জ্বলদর্চি

ব্যতিক্রমী সমুদ্র ঘোড়া /নিশান চ্যাটার্জী

জীবনের গভীরে বিজ্ঞান-২১

ব্যতিক্রমী সমুদ্র ঘোড়া

নিশান চ্যাটার্জী

ব্যতিক্রম হল বিজ্ঞানের অঙ্গ। তাই বিজ্ঞানকে চেনা ছকে বাঁধা দুঃসাধ্য। কিন্তু প্রকৃত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ব্যতিক্রমী ঘটনা সমূহ ব্যাখ্যা করাও বিজ্ঞানের অন্যতম সফলতা বলে ধরা হয়,যা অনেক সময় সমাজের বুকে জমে থাকা অচলায়তনের জগদ্দল পাথরকেও নিমেষে ধূলিসাৎ করে ফেলতে পারে। তাই কখনো কখনো তাকে কিছু স্বার্থান্বেষী শক্তি গণশত্রু নামে আখ্যায়িত করতেও পিছুপা হয়না। বিজ্ঞান বহু ক্ষেত্রেই মানুষকে আশ্চর্য সব ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে এবং কখনো কখনো তা প্রকৃতির স্বাভাবিকতা কেও ছাড়িয়ে যায়। সেরকমই আজকের আলোচ্য বিষয় হল একটি আশ্চর্যজনক  সামুদ্রিক জলজ মাছ -- সি হর্স (Sea Horse)। যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় 'হিপ্পোক্যাম্পাস', যা একটি গ্রীক শব্দ। গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী 'হিপ্পোস' মানে হল - ঘোড়া। আর 'ক্যাম্পোস' মানে হল - সমুদ্রের রাজা। গ্রীকদের কাছে পসেইডন (Poseidon) হল - সমুদ্র দেবতা। যার সামনের অংশ ঘোড়ার মত আর পিছনের অংশ মাছের মত। সেই জলের দেবতার সাথে মিল আছে বলেই এই প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নামের গণ 'হিপ্পোক্যাম্পাস'। আর ঘোড়ার মত গঠন বলে এর নাম সি-হর্স। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অগভীর সমুদ্রে প্রাণীটিকে দেখতে পাওয়া যায়। এরা লম্বায় ১.৫ সেন্টিমিটার থেকে ৩৫.৫ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। এটি একটি অস্থিবিশিষ্ট মাছ হলেও এদের কোন আঁশ নেই। বরং সারা দেহ অনেকগুলো শক্ত পাতের মতো ফলক দিয়ে নির্মিত গঠন দিয়ে ঢাকা আর তার উপর থাকে ত্বকের আবরণ। এদের পৃষ্ঠ পাখনা ও বক্ষ পাখনা থাকলেও পুচ্ছ পাখনা থাকেনা। তার  পরিবর্তে থাকে লম্বা একটি বাঁকানো লেজ। এরা মাছের মত জলের সঙ্গে সমান্তরালভাবে সাঁতার না কেটে উল্লম্বভাবে সাঁতার কাটে। এদের মুখটা ভারী অদ্ভুত। দুটো চোয়াল জুড়ে লম্বা হয়ে তৈরি হয়েছে তুন্ড , চোয়াল জুড়ে যাওয়ায় হা করে খাবার ধরার উপায় নেই। তাই তুন্ডের  ওপরে যে ছিদ্র থাকে সেই ছিদ্র দিয়ে এরা খুব ছোট ছোট চিংড়ি, লার্ভা বা কাঁকড়া জাতীয় প্রাণী মুখের মধ্যে টেনে নেয়। এরা গিরগিটির মতো রং পাল্টায়। এদের দেহে পাকস্থলী নেই তাই খাবার দ্রুত হজম হয়ে কোষে পৌঁছায়। এটি মাছের মতো দেখতে না হলেও এটিকে মাছ বলা হয় কারণ এরা ফুলকার  মাধ্যমে শ্বাসকার্য চালায়। এখনো পর্যন্ত সি হর্সের ৪৬ টি প্রজাতি পাওয়া গেছে। বিপদের মুহুর্তে, সমুদ্রের ঘোড়াগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের চলাচলের গতি বাড়িয়ে তুলতে পারে, তাদের পাখনা প্রতি সেকেন্ডে 35 বার ফ্ল্যাপ করতে পারে (কিছু বিজ্ঞানী এমনকি 70 নম্বরটিও কল করেন)। এই মাছগুলি সর্পিলভাবে উপরে এবং নীচে চলে যায়। যাইহোক, সামুদ্রিক ঘোড়াগুলি দ্রুত সাঁতার কাটতে সক্ষম নয় - তারা পরিচিত মাছের মধ্যে সবচেয়ে ধীর সাঁতারের রেকর্ডধারী হিসাবে বিবেচিত হয়। বেশিরভাগ সময়, সামুদ্রিক ঘোড়া জলে স্থিরভাবে ঝুলে থাকে, শেওলা, প্রবাল বা এমনকি কোনও আত্মীয়ের ঘাড়ে বা লেজ ধরে ঝুলে থাকে। তবে সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হল এই প্রজাতির মধ্যে গর্ভধারণের বিষয়টি। আমরা জানি সচরাচর  মা গর্ভধারণ করেন ও সন্তানের পরিচর্যা করেন। কিন্তু বাবাও কিছু অংশে কম যায়না। কারণ বাবারা কর্তব্যপরায়ণ, সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে মায়ের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে থাকেন। সমগ্র জগতে এই একই নিয়ম। কিন্তু যদি আমরা বলি বাবারা সন্তান ধারণ করবে আর বাচ্চা জন্ম দেবে,এমনটাও কি সম্ভব? এমন বিরলতম ঘটনা আমাদের জীবজগতেই রয়েছে। অনেকের কাছেই হয়তো তা জানা আবার অনেকের কাছে তা হয়তো অজানা। এই গর্ভধারণকারী বাবারা হল সি হর্স। সাধারণত পুরুষ সি হর্সের পেটে বটুয়ার মতো একটি থলি থাকে (অনেকটা কাঙ্গারু পেটের থলির মতো)। সঙ্গমের সময় স্ত্রী সি হর্স এই থলিতে ডিম পাড়ে। যতদিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের না হয় ততদিন ডিমগুলি পুরুষ সি হর্সের থলিতেই থাকে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সি হর্স শিশুরা পিতৃগর্ভ থেকে এসেছে। বিজ্ঞানীদের মতে সি হর্সের প্রাক সঙ্গম পূর্বে পুরুষ ও স্ত্রী সি হর্সের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সুস্পষ্ট হয়। এই সময় তাদের দেহের রং পরিবর্তন হয় ঘনঘন। পুরুষ সি হর্সে প্রজাতিভেদে ৯ থেকে ৪৫ দিন গর্ভধারণ করে (এটি প্রজাতির উপর নির্ভর করে)। পুরুষটি গর্ভধারণকালে ৩৩% বেশি অক্সিজেন নেয়, বেশি খাবার খায়। ডিমগুলি থলিতে নিয়ে খুব সাবধানে চলাফেরা করে। কোনো জলজ উদ্ভিদ ও পাথরের উপর বসে কাটিয়ে দেয় দিন ও রাতের বেশিরভাগ সময়। এ যেন সন্তানের প্রতি বাবার কর্তব্যপরায়ণতা ও ভালোবাসা। পুরুষের শরীর থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আর অক্সিজেন নিয়ে বাড়তে থাকে সি হর্সের ছানাপোনারা। বাবা সি হর্সের পেট ক্রমশ বড় হয় এবং বাচ্চাগুলি প্রসবের উপযোগী হলে পুরুষ সি হর্স পেটের থলি থেকে বাচ্চা গুলোকে বের করে দেয়। তবুও বাচ্চা প্রসবের সময় বাচ্চাদের মধ্যে মাত্র অল্প সংখ্যক বাচ্চা পূর্ণবয়স্ক হতে পারে। খাদক প্রাণী, জলের স্রোত, বাকি বাচ্চাদের কেড়ে নেয়। এদের মুখ অনেকটা দাবা খেলার ঘোড়া গুটির মত হয়। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ভঙ্গি, আঁকড়ে ধরার ক্ষমতা যুক্ত বাঁকানো লেজ দেখলে মনে সমীহ জাগে। তবে মজাদার বৈশিষ্ট্য হল এই প্রাণীটিকে এখন কৃত্রিম জলাধারেও পোষা হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়াতে এরকম একটি খামার আছে যেখানে সামুদ্রিক ঘোড়াকে লালন পালন করা হয়। এখনো পর্যন্ত সি হর্স এর সবচাইতে পুরানো ফসিলটির বয়স ১৩ মিলিয়ন বছর। প্রাকৃতিক পরিবেশে এরা ১-৫ বছর বাঁচে। প্রায় পাঁচটি বিভিন্ন প্রজাতির সি হর্স ভারতের প্রবাল প্রাচীর অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যায়। চীনে সি হর্সকে ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। বছরে প্রায় ২ কোটি সি হর্স এই উদ্দ্যেশ্যে আহরণ করা হয়। তবে বর্তমানে সি হর্সের ব্যাপকভাবে চাহিদা, মাছের জালে আটকে পড়া সি হর্সকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে অ্যাকোয়ারিয়ামে সাজানো -- এইসব কারণের জন্য এদের জীবন বিপন্নের পথে।মানুষ নিজেই সমুদ্রের ঘোড়াদের জন্য একটি বড় বিপদ। আজ, সমুদ্রের ঘোড়াগুলি বিলুপ্তির পথে - তাদের জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। বিজ্ঞানের কাছে পরিচিত 32টির মধ্যে 30 প্রজাতির সামুদ্রিক ঘোড়া রেড বুকের তালিকাভুক্ত। এর অনেকগুলি কারণ রয়েছে এবং তাদের মধ্যে একটি হল থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং ফিলিপাইনের উপকূলে স্কেটের বিশাল ক্যাপচার। মাছের বহিরাগত চেহারা  স্মারক এবং উপহার হিসাবে ব্যবহার করা লোকেরাও  তাদের ধ্বংস করেছে। NIO (NATIONAL INSTITUTE OF OCEANOGRAPHY)- এর বিজ্ঞানীরা বর্তমানে তাই এই বিষয়ে চিন্তিত।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments