জ্বলদর্চি

রাবণপোড়া /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪১

রাবণপোড়া

ভাস্করব্রত পতি 

"রামায়ণের ইতিহাস আছে লেখা রাবণ চিত্র শয্যাশরীর এঁকে ঘুমায় সীতা স্বয়ং / কী পাপ তাতে ফুটেছে শালুক, সে তো খুঁজবেই মত্ত মাছি, বজ্রশরীর, রক্তচক্ষু / আলিঙ্গনে তো আমার পূর্বপুরুষ লক্ষ চাঁদের পূর্বরাগ ছায়াতে হোক হংসমিথুন / ঘুমহীন শেষ অনার্য প্রতিনিধি ছড়িয়ে দিচ্ছে ছাই উর্বরতার কৃষিমাটি, মুখে শরীরে আগুন দাউদাউ / হেরে যাওয়া রাগ ও বিরক্তির এই তো উৎসমুখ পুড়ে ছাই, হাওয়া হচ্ছে ত্রিকালভূত / ফের নবজন্ম প্রবৃত্তি ও কামনার সংরাগ অন্তসূর্য তিলকে উঠে দাঁড়াচ্ছে দ্বন্দ্বময় প্রতীক / হে হাহাকার সম্ভবপর প্রসারিত সর্ব হাত, পুড়ছে আলো দিচ্ছে বিদ্যুৎ, চমকে উঠছে ঘাস, মাটি / হেরে যাওয়া দাঁত কিরিমিরি আমার পূর্বপুরুষ তার সঙ্গে হোক সীতার হংস মিথুন পুনরায়"-- 
'রাবণ' কবিতায় এভাবেই রাবণকে চিত্রায়িত করেছেন কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী। মহাবলী রাবণের পুত্তলিকা পুড়িয়ে অশুভ শক্তির বিনাশে ব্রতী হয় এই বাংলার মানুষ। লৌকিক এই উৎসবকে ঘিরে একটাই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে -- অহঙ্কার করলে পতন হবেই। সবকিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে অন্যায়ের পথে চললে।

সংস্কৃতে রাবণের অর্থ—‘ক্রন্দনের হেতু'। তামিলে এর অর্থ—'সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী'। কেউ কেউ বলেন, 'অতুলনীয় সৌন্দর্যের বালক’ বা ‘নীতিনিষ্ঠ ব্যক্তি'। রামায়ণ অনুসারে দশেরা বা বিজয়া দশমীর দিন তথা আশ্বিনের শুক্লাদশমীতে রামচন্দ্র বধ করেছিলেন রাবণকে। আবার মহাভারত অনুযায়ী ঠিক এই দিনেই পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের অজ্ঞাতবাস শেষ করে ফিরে আসে হস্তিনাপুরে। আবার ইতিহাস অনুযায়ী এই দিনই 'চণ্ডাশোক' থেকে 'ধর্মাশোক' এ রূপান্তরিত হয়েছিলেন মহামতী অশোক। সম্রাট অশোক এই বিজয়া দশমীর দিনই বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। শুধু অশোক নয়, পরবর্তীতে বাবাসাহেব আম্বেদকারও এই একই দিনে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।

বিজয়া দশমীতে শুধু রাবণ নয়, রাবণের সাথে মেঘনাদ এবং কুম্ভকর্ণের কুশপুতুলও দাহ করার রেওয়াজ রয়েছে। মানুষের বিশ্বাস, এই দশেরার দিন নীলকণ্ঠ পাখি দর্শন করলে সকলের জীবন সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে। তাই প্রাচীন জমিদারদের পারিবারিক পুজোয় নীলকণ্ঠ পাখি ওড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে। বর্তমানে এই পাখি বিলুপ্তপ্রায় হয়ে ওঠায় মাটির তৈরি প্রতিকী নীলকণ্ঠ পাখি ব্যবহার করা হয় কোথাও কোথাও।
দক্ষিণ ভারতে রাবণবধ বা দশেরা পালিত হলেও সেখানে আছে রাবণের মন্দির। দেবতাজ্ঞানে পূজিত হন তিনি। কাঁকিনাড়ার শিবমন্দিরে রাবণ পুজো হয়। সেখানকার ধীবররাই রাবণ পুজো করে। কর্নাটকের মহীশুর বা মাইসোর এ দশেরার দিন হাতিদের প্যারেড আয়োজিত হয়। এদিন এখানকার দেবী চামুণ্ডেশ্বরীকে নিয়ে 'বলরাম' এবং 'দ্রোণ' নামের দুটি হাতি শোভাযাত্রা করে। এই রেওয়াজ বহুদিন ধরে চলছে। রাজস্থানের 'রাবণহাত্তা' বাদ্যযন্ত্র রাবণের আবিষ্কার বলে প্রচারিত, যা আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। হিমাচল প্রদেশের কুলুতে সাত দিন ধরে দশেরা উৎসব উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়।

দশম চমরাজ ওয়াধেরা নামে এক রাজা দশেরা উৎসবের মূল আকর্ষণ কুশপুতুল পোড়ানোর রেওয়াজ প্রথম চালু করেন বলে তথ্য মেলে। শোনা যায়, মধ্যপ্রদেশের বিদিশা জেলার নেতারনের রাবণগ্রামে কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণরাই রাবণ পুজোর গোড়াপত্তন করেছিলেন। বহু আগে রাজা শিবশংকর কানপুরে রাবণ মন্দির স্থাপন করেছিলেন। একসময় অযোধ্যাতে প্রথম রাবণ পুজো হলেও এখন আর হয়না। রাজস্থানের আলোয়ারের কাছে এক জৈন মন্দিরে রাবণ পূজিত হন। কথিত আছে, রাবণ নাকি পরেশনাথের ভক্ত ছিলেন। এখানে আসার সময় তিনি পরেশনাথের মূর্তি আনতে ভুলে যান। মন্দোদরী তখন একটি মূর্তির ছবি এঁকে দেন। সেই ছবিতেই পুজো করতেন রাবণ। তারপর থেকে এই মন্দির ‘পরেশনাথ রাবণ মন্দির' বলে পরিচিত। নেপালে বিজয়া দশমী তথা দশেরাকে বলা হয় 'দশেঁ'। মহারাষ্ট্রতে এই বিজয়া দশমীকে বলা হয় 'অশোক বিজয়া দশমী'। 

এই বিশেষ দিনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কুস্তি খেলার প্রচলনও ছিল একসময়। আজ আর তেমন রীতি অনুসৃত হয় না। তবে আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশাতে এই দিনে এক বিশেষ রীতি অনুসরণের তথ্য মেলে। দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিনই তো বিজয়া দশমী। ফলে ঠিক বিসর্জনের আগে দেবীকে দইভাত, মিষ্টি, পিঠা এবং মাছভাজা খাওয়ানোর চল রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন পারিবারিক দুর্গাপূজায় এখনও এই রীতির খোঁজ মেলে। তমলুকের কেলোমালের বনমালীকালুয়া গ্রামে ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের আগে দেবীকে দইভাত তথা দধিকর্মা খাওয়ানো হয়।

ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিজয়া দশমীর দিন কয়েক হাজার মানুষ মেতে ওঠেন খড়গপুর শহরের নিউ সেটেলমেন্টের রাবণ ময়দানে আয়োজিত হয় রাবণপোড়া দেখতে। আঁকজমক এবং গঠনগত দিক থেকে এই রাবণপোড়া দুই মেদিনীপুর তো বটেই, সারা রাজ্যের মধ্যে উচ্চতার দিক থেকেও সেরার শিরোপা পেয়েছে। মূলতঃ দক্ষিন ভারতীয়দের দ্বারা 'দশেরা' উৎসবটি এখানে পরিচালিত হলেও উৎসবে সব ধরনের মানুষ ভিড় জমান। আজ বাংলার সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়েছে রাবণপোড়া। অবাঙালিদের পাশাপাশি বাঙালিরাও উৎসবের শরিক হন এখানে। 

দক্ষিণ পূর্ব রেলের খড়গপুর ও গোকুলপুর স্টেশনের মাঝে গিরি ময়দান স্টেশন। এই স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে খ্রীষ্টানদের কবরস্থান। তা ছাড়িয়ে কয়েক কদম গেলেই মিলবে রাবণ ময়দান। বিস্তীর্ণ মাঠ, সেই মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে দশানন। বিকেলে হয় রাবণপোড়া। তখন বিভিন্ন প্রাপ্ত থেকে গন্যমান্যরা এসে হাজির হন। থাকেন স্থানীয় বিধায়ক, পুলিশ সুপার, দক্ষিন পূর্ব রেলের ডি. আর. এম. সহ বিশিষ্ট অতিথিরা। বিভিন্ন বছর কোনও একজন অতিথিকে রাবণের বুকে তীর ছুঁড়ে রাবণপোড়ার সূচনা করতে দেওয়া হয়। এটাই এখানকার ট্রাডিশান। এ এক অনন্য লৌকিক উৎসব। যা ধীরে ধীরে বাঙালি সংস্কৃতির অন্দরমহলে প্রবেশ করে গিয়েছে।

মূল অনুষ্ঠানের আগে ময়দানে শুরু হয় রাম রাবণের নকল যুদ্ধ। অনেকটা ঠিক নতুন দিল্লীর রামলীলা ময়দানের মতো। শহরের গোলবাজারের রামমন্দির থেকে হয় রাম লক্ষ্মণ, সীতা এবং হনুমানকে নিয়ে সুসজ্জিত শোভাযাত্রা। দুপুরে শুরু হয় তা। ব্যান্ড পার্টি থাকে সঙ্গে। রামায়ণের নানা দৃশ্য সংবলিত ট্যাবলো নিয়ে সেই শোভাযাত্রা গোটা খড়গপুর শহর পরিক্রমা করে বিকেল পাঁচটা নাগাদ এসে পৌঁছায় রাবণ ময়দানে। এবার রাবণবধের পালা। কিন্তু তার আগে চলে নকল যুদ্ধ।

১৯২৫ সাল থেকে এই রেলশহরে চলছে লৌকিক উৎসব রাবণপোড়া। সেই থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে চলে আসছে এই উৎসব। সেদিন উৎসবের সূচনা করেছিলেন যে কয়েকজন, এঁদের মধ্যে ফুলচাঁদ বাজোরিয়া, উমাশঙ্কর মিশ্রদের নামোল্লেখ করা যায়। রেলের মাঠে সেই শুরু হওয়া উৎসবের রেশ ধরে তা ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠে রাবণ ময়দান নামে। একে রামলীলা ময়দানও বলা হয়।

বিজয়া দশমীর দিন সকালেই বহু বাঙালি ও অবাঙালি মানুষ স্নান করে হাজির হন গোলবাজারের রামমন্দিরে। যেখানে তাঁরা পুজো দেন। হনুমান মন্দিরেও পূজো দেন। এরপর জীবন্ত রাম, লক্ষ্মণ, সীতার সাথে শোভাযাত্রায় পা মিলিয়ে হাজির হন রাবণ ময়দানে। একসময় রামমন্দির সংলগ্ন প্রাঙ্গনে আয়োজিত হত রামলীলা অনুষ্ঠান। কিন্তু রামলীলার সীতার মালার নীলামকে কেন্দ্র করে খুনের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এই শোভাযাত্রার ট্যাবলোগুলি তৈরি করে বিভিন্ন আখড়া।

অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভের প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে এখানে আয়োজিত হয় রাবণপোড়া। যদিও এখন দেখনদারী ভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রতি বছর বিভিন্ন ক্লাবের হাতে সঁপে দেওয়া হয় রাবণ তৈরির ভার। তারাই রাবণের কাঠামো গড়ে তোলেন শিল্পীদের দিয়ে। গনেশ পুজার সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় খড়গপুরের রাবণপোড়ার জন্য রাবণ তৈরির কাজ। প্রায় ৫০ - ৬০ জন মিলে ব্যস্ত থাকে কাজে। এই রাবণের ১০ টি মাথা এবং ২০ টি হাত তৈরি হয়।

দন্ডায়মান রাবণের উচ্চতা তাক লাগানোর মতো। ২০১১ তে রয়্যাল স্টার অ্যাকাডেমি এখানে রাবণের উচ্চতা করেছিল ৫৮ ফুট। খরচ হয়েছিল ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। ২০০৮ এ তাঁরাই রাবণ বানিয়েছিল ৫৫ ফুট উঁচু এবং ৩৩ ফুট চওড়া। লেগেছিল ৮ কুইন্টাল কাগজ এবং ২০০ টি বাঁশ। কেবল মাথাগুলির উচ্চতা ১৫ ফুট। রাবণের সারা দেহে ছিল ২০ হাজার টাকার আতসবাজি। ২০০৭ এর তুলনায় ১০ ফুট বেশি উচ্চতা ছিল রাবণের। ২০০৫ এও এই ক্লাবের সদস্যরা রাবণ বানিয়েছিলেন। বিশালকায় দশাননের মূর্তিটিকে দাঁড় করানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল লোহার থাম্। ১৯৮৪ থেকে এখনে রাবণ তৈরির দায়িত্ব পায় গান্ধী সেবা সঙ্গম (নিউ সেটেলমেন্ট)। এ পর্যন্ত (২০১২) তাঁরা মোট ১৮ বার রাবণ বানিয়েছে। ২০০৬ তে এখানে রাবণের উচ্চতা ছিল ৫৩ ফুট এবং চওড়া ছিল ৩০ ফুট। ২০০৯ তে রাবণের উচ্চতা ছিল ৫৪ ফুট। আজাদ বয়েজ ক্লাব ৮০ হাজার টাকা খরচ করে বানিয়েছিল তা। এর মধ্যে ২৫ হাজার টাকার আতসবাজি ছিল। ২০১০ এ রাইজিং ফ্রেন্ড ক্লাব ৫৫ ফুটের রাবণ করেছিল। খরচ হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার টাকা। তবে ১৯৯৮ এর ১লা অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন খড়গপুরের রাবণপোড়া উৎসবে রাবণের উচ্চতা হয়েছিল সবচেয়ে বেশি ৬৩ ফুট। যা রেকর্ড। প্রতি বছর এরকম উচ্চতার গড়ে রাবণ তৈরি হয়। করোনা মহামারীর পরে ২০২২ এ এখানে নবোৎসাহে পালিত হয়েছে রাবণপোড়া। এই খড়গপুরের রাবণপোড়ার অনুপ্রেরণায় রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আজ রাবণপোড়া আয়োজিত হয়।

রাবণের মূর্তির থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা উঁচু মঞ্চে বসানো হয় সীতাকে। জীবন্ত সীতা এখানে বসে থাকেন রাবণের দিকে তাকিয়ে। গোটা ময়দান জুড়ে তখন ভিড় ভিড়াক্কায়। নানা ধরনের দোকানদার এবং নানা বর্ণের মানুষের ভিড়ে তখন 'মিনি ইন্ডিয়া' খড়গপুর মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। রাবণের মূর্তির মধ্যে থাকে অসংখ্য আতসবাজি। কোনও বিশিষ্ট অতিথিকে দিয়ে রাবণের বুকে তীর নিশানা করলেই রাবণের মূর্তিতে অগ্নিসংযোগ হয়ে যায়। তখন একে একে রাবণের মূর্তিগুলি জ্বলতে থাকে। তার মধ্যে থাকা আতসবাজিগুলি সশব্দে ফাটতে থাকে। নানা কেরামতি দেখা যায় আতসবাজির মাধ্যমে। এই উৎসবকে ঘিরে জনসমাগমের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলার রক্ষা করা একটি অন্যতম গুরুদায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। 

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বিজয়া দশমীতে রাবণদহনের কথা। এই বিশেষ দিন আসলে 'দশেরা'। এদিন অনেকেই সোনাও দান করেন। কিংবা সোনার প্রতিভূ হিসেবে শ্বেতকাঞ্চন গাছের পাতাও দান করেন। এই সোনাদানের বিষয়টির পিছনে এক সুন্দর কাহিনীর খোঁজ মেলে।

দ্বাপর যুগে বরতনু নামে এক ঋষির কাছে পড়তেন কৌটস। তিনি তাঁর শিক্ষা গ্রহণের কাজ শেষ হলে সিদ্ধান্ত নেন যে ঋষিবর তথা গুরুদেবকে কিছু গুরুদক্ষিণা দেবেন। সেকথা জানান বরতনুকে। কিন্তু এই গুরুদক্ষিণা নেওয়ার বিরোধী ছিলেন ঋষিবর। ঋষি তা জানালেও কৌটস দিতে চাইলেন। অগত্যা বরতনু তাঁর শিষ্যের কাছে ১৪ টি বেদ শেখানোর জন্য বেদ পিছু ১ কোটি করে মোট ১৪ কোটি স্বর্ণমুদ্রা চাইলেন।

কিন্তু দরিদ্র কৌটস ঐ পরিমান স্বর্ণমুদ্রা পাবে কোথা থেকে? বাধ্য হয়ে তিনি হাজির হন রঘুরাজের কাছে। ইনি রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ। সেই রঘুরাজের ভাণ্ডারেও ঐ পরিমান স্বর্ণমুদ্রা মজুত ছিল না। তখন রঘুরাজ শরণাপন্ন হলেন দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে। অবশেষে দেবরাজ ইন্দ্র ধনদেবতা কুবেরকে নির্দেশ দেন তখনি যেন অযোধ্যার প্রতিটি শ্বেতকাঞ্চন গাছের ওপর স্বর্ণমুদ্রার বৃষ্টি হয়। ঘটনাও তেমনই ঘটল। 

এবার কৌটস সেইসব স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে দিতে গেলেন ঋষি বরতনুকে গুরুদক্ষিণার প্রাপ্য হিসেবে। কিন্তু ঋষি মোটেও সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা চাইলেন না। তিনি নেবেন মাত্র ১৪ কোটি স্বর্ণমুদ্রা। বাধ্য হয়ে বাকি স্বর্ণমুদ্রা কৌটস ফেরৎ দিতে চাইলেন অযোধ্যারাজ রঘুরাজকে। কিন্তু রঘুরাজ জানান, দান করা জিনিস তিনি ফেরৎ নেবেন না। তখন কৌটস অতিরিক্ত যাবতীয় স্বর্ণমুদ্রা অকাতরে বিলিয়ে দেন অযোধ্যার জনগনকে। দিনটি ছিল বিজয়া দশমী তথা আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী। সেই থেকে এই দিনে মানুষজন সোনার প্রতিকল্প হিসেবে শ্বেতকাঞ্চন গাছের পাতা বিলি করে থাকে।

দশেরা মানেই দানব দহন। রাবণ, মেঘনাদ এবং কুম্ভকর্ণের কুশপুত্তলিকা দহন। এই কুশপুত্তলিকা নির্মিত হয় আতসবাজি দিয়ে; অর্থাৎ শব্দবাজির পঞ্চব্যাঞ্জন পরিবেশিত হয় এই উৎসবের মাধ্যমে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বিজয়া দশমীর দশেরা উৎসব দিয়েই শুরু হয় আতসবাজির উলঙ্গ কীর্তন। শব্দবিধি লঙ্ঘনের মাধ্যমে আমাদের সমাজ পরিবেশকে ধূষরিত করার নির্মম প্রয়াস। যার রেশ অনুরণিত হতে থাকে দেওয়ালী ছাড়িয়ে আরও বহুদূর পর্যন্ত।

উৎসবের নামে রাবণ দহনের মাধ্যমে আমরা আসলে পরিবেশকে পদদলিত করে থাকি বিষাক্ত গ্যাস উপহার দিয়ে। শব্দব্রহ্ম আমাদের বিদ্ধ করছে উৎসবের মুখোশ পরে। শব্দবাজির বিরুদ্ধে অনেকেই মুখ খুলেছেন। খোলা বাজারে বিক্রি হওয়া বাজির দিকেই আমাদের নজর পড়ে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু, সেই বাজি যখন মহাকাব্যিক চরিত্রের আড়ালে ধর্মীয় ভাবাবেগের মোড়কে আবির্ভূত হয় আমাদের সামনে, তখন কিন্তু আমাদের অনেকেরই নজর এড়িয়ে যায়। যেমন এই দশেরা উৎসবের 'রাবণপোড়া'র ক্ষেত্রে ঘটেছে।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments