার কি হল জানিস? 

---- কি হল? কি হল? 

  সমস্বরে বলে উঠল ছোটরা। 


  ছোটকা গুছিয়ে বসে শুরু করল---দ্যাখ। পঞ্চ পাণ্ডব কে জানিস ত? যুধিষ্ঠির ভীম অর্জুন নকুল আর সহদেব। 
এদের বাবা পান্ডু অকালে মারা যায়। তখন তারা আশ্রিত হয় কৌরব দের। মুশকিল কি জানিস? কৌরবদের একশ ভাইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ ছিল খুব দুরন্ত প্রকৃতির। প্রায়ই মারপিট করত পাণ্ডবদের সঙ্গে। 
 এবার জয় টুম্পা আর সোনাই নড়ে চড়ে বসে। গল্প তাদের খুব চেনা চেনা। তাদের  প্রিয় থ্রিলার গল্প গুলোর মত যেন? 
 সোনাই শ্যাম্পু করা চুল ঝাঁকিয়ে, কোলের মোবাইল গেমের সুইচ অফ করে ফিসফিস করে বলল ---
  ব্যাড গাই। কৌরব ব্যাড গাই। 
---একদম ঠিক। তখন ওদের বয়স তোদের মত। কি একটু বড়। তেরো চোদ্দ। কিন্তু রাজার ছেলে ওরা। পড়াশুনো করতে চায় না। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়।
বেচারা পাণ্ডব! তাদের খেটে খুটে শিখতে হচ্ছে। একে মাথার উপর কেউ নেই। শুধু এক বিধবা মা কুন্তী। তারও কোনো অধিকার নেই। তাই তাদের জীবনে স্ট্রাগল করেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে! 
---ফাইটিং হত ওদের মধ্যে? 
---হত রে। কিন্তু ভীম ওদের হারিয়ে দিত। ছোট থেকেই সে ছিল শক্তিশালী। ভয় পেতনা কাউকে। কৌরবদের বড় ভাই দূর্যোধন সুযোগ পেলেই ভীম কে আক্রমণ করত। 
----আর ভীম? সমস্বরে সবাই বলে উঠল। 
---এই ত রে । সব ফ্যান হয়ে গেছিস ভীমসেনের। ভীমসেন ত পিটিয়ে ছাতু করে দিত সব কটাকে। একদিকে পাঁচটা ভাই মোটে। অন্যদিকে ওরা অনেক গুলো। তাতে কি? খেলার মাঠে পিছনে লাগলেই, ভীম ছেড়ে কথা কইত না। 
----সুপারম্যান! ইয়াহু! 
টুম্পা চেঁচিয়ে উঠল। 


  মাতা কুন্তী বারণ করেছিলেন--বাছারা। কৌরবদের সঙ্গে ঝগড়া করো না। ওদের আশ্রয়ে আছি। 
যুধিষ্ঠির শান্ত ভদ্র ভালো ছেলে। সে বলত
  ---- মা । আমরা নিজের মনে অস্ত্র শিক্ষা পড়াশুনো করি। ওরাই এসে মারামারি করে। ভীম একটু গোলগাল বলে, ওরা ডাকে ওকে গরু বলে! 
   শুনে কুন্তীর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। তিনি ছেলেদের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন ----
   ---তোরা তাড়াতাড়ি বড় হলে, আমার চিন্তা দূর হয়। 

  গল্প চলছে। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও কখন যেন ঢুকে পড়েছে গল্পের মধ্যে। 

   সমরেশবাবু বললেন ---সত্যিরে। এই সব গল্প কোনোদিন পুরনো হবে না। আমাদের রোজকার জীবনে দ্যাখ, ভালো আর মন্দের লড়াই। 
অদিতি আর এক রাউন্ড চা বানাতে যাচ্ছিল। ফিরে তাকিয়ে বলল ---এখন ভালো লোক আর জিততে পারে না...এই যা তফাৎ। 
---বৌদি,
অমিত বলল --- ভালো লোক কষ্ট বেশি পেলেও শেষ পর্যন্ত জিত হবে তাদের। যুগ আলাদা গল্পর পরিণতি এক। ----কি জানি। 
 হাত উল্টে অদিতি চলে গেল। 
ছোটরা অধৈর্য। বড়দের কূট তর্কে তাদের মন নেই। 
অমিত আবার শুরু করল:

একদিন, বিষ মাখান লাড্ডু নিয়ে এল দুর্যোধন। আদর করে বসিয়ে খাইয়ে দিল সেই লাড্ডু। তারপর অচেতন ভীমসেনকে ঠেলে ফেলে দিল নদীর জলে। 

---ইস। রিক বলে উঠল--কি দুষ্টু গো? তারপর? 

         বাইরের বৃষ্টির জোর আরো বেড়ে গেল। আধো অন্ধকারে ছোটকার গলা যেন সেই প্রাচীন কালকে তুলে নিয়ে এল কলকাতার গোল বারান্দায়---

     জলের নীচে তলিয়ে যেতে যেতে , ভীমের জ্ঞান ফিরে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। প্রবল ইচ্ছেশক্তি প্রয়োগ করে, সমস্ত শরীর দিয়ে জল ঠেলে উঠতে লাগল সে। একসময় ভুস করে উপরে ভেসে উঠে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে ভীম ভাবল--

   আর সহ্য নয়। একদিন এর ফল ভুগতে হবে এদের। আমার হাতেই। 
বড় হতে হতে , নিজেকে গদা অস্ত্রে পারদর্শী করে তুলল সে। বিশাল চেহারা তাঁর। শরীরে লোম নেই। ধপ ধপ সাদা গায়ের রঙ। চোখ ছোট। মুখের রেখায় রেখায় কাঠিন্য। 


     পঞ্চপাণ্ডব আর মাতা কুন্তীর কাছে ভীম হয়ে উঠল এক বটবৃক্ষ। মানুষ যখন নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারে, তখন সে হয় আশ্রয়। ভীম হয়ে উঠল সেইরকম। সুপারম্যান। ভরসা।

---সেই বক- রাক্ষসের গল্পটা ঠাকুরপো? --অদিতি বলল।

--- ঠিক বৌদি। ওটা বেশ সাংঘাতিক গল্প। সেই সময় --

কৌরবদের চক্রান্তে, পাণ্ডবরা , মাতা কুন্তী সহ বাস করছে এক অজানা গ্রামে। ছদ্মবেশে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছে ব্রাহ্মণের ঘরে। সেই এলাকার আতংক তখন বক -রাক্ষস। রোজ এক তাজা মানুষ পৌঁছে দিতে হবে তার কাছে। নাহলে সারা এলাকা একদিনেই শেষ করে দেবে সে। সেদিন পালা পড়েছে সেই ব্রাহ্মণের ছেলের। ঘর জুড়ে কান্নার রোল। কে যাবে ওই সাক্ষাৎ মৃত্যুর কাছে ?

  উঠে দাঁড়াল ভীমসেন। ব্রাহ্মণকে বলল ---

 আপনি চিন্তা করবেন না। আমি যাচ্ছি। 

---সে কি! না না। ব্যাকুল ব্রাহ্মণ বলে --তোমরা আমার অতিথি!

শান্ত হাসি হেসে ভীম বলল--ভাববেন না।

    খুব নিরীহ গোবেচারার  মত গাছের তলায় বসে আছে ভীম।  এমন সময় বিকট চেহারা নিয়ে বক রাক্ষস হাজির।  ভীম বলল--আসুন । আমাকে খাবেন আসুন!

হতবাক হয়ে রাক্ষস বলল--তোমাকে খাবো? তুমি ভয় পাচ্ছনা?

---নাঃ।

চোখ বড় করে , দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল--বটে! ভয় পাচ্ছো না! মুন্ডু আগে ছিঁড়ে নি তোমার--তারপর দ্যাখো।

বলতে বলতে ধেয়ে এল সে। চকিতে সরে গেল ভীম। সরে গিয়েই, বিশাল শক্তিশালী দুই হাতে ধরে ফেলল বকের দুই পা। বন বন করে মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে আছড়ে ফেলল মাটিতে।। হাঁফাতে থাকা রাক্ষসের উপর নিজের পাথরের মত পা তুলে দিয়ে ভীম বললে---লড়াই হবে সমানে সমানে। অসহায় দুর্বল মানুষকে ভয় দেখায় যারা, তারা আর যাই হোক, বীর কখনো নয়। আজ থেকে এই এলাকা নিরাপদ।

       ভীমের গল্প শুনতে শুনতে স্তব্ধ সবাই। কাজের কাকু নন্দ এসেও দাঁড়িয়েছে এক কোণে। ভীম ক্রমশ জীবন্ত হয়ে বেরিয়ে আসছে মহাভারতের পাতা থেকে।  ছোটকা বলে চলল: 

 ----দ্রৌপদীর অপমানের কথা জানো নিশ্চয়। যখন ভরা সভায় একলা অসহায় দ্রৌপদী সাহায্যের জন্য অনুনয় বিনয় করছিল, রুখে দাঁড়িয়েছিল এই ভীমসেন। চিৎকার করে সে বলেছিল

  থামো। কুলাঙ্গার। অসহায়ের উপর অত্যাচার? মনে রেখো। এর শোধ আমি নেব। একজন একজন করে হত্যা করব সবাইকে। 

    ভরা সভাকক্ষ নির্বাক। মুখে না বললেও, মনে মনে সবাই লজ্জা পেল নিজেদের কাপুরুষের মত আচরণে। নারীর মর্যাদা যে রক্ষা করে সে হল আসল বীর। ভীমসেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সে কাউকে ভয় পায়না। নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে, অন্যকে রক্ষা যে করতে পারে, সে ই হল সুপারম্যান। 
--- রিয়েল সুপারম্যান! ফিস ফিস করে তিন্নি বলে। 
---ভীমসেন একাই কাঁপিয়ে দিত যুদ্ধক্ষেত্র। বিশাল গদা কাঁধের উপর নিয়ে, সে যখন হুংকার ছাড়ত সবাই কেঁপে উঠত। দূর্যোধন দু: শাসন ---এই সব পাজি লোকগুলোকে সে একাই শায়েস্তা করেছিল। 


মুগ্ধ স্বরে জয় বলল--আমাদের দেশে এমন অনেক সুপারম্যান আছে কাকু? 

---আছে বইকি। তাদের গল্প একে একে শুনবি। এখন ভীমসেনের মত অন্যের আশ্রয় হবার চেষ্টা করো। তবে তোমরাও একদিন হয়ে উঠবে সত্যিকারের ---

----সুপারম্যান--সমস্বরে বলে উঠল তিন কিশোর কিশোরী। 


ওরা সবাই বন্ধু 
সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়


গজুর ম্যাও মানে মিমিকে তো তোমরা সকলেই চেনো। সারা পাড়া ওর উৎপাতে অস্থির হয়ে থাকে।কারোর বাড়ির দুধ, কারোর বাড়ির মাছ, ও দিব্যি আত্মস্যাৎ করে। এছাড়াও এর বাড়ি ওর বাড়িতে ছানার জন্ম দেওয়া তো আছেই।

সেই মিমির একটা গুণের কথা আমি ছাড়া কেউ জানেনা। ও মানুষের ভাষা দিব্যি বুঝতে পারে।তাই হাজার বিপদে পড়েও ও সামলে যায়। পাড়ার সব বাড়িতেই ওর অবাধ গতিবিধি। 
এই তো সেদিন গজুর মা কড়াইয়ে খানিকটা পায়েস করে বাটিতে বাটিতে তুলে রেখেছিল। গজুর সেদিন জন্মদিন। ওদের বাড়ির চারজনের চারবাটি, কাজের মেয়ে বিন্তির এক বাটি, আর পাশের মল্লিকা আর নকুলদের বাড়ির জন্য দুবাটি সাজিয়ে রাখা ছিল।আর একবাটিতে ছিল বাড়তিটুকু, কেউ একটু চাইলে দেওয়ার জন্য।
গজু মাকে বলেছিল, “মিমির রেখেছ তো? ও পায়েস খেতে ভালবাসে।”
গজুর মা বলেছিল, “বেড়াল দুধ ভালবাসে,পায়েস খায় বলে শুনিনি। ঠিক আছে বাঁচলে ওকে দোব নাহয়।”
কথাটা শুনে, গজুর মনখারাপ হলেও কিছু বলেনি মাকে। ওদের তো অবস্থা তেমন ভাল নয়। গজু জানে এক প্যাকেট দুধ কিনে মা যে পায়েস করেছে, তা কারো পাতে দেবার মত নয়। একটু কিসমিস দেওয়া সেই ভাতের পায়েস যেমনই খেতে হোক, গজু আহ্লাদ করেই খাবে। কিন্তু মা মিমিকে একটু দিলে পারত। হাজার হোক ও তো বাড়ির একজন সদস্য।
মিমি সব কথা শুনেছে। যা বোঝার বুঝেছে। সবার খাওয়া হয়ে যেতে বাড়তি পায়েসটা গজুর মা রান্নাঘরেই রেখে দিয়েছিল ডিস চাপা দিয়ে। ছুটির দিন ,ভালোমন্দ খেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আলতো পায়ের টোকায় ডিস ফেলে দিয়ে বাড়তি বাটির পায়েসটা চেঁচে পুঁছে খেয়ে নিয়েছিল ও। বিকেলে গজুর মা চা করতে এসে দেখেছিল বাটি একেবারেই পরিষ্কার, আর মিমি মহারাণী সে তল্লাটেই নেই।
মা গজুকে শাসিয়ে বলেছিল, “তোর পেয়ারের বেড়ালের কান্ড দেখে যা। ওকে আর আমি বাড়িতেই ঢুকতে দেবনা।” 
# #
তারপর সপ্তাখানেক মিমি আর ও তল্লাট মাড়ায়নি।
মিমির সঙ্গে ভোলা কুকুরের খুব ভাব। এমন অনেকদিন হয়েছে,ডাস্টবিনে মাছের কাঁটা বা  মাছ পড়লে ভোলা মিমিকে ডেকে খাইয়েছে। আবার মাংসের হাড় পেলে মিমি ভোলাকে ডেকেছে নিজের ভাষায়। তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝেছ ওরা সবাই সবাইকার ভাষা বলতে না পারলেও বুঝতে পারে। ভোলা, গজুর আরেকজনের সঙ্গেও খুব ভাব।সে হল রিনিদের বাড়ির পোষা টিয়া পাখি, মোনা।
মোনা  চেহারায় ছোট হলে কী হবে মেজাজে সাংঘাতিক। গজু আর ভোলাকে ওই সামলে রাখে। ভোলা রোজ রিনিদের পাড়ার এর ওর বাড়ির সামনে পটি করে দেয়।ওদের তো বাথরুম নেই। আর এটাও বোঝেনা কোন বাড়ির সামনে পটি করা উচিত নয়। তাই রিনিদের পাড়ার লোকেরা ওর ওপর খাপ্পা। রোজ জল ঢালতে ঢালতে তিতিবিরক্ত হয়ে সেদিন লালুদা লাঠি নিয়ে তৈরি ছিল।ভোলা ডাস্টবিনে খেতে এলেই বেদম পেটাবে।
যথারীতি দুপুরবেলা ভোলা ডাস্টবিনে মুখ দিয়ে খাচ্ছে আর লালুদা লাঠি নিয়ে গুটিগুটি এগোচ্ছে, রিনিদের বারান্দায় রাখা খাঁচা থেকে মোনা দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলেছে, “পালা ভোলা,পালা।”
 ভোলা অমনি এক দৌড়ে পগার পার।মিমি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে খুব হাসছিল লালুদার মুখের বোকা হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে। তোমরা অবশ্য মিমির হাসি বুঝতে পারবে না। যাই হোক মিমি কিন্তু শেষ অবধি গজুদের বাড়ি ফিরেই গেল।বলেছি না, ও মানুষের ভাষা বোঝে।
সেদিন নিজের মনে বাইরের কলে চাল ধুতে ধুতে গজুর মা বলছিল, “সেই যে পায়েস খেয়ে মিমি পালাল, আর তার টিকিটি দেখতে পাচ্ছি না।এদিকে তার চিন্তায় আমার ছেলেটার খাওয়া ঘুম ডকে উঠল। বেড়াল জাতটাই এরকম নেমকহারাম!” একথা শোনার পরেও কী মিমি ফিরে যাবেনা? ও যে গজুকে বড্ড ভালোবাসে।
# #
এখন যদি যাও দেখবে গজুর মা মিমিকে ডেকে ডেকে পায়েস খাওয়াচ্ছে। তার পেছনে অবশ্য অন্য কাহিনি আছে।
গজুদের বাড়ির টালি ভেঙে পড়ছিল। তাই গজু সেদিন এক মিস্ত্রি ডেকে আনে। সে আর তার যোগাড়ে মিলে টালি সারানোর সময় গজুর মা বাক্স খুলেছিল, জমানো টাকা থেকে মিস্ত্রিদের পাওনা মেটাবে বলে। ঠিক সেই সময়েই বাড়ির ঢোকার মুখে গজু পা হড়কে পড়ে যায়, আর “মা” বলে চিৎকার করে।
গজুর গলায় ওরকম কাতর আওয়াজ শুনে ওর মা বাক্স না বন্ধ করেই ছুটে বেরিয়ে যায়।সব মানুষ তো ভাল হয় না। টালি মিস্ত্রিটা ছিল পাকা চোর। বাক্স খোলা দেখে নেমে এসে টাকার ব্যাগে যেই হাত দিয়েছে, মিমি অমনি দৌড়ে এসে ওর চারপাশে ঘুরে মিউ মিউ করে প্রবল আপত্তি জুড়েছে।
মিস্ত্রি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টাকা নিয়ে পালাতে পারেনি। গজুর মার হাতে বামালসমেত ধরা পড়ে গিয়েছে।খুব হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ায় গজুর মা অবশ্য তাকে কোন শাস্তিই দেয়নি। গরীব মানুষ বলে তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
টালি সারিয়ে সে বাড়ি ফিরে গিয়েছে।তারপর থেকেই ওবাড়িতে মিমির দর বেড়েছে। সবাই মিলেই ওকে খাতির করছে।
তোমরা হয়ত বলবে “তুমি কে? এতকথা তুমি জানলে কিকরে?”
জানতেই যখন চাইছ, আমার পরিচয় দিই তাহলে , “আমি ওবাড়ির হাওয়া।সব জায়গায় আছি,সব কিছু দেখি ,শুনি, বুঝি।অথচ অদৃশ্য।”  
এখনও তোমরা যদি খুঁজে খুঁজে গজুর বাড়ি যাও, গজুদের সবাইকে দেখতে পাবে। আর দেখবে মিমি ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরের ডাস্টবিনে ভোলা মুখ ঢুকিয়ে কিসব খাচ্ছে। আর মোনা চুপ করে দাঁড়ে বসে সবকিছুর ওপর নজর রাখছে।
ওদের বন্ধুত্বের খবর এতদিন শুধু আমি জানতাম, এবার তোমরাও জানলে।



হাটিম সাইট
তৃষ্ণা বসাক
 

হাট্টিমা টিম টিম,
তারা পাড়ত মাঠে ডিম,
নিঝুম রাতে ছাদে উঠে
খেত চাঁদের হিম।
 
তাদের বংশে এমনি ধারা
তাদের শিংগুলো সব খাড়া
বাঁকানো শিং দেখলে কারো
করত পাড়াছাড়া!
 
মাঠের ডিমগুলোতে তা,
তারা কেউ কি দিত না?
কোথায় তবে উধাও হল
হাট্টিমাদের ছা?
 
হট্টমালার দেশে,
তারা উঠল গিয়ে শেষে?
নাকি গেল এক যাত্রায়
কোভিড ব্যামোয় টেঁসে?
 
এমন খবর নানা,
যেতেই পারে জানা,
গুগল খুলে খোজো দিকি
হাটিম সাইট খানা!


ধারাবাহিক উপন্যাসিকা

ধানের শীষে শিশিরবিন্দু
সুকুমার রুজ
শেষ পর্ব


পাঁচ      

এই তো তোমরা এসে গেছ! সকলে গল্প শোনার জন্য নিশ্চয় রেডি! কাল যা বলেছিলাম, আশা করি তোমাদের মনে আছে। আজ প্রথমেই তোমাদেরকে একটা পুচকে মেয়ের কথা বলব। সুহাসের বোন চন্দনা। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। সেইসঙ্গে ঘরের কাজকর্মও করে।  
  কাজ করে শুনে অবাক হচ্ছো! ও তোমাদের মতই ছোট। ওর বয়স এখন দশবছর। কিন্তু ওর একদম বড়দের মতো বোধশক্তি ও কাজ করার ক্ষমতা। আসলে কী জানো! পরিস্থিতি মানুষকে তৈরি করে নেয়। চন্দনার মা-কে সকালবেলায় উঠেই কাজে যেতে হয়। বেরোনোর আগে বাড়ি ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ, উঠোন ঝাঁট দেওয়া, এঁটো বাসনপত্র ধোয়া, হাঁড়ি-কড়া মাজা-ধোয়া, এমনকি চন্দনার জন্য চারটি ভাতও রান্না করে রাখতে হয়। ও যে দশটার সময় স্কুলে যাবে। তাই সকালে সেইসব কাজে চন্দনাও হাত লাগায়। ওর সাধ্যমত কাজ করে। যেমন হাঁড়ি-কড়াগুলো মা মেজে দিলে ও ধুয়ে দাওয়ায় রেখে আসে। কাঠের উনুনে মা যখন ভাত রান্না করে, ও তখন উনুনে কাঠকুটো ঠেলে দেয় ঠিকঠাক জ্বালানির জোগানের জন্য।  
   ভাবছো, এসব করলে ও লেখাপড়া করে কখন! করে করে! ইচ্ছে থাকলে সবই করা যায়। ও ভোরবেলা উঠেই পড়তে বসে। তখনও সূর্য ওঠে না। শুধু গাছ-গাছালিতে অজস্র পাখি কিচিরমিচির করে। ওই পাখিদের সঙ্গে চন্দনার খুব বন্ধুত্ব। তোমাদেরকে চন্দনার সঙ্গে পাখির বন্ধুত্বের একটা ঘটনা বলি।
  একটা হীরামন পাখি রোজ সকালবেলা ওদের উঠোনে পেয়ারাগাছে আসে। ক্যাঁচর ম্যাচর করে অনেক কথা বলে। তার ভাষা একমাত্র চন্দনাই বুঝতে পারে। ও হীরামনের সঙ্গে কত কথা বলে। ওর খুব বন্ধুত্ব ওই হীরামনের সাথে। ও ওর স্কুলের বন্ধুদের কাছে ওই বন্ধুর কথা বলেছে। বন্ধুরা হীরামনকে দেখার জন্য খুব উৎসাহী হয়েছে। তাই চন্দনা বন্ধুদেরকে ওদের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু হীরামনের দেখা নেই!  তখন বন্ধুরা বলেছে, চন্দনা, 'তুই তো খুব মিথ্যুক! কোথায় তোর সেই বন্ধু?'    
   বন্ধুদের কথাগুলো শুনে চন্দনা কোন কথা বলে না। ওর ডাগর চোখজোড়া পেয়ারাগাছের দিকে স্থির, মনের মাঝে মেঘ, চোখের কোনে বৃষ্টিফোঁটা। ও মিথ্যে বলেনি। অথচ বন্ধুরা...!           
  চন্দনা বন্ধুদের কাছে আর বসে থাকতে পারে না। ওর কান্না পায়। তাই ও রান্নাঘরে মায়ের কাছে চলে আসে। ওর বন্ধুরা আসবে ব'লে মা আজ কাজে যায়নি। বন্ধুদের জন্য সামান্য খাবার তৈরি করছে। ও মায়ের আঁচল ধরে অভিমানী গলায় বলে ওঠে — মা, আমার নতুন বন্ধু তো এলো না!        
  ওর মাথায় হাত বুলিয়ে মা বলে — আসবে রে বাবা! আসবে। মানুষেরা কথা না রাখলেও ওরা কথা রাখে। যা, তুই এখন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প কর। একটু পরেই খেতে দেব।           
  চন্দনা বন্ধুদের কাছে যায় না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঠোনে লেবুগাছ দেখে। পেয়ারাগাছের ডালে চোখ ছোঁড়ে। কিন্তু কোথাও নেই ওর নতুন বন্ধু। অথচ রোজ খাওয়ার সময় মা গলা উঁচিয়ে 'আয় আয় হীরামন' ব'লে ডাকতেই, কোত্থেকে উড়ে এসে দাওয়ায় বসে। ডাইনে-বাঁয়ে ঘার ঘোরায়। ও খেতে খেতে কয়েকদানা ভাত ছড়িয়ে দেয় মেঝেতে। সে তুরুক তুরুক লাফায় আর খুঁটে খুঁটে ভাত খায়। তা দেখতে দেখতে কখন যে মা ওর পেটে সমস্ত ভাত চালান করে দেয়, তা ও জানতেই পারে না। খাওয়া শেষ হতে না হতেই, বন্ধুটা ফুরুৎ করে উড়ে আবার পেয়ারাগাছে গিয়ে বসে। বাদামি পালক ফুলিয়ে, মাথার কালো ঝুঁটি উঁচিয়ে, আকাশপানে মুখ তুলে মিষ্টি সুরে শিস দিয়ে ওঠে। তখন মা বলে, 'দেখলি, তুই সব ভাত খেয়ে নিয়েছিস ব'লে খুশি হয়ে তোর বন্ধু তোকে গান শুনিয়ে দিল।' তখন ওর মনটা খুশিতে ভরে যায়।  
  অথচ আজ ওর মনে কষ্ট। ওর মা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে — তৈরি হয়ে গেছে, এবার সবাইকে খেতে দেবো। 
  একটু পরেই সবাই দাওয়ায় খেতে বসেছে। মা হাসি হাসি মুখে ওদেরকে খাবার দিচ্ছে। চন্দনার খাওয়ায় তেমন মন নেই। মা আড়চোখে ওর দিকে তাকায়। মুচকি হেসে পেয়ারাগাছের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে সুর করে ডেকে ওঠে — আয় আয় হীরামন...!   
  চন্দনার মনে দোলাচল, বন্ধু আসবে তো? না এলে স্কুলের বন্ধুদের কাছে খেলো হতে হবে। ওরা মিথ্যুক বলবে। ও হঠাৎ দেখে, হাওয়ায় গা ভাসিয়ে পেয়ারাগাছ থেকে উড়ে এলো ওর বন্ধু। চন্দনার কাঁধের উপরে বসল। ওর ঠোঁটের ফাঁকে মুক্তোঝিলিক।  
  আরে! ওর মুখে কী যেন একটা! ও মা! টকটকে হলুদ রঙের একটা নাম না জানা ফুল! সকলে হইহই করে ওঠে। চন্দনা বলে — এই দ্যাখ, আমার নতুন বন্ধু এসে গেছে। তোরা বিশ্বাসই করছিলিস না।    
  চন্দনা বন্ধুকে আদর করার জন্য হাত উঁচু করতেই, হাতের তালুতে টুপুস করে ফুলটা ফেলে দেয় পাখিটা। মা ততক্ষণে একটা ছোট্ট বাটিতে হীরামনের জন্যও খাবার নিয়ে এসেছে। হীরামনের সেদিকে খেয়াল নেই। সে আকাশের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তুমুল সুরে শিস দিতে থাকে। সকলে সে শিসের মধ্যে শুনতে পায় — বন্ধুরা ভালো থেকো বন্ধুরা ভালো থেকো ...!   
  এই হল গিয়ে পাখির সঙ্গে চন্দনার বন্ধুত্বের গল্প। চন্দনা ফুলও খুব ভালোবাসে। ভোরবেলা যখন আকাশটা আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে, বাইরে কেমন হালকা বাতাস বয়ে যায়। উঠোনে শিউলিগাছ থেকে টুপটাপ শিউলিফুল ঝরে পড়ে। ও তখন একমুঠো শিউলিফুল কুড়িয়ে নিয়ে আসে। সেগুলোকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বইয়ের তাকে রাখে। সারা ঘর সুগন্ধে ভরে যায়।    
  তারপর ও উঠোনে একটা চাটাই পেতে পড়তে বসে। উঠোনের এক কোণে তখনো কালু ঘুমোয়। ও সুর করে বাংলা বইয়ের ছড়া পড়া শুরু করলেই কালু জেগে যায়। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে কানে পট পট শব্দ তুলে যেন ঘুম তাড়ায়। বাইরে থেকে এক চক্কর দিয়ে আসে। তারপর চন্দনার সামনে বসে বসে ওর পড়া শোনে। ভাবখানা এমন, যেন খুব মজা পাচ্ছে!  সে ঘাড় নেড়ে নেড়ে চন্দনার অংক কষা দেখে। যেন কতই বুঝছে। চন্দনা যখন ওকে বলে — বল তো কালু! দুই দু'গুনে কত হয়? 
  কালু তখন ডাইনে বাঁয়ে লেজ নাড়ে। যেন লেজ নেড়ে বলে — না না, বলবো না। 
  চন্দনার মা আর দাদা ঘুম থেকে ওঠার আগেই ওর স্কুলের হোমটাস্ক হয়ে যায়। শূন্যস্থান পূরণ, বাক্য রচনা, আর অংক যেটা যেটা পারে না, দাদার কাছে জেনে নেয়, শিখে নেয়। ততক্ষণে ওর মা ঘরের কাজকর্ম শুরু করেছে। ও তখন মায়ের সঙ্গে কাজে হাত লাগায়।  
  ওদের একটা ছাগল আছে। তার নাম রাঙি। তার দুটো ছানাও আছে জকি ও রকি। চন্দনা রাঙির জন্য কিছু ঘাস, লতাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসে। দেখে, রাঙি সেগুলো খাচ্ছে না। তখন ও রাঙিকে খুব বকুনি দেয়। রাঙি তখন ম্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ শব্দ করে রাস্তার ওপাশে ঝোপটাই গিয়ে নিজের পছন্দমতো লতাপাতা খায়। মায়ের পিছন পিছন ছানাদুটোও যায়।  
  একদিনের একটা ঘটনা তোমাদের বলি। সেদিন স্কুল ছুটি। চন্দনার মা কাজে গেছে। বাড়িতে চন্দনা একা। না, একটু ভুল বলা হল। ওর সঙ্গে রয়েছে রাঙি, তার দুই ছানা জকি ও রকি আর কালু। কালু এখন ওদের অভিভাবক, পাহারাদার, আবার খেলার সাথীও। জকি-রকি নদীর ধারে বা জঙ্গলের দিকে গেলে, কালু ভোক ভোক ক'রে ওদের বকুনি দিয়ে বাড়ির উঠোনে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। জঙ্গলের শেয়াল-ব্যাটাকে তো বিশ্বাস নেই! ওদেরকে একা পেলে ঝোপ থেকে ঝপ করে বেরিয়ে, খপ করে একটাকে ধরে গর্তে টেনে নিয়ে যাবে। তখন ওদের মা রাঙি সারাদিন সারারাত ধরে ম্যাঁ ম্যাঁ করে কাঁদবে। সে এক মন খারাপের ব্যাপার। তা দেখে চন্দনারও কান্না পেয়ে যাবে, কালুরও মন খারাপ হবে। তাই কালু সবসময় ওদের চোখে চোখে রাখে।              
  সেদিন ওরা চার বন্ধুতে বেশ আনন্দেই কাটাচ্ছে। উঠোনে চন্দনা, জকি-রকি আর কালু লুকোচুরি খেলছে। জকি-রকিটা বোকার হদ্দ! ঠিকমতো লুকোতেই পারে না। রাংচিতার বেড়ার আড়ালে ওদেরকে লুকোনোর সুবিধা করে দিলেও, দু'জনে মিঁ-হিঁ-হিঁ, মিঁ-হিঁ-হিঁ ক'রে কথা বলে ফেলে। ব্যাস! কালু ওদেরকে ঠিক খুঁজে পেয়ে যায়। ও যে ভীষণ চালু! চন্দনা যত কঠিন কঠিন জায়গাতেই লুকোক না কেন, কালু ঠিক খুঁজে বের করে ফেলে। মাটি শুঁকে শুঁকে কী করে যে ঠিক কাছে পৌঁছে যায়, কে জানে! তারপর ভোউউউ করে বলে, 'ওই তো তুমি, খুঁজে পেয়ে গেছি।'     
  চন্দনা একদিন মা-কে শুধিয়েছিল, 'মা, লুকোচুরি খেলার সময় কালু কোন কোনদিন এমন এমন জায়গায় লুকোয় যে,  ওকে খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু আমি যেখানেই লুকোই, কালু ঠিক খুঁজে পেয়ে যায়। ওর এত বুদ্ধি কেন গো?'       
  মা বলেছিল, 'ওরে পাগলি! কুকুরের ঘ্রাণশক্তি যে খুব প্রখর। ও গন্ধ শুঁকে শুঁকে খুঁজে বের করে।'  
  একথা শোনার পর থেকে চন্দনা কালুর নাকে একখানা নিজের মাস্ক পরিয়ে দেয়। মনে মনে বলে, 'খুব চালাক তুমি না!  গন্ধ পেয়ে খুঁজে বের করো। এই দিলাম তোমার নাক বন্ধ করে। এবার খোঁজো, দেখি কেমন পারো! 
  কালু মাস্কটা পড়ে যেন বেশ মজা পায়। হিক হিক করে হাসে, গা দুলিয়ে দুলিয়ে হাঁটে। যেন বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতো এইমাত্র বিউটি পার্লার থেকে ফেসিয়াল করে, সেজেগুজে এলো! আসলে, ও চন্দনাকে মাস্ক পড়তে দেখেছে। সেই মাস্ক এখন ওর নাকে। তার মানে, ওর গুরুত্বও চন্দনার থেকে কিছু কম নয়। এটা বোঝাতে ও জকি-রকির গায়ে গা ঘষে আর লেজ নাড়িয়ে ওদের গায়ে সুড়সুড়ি দেয়। যেন বলতে চায়, 'দ্যাখ, আমি তোদের চেয়ে উঁচু দরের।'  
  জকি-রকি অতশত বোঝে না। কালুর দেওয়া সুড়সুড়িতে তুমুল আনন্দে লাফাতে থাকে। আর ওদের গলায় বাঁধা ঘুঙুরদুটো ঠিন ঠিন করে বেজে ওঠে। ওদের মা রাঙি উঠোনের একপাশে বসে জাবর কাটে, আর আমড়া-চোখে ড্যাবডেবিয়ে ছেলেদুটোর লম্ফঝম্প দেখে।   
  তো সেদিন হয়েছে কী, লুকোচুরি খেলতে খেলতে চন্দনা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ও একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। রাঙিটা খিদের জ্বালায় পাশের ঝোপে লতাপাতা চিবোতে গেছে। অনেক লম্ফঝম্পের পর ক্লান্ত হয়ে জকি-রকি উঠোনের এক কোণে শুয়েছিল। মাঝে মাঝে ওদের লম্বা কান নাড়িয়ে পট পট আওয়াজ তুলছিল। কালুটা ওর মুখের সামনে উড়ে বেড়ানো একটা ডাঁশমাছিকে কামড়ে ধরার চেষ্টা করছিল, আর বিফল হচ্ছিল। চন্দনা আচারের বয়াম থেকে একটা আমের টুকরো বের করে নিয়ে চুষছিল আর পেয়ারাগাছের ডালপালার মধ্যে বন্ধু হীরামনকে খুঁজছিল। পাখিটাকে খুঁজে পাওয়ার নেশায় ও পেয়ারাগাছের নিচে চলে গিয়েছিলো। 
  ফিরে এসে দেখে, উঠোনে জকি-রকিও নেই আর কালুও নেই। ও ভাবে, এই ভরদুপুরে ওরা আবার কোথায় গেল! ওদেরকে খুঁজতে যেতেও মন সরে না। মা ফিরে এসে যদি দেখে, বাড়িতে কেউ নেই, তাহলেই তো হয়েছে! মা ভীষণ রাগী। হয়তো বেড়ার রাংচিতা-ডাল তুলে নিয়ে কয়েক ঘা বসিয়ে দেবে। তাই ও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।       
  হঠাৎ চন্দনার কানে আসে জকি-রকির তীব্র চিৎকার। আর সেই সঙ্গে কালুর ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। আওয়াজ লক্ষ্য করে ও ছুটে যায় নদীর ধারের জঙ্গলের দিকে। কিছুটা গিয়ে দেখে, জকি তিরবেগে ছুটে আসছে সেইসঙ্গে ম্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ ডাক, নাকি কান্না বোঝা যাচ্ছে না। তার পেছনে রকি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ওর পা থেকে রক্ত ঝরছে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। যেন রকি বেচারা চিৎকার করতেও ভুলে গেছে।   
  চন্দনা ছুটে গিয়ে রকিকে কোলে তুলে নেয়। ও বুঝতে পারে, এ নিশ্চয়ই নদীর ধারের শেয়ালটার কাজ। বুদ্ধুরাম দুটোকে বললেও শোনে না, বোঝালেও বোঝে না। ও উঠে যেই পেয়ারাতলায় গেছে, সেই সুযোগে পাজিদুটো চলে গেছে নদীর ধারে। কী যে কাজ ওখানে কে জানে! লতাপাতাও তো খেতে শেখেনি। এখনও মায়ের দুধ খায়। ওদের যেতে দেখে কালুও নিশ্চয় পেছন পেছন গেছে! সে গেলো কোথায়!     
  চন্দনা আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে, সে এক ভয়ানক কাণ্ডকারখানা। কালু একটা শিয়ালের ঘাড়ে কামড়ে ধরে গরর গরর শব্দ করছে। অথচ কালুর গলার কাছ থেকে গল গল করে রক্ত ঝরছে। নিশ্চয় ওই শয়তান শেয়ালটা রকিকে ধরেছিল। কালু তাকে বাঁচাতে গেলে, ওর গলায় কামড় বসিয়েছে। কালু কি আর ছাড়ে! এখন ব্যাটা শেয়াল কালুর কবল থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাঁকপাঁক করছে। থাবা দিয়ে কালুর গায়ে আঁচড় কাটছে। কিন্তু কালুর সেদিকে দৃকপাত নেই। ও শেয়ালের ঘাড়ের কামড় কিছুতেই আলগা করতে রাজি নয়। চন্দনা ভয়ে কাছে যেতেও পারে না। শুধু হাঁক পারে, 'কালু, চলে  আয়... চলে আয় কালু!'    
  কিন্তু কালু ওর কথা শোনে না। শেয়ালের ঘাড়ে কামড় বসিয়ে শুধু ঝাঁকুনি দিতে থাকে। একসময় শেয়ালটা নিস্তেজ হয়ে  যায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে কালুও। চন্দনা ভয়ে ভয়ে কালুর কাছে যায়। কোনরকমে ওকে টেনে সরিয়ে নিয়ে আসে। কোলে তুলে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারবে কেন! কালু যে যথেষ্ট তাগড়া! অনেক কষ্টে টেনে হিঁচড়ে চন্দনা ওকে বাড়ির উঠোনে নিয়ে আসে। ওর গলায়, গায়ে মাথায় জল ঢালে। কালুর গলায় গভীর ক্ষত। চামড়া ঝুলে পড়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠোন। ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে কালু। তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। তা দেখে জকি-রকি পায়ে-পায়ে কালুর কাছে আসে। মিঁ-হিঁ-হিঁ করে কীসব বলে। কালু কোনরকমে ঘাড়টা একবার সোজা করে। রকিকে কাছে পেয়ে ওর পায়ে রক্ত ঝরতে থাকা জায়গাটা চেটে দেয়।  
  এমন সময় রাঙি কোথায় থেকে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হয়। কার কাছে খবর পেয়েছে, কে জানে! রকির ও কালুর ওই অবস্থা দেখে ও আবার বাইরে ছুট মারে। ঝট করে পাশের ঝোপ থেকে কিছু বিশেষ লতাপাতা মুখে করে নিয়ে এসে চন্দনার কাছে রাখে। চন্দনা বুঝে যায়, কী করতে হবে। ও ঝটপট ওই লতাপাতাগুলো একটা ইটের টুকরো দিয়ে থেঁতো করে ফেলে। তারপর সেগুলো কালুর গলার ক্ষতস্থানে আর রকির পায়ে লাগিয়ে দেয়। জকিটা তখন চুপটি করে বসে রয়েছে ভাইয়ের পাশে। তার ছোট্ট লেজটা দিয়ে তুড়ুক তুড়ুক করে ভাইয়ের গায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। 
  কিছুক্ষণের মধ্যেই কালুর গলা থেকে আর রকির পা থেকে রক্ত ঝরা বন্ধ হয়ে যায়। ওরা বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তা দেখে চন্দনার মুখে হাসি ফোটে। আর জকিটা আনন্দে তিড়িং বিড়িং লাফাতে থাকে। ওর গলার ঘন্টিতে আওয়াজ ওঠে ঠিনঠিন ঠিনঠিন ...। এমন সময় চন্দনার মা বাড়ি ফেরে। 
  আজ অনেকক্ষণ তোমাদেরকে আটকে রেখেছি। ছুটির ঘণ্টা কখন পড়ে গেছে। আজকে তাহলে এই অবধি থাক। বেচারা কালু ও রকি একটু সুস্থ হয়ে উঠুক। নাকি বলো! 
ছয়

    সুহাস-চন্দনাদের জীবনের কাহিনি তোমাদের কেমন লাগছে? 
    ভালো লাগছে? বাঃ বাঃ! তোমরা যে মন দিয়ে ওদের গল্প শুনছ, ওদের দুঃখে কষ্ট পাচ্ছ, ওদের আনন্দে আনন্দ পাচ্ছ, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। কী বলছ? শেয়াল কেন প্রহরে প্রহরে ডাকে? আরেব্বাস! তোমরা ভোলনি দেখছি! ঠিক আছে, এখুনি বলব সে কথা। 
  কাছের কোনো বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করার জন্য শিয়াল ডাকে। একসঙ্গে কিছু সময় কাটানোর জন্য ডাকে। কোথা থেকে, কীভাবে খাবার সংগ্রহ করবে সে ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্যও ডাকে। 
  ওরা খুব চালাক। রাত নামলেই ওরা খাবারের খোঁজে লোকালয়ে বেরিয়ে আসে। শিকার ধরার জন্য ওরা বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে। একটা শিয়াল ডাকলে আশেপাশের শিয়ালগুলোও ডাকতে শুরু করে। তার কারণ হল, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা।    
  শিয়ালের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার অনেকটা কুকুরের মত। বিশেষ সময়ে ডাকা। চলার সময় লেজ নাড়ানো। যোগাযোগ রক্ষা করা। খাবার খোঁজার জন্য বিশেষ কৌশল, এসব ওদের প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতা।   
  কী বলছ! শিয়াল শুধু শীতকালে ডাকে! না না, শেয়াল সারা বছরই ডাকে। শীতকাল শিয়ালদের বংশবৃদ্ধির সময়। এ সময় পুরুষ শিয়ালরা উচ্চ স্বরে ডেকে মেয়ে শিয়ালদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে। এ ডাকটাই আমরা বেশি শুনতে পাই। শীতকালে ডাকটা কানে বেশী আসার কারণও আছে। সেটা হলো, গরমকালে বাতাস গরম হওয়াতে হাল্কা থাকে। তোমরা জানো, এতে বাতাসের ঘনত্ব কমে যায়। ফলে বায়ু দ্রুত চলাচল করে। তাই গরমকালে শিয়ালের ডাক সেভাবে কান অবধি পৌঁছয় না। 
  কিন্তু শীতকালে বাতাস ঠান্ডা থাকে। ঠান্ডা বাতাসের ঘনত্ব বেশী। ঘন বাতাস শব্দের জন্য ভালো পরিবাহী এবং ঘনত্ব বেশী হওয়াতে জোরে চলাচলও করে না। ভালো পরিবাহী এবং  ঘনত্বর কারণেই শীতকালে শব্দের আওয়াজ বা তীব্রতা বেশী হয়। তাছাড়া শীতকালে প্রকৃতি নিস্তব্ধ থাকায় আমরা অন্য সময়ের চেয়ে যে কোন শব্দ বেশি জোরে শুনতে পাই। তাই মনে হয় শিয়াল শুধু শীতকালেই ডাকে। সবচেয়ে বড় কথা হল, ওদের মধ্যে খুব একতা। ওরা সবসময় একটা পরিবারের মতো মিলেমিশে থাকে। 
  তোমরা তো জানোই সেই চাষি, তার পাঁচটা ছেলে আর একগোছা লাঠির গল্পটা। একটা লাঠিকে অনায়াসে ভেঙে ফেলা যায়। কিন্তু একগোছা লাঠিকে চাষির ছেলেরা চেষ্টা করেও ভাঙতে পারল না। তার মানে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে, কেউ সহজে ক্ষতি করতে পারে না। তোমরাও সকলে মিলেমিশে থাকবে। কেউ কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া করবে না। মারামারি করবে না। সবাই সকলের কথা মেনে চলবে। তবে, ক্লাসে ক্যাপ্টেনের মতো একজন অভিভাবক সব পরিবারেই থাকেন। পরিবারের সকলে তাঁর কথা মেনে চলেন।      
  তেমনি এখন সুহাসদের পরিবারে সুহাসের মা বয়সে বড় হলে সুহাস এখন পরিবারের অভিভাবক। ওর কথা ওর মা ও চন্দনা মেনে চলে। তাই ব'লে সুহাস ওর বোনের উপর সবসময় খবরদারি করে, তা কিন্তু নয়! ও বোনকে খুব ভালোবাসে।       তাকে কখনও মারে না। কিন্তু বোন যদি কোন কিছু ভুল করে ফেলে, তাহলে বকুনি দেয়। তখন ওকে দেখে মনে হয়, ও যেন কত বড় হয়ে গেছে! সুহাসের রকম সকম দেখে ওর মা তখন মিটিমিটি হাসে। আর ভাবে, পরিবেশ ও পরিস্থিতি মানুষকে কী তাড়াতাড়ি পরিণত করে তোলে! ওদের বাবার যা করার কথা ছিল, তা এখন সুহাস করছে। 
  ওর মায়ের মনে কত ভাবনা বয়ে চলে। ভেবেছিল, ছেলেটাকে মানুষের মতন মানুষ করবে। অনেক লেখাপড়া শেখাবে। বড় হয়ে সুহাস চাকরি করবে।  
  কিন্তু ওর বাবা তাড়াতাড়ি মারা যাওয়ায় সব কেমন পাল্টে গেল! সুহাসকে এখন থেকে ছুটতে হচ্ছে টাকা রোজগারের জন্য। অনেকবার ভেবেছে, ওকে আবার স্কুলে পাঠাবে। স্যাররা তো ভরসা দিয়েছেন, এখন পড়াশোনার তেমন খরচও নেই।   
  কিন্তু পরের বাড়িতে মুড়ি ভেজে, ধানসিদ্ধ করে তিনজনের পেট চালানোর মতন উপার্জন হয় না যে! ছেলেটার এখন বেড়ে ওঠার সময়। ওকে তো একটু ভালো খাবার দাবার দেওয়া দরকার। 
  তাছাড়া সুহাস মাঠে-ঘাটে কাজ করতে যাওয়া পছন্দ করে। ও বলে, বোনকে ভালো করে লেখাপড়া শেখাবে। ওকে স্কুলের দিদিমনি হতেই হবে। তার জন্য বেশি বেশি টাকা রোজগার করা দরকার। তাই ও রোজ ভোরবেলা উঠে মাঠেঘাটে কাজ করতে যায়। তবুও ওর কিন্তু ধানের শীষের উপর শিশিরবিন্দু দেখার মন আছে। তাই ও মাঠের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় গুন গুন করে গান গায়। আর আপন মনে কত কিছু যে ভাবতে থাকে! ও কী ভাবে, তার হদিশ আমি আর কী করে পাবো বলো!   
(সমাপ্ত)


মগজের ওজন
মুক্তি দাশ


পরীক্ষায় ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট একটু এদিক-ওদিক হলে প্রায়শই বাবা-মায়েরা আশাভঙ্গজনিত মনোবেদনায় ভুগে থাকেন। অপেক্ষাকৃত মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সংগে তুলনা করে তাঁরা নিজ নিজ সন্তানদের হামেশাই এই বলে অভিহিত করেন যে, ঈশ্বর বা বিধাতা যখন সব মানুষেরই সমপরিমাণ বুদ্ধি বা মগজ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তখন তাঁদের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা নামক প্রতিযোগিতায় কেন পিছিয়ে পড়বে? যেন তাঁরা মানুষের মাথায় মগজ বা ঘিলুর অবস্থান ও পরিমাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। যেন তাঁরা কত মস্তিষ্ক-বিশারদ।

কিন্তু তাঁদের জেনে রাখা উচিৎ যে, মানুষের মস্তক নামক আধারে মগজ প্রদানের ব্যাপারে বিধাতার বৈষম্যমূলক নীতির চালটা এ-যুগের মানুষ ধরে ফেলেছে। দেখা গেছে, একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মগজের পরিমাণ ও একজন প্রতিভাধর ব্যক্তির মগজের পরিমাণের মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য রয়েছে।

একজন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মস্তকস্থিত মগজ বা ঘিলুর পরিমাণ যেখানে গড়ে ঊনপঞ্চাশ আউন্স থাকার কথা, সেখানে লর্ড বায়রণের মতো বিশ্ববন্দিত ইংরেজ কবির মগজের ওজন বিরাশি দশমিক দুই পাঁচ আউন্স। 

অপরদিকে চুয়াত্তর আউন্স পরিমাণ মগজ নিয়ে রুশ ঔপন্যাসিক ইভান তুর্গানেভ বিশ্বে সমাদৃত হয়েছেন। 

রুশ নেতা লিওন ট্রটস্কির ঘিলুর পরিমাণ ছিল ছাপান্ন আউন্স। আমেরিকান অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো-র নাম শুনলে এখনও পৃথিবীর তাবৎ মানুষ তাঁর বিরল অভিনয়-প্রতিভা অসীম মুগ্ধতার সাথে স্মরণ করে। কিন্তু তাঁর মগজ সম্পর্কে ক’জন আর হদিশ রাখে? সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই মার্কিনী অভিনেত্রীর মগজের ওজন পঞ্চাশ দশমিক সাত নয় আউন্স। স্বাভাবিকের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশি।

তবে স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজনের মগজের অধিকারী হয়েও বিশ্বে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন – এরকম ব্যতিক্রমী নজিরও বিরল নয়। ফরাসি লেখক আন্তোলে ফ্রান্স তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মগজের ওজন মাত্র পঁয়ত্রিশ আউন্স। স্বাভাবিকের তুলনায় চোদ্দ আউন্স কম। তাতে কী-ই বা আসে যায়! তাতেই তিনি তাঁর সৃষ্টকর্ম দ্বারা পৃথিবীকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

তার মানে, এটাই প্রমাণিত হয় যে, মগজের পরিমাণ স্বাভাবিকের নিম্নসীমায় থাকলেও নিজস্ব অধ্যবসায় ও নিরবচ্ছিন্ন একাগ্র সাধনার দ্বারা তার উর্বরাশক্তিকে বাড়িয়ে তোলা যায় – যা একজন মানুষকে সাধারণের পর্যায় থেকে উন্নীত করে এবং দিতে পারে অঢেল যশ ও প্রতিপত্তি।


সেই লোকটা 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

  চেয়ে আছে বিশু একদৃষ্টিতে এই সেই খ্যাপা লোক
কাঁধে তার ঝোলা
এ বেলা ও বেলা 
ধুলো থেকে ভুলে কী যে নেয় তুলে ডাস্টবিনে রাখে চোখ। 

রোগা লিটপিটে রাগী খিটমিটে গায়ে কালশিটে দাগ
বিড়বিড় বকে
চোখের পলকে
হাসি উঠে ফোটে তার দুটি ঠোঁটে,কোথায় উধাও রাগ। 

নেড়িকুত্তারা প্রিয়জন যারা তার ছায়া ধরে হাঁটে
রোদে পুড়ে নিজে
জামা ঘামে ভিজে 
শরীরে শুকোয়,  সেও ঘাসে শোয় অথবা পুকুরঘাটে।

কী আছে ঝোলাতে?তার দুটি হাতে বিস্কুট পাউরুটি 
এতে খুশি মন 
থাকে প্রাণপণ 
কুকুরকে দিয়ে নিজে নেয় খেয়ে পেট ভরে মোটামুটি। 

এই লোকটাকে সকলেই দেখে,না কি থাকে আনমনা ?
ভাবছিল বিশু
ছোট এক শিশু 
লোকটা সঠিক আর মানবিক, নয় সে আবর্জনা।


ধারাবাহিক থ্রিলার উপন্যাস

শততানের উঁকি
তপশ্রী পাল


“আমারও মনে হচ্ছে বিশাখার খুব বিপদ রে দাদা! আর সেই মেসেজটা? ওটা কী ওরই ছিলো?”
“তাই তো মনে হচ্ছে! শোন, আজ বিকেলে একবার ওদের বাড়ি যাব, সঙ্গে ঐশিকাকেও নিয়ে নিস!”
“কিন্তু আমি আগে কোনদিন ওদের বাড়ি যাইনি। আমার সঙ্গে ওর তেমন ভাব ছিলো না রে। ওর বাবা মা যদি আমরা বাচ্চা ছেলে বলে পাত্তা না দেয়?”
“হুম, দাঁড়া! লালবাজারের পাকড়াশী আঙ্কল বাবার বন্ধু! বাবা বাইরে যাওয়ার আগে, একসাথে কলেজে পড়তো! একবার বাবাকে বলছি ওঁর সাথে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা বলতে। পাকড়াশী আঙ্কল ওদের থানার সঙ্গে যোগাযোগ করলে পুলিশ খুব সিরিয়াস হয়ে যাবে, কারণ আঙ্কল এখন গোয়েন্দা পুলিশের হেড! তখন আমরা পুলিশের সাথেই ওদের বাড়ি যেতে পারবো। তাহলে আজ হবে না। আজ কথাটথা বলে, কাল সকালে বরং যাওয়া যেতে পারে।“
“কিন্তু কাল সপ্তমী রে দাদা! আমরা ঘুরবো না?”
“আগে বন্ধু না আগে ঘোরা? ওকে আগে বাঁচাতে হবে! চল আজ বিকেলে সাউথের বড় বড় ঠাকুর কটা দেখে নিই। তারপর আরো দিন তো পড়ে আছে! প্যান্ডেলে তো ঢোকাই যাবে না। ঐ বাইরে দিয়ে গাড়িতে করে ঘুরে আসবো।“
“তবে তাই কর!” বলে প্রোটন “আজ রাতে ঐশিকাকে বলে রাখতে হবে।“ 

ঐশিকার কাছ থেকে বিশাখাদের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিলো প্রোটন। বিশাখারা থাকে সেই উত্তর কলকাতায় দমদমে। প্রোটনদের বাড়ি যোধপুর পার্ক থেকে ওখানে যেতেই তো দুঘন্টা লেগে যাবে! তার ওপর আবার পুজোর সময় রাস্তায় ট্রাফিক রেস্ট্রিকশন চারিদিকে! ঐশিকারা থাকে যাদবপুরে। যাওয়ার সময় ওকে তুলে নিতে হবে। 
প্রোটনের মা তো শুনেই ভয়টয় পেয়ে বললেন “না, না তোমাদের আর এ সবের মধ্যে মাথা গলিয়ে দরকার নেই! নিউট্রনটা মাত্র কয়েকদিনের জন্য এসেছে! ওকে কেন এ সব বিপদের মধ্যে ফেলা?” কিন্তু বাবা আর কাকা মা কে বুঝিয়ে বললেন যে প্রোটনেরই তো ক্লাস ফ্রেন্ড বিশাখা! তার এতো বিপদে যদি প্রোটন কোন সাহায্য করতে পারে করবে না কেন? নিউট্রন বললো “জ্যামা, তুমি একটুও চিন্তা করো না। প্রোটন আর আমি এক হলে ফেলুদাকেও হারিয়ে দিতে পারি! আর পাকড়াশী আঙ্কল তো আছেনই!”    
মিস্টার পাকড়াশী দমদম নাগেরবাজার থানার ওসি মিস্টার নবনীত ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সব কথা শুনে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। প্রথম কথা যে মাসীর কাছে বিশাখা থাকতো তার কাছে প্রথমে কিছুই জানা যাচ্ছিলো না। সবের উত্তরেই সে “আমি জানি না” বলছিলো। সে নাকি কখনোই বিশাখাকে ছেড়ে যায় না যতক্ষণ তার মা বা বাবা কেউ ফিরে না আসে। তারপর তাকে প্রচুর ধমক দিয়ে ভয় দেখিয়ে জানা যায় যে বিশাখা উধাও হওয়ার কয়েকদিন আগে কয়েকটি অচেনা লোক বাড়ি যাওয়ার সময় তাকে ধরে। তাকে মোটা টাকা দিয়ে বলা হয় ঐদিন দুপুরে ঘন্টা দুয়েকের জন্য তাকে বাড়ির বাইরে যেতেই হবে নইলে তার প্রাণ নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে! কিন্তু এই লোকগুলি কে বা কারা সেটা কোনভাবেই পুলিশ জানতে পারেনি। মাসী ভালোভাবে চেহারার বর্ণনাও দিতে পারছে না, কারণ তাদের সবার মুখে কালো মাস্ক পরা ছিলো। মাথায় ছিলো টুপি। খালি একটি লোক নাকি তোতলাচ্ছিলো! 
যাই হোক মিস্টার পাকড়াশী বললেন তিনিও ওদের সঙ্গে যাবেন। 

ষষ্ঠীর দিন বেশ কটা ঠাকুর দেখে এসেছিলো প্রোটন আর নিউট্রন। সবচেয়ে ভালো লেগেছে নবনিকুঞ্জের সন্দেশের ঠাকুর! অপূর্ব সুন্দর কড়াপাক সন্দেশ দিয়ে তৈরী! কী করে যে পিঁপড়ে ধরছে না, বুঝতে পারেনি ওরা। সকালবেলা নটা নাগাদ লুচি তরকারী আর পায়েস দিয়ে প্রাতরাশ সেরে নিউট্রন আর প্রোটন রওনা হলো। মিস্টার পাকড়াশী এলেন একটা মস্ত স্করপিও করে! যাদবপুরে ঐশিকাকে তুলে নিলো ওরা, তারপর গাড়ি সোজা চললো নাগেরবাজারের দিকে।  
সব প্যান্ডেলে সপ্তমী পুজোর মন্ত্রপাঠ হচ্ছে! একটু পরেই অঞ্জলি শুরু হবে, কিন্তু প্রোটনের মাথায় তখন পুজো টুজো কিছুই আর খেলছিলো না। নিউট্রনও বেশ গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। বেশ খানিকক্ষণ পর হঠাত বললো “ফোনটা অফ থাকলেও আই এম এ আই নম্বরটা থেকে কিন্তু পুলিশ বুঝতে পারে যে নম্বরটা কার আর কোথায় রয়েছে!” প্রোটন বললো “কোন ফোনটা রে? “কেন? যে ফোনটা থেকে হঠাত একটা মেসেজ এলো আর তারপরেই অফ হয়ে গেলো –“ “ও সেই মেসেজ? ওটা বিশাখার কিনা –!“ হঠাত ঐশিকা বলে উঠলো “ওটা বিশাখারই ছিলো। ও, সব মেসেজের শেষে কয়েকটা এক্সক্লামেশন সাইন দেয় সবসময়! ওটাতেও দিয়েছিলো!” হঠাত মিস্টার পাকড়াশী গম্ভীরভাবে বললেন “আমি আজই খোঁজ করতে বলছি!”

পুজোর দিনে বাইপাস অন্য সময়ের চেয়ে খালি ছিলো, কারণ এখানে কোন পুজো হয় না। লেকটাউন অবধি তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলো ওরা। তারপরেই ভীড়ে ভীড় চারিদিক! যাইহোক পুলিশের গাড়ির হুটার দেখে সবাই রাস্তা ছেড়ে দিচ্ছিলো বলে মোটামুটি ঘন্টাখানেকে বিশাখাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলো ওরা ঐশিকার ডিরেকশন মতো। বিশাখাদের বাড়িটা অনেক পুরোনো আমলের বিশাল তিনতলা বাড়ি! দোতলায় লম্বা জাফরী দেওয়া বারান্দা। সামনে অনেকটা খালি জায়গায় কোন এককালে বাগান ছিলো। এখন অযত্নের চিহ্ণ! বাড়িটা পুজোর দিনেও কেমন নিশ্চুপ পড়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ কোত্থাও নেই। গাড়িটা বাড়ির হাতায় ঢুকে বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে বাড়ির একতলার বারান্দার নীচে দাঁড়ালো। ওরা নামতে যাচ্ছে এমন সময় ভিতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বললেন “আসুন, আসুন! কী টেনশনে যে আমাদের দিন কাটছে ভাবতে পারবেন না!” ভদ্রলোকের পিছন পিছন ভিতরে ঢুকে একটা বড়সড় বসার ঘরে এসে বসলো ওরা। বড় বড় সোফা, চেয়ার, ঝাড়লন্ঠন, সেন্টার টেবল সুন্দর করে সাজানো। মিস্টার পাকড়াশী নিজের কার্ড দিতেই বিশাখার বাবা বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকালেন। মিস্টার পাকড়াশী বললেন 
“এরা সবাই বিশাখার স্কুল ফ্রেন্ড। ঐশিকাকে তো আপনি চেনেন। আর এ হলো আরাত্রিক। আর এটি ওর দাদা। বাইরে থাকে, পুজোয় এসেছে। ওই আমাকে জানায়। বিশাখার জন্য ওরা সবাই খুব চিন্তিত। বলুন তো এবার প্রথম থেকে – কী কী ঠিক ঘটেছিলো?”
ইতিমধ্যে বিশাখার মাও এসে বসেছেন। কেঁদে কেঁদে চোখগুলো ফুলে গেছে। এলোমেলো চুল। একটা হাউসকোট পরে চলে এসেছেন। তিনি বললেন 
“আমি বলছি। বিশাখা আমার ফোন থেকেই অনলাইন ক্লাসে ঢুকতো। আমি একটা ব্যাঙ্কে ক্লারিকাল কাজ করি। আমার দুটো ফোন। একটা বিশাখাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলাম অনলাইন ক্লাস করার জন্য। আমরা দুজন বেরিয়ে গেলে ও একটি কাজের মাসীর কাছেই থাকতো। তাকে বলাই ছিলো যে আমরা একজন অন্ততঃ না ফিরলে কোন অবস্থায় যেন ওকে ফেলে কোথাও না যায়। আর বিশাখাকেও বলা ছিলো কোন অবস্থায় যেন কাউকে দরজা না খোলে!“
“সেই মাসী কতোদিন ধরে আছে? সেন্টার থেকে নেওয়া?”
“হ্যাঁ। প্রায় গত দুবছর ধরে আছে। এমনিতে বেশ বিশ্বাসী। কিন্তু এখন তো ও পুলিশের কাছে বলেছে যে ঘটনার দিন ও নাকি ঘন্টা দুয়েকের জন্য মেয়ের বাড়ি চলে গেছিলো দুপুরবেলা! আর ঠিক সেই সময় কেউ একজন আসে, যাকে বিশাখা দরজা খুলেছিলো! কিন্তু কেন সেটাই আমরা বুঝতে পারছি না! ও কিন্তু কোন কারণেই অচেনা লোককে দরজা খোলে না। “
নিউট্রন হঠাত জিজ্ঞাসা করলো “আচ্ছা আন্টি, বিশাখা যে ফোনটা থেকে অনলাইন ক্লাস করতো সেটার সম্বন্ধে কিছু বলেছিলো আপনাকে?”       
“না তো” তারপর খানিক ভেবে বললেন “ও হ্যাঁ! ঠিক তো! ও মিসিং হবার দিনকতক আগে একবার বলেছিলো ফোনটা অদ্ভুত বিহেভ করছে। নিজে থেকেই নাকি অনেক উইন্ডো খুলে যাচ্ছে। আমি বেশি আমল দিইনি, ভেবেছিলাম নতুন ফোন কেনার জন্য ও সব বলছে। কেন বলতো?”
“না আন্টি, সম্ভবতঃ আপনার ফোনটা হ্যাক হয়েছে। কেউ সম্ভবতঃ আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ঢুকে হ্যাক করে ফোনটা আর আপনার মেসেজগুলো পড়ে ফেলে, যাতে বিশাখার স্কুলের অনলাইন ক্লাসের লগ-ইন আইডি, পাসওয়ার্ড ছিলো।“
এবার বিশাখার মা খুব অবাক হয়ে বললেন “সে কী! কী সর্বনাশ! আমি তো বুঝতেই পারিনি! আমার আরো কত কী থাকে! কে জানে আমার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট ডিটেলও পেয়ে গেলো নাকি! কিন্তু কেউ বিশাখার স্কুলের অনলাইন ক্লাসের আই ডি জেনে কী করবে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
এবার প্রোটন বললো “আন্টি আমাদের মনে হচ্ছে – ঠিক কি ভুল জানি না – আমিই প্রথম দেখি, দুটো বিশাখা লগ-ইন করে বসে আছে একদিন। কেউ কিছু একটা ইনফরমেশন চাইছিলো স্কুলের বা ক্লাসের ব্যাপারে – আর সেটা এক দু দিন লগ-ইন করে পেয়ে যায়। কিন্তু কী ইনফরমেশন সেটা –“
এবার মিস্টার পাকড়াশী বললেন “আচ্ছা আরাত্রিক, তুমি ভেবে বলো তো, যেদিন তুমি দুটো বিশাখাকে দেখলে, সেদিন বা তার আগের দিন, ম্যাডাম ক্লাসে কিছু বলেছিলেন, যেটা খুব ইমপরট্যান্ট?”
খানিকক্ষণ ভেবে প্রোটন বললো “একটাই জিনিস ম্যাম অ্যানাউন্স করেছিলেন, যে এবার ছুটির আগে স্টাডি মেটিরিয়াল পাঠানো হবে সবার বাড়িতে, সেগুলো সলভ করতে হবে, কারণ তার থেকেই হাফ-ইয়ারলিতে প্রশ্ন আসতে পারে। কিন্তু সেটা শুনে অন্য কারো কী লাভ?”
( ক্রমশ)


টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার
অমিতাভ দাস

নতুন সাইকেল চালানো শিখেছে বুবলাই। মজাটাই আলাদা। সব সময় ওর কেবল সাইকেল চালাতেই ইচ্ছে করে। বাবা দুপুরে বাড়িতে কাজ থেকে ফিরলে সে অপেক্ষায় থাকে, কখন বাবা ঘুমুবে আর সে সাইকেল নিয়ে টো টো করে ঘুরবে। পাশের বাড়ির বাবুদা ওকে বলে টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার। মাঝে মাঝে শাসন করে। এই নামটা বুবলাইয়ের খুব পছন্দের। কেন পছন্দের তা সে নিজেও জানে না। 
   সাইকেল চালানো শিখলে কী হবে , পুরোপুরি প্যাডেলে পা পায় না। লাফিয়ে লাফিয়ে সাইকেলে ওঠে। ভয় যে সে পায় না তা নয়। তবু ওই বয়সের একটা অপার্থিব আনন্দ আছে। একটা জোর , একটা মায়াবী আকর্ষণ আছে ছুটে চলার। নতুন কিছু জানার বা বোঝার। এই কৌতুহলটা সাংঘাতিক। 
       বাংলাদেশ থেকে মাসি এসেছে। কাল চলে যাবে। বড় মাসি এসেছে বলে ওরা মামাবাড়ি এসেছে।
        শনিবার। দুপুরবেলা। ঘটনাটা ঘটল।
     মামাবাড়ির পাশেই রাস্তার ধারে বিরাট পুকুর বসাকদের। পুকুরের উত্তর দিকে বিরাট সিনেমা হলের পাঁচিল সবুজ জঙ্গলে ঘেরা। দক্ষিনে রাস্তা। পূর্ব দিকে আর পশ্চিম দিকে ঘাট। নারকেল ও সুপুরিগাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরী। সাবধানে না নামলে পিছলে যেতে পারে পা। পুকুরের স্বচ্ছ জলরাশি দেখে বুবলাইয়ের খুব ভালো লাগত। গাছের সবুজ ছায়া পড়ত পুকুরে। মা-দিদিমাকে সে এই পুকুরে স্নান করতে দেখেছে। পুবদিকের ঘাটের সঙ্গে লাগোয়া বেশ বড় একটা ঝুমকো জবার গাছ। গাছে এত ফুল বুবলাই গুনে শেষ করতে পারে না। 
  সে এখন ক্লাস ফাইভ। মাঝে মাঝে বুকুন টুকুন কুট্টুস এদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে গাছে উঠে ফুল তোলে। 'বেশ বড় গাছ কিন্তু। পড়ে যাবি--সাবধানে।' টুকুন বলে। ওকে আশ্বস্ত করে ফুল তুলে আনে বুবলাই। টুকুনকে দেয়। টুকুনের মুখে আলো খেলে যায়। 
        বসাক বাড়িতে ছোট্ট এক কালী মন্দির আছে। সেই প্রথম বুবলাই কোনো বাড়িতে কালীমন্দির ও  মূর্তি দেখেছে। নীল রঙের প্রতিমা। সে জেনেছে জবা- ঝুমকো জবা এসব দিয়ে কালীপুজো হয়। কেন যেন দিনের বেলায়ও পরিবেশটা কেমন ছমছম করত। ভয় লাগত বুবলাইয়ের। মা-কে সেকথা বলায় মা বলেছিল , কালীঠাকুরের সঙ্গে সব সময় নাগিনী-যোগিনী থাকে।
--নাগিনী-যোগিনী কে মা?
  উত্তরে মা বলেছিল, অপদেবতা। বড় হও বুঝতে পারবে। একা একা কখনো পুকুর ঘাটে ও বসাকদের কালীমন্দিরের দিকে যাবে না। যখন-তখন বিপদ ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া দুপুরবেলায় ছেলেধরারা ঘোরে। মুখ বন্ধ করে বস্তায় ভরে নিয়ে যাবে। এসব কথা বোন বিশ্বাস করলেও বুবলাই বিশ্বাস করত না। বিশ্বাস করবার কথাও নয়। কারণ সে এখন হাই স্কুলে পড়ে। বড় হচ্ছে।

  সবাই যখন দুপুরে খেয়ে-দেয়ে গল্প করছে তখন কোনো এক ফাঁকে বোন মুনতাইকে সঙ্গে নিয়ে খেলতে বেরিয়েছে বুবলাই। খেলা মানে তো সাইকেল। বাবার সাইকেলটা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা। সেইটে দেখিয়ে বোনকে বুবলাই বললে, নতুন সাইকেল চালানো শিখেছি। উঠবি সাইকেলে? চল ঘুরে আসি।
--না বাবা, আমি যাব না । মা বকবে।
--জানতেই পারবে না। সবাই তো এখন ঘরে গল্প করছে। চল না। খুব মজা হবে।
   মুনতাইয়ের এখন ক্লাস টু। দাদার কথায় সে বেশ খুশি হল। বলল, চল তাহলে যাই। একটু খানি যাবো কিন্তু। মা যদি ডাকে...
    মুনতাইকে  সামনে বসিয়ে লাফ দিয়ে সাইকেলে উঠে বসল বুবলাই। রাস্তা ধরে কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে এলো। 
   নির্জন শীতের দুপুর। কোথায় যেন পাখি ডাকছে। রোদ্দুর গুটিয়ে নিচ্ছে ডানা। ধুলো উড়ছে সাদা হয়ে যাওয়া মাটির রাস্তা থেকে। মামাবাড়ির এই রাস্তাটা সব সময়-ই বেশ নির্জন। লোকজন কম চলাচল করে। অল্প কয়েক ঘরের বসতি মাত্র।
   বসাকদের পুকুরের সামনে আসতেই কেন যেন অন্য মনস্ক হয়ে গেল বুবলাই। রাস্তা থেকে বা-দিকে ঘেঁষে গেল সাইকেলটা। সেদিকে জল। পুকুরের দিকে তাকাল ।বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল কেন কে জানে! হঠাৎ পেছনের চাকার নিচে একটা ইটের টুকরো লেগে দড়াম করে পড়ে গেল পুকুর পাড়ে। বুবলাইয়ের মনে হল সাইকেলটা কে যেন পুকুরের দিকেই টেনে নিল। চিৎকার করে উঠল মুনতাই। সৌভাগ্য বলতে হবে। ছোটমামা কী একটা নিয়ে ঠিক সেই সময় বাজার থেকে ফিরছিল। দূর থেকে দেখেই দৌড়ে গেল । কোলে তুলে নিল মুনতাইকে। সে তো চিল চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। হাত ধরে তুলল বুবলাইকে। সে উঠেই আগে সাইকেলটা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অথচ ওর পা থেকে রক্ত ঝড়ছে। লোকজন ছুটে এসেছে। চিৎকার -চেঁচামিচিতে মা-বাবা-মাসি ও অন্যরাও হাজির। বাবা তো রেগে আগুন। এই মারে তো সেই মারে। ছোটমামা আটকে দেয় বাবাকে। মুনতাই কান্না করেই চলেছে। মামা বললে, কিচ্ছু হয়নি। কাঁদিস না। বিকেলে ক্যাডবেরি কিনে দেব। তারপর সে থামে।  ওর হাত-পায় ঘষা লেগেছে--রক্ত বেরোচ্ছে। 
  মাসি বললে, ডাক্তার কাছে নিয়ে যেতে হবে এখুনি। ইনজেকশন দিতে হবে। তা শুনে বুবলাইয়ের খুব কান্না পেল এবার। সে কান্না করে দিল। বলল, না আমি ইনজেকশন দেব না। খুব ব্যাথা লাগে। দিদিমা বুবলাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললে, মাথায় চোট পেয়েছে। ফুলে উঠেছে। তিনি বরফ এনে মাথার ক্ষতস্থানে ঘষে দিলেন। 
   সেদিন থেকে বুবলাই মামাবাড়িতে গিয়ে আর কখনো বসাকদের পুকুরের দিকে যায়নি। এমনকী তাকায় না পর্যন্ত। ঝুমকো জবা গাছেও ওঠেনি। সাইকেলেও হাত দেয়নি। ভালো ছেলে হয়ে দুপুরবেলা অঙ্ক কষেছে। বিকেলবেলা বাড়ির উঠোনেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলেছে ফুটবল -ক্রিকেট। বাবুদা কেবল বেশ কয়েকবার বলেছে, তোর আর টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার হওয়া হল না রে বুবলাই।


হারানো দিন
ভজন দত্ত

হারিয়েছি হাডুডু 
কাঁচেরগুলি কানামাছি 
সীতাহরণ ছু কিতকিত 
আইসবাইস খোলামকুচি
কুমীরডাঙা, লুকোচুরি  
রুমালচোর ডাংগুলি
এক্কাদোক্কা রান্নাবাটি 

শুনছি স্মার্টফোন হাতে 
স্মার্ট হচ্ছে পৃথিবী!

সাগর থেকে বিছানায়  
উঠে আসছে নীল তিমি।

ফুটবলও আজ হাওয়াহীন 
তোবড়ানো আর আনস্মার্ট। 

চৌরাশিয়ার বাঁশির সুর
এখন নির্মম বিষাদ...

পরীর ডানায় আকাশভ্রমণ 
মানসী গাঙ্গুলী


রাত অনেক হল। মিমির ঘুম আসছে না কিছুতেই। একটা পরীর গল্প পড়ছে শুয়ে শুয়ে কিন্তু গল্পে বেশ মনোযোগ দিতে পারছে না। আগে মা-বাবার মাঝখানে রাজকুমারীর মত শুয়ে ঘুমাত, দুজনেই কত আদর করত ওকে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। মনে মনে হাজার প্রশ্ন ভিড় করে আসছে। "মা কি পরী হয়ে গেছে? নাকি ঠাকুর? নাকি তারা?" মা-ই ছিল ওর জগত। সেই মা হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে মারা গেলে চারবছরের মিমি প্রকৃতই অনাথ হয়ে পড়ে। ছোট্ট মিমিকে নিয়ে বাবা বড় অসহায়। সকলে পরামর্শ দিল, "রঞ্জিত, একটা বিয়ে কর। যে গেছে সে তো আর ফিরে আসবে না। তোমায় সুস্থভাবে বাঁচতে হবে। নিজের জন্য, মেয়ের জন্য।" বাবাও ভেবে দেখলেন, "কথাটা ভুল বলেনি সবাই"। একবছর পার হলে মিমির নতুন-মা এল বাড়িতে। বাবা আর নতুন-মা পাশের ঘরে শুয়েছে। মিমি একা একটা ঘরে।
          মিমির মনে পড়ছে, "মা আমাকে কত আদর করত, গান শোনাত। সেইসব আনন্দের দিনগুলো আমার হারিয়ে গেল।" ও হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল। "কেন গো মা চলে গেলে আমায় একা ফেলে?" চোখ দিয়ে ওর জল গড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন জানলার কাচে ঠকঠক করছে। ভাবল মনের ভুল। কিন্তু না, আওয়াজ বন্ধ হল না। ও প্রথমে ভয় পেয়ে গেল। এই দোতলার ঘরের জানালায় কী করে কেউ এসে দাঁড়াবে? চোর নয় তো? উঠে বসল, তারপর ভাল করে তাকিয়ে দেখল জানলার দিকে। মনে হল যেন কোনো মহিলা। ও আস্তে আস্তে  জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অবাক হয়ে দেখল একটা পরী জানলার বাইরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ও। সত্যি সত্যি একটা পরীই তো। সাদা ফিনফিনে শাড়ি তার পরনে। সে শাড়ি যেন মাকড়সার জালের চেয়েও পাতলা। পিঠে দুটো ফিনফিনে সাদা-ডানা, মাথায় সাদা জালের মত ওড়না। ওড়নাটা মুখের ওপর পড়ে এক আলোছায়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাতে মুখটা পরিষ্কার বোঝা যায় না। পূর্ণিমার রাত। আকাশভরা জোছনা। সেই জোছনায় সাদা পোশাকপরা পরীকে অপরূপ দেখাচ্ছে। মিমি নির্নিমেষে সেইদিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের যেন পলক পড়ে না ওর।  মিমিকে আদর করে মিষ্টি স্বরে বলল পরী, "অমন করে কী দেখছ? চল আমার সঙ্গে বেড়াতে চল।" মিমির মনটা ছটফট করে উঠল বেরোবার জন্য। কিন্তু বলল, "যাব কী করে? বাবা যদি উঠে আমায় খোঁজে? নতুন-মা খুঁজে না পেয়ে যদি রাগ করে?" পরী বলে, "এ মা, বোকা মেয়ে, এখন তো সবাই ঘুমাচ্ছে, কেউ টেরও পাবে না। আর আমি তো তোমায় সকাল হবার আগেই আবার পৌঁছে দিয়ে যাবো।" 
"ঠিক তো, কেউ টের পাবে না তো?" 
"একদম ঠিক, দেখো না কত জায়গায় নিয়ে যাবো তোমায়। মেঘের দেশে, চাঁদের দেশে, আকাশভরা তারার দেশে।" 
মিমি হাততালি দিয়ে উঠল, "কী মজা, আমি যা-বো, আমি যা-বো।" জানালার কাচের কাছে পরী তার ডানা বাড়িয়ে দিল। অত পাতলা ডানা দেখে মিমি ভয় পেয়ে গেল। বলল, "আমি ডানায় চাপবো না, চাপলে তো ডানা ছিঁড়ে যাবে।" পরী মিষ্টি হেসে বলল, "পাগল মেয়ে, চেপেই দেখো না এ কেমন শক্তপোক্ত ডানা।" পরীর আশ্বাস পেয়ে মিমি খুব সাবধানে তার ডানায় চেপে বসল।
            পরী উড়তে শুরু করল। মিমি ভয় পেয়ে শক্ত করে চেপে ধরল পরীর ডানা। পরী হেসে ফেলল। "কোনো ভয় নেই মিমি, তুমি শুধু আনন্দ করে ওড়ার মজা নাও, মেঘের রাজত্বে ঘুরে সব দেখো।" পরী প্রথমে উঁচুতে উড়ল। সব বাড়ির ছাদ ছাড়িয়ে ক্রমে এরোপ্লেনের মত বেশ অনেকটা উঁচুতে উঠে উড়তে লাগল। নিচে শহরের রাস্তার আলোগুলো তারার মতো দেখাচ্ছে। মিমি হাততালি দিয়ে উঠল, "কী মজা, ওপরে একটা আকাশ, নিচে একটা আকাশ, তারায় তারায় ভরা।" পরী বলল, "কী মিমি, কেমন লাগছে বল।" "দারুণ দারুণ, আমার খুব আনন্দ লাগছে", উত্তরে মিমি বলল। এরপরই পরী টুক করে মেঘের মধ্যে ঢুকে পড়ল। গায়ের ওপর দিয়ে, নিচ দিয়ে, চারপাশ দিয়ে মেঘেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও থেকে তারাদের দেখা যাচ্ছে, কোথাও শুধুই ধোঁয়ার মত মেঘ। হঠাৎ মেঘের ফাঁক থেকে যেখানে তারা দেখা যাচ্ছে, পরী হাত বাড়িয়ে টুক করে সেখান থেকে একটা তারা নিজের হাতে নিয়ে নিল। বলল, "চলো, আর কোনো চিন্তা নেই। এই তারার আলোয় আমরা এখন আকাশে ঘুরে বেড়াবো। আর কোথাও অন্ধকার লাগবে না। মিমি অবাকের পর অবাক। ভাবে, "আমরা যেমন টর্চ হাতে নিয়ে ঘুরি, পরীরা তেমনি তারা হাতে নিয়ে ঘোরে!" আর কী উজ্জ্বল তার আলো। একটা তারায় এত আলো থাকে মিমির তা জানা ছিল না। দূর থেকে আকাশ পানে চেয়ে ও ছোট থেকে দেখেছে একটা আলোর বিন্দু যেটা মিটমিট করে জলে আর নেভে সেটাই তারা। এত কাছ থেকে তারা কোনদিন দেখেনি যে ও, তাই ওর চোখের ঘোর যেন আর কাটছে না কিছুতে।
          এবার পরী ওকে নিয়ে গেল পরীদের রাজ্যে। কত পরী আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতির মত। মিমি পরীকে জিজ্ঞেস করল, "এত পরী কোথায় থাকে? ওরা রাতে ঘুমায় না?" "এটা তো পরীদের রাজ্য, সব পরীরাই এখানে থাকে। আর আমরা পরীরা রাতে ঘুমাই না, আমরা দিনেরবেলায় ঘুমাই।" 
           ঘুরতে ঘুরতে আকাশের কোন প্রান্তে যে পরী নিয়ে গেল, সেখান থেকে মাটির পৃথিবীতে দিনের আলো, ঝকঝক করছে আকাশ, আর সারা আকাশ জুড়ে বিশাল বড় রামধনু। তার আগেই বোধহয় সেখানে বৃষ্টি হয়েছিল। মিমি রামধনু দেখেছে একবার, কিন্তু অতবড় রামধনু দেখেনি কখনও আগে। অতবড় রামধনু দেখে ওর যে কী আনন্দ হয়েছে। মুখে ওর রা'টি নেই। পরী বেশ অনুভব করতে পারছে ওর অবস্থা। কিন্তু দিনের আলোয় মিমি পরীকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। পরীর সব কথা শুনতে পাচ্ছে, নড়াচড়া টের পাচ্ছে, ডানায় বসে আছে কিন্তু অন্ধকারে যেমন পরিষ্কার দেখছিল চাঁদের আলোয়, সূর্যের আলোয় তা আর পরিষ্কার নয়। পরী বলে, "কী মিমি চাপবে নাকি রামধনুর ওভারব্রিজে?" মিমি ভাবে পরী ওর সঙ্গে মজা করছে। তাই বলে, "ধুর, রামধনুর ওপর চাপা যায় নাকি?" "হ্যাঁ তো, চাপা যায় বৈকি। চলো চাপাই তোমায়।" পরী হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে রামধনুর একদম উঁচুতে উঠে পড়ল মিমিকে ডানায় চাপিয়ে। মিমির যে কী মজা লাগছে! রামধনুর একদম উপরে উঠে পরী মিমিকে ডানা থেকে নামিয়ে দিল মাঝখানে। বলল, "এবার তোমার যেদিকে খুশি নিজে নিজেই নামতে পারবে।" মিমি খুব ভয় পেয়ে যায়। "পড়ে যাবো তো!" শুনে পরী বলে, "আমি তো আছি, আমি কি তোমায় পড়ে যেতে দিতে পারি? তুমি এখানে বসে পড়। যেমন করে পার্কে স্লিপে চড়ে স্লিপ খাও, তেমনি করে নামতে থাকো। যেই রামধনু শেষ হয়ে যাবে আমি আবার তোমায় ডানায় চাপিয়ে নেবো।" "ঠিক তো? পড়ে যাবো না তো?" "মোটেই না, আমি যেমন যত্ন করে তোমায় বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি, তেমনি যত্ন করে আবার তোমায় ডানায় তুলে নেবো। তুমি আনন্দ পাবে, তাই বললাম। যদি বেশি ভয় করে থাক।" "না না, আমি স্লিপ খাবো, তুমি আমায় ধরে নিও।" মিমি গড়িয়ে পড়ল। খুব মজা লাগছে ওর। খিলখিল করে হাসছে, হাততালি দিচ্ছে। রামধনু শেষ হতেই ও আবছা দেখতে পেল পরী ডানা পেতে ওর অপেক্ষায়। ও আবার পরীর ডানায় চেপে বসল। "কী, কেমন লাগল?" মিমি বলে, "ভারী সুন্দর, কেমন নরম নরম স্লিপ, পার্কের মত শক্ত নয়। তুমি খুব ভাল, আমায় কত আনন্দ দিচ্ছ।" "তুমিও খুব ভাল মিমি, তাই তো তোমায় আনন্দ দিতে উড়িয়ে নিয়ে এলাম আমি।" পরী উড়তে উড়তে আবার ওকে নিয়ে এল অন্ধকারের দেশে, রাতের দেশে। যেখানে মাথার ওপরের আকাশ তারায় ভরা, নিচের পৃথিবীর পথের আলো জ্বলছে তখনও তারার মত। মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। আকাশে অন্ধকারের ঘোর কাটছে। তারাগুলো আবছা হচ্ছে। পুব আকাশে লালচে আভা। ভারী মনোরম সে দৃশ্য। দিনের আলো ফুটে উঠছে। এবার ফিরতে হবে কিন্তু ওর মোটেই ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে আবার অন্ধকার হোক। তাহলে ও আকাশে পরীর ডানায় চেপে উড়ে বেড়াতে পারবে। কিন্তু তা যে হবার নয়। তাই পরী আবার ওকে ওর জানালায় নামিয়ে দিল। যাবার সময় পরী ওর দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে একটা চুমো ছুঁড়ে দিল। ভোরের আবছা আলোয় মিমি দেখল পরীর মুখটা ওর মায়ের মতো। "তার মানে মা পরী হয়ে গেছে? আমি মায়ের কথা ভেবে কাঁদছিলাম বলে মা আমায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। এতক্ষণ আমি টেরই পেলাম না! তাহলে মাকে কিছুতেই ছাড়তাম না।" মিমি "মা" করে চিৎকার করে উঠল। জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরে। নতুন-মা ছুট্টে এসে মিমিকে জড়িয়ে ধরল।  "এই তো মিমি, আমি তোমার কাছেই আছি।" মিমিও নতুন-মাকে জড়িয়ে ধরলো দু'হাত দিয়ে। নতুন-মা কেবল দেখতে পেল না মিমির দু'চোখ ভরা জল।


“পা বেরোনো কম্বল”
তথাগত বন্দ্যোপাধ্যায়

জেব্রার বাসাতে,
শীতকালে আসাতে,
জিরাফের সম্বল-
জেব্রার কম্বল।
নাক অব্দি টানতেই,
পা বেরোয় প্রান্তেই।
নিম্নাঙ্গয় টান-
দিলে গলা হয় ম্লান।
বিছানায় গড়াতে,
এ শাঁখের করাতে,
মাফলার গলাতে,
পা গুটিয়ে তলাতে,
হাঁটু তোলে আকাশে,
মুখ করে ফ্যাকাসে।



পুটুং

সৌমী আচার্য্য

পুটুং ঘাড় বেঁকিয়ে ডোডোর দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকল, তখন সবে সূর্য ডুববো ডুববো বলে গান ধরেছে। দল বেঁধে কত পাখিরা বাড়িও ফিরছে। তবে ডোডো পুটুংকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে দিব‍্যি গুটিগুটি হেঁটে চলল দেবাদারু এ্যাভিন্যূর দিকে। পুটুং জোরে চিৎকার করে উঠল। ডোডো একটু থেমে বলল, 'কিছু বলবি!'

-হ্যাঁ বলবো। তুই যা বলছিস সে সব বাজে কথা।

-বাজে কথা! কোনটা? আজ তোর রণিদাদার ধপাস করে জারুল গাছ থেকে পড়ে যাওয়া ? নাকি সাইকেল রেসে গো হারান হারাটা?

পুটুং রাগে কেঁপে উঠল চিৎকার করে বলতে শুরু করল, 'দেখ ডোডো, জারুল গাছ থেকে তোর হুতকো ঝুঁটি বাঁধা গোল্ডি ভাইয়া যে আমার দাদাকে ফেলে দিয়েছে সবাই সেটা জানে আর পরশু দাদার শরীর খুব খারাপ ছিল। তবু জোর করে হতচ্ছাড়া গোল্ডি দাদাকে সাইকেল রেস করিয়েছে। বাড়ি ফিরে কী বমি কী বমি। মামমাম তো কেঁদে যাচ্ছিল। পাপা শুধু বলল, ধৈর্য্য ধরো ধৈর্য্য।' ডোডো খ‍্যা খ‍্যা করে কেশে উঠল। বিচ্ছিড়ি ভাবে ঘুরপাক খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা নোংরা ন‍্যাকড়া ছুঁড়ে দিল পুটুং এর দিকে।

-যা যা নাক মোছ আর তোর রণিদার চোখের জল মুছিয়ে দে।

পুটুং আর সহ‍্য করতে পারল না লাফিয়ে উঠে রাগের চোটে ডোডোর বাঁ কানটা জোরে কামড়ে দিল। ডোডোর চিৎকারে ততক্ষণে গোল্ডি ছুটে আসতে শুরু করেছে বাড়ি থেকে। দেখামাত্র একলাফে ডোডোকে ছেড়ে পুটুং ছুট লাগাল বাড়ির দিকে। কিন্তু ও লক্ষ‍্য করেনি আকাশে কালো মেঘ করে এসেছে। বিকেলের হলদেটে আলোর গায়ে দেখতে দেখতে কেউ যেন ছাই রঙ ঘষে দিল। সতীশ বুড়োর আমবাগানের কাছে এসে জোরে মেঘ ডেকে উঠতেই পুটুং ভয় পেয়ে গেল। মেঘ ডাকলে বা বাজ পড়লে ও ভীষণ ভয় পায়। কী করবে বুঝতে না পেরে বাগানের ভেতর ঢুকতে গেল আর তখনি আবার মেঘ ডেকে উঠল।

                         (২)

'পুটুং, পুটুং' রণি ডাকতে ডাকতে চলেছে হাতে টর্চ। সাথে ওর বাবা চঞ্চল। কালবৈশাখীটা এমন দুম করে এসে গেল যে বাড়ির সবাই দরজা জানলা বন্ধ করা, মেলে রাখা জামা কাপড় তোলা এসব নিয়ে মহাব‍্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু সামলে সবার আগে রণিই বলল, 'মা পুটুং কোথায়?' রমিতা ঘর ঝাড় দিতে দিতে বলল, 'বাড়ির এত হ্যাপা সামলে আমি কি আর সে সব দেখতে পারি বাবা! কবার পুটুং বলে দেখ ডেকে।' রণি পুটুং পুটুং করে ডেকে কোনো সাড়া পেলনা। মনটা খারাপ হয়ে গেল ওর। মেঘ ডাকলে খুব ভয় পায় বেচারা। পরশু দিন যখন খুব বমি হচ্ছিল ও দেখেছে পুটুং ঘাড় কাত করে করুণ চোখে তাকিয়েছিল। রণি অস্হির হয়ে উঠল। বৃষ্টি থামতেই বেরোবে ভাবছে এমন সময় গোল্ডি এসে হাজির। এসেই হিন্দী বাংলা মিশিয়ে জগাখিচুড়ি ভাষায় চিল্লে উঠল।

-তোর পুটুং হামার ডোডো কো কাটা। ওকে দেখতে পেলেই মারকে মাথা ভাঙবো। বলে গিলাম বাদমে হামায় দোষ দিবে না।

রণি কিছুই বুঝতে পারলো না। চোখ সরু করে খানিক গোল্ডির দিকে চেয়ে থাকল। ভীষণ দুষ্টু প্রকৃতির ছেলে। আজ সবাই মিলে জারুল ফুল তুলে মহুয়া ম্যামকে দিতে যাবে বলেছিল। ওদের সবার প্রিয় মহুয়া ম্যাম আগামীকাল হায়ার স্টাডির জন্য আমেরিকা চলে যাচ্ছে। তাই রণি একটা দারুণ ছবি এঁকেছে আর সাথে জারুল ফুল। এই ফুলটাই ম্যামের বড্ড প্রিয়। কিন্তু গাছে উঠতেই গোল্ডি ঝুঁটি নাড়িয়ে বলল, 'তুই তো এঁকেছিস, ফির ফুল কেনো দিবি? ফুল হামি দিব।' আশ্চর্য কথা তো আঁকলে ফুল দেওয়া যাবে না ?

-তুই যা না ফুল পাড়। আমি কি বারণ করেছি?

এইবলে রণি যেই ডানদিকের সরু ডালে পা দিয়েছে অমনি পা দিয়ে ছোট্ট একটা লেঙ্গি। রণি সামলাতে পারল না, হুড়মুড়িয়ে পড়ল নীচে। সবাই হৈ হৈ করে উঠল। নির্বিকার ভাবে গোল্ডি বলল, 'আরে হামি উপড়ে উঠতে গিয়ে পা লেগে বেচারা গিরে গেল। তোল তোল।' রণি তখনি দেখেছে রাগে গজরাচ্ছে পুটুং। রাগের আরো বিশেষ কারণ ছিল। ও পড়ে যাওয়া মাত্র ডোডো নেচে কেঁদে গোলগোল করে ঘুরে আনন্দ প্রকাশ করছিল। এটা পুটুং মানতে পারেনি। সবাই রণিকে ধরাধরি করে তোলার পর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মহুয়া ম‍্যামের বাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েছে। পুটুং আর ডোডোকে ঠিক লক্ষ্য করেনি রণি। গোল্ডিও বন্ধুদের ওর উপর রাগ দেখে বাড়ি ফিরে গিয়েছে। তারপর এখন এইসব। রণি বাবার সাথে রাস্তায় বেরিয়ে এসে খুঁজতে লাগল।

-পুটুং! পুটুং!

হঠাৎ রণি শুনতে পেল সতীশ বুড়োর আমবাগানের দিক থেকে আওয়াজটা আসছে। বাবাকে নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে ক্ষীণ আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করল। আর তখনি গর্তের মধ‍্যে খুঁজে পেল পুটুংকে। কাদা জলে অর্দ্ধেক চুবে আছে। রণি চিৎকার করে উঠল। বাবার সাহায‍্যে ওকে ধীরে ধীরে উপরে আনতেই দেখল পিছনের বাঁপাটা মাটিতে লাগাচ্ছে না। তবু লেজটা নাড়িয়েই যাচ্ছে। রণি বুঝল গর্তে পড়ে পাটায় চোট পেয়েছে। কোলে তুলে নিতেই জিভ দিয়ে রণিকে চেটেচেটে অস্হির করে তুলল।

-রণিদাদা আমায় যেন বকবে না, আমি ডোডোকে কামড়ে দিয়েছি। সরি। কিন্তু ও ভীষণ পচা দুষ্টু। 

পুটুং এর কাঁইকুঁই ঘেউ আঁউ সবকিছুর অর্থ রণি বুঝতে পারছে। ওর বাবা হেসে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী এত বলছে বলত?'

-কী আবার ডোডোকে কামড়েছে তাই আমায় বোঝাতে চাইছে ও কেন কামড়েছে।

রণি হেসে ওকে বুকে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বলল, 'তবু তুই ঠিক করিসনি পুটুং, তোর পা সেরে গেলে ওকে সরি বলিস।' পুটুং ঘাড় কাত করে মন দিয়ে কথাটা শুনে ভুক ভুক ভৌঔঔঔ বলে প্রতিবাদ করল নাকি মেনে নিল সেটা ঠিক বুঝল না রণি। কেবল ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল। টর্চের আলোর রেখায় ওরা তিনজন বাড়ির পথ এগিয়ে চলল।


মেঘচোর

রাখী সরদার

কে গো তুমি !
মেঘরাজত্বের মেঘ নিয়ে সব
                     দিচ্ছ কোথায় পাড়ি?
কোন্ দেশেতে থাকো তুমি?
                     কোথায় তোমার বাড়ি?


নীলচে মেঘ,কালচে মেঘ আর
                   ভিজে মেঘের ছানা,
ছাড়ো বলছি, ওদের আমি
                       যেতে দেবনা।

আমি বৃষ্টিমালা,
মেঘের চূড়ায় ঘর,আমায় দেখে 
তোমার বলো কিসের এত ডর!

ভয় পাবোনা!
বলছো কিগো!তুমি যে মেঘচোর।
মেঘবালিকা কোথায় তোরা
খুঁজছি যে রাতভোর।

উড়ে বেড়াও মেঘের রাজা
           করো তোমার কাজ
মেঘবালাদের নিজ হাতে
                    সাজিয়ে দেব আজ।

বৃষ্টিমালা, শোনো শোনো
        এমনভাবে খেলোনা
ছোট্ট প্রাণে ওদের ওগো 
             কোনো ব‍্যথাই সয়না।

যাই গো রাজা,ফিরবো না আর
          তোমার দেশের মাঝে
মেঘচুরির অপবাদ
            প্রাণের মাঝে বাজে

যেওনাগো বৃষ্টিমালা
             লক্ষ্মী সোনামেয়ে
সব মেঘ দেব তোমায়
               এসো গান গেয়ে।

                    


ভ্রমণ

চীনের প্রাচীরের মাথায়

মলয় সরকার


সেবার গিয়ে হাজির হলাম , যাকে বলে ড্রাগনের দেশ, সেই চীনে। আমার তো পায়ের তলায় সর্ষে। সুযোগ পেলেই ‘পালাই  পালাই’ করি। চীনে যাওয়ার ইচ্ছা সেই কোন ছোটবেলা থেকেই । আর চীন মানেই চীনের প্রাচীর, যা নাকি চাঁদ থেকেও দেখা যায় ।যদিও ,প্রকৃত যাঁরা চাঁদে গিয়েছিলেন, সেই নীল আর্মস্ট্রং বা কেউ দাবী বা বিশ্বাস করেন নি যে, সেটা তাঁরা দেখেছেন বা দেখা সম্ভব।

কাজেই, চীনের রাজধানী বেজিং পৌঁছেই দু’ এক দিনের মধ্যেই সেটি দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা হল। চীনের প্রাচীর  দেখা যায় অনেকগুলো জায়গা থেকে। তার মধ্যে  মোটামুটি দুটো জায়গা বেশী প্রচলিত, একটা হল মুতিয়ান্যু আর একটা হল বাদালিং। আমরা ঠিক  করেছিলাম বাদালিং -এই যাব, কারণ, বাদালিং এ ভিড়টা একটু কম হয়। এখানে আরও একটা বড় কথা, দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য সব ব্যবস্থাও করা আছে।  তাই আমরা বাদালিং যাওয়াই মনস্থ করেছিলাম। ।

 ভোরে উঠে ট্যাক্সি নিতে হল। এখানে অনেক জায়গাতেই ট্যাক্সি নিতে হয়েছে। গেলাম, বাস যেখান থেকে ছাড়ে সেই ডেসেংমেন বাস স্টপে। 

পৌঁছালাম তো ঠিক, কিন্তু গিয়ে লাইন দেখে চক্ষু চড়কগাছ। আমরা তো ভাবলাম আজ আর দেখা হবে না । লাইনে তো ২-৩ ঘণ্টা লাগবেই।প্রচণ্ড ভীড়, সবাই বিশাল লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে। আর লাইন চলে গেছে অ্যানাকোণ্ডা সাপের মত সুদীর্ঘ দেহ নিয়ে। লাইন দেখে ভয়ই পেয়ে গেলাম।কি আর করব, যা থাকে কপালে , বলে, লাইনে দাঁড়ালাম।। কিন্তু কি আশ্চর্য, প্রায় ২০মিনিট থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যেই  বাসে ওঠার সুযোগ পেয়ে গেলাম।

 ব্যবস্থা দেখে আমরা তো তাজ্জব। প্রতি মুহূর্তে  একটা করে বাস ভরে যাচ্ছে আবার একটা বাস তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে এসে পড়ছে। ঝাঁ চকচকে কচি কলাপাতা রঙের লাক্সারী বাস। বেশ সুন্দর ব্যবস্থা।

আকাশও ছিল ঝকঝকে রোদে ভরা, মনটাও বেশ তাজা হয়ে উঠল বাসে বসে। টিকিট ব্যবস্থা বাসেই আছে। এক ঘণ্টার ‘নন্ স্টপ’ বাসযাত্রা। শহর ছাড়িয়ে সবুজের মধ্যে দিয়ে , কখনও উঁচু উঁচু পাহাড়ের পাশ দিয়ে,কখনও মাথা দিয়ে চলল বাস। আমাদের চললাম, স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে। মনের তখন যে কি উত্তেজনা, ঠিকমত , ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়। বেশ খানিকটা দূর , প্রায় আধ ঘণ্টা যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলাম সামনে এক টুকরো চীনের প্রাচীর। ভাবলাম এসে গেল নাকি! কিন্তু নাঃ, বাস এখানে থামল না ।

 আসলে এই যে প্রাচীর ,এটা সম্ভবতঃ ২১২ - ২০৬  খৃষ্টপূর্বে প্রথম তৈরী হয়েছিল বহিঃশত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে এবং মোট দৈর্ঘ্য ছিল সমস্ত শাখা - প্রশাখা মিলিয়ে প্রায় ২১০০০ কিমি মত। অবশ্য এর পর বহুবার তা নষ্ট হয়েছে ,আবার  সারানো হয়েছে। শেষে  সম্প্রতি চতুর্দশ  শতাব্দীতে মিং রাজাদের রাজত্বকালে এটি আবার সারানো হয়। তবু এর অনেক অংশই নষ্ট হয়ে গেছে কালের প্রভাবে । শুধু বিভিন্ন জায়গায় টুকরো টুকরো হয়ে স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে। তবে দর্শকদের দেখানোর জন্য বিশেষ ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে এই বাদালিং অংশকেই। এখানে সারা পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছেন । এই অংশের দেওয়াল প্রায় ২৬ ফুট উঁচু, এবং ৭.৫ মাইল বা ১২ কিমি লম্বা , চওড়ায় প্রায় কুড়ি ফুট । বলা হয় পাঁচটা ঘোড়া বা ২০ জন সৈনিক পাশাপাশি যেতে পারবে এর উপর দিয়ে। তবে দেখলাম ,তা বোধ হয় সব জায়গায় সম্ভব নয়। এর মধ্যে আবার বাদালিং অংশে মাত্র ৩.৭৪ কিমি দর্শকের জন্য  খোলা আছে যার মধ্যে ১৯টি ওয়াচ টাওয়ার আছে। তার মধ্যে সব চেয়ে উঁচু টাওয়ারটা ১২ নং টাওয়ার। এই টাওয়ারগুলো ছোটো ঘরের মত। এখানে পুরানো দিনে সৈন্যেরা বিশ্রাম নিত, খাবার খেত ,ঝড় বৃষ্টিতে দাঁড়াত আবার অন্য দূরের সৈন্যদের সংকেত দেখাত। এর পাথর প্রায় সমস্তটাই আনা হয়েছিল আশপাশ থেকেই।

যাক , গিয়ে তো নামা গেল বাদালিং এ। অবশ্য আসার পথে  বিভিন্ন  জায়গায় জায়গায়  টুকরো টুকরো প্রাচীরের অংশ চোখে পড়েছে।তবে অনেক জায়গাই বোধ হয় সুগম নয়।

নেমে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানা গেল, তিন রকম ব্যবস্থা আছে। হয় পুরোটা হেঁটে ওঠা, নয়ত’ ৪ নং ওয়াচ টাওয়ার পর্যন্ত পুলি কারে (Pulley Car) উঠে তারপর বাকীটা হেঁটে ওঠা, আর নাহলে পুরোটাই রোপওয়ে  চড়ে যাওয়া আসা। আমরা মধ্যপন্থাই নিলাম। তার দুটো কারণ আছে। প্রথমতঃ, ভয় আছে, পুরোটা হেঁটে উঠতে পারব কি জানিনা। দ্বিতীয়তঃ রোপ ওয়ে তে গেলে সবটা উপভোগ করা যায় না , হাঁটার মজাটাই মাঠে মারা যায়। অথচ পুলি কারে চাপলে সেটার অভিজ্ঞতাও হল , আবার হাঁটার মজাও হল। এত দিনের স্বপ্ন -চীনের প্রাচীর দেখা, সেখানে তার ওপর হাঁটব না , তা কি করে হয়! তাই শেষমেশ ‘পুলি কারে’ চেপে ৪নম্বর টাওয়ার পর্যন্ত যাওয়াই ঠিক হল। 

বেশ ঝলমলে রোদ। তবে হাল্কা একটা ভাল লাগা ঠাণ্ডা আছে। চারিদিকে উচ্ছ্বল চীনা ছেলে মেয়ে , বেশ কিছু বয়স্ক রয়েছে। তবে এখানে দেখছি অল্পকিছু বিদেশী পর্যটকও রয়েছে। বেশ সুন্দর প্রাচীর ,পাহাড়ের উপর। চারিদিকে ঢেউ খেলানো  পাহাড়ের সারি।তার উপর ঘন সবুজ গাছ দিয়ে ঢাকা। পুলি কারে যেতে হলে বিয়ার পার্কের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বিয়ার পার্কে বেশ কয়েকটা কালো ভালুক রাখা আছে। তাদের খাওয়ানো যায়, দেবার জন্য খাবার বিক্রী হচ্ছে। ওরাও খাবার চাইছে। এছাড়া, রাস্তার পাশে দেখি, আমাদের দেশের মত কিছু বিশেষ খাবার দোকান , গিফটের দোকান, এইসব। কি একটা খাবার বানাচ্ছে, ময়দার লেছিকে বড় কাঠের হাতুড়ী দিয়ে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে দমাদ্দম পিটোচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না। পরে শুনেছিলাম, ওরা এই দিয়ে একরকম মিষ্টি বানায়, তার নাম ‘মোচি’ ।এসব দেখে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছা হল না। তখন চীনের প্রাচীর ডাকছে।

 একটু উঁচু ঢালে হেঁটে এগোতেই একটা ছোট গেট দিয়ে ঢোকালো । দেখি , সেখানে একটা টানা চেনের উপর  পা ছড়িয়ে বসার মত পরপর ফাইবারের চেয়ার রয়েছে। এগুলো, চেনটা ঘুরলেই তার সাথে এগোবে। হাত দুটো খোলা , পিঠে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম ৪ নং টাওয়ার পর্যন্ত । বেশ মজাই লাগল। একটু পরেই ৪র্থ টাওয়ারএ এসে গেলাম। দেখলাম বেশ খানিকটা উপরে এসেছি। 

এখান থেকে আরম্ভ হল আমাদের আসল চীনের প্রাচীরের উপর হাঁটা।ভেবেই মনটা আনন্দে ভরে গেল যে, আমরা এখন সেই এতদিনের স্বপ্ন দেখা চীনের প্রাচীরের মাথায়! 
 

বাদালিং এ চীনের প্রাচীরে যাওয়ার গেট

চিনের প্রাচীরের সর্বোচ্চ ১২ নং টাওয়ারের কাছে
যথেষ্ট চওড়া ও মসৃণ রাস্তা প্রাচীরে


বেশ চওড়া রাস্তার মত, দুধারে প্রায়  চার ফুট মত উঁচু পাঁচিল দেওয়া চৌকো পাথর দিয়ে নিখুঁত ভাবে গাঁথা 
এক পাঁচিল , যা পাহাড় শ্রেণীর মাথার উপর দিয়ে একবার উঠে আর একবার নেমে, যেমন যেমন পাহাড় গেছে , সেইভাবে চলেছে বহুদূর। মাঝে মাঝে শুধু এক একটা ওয়াচ টাওয়ার দেখা যায়। আমি এর কয়েকটা শাখা প্রশাখাও দেখলাম । হয়ত তা প্রহরার সুবিধার জন্য ছিল। কিছু কিছু জায়গা ভেঙ্গে গেছে তাও দেখলাম। তবে সাবধানে এবং উঁচু- নীচু দেখে চললে পুরোটা হেঁটে যাওয়া কোন ব্যাপারই নয়। যেতে যেতে চারিদিকে সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়ের ঢেউ ঠিক যেন একটা সবুজ সমুদ্রের ছবি চোখের সামনে তুলে ধরে। সেই প্রাচীন যুগে কত মানুষ কত দিন ধরে কি ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় এই এত বিশাল কর্মকাণ্ড শেষ করেছে ভাবলে আশ্চর্য লাগে ।আমরা ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে, কখনও সিঁড়ি, আবার কখনও সমতল এইভাবে একসময় পৌঁছেই গেলাম সবচেয়ে উঁচু ১২নম্বর টাওয়ারে ।বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায় এখান থেকে।  
সেখানে খানিকক্ষণ থেকে আবার রওনা দিলাম ধীরে ধীরে রওনা দিলাম ফিরতি পথে। আমার বহুদিনের অধরা এক স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ার আনন্দে মনটা ভরে উঠল।
(ছবিগুলি লেখকের নিজস্ব এলবাম থেকে সংগৃহিত)

 আরও পড়ুন 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. ছোট্ট কিন্তু সুন্দর একটি ছোটদের পত্রিকা।

    ReplyDelete