জ্বলদর্চি

অভিবাসী দুর্গাপূজার মজার জোর খবর বয়স্ক বনাম অ-বয়স্ক/সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়

অভিবাসী দুর্গাপূজার মজার জোর খবর বয়স্ক বনাম অ-বয়স্ক

সীমা ব্যানার্জ্জী-রায়
গারল্যান্ড, টেক্সাস


দু বছরের পর বাঙালি আবার নিজের আয়ত্ত্বে এসেছে। ডালাসে ধুমধাম করে পুজো হল সপ্তাহান্তে ৩০শে সেপ্টেম্বর ও পয়লা অক্টোবর, ২০২২। ফুরফুরে রোদের হিমেল হাওয়ায় সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল শুক্রবার আর শনিবার সকাল সন্ধ্যে। জমজমাট পুজো প্যান্ডেল সরি প্যান্ডেল না-একটা হলঘর।

গ্রেনভিল আর্টস সেন্টার, ৩০০ এন ফিফথ স্ট্রীট, গার্ল্যান্ড, টেক্সাস-৭৫০৪০

আন্তরিকের ঠাকুর কুমারটুলি থেকে আনা হয়েছিল।

আমাদের ক্লাবের নাম-আন্তরিক। সত্যিই আন্তরিকের অভাব ছিল না। তবে দলবাজির মধ্যে বাঙালি নিজেদের আটকে রাখে এই সুদূর অভিবাসেও, তা কখনো হয় নাকি? আমাদের বাড়ী থেকে গাড়িতে মাত্র ৭ মিনিটের ব্যবধান তাই সেখানেই যাওয়া স্থির করেছিলাম। ডালাসে মোট তিনটে পুজো হয়-

১) আন্তরিক (কলকাতার পুজো), ২) ডি এফ ডব্লু(DFW)(ভারতের পুজো), ৩) রিদম(বাংলাদেশি পুজো)। এই ভাগগুলো আমিই এইভাবে করেছি। আন্তরিক(২৪ বছর, পরের বছর ২৫ বছর হবে)।

-নতুন যারা এসেছে তাদের সাথে আলাপ পরিচয় হলে পরের বার আবার তারা আসবে-যেখানে ক্লাবের নাম আন্তরিক। কাজেই আমার স্বভাবমত আলাপ করতে এগিয়ে গেছিলাম। খুব অন্তরঙ্গ হল সুদেষ্ণা আর তার ইউক্রেন বাসী ইউজিনের সাথে। জার্মানিতে পিএইচডি করতে করতে ভাব ভালোবাসা। তার থেকে প্রেম -তার পরিণতি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ। সুখী দম্পতি।

ওই যে কথায় আছে না-

যেখানে বাঙালি /সেখানে কূটকাচালি।

বেশ তো সব নিয়ম মেনে চলছিল-হঠাৎ আবার নতুন নিয়ম কেন? ভালো করে চিন্তা করলে খুব ভালো নিয়ম-কিন্তু সবাই তো সেভাবে নেবেন না? 'বয়স্ক' কথাটাকে অনেকে একটু মানে ভালোভাবেই এড়িয়ে চলেন বিশেষতঃ এই অভিবাসে তো একেবারেই না। আমেরিকানরা বলেঃ "বয়স একটা ফ্যাক্টর না-মনটা সবুজ থাকলেই বয়স সাঙ্ঘাতিক মার খায়।"

একজনঃ দেখো যতবার ওইদিকে যাচ্ছি ততবার বলে, “বয়স্কদের আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরে আমার চুলের সামনেটা দুএকগাছি সাদা বলে কি আমি বয়স্ক? অবশ্যই ভালোই হয়েছে একেবারে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে আরতি করলাম। ভাগ্যিস দেখা গেছে সাদা চুল। হা হা হা।

দ্বিতীয় জনঃ এতো একঘরে অবস্থা-না পাচ্ছি ঠাকুরের মুখ দেখতে আর না পাচ্ছি এক জায়গায় বসতে। ঠাকুরের মুখ তো অ-বয়স্কাদের দিকে। এখানেও নিয়ম জারী হবে- কে তা জানত?

কলকাতা থেকে মেয়ের কাছে আসা একজনঃ এখানে সব হচ্ছে কিন্তু কলকাতার মতন নয় কিন্তু।

আমি তো শুধু শুনতে গেছি বলতে তো যাই নি? তাও সুযোগ সুবিধা মত দুদিকেই টুকি টুকি খেলে আসছি। আগের দিন ছোট ভাই আসাতে এখানে মানে বাড়ির কাছের চাইনীজ আর ভিয়েতনামীজ মেশানো রেস্টোর‍্যান্টে ঢুকেই আগে ক্র্যাব আর চিংড়ি নিলাম। পরে যে এরা একসাথে আমার মুখে নৃত্য করবে তা কি আর জানতাম?

যাইহোক, শুক্রবার ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল বোধন-ষষ্ঠী আর সপ্তমীর পুজো। কলকাতা থেকে এসেছিল অঙ্কিতা ভট্টাচার্য তার গ্রুপের সাথে। বেশ ভালোই গান শোনা হল। "এ চতুরনাদ। বড়ে হুঁশিয়ার।" "খাইকে পান বেনারসওয়ালা।" সবাই খুব আনন্দ করলাম আমরা। নাচ হল খাওয়ার পরে বেশ -খাবার হজম হয়ে গেছিল। বিকেল পাঁচটা থেকে রাত বারোটা।

প্রথমদিনঃ চাইনীজ আর বাঙালি মিশ্রণে খাওয়া দাওয়া। সবার খাওয়া দেখে মনে হয়েছিল খুব সুস্বাদু খাবার।

নুডলস, সাদা ভাত, ভুট্টা বেসনে ভাজা, মাছের কালিয়া, মাটন কষা, আইস্ক্রিম ও গোলাপজাম। ভুট্টা বেসনে ভাজা আমার খুব ভালো লেগেছিল-নতুনত্ব ছিল তাতে।

অষ্টমীরঃ সকালের ভোগের খিচুড়ি, পরোটা, ল্যাবড়া, পাঁপড়ভাজা, বেগুনী, টমেটোর চাটনি ও পায়েস।

বিকেলে বাঙালির প্রিয় মুড়ি মাখা। জিলিপি, ডোনাট। খেতে খেতে একজন বললঃ "বাড়িতে এইভাবে মুড়ি মাখলে ভালো লাগে না, তাই না?”

“একদম ঠিক! তবে নারকোল ভেবে বেশ খানিকটা আদা নিয়ে ফেলেছিলাম।" হেসে বললাম আমি।

অষ্টমী রাতের খাবার ছিল... জিরা রাইস, দাল মাখানি, মটর পনীর, কলকাতার ট্যাংরা স্টাইল চিলি ফিস, চিলি চিকেন, চিকেন ফ্রাইড রাইস, ছাগলের মাংস, রায়তা, গাজরের হালুয়া।

ওহ হ্যাঁ! অষ্টমীর দিন যিনি অঞ্জলি মন্ত্র বলেছিলেন তার আগে তিনি একটি শিক্ষামূলক খুব সুন্দর একটা গল্প বলেন মাইকে; গল্পটা এইরকম যতটা মনে আছে লিখি কেমন? ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী।

...এক নিষ্ঠাকাষ্ঠা ব্রাহ্মণের এক পুত্র ছিল। তিনি সেই পুত্রকে সুশিক্ষার জন্য গুরুগৃহে পাঠালেন। পুত্র সব শিক্ষা শেষে নিজের গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি তার পিতাকে বললেন, “আমি সব শিক্ষা শেষ করে এসেছি বাবা। বেদ, গীতা, সব সমাপ্ত করে এসেছি।"

পিতা বললেন, “তা বেশ। তবে তুমি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে ভাববো, তোমার শিক্ষা

সম্পূর্ণ হয়েছে। বলো দেখি পুত্র? পাপের প্রিয় বাপ কে?”

পুত্র অবাক হয়ে পিতাকে বললেন, "এ কেমন ধারা প্রশ্ন পিতা? পাপের বাবা পাপ আবার কে হবে?”

"না পুত্র! তুমিই এর সঠিক উত্তর খুঁজে আনো। শুধু জেনো পাপের শুধু এক বাপই নয়! সমস্ত সৃষ্টির শুরু থেকে পাপের তিন বাপ রয়েছে৷ আর এই তিন বাপ হল কাম, ক্রোধ, লোভ৷"

ব্রাহ্মণপুত্র বললেন, “বেশ আমি চললাম, যতদিন না এর উত্তর আমি না পাই... আমি গৃহে ফিরব না।" যেতে যেতে যার সাথেই দেখা হচ্ছে, সবাইকে পিতার বলা প্রশ্ন করছেন। কিন্তু কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারছে না।

তখন সেই ব্রাহ্মণপুত্র ঘুরতে ঘুরতে এক নির্জন গ্রামে এসে পৌঁছালেন সেখানে চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। খুব সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ। মাটি দিয়ে লেপা সেই সুন্দর গৃহ। একদিকে পরিষ্কার তুলসী মঞ্চ। তার চারিপাশে খুব সুন্দর আলপনা দেওয়া। ব্রাহ্মণপুত্র ভাবলেন, “ এখানে নিশ্চয়-ই কোনো বৈষ্ণব বাস করেন।" তাই তিনি প্রবেশ করলেন সেই গৃহে। এদিকে সারাদিন ঘোরার ফলে খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েছিলেন ব্রাহ্মণপুত্র।

ওনাকে ঢুকতে দেখে এক মহিলা বাইরে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি চাই আপনার? আপনার পাদস্পর্শে আমার গৃহ আজ পবিত্র হয়েছে।”

ব্রাহ্মণপুত্র বললেন, “আমি এই বাড়ীর মালিকের সাথে দেখা করতে চাই।"

তখন সেই মহিলা বললেন, "আমিই এই বাড়ির মালিক। বলুন আপনার কি জিজ্ঞাস্য আছে।"

"আমি খুব তৃষ্ণার্ত একটু জল খাওয়াতে পারবেন?” ব্রাহ্মণপুত্র বললেন।

“নিশ্চয়-ই! আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।" বলে মহিলা ভেতরে চলে গেলেন। খানিক পরে একটি পরিষ্কার মাটির পাত্রে ঠান্ডা জল এনে ব্রাহ্মণপুত্রকে দিলেন।

ব্রাহ্মণপুত্র সেই জল খেয়ে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ আপনি তো বৈষ্ণব, তাই না?”

সেই মহিলা তখন বললেন, “না, আমি একজন পতিতা।"

ব্রাহ্মণপুত্র শুনে বললেন, “কী? পতিতা? এ তো শোনাও পাপ। ছি ছি ছিঃ-এ আমি কি করলাম। যাই গঙ্গায় ডুব দিয়ে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করি গে।"

মহিলা বললেন, “শুনুন, আমি আপনাকে ৫টি স্বর্ণমুদ্রা দিচ্ছি- নিয়ে নদীতে স্নান করে আসুন। আপনার সব পাপ ধুয়ে যাবে।"

ব্রাহ্মণপুত্র কিছুক্ষণ চিন্তা করে মনে মনে ভাবলেন, “৫টি স্বর্ণমুদ্রা যখন বিনা পরিশ্রমে পাচ্ছি তখন না নেওয়ার কি আছে?”... সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়ে গেলেন।

এইবার সেই মহিলা বললেন, "আমার আরো একটি প্রশ্ন আছে।"

"বলুন!" বললেন ব্রাহ্মণপুত্র।

“আমার খুব ইচ্ছে আমি নিজের হাতে রান্না করে আপনাকে খেতে দেব। আর আপনাকে ৩টি স্বর্ণমুদ্রা দেব।"

ব্রাহ্মণপুত্র আবার চিন্তা করে ভাবলেন, “আরো ৩টি স্বর্ণমুদ্রা? খারাপ তো নয়।" স্বর্ণমুদ্রা পেয়ে নদীতে স্নান করে আসলেই তো সব পাপ দূর হয়ে যাবে।"

ব্রাহ্মণপুত্র রাজি হলে সেই মহিলা আবার বললেন, “ঠাকুর! আমার আরো একটি প্রশ্ন আছে। আমার খুব ইচ্ছে আমি নিজের হাতে আপনাকে খাইয়ে দেব।"

ব্রাহ্মণপুত্র বললেন, "না না তা হয় না। আমার পাপ হবে তাতে।"

তখন সেই মহিলা আবার বললেন, “আমি আপনাকে ৫০ টি স্বর্ণমুদ্রা দেবো। তারপরে আপনি গঙ্গায় ৫ ডুব দিয়ে স্নান করে আসবেন। আপনার সব পাপ ধুয়ে যাবে গঙ্গার জলে।"

ব্রাহ্মণপুত্র রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু সেই মহিলা তখন ব্রাহ্মণপুত্র-এর গালে ঠাস করে এক চড় দিলেন।

ব্রাহ্মণপুত্র রেগে গিয়ে বললেন, “ একি আপনি আমাকে মারলেন কেন?”

"আপনি ব্রাহ্মণ হয়ে লোভের বশবর্তী হয়েছেন... তাই আমার এই চড় আপনার গালে পড়ল। ছিঃ ছিঃ ছিঃ আপনি এত লোভী ? জেনে রাখুন কাম ক্রোধ আর লোভ হচ্ছে পাপের বাবা।"

ব্রাহ্মণপুত্র পিতার দেওয়া প্রশ্নের উত্তর মহিলার কাছে জানতে পেরে মনে মনে খুব অনুশোচনা করতে লাগলেন।

বেশ ভালো লেগেছিল শিক্ষামূলক গল্পটা শুনে। তাই আপনাদের ও জানালাম। আশা করি ভালো লাগবে।

আমাদের এখানে সিঁদূর খেলা হবে ৮ই অক্টোবর। দূরে হওয়াতে রাতে আর ড্রাইভ করে যাব না।

এই দেশে আত্মীয়-স্বজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার দরুণ আজ পর্যন্ত আমি সুদূর আমেরিকায় বেশ কয়েকটা শহরে পুজো দেখেছি। পুজোর শেষে মা আবার সপরিবারে কারুর গ্যারেজে বাক্সবন্দী হয়ে থাকবেন।

বাঙালি আছে বাঙালিতেই-বেশ বোঝা যায়। একটু মজা করে লিখলাম।

ঢাকের তালে তালে বললাম-

"আসছে বছর আবার এসো মা।

তুমি যে শান্তি রূপেন সংস্থিতা।"
 
পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments

  1. তোমাদের ওখানে 2দিনে পুজো শেষ হয়?

    ReplyDelete