জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/দ্বাদশ পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
দ্বাদশ পর্ব         
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


দীপক রাগ 

পরের দিনে সরস্বতী সকাল বেলায় যখন গানের তালিম নিতে পিতার কাছে এলো তানসেন তখন গতকালের দরবারে সম্রাটের আদেশের কথা বলে তাকে বললেন "দেখ সরস্বতী, দীপক রাগ গাইলে বাতাস উত্তপ্ত হয়ে রাগ পরিবেশন স্থলে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হবার সম্ভাবনা শতকরা একশো ভাগ। সে ক্ষেত্রে গায়কের শরীর দগ্ধ হয়ে যাবে। একমাত্র উপায় হচ্ছে সেই স্থানে মেঘমল্লার রাগে বাতাসকে শীতল করে মেঘের সঞ্চার করা। মেঘ সঞ্চারের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যে ধারাবর্ষনের মাধ্যমে অগ্নিকে নির্বাপিত করা। আমি সম্রাটের আদেশ পালন করতে বাধ্য। সে ক্ষেত্রে আমি তোমাকে মেঘমল্লার রাগের তালিম দিয়ে তৈরী করব। ঐদিন তুমি আমার সাথে দরবারে যেয়ে মেঘমল্লার রাগ গেয়ে আমার দগ্ধ শরীরকে বাঁচিয়ে তুলবে। তোমার নিখুঁত গায়নে আমার জীবন রক্ষা পাবে। তুমি পারবে তো এই রাগ সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করতে"? পিতার কাছে সমস্ত ঘটনা শুনে সরস্বতী বলল "আপনি আমাকে আজ থেকেই মেঘমল্লার রাগের তালিম দেন। আমি নিশ্চিত যে আপনার কাছে শুদ্ধভাবে গায়কী রীতি অনুশীলন করে আপনার জীবন রক্ষা করব"। পিতা-পুত্রীর এই কথা দরজার বাইরে থেকে রূপোয়াতী শুনে যার পর নাই চিন্তিত হলো। তার মনে হলো যদি কার্যক্ষেত্রে সরস্বতী মেঘমল্লার রাগ গাইতে কোন কারনে অসমর্থ হয় সে ক্ষেত্রে গুরুজীর জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।                                                 

সেই দিন থেকে তানসেন সকাল-সন্ধ্যা দু' বেলাতেই সরস্বতীকে মেঘমল্লার রাগের তালিম দিতে লাগলেন। তালিম দেওয়ার সময় তিনি বুঝতে পারলেন দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন তাকে জানিয়ে দিলো 'তুমি রূপোয়াতীকে গানের তালিম দিতে অপারগ হলেও তার একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা সে এইভাবে সমস্ত রাগ গাইতে পারদর্শী হবে। তানসেন মনে মনে খুব খুশী হলেন। ইতিমধ্যে একদিন দরবারের শেষে বীরবল ও বাজ বাহাদুর তানসেনের হাভেলিতে এসে বললেন সংগীত সম্রাট আমরা গোপনে জানতে পেরেছি মিঞা খোদাবক্স ও তার সঙ্গীরা আপনাকে বিপদে ফেলার জন্য তাদের পরিকল্পনা মতো সম্রাটকে দিয়ে আপনাকে দীপক রাগ গাইবার আদেশ বের করেছেন। ভালো মন্দ না বুঝে নিজের আভিজাত্য বোধে সম্রাটও তাঁদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আপনাকে আদেশ করেছেন। ফিরে যাবার সময় তারা স্বস্তি প্রকাশ করে ফিরে গেলেন যে তানসেন নিজেকে বাঁচানোর জন্য সরস্বতীকে নিখুঁতভাবে মেঘ মল্লার রাগ গাইবার রীতি অনুশীলন করাচ্ছেন এবং সরস্বতীও পিতার নির্দেশ মত সঠিকভাবে অনুশীলন করছে। 

সম্রাটের আদেশ দেওয়ার পরে ত্রয়োদশ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দিন সন্ধ্যেবেলা রেওয়াজের শেষে তানসেন সরস্বতীকে বললেন "আজ তুমি এককভাবে রাগটি গাও। দেখি তুমি নিখুঁতভাবে রাগটি গাইতে সক্ষম হয়েছে কিনা?" সরস্বতী নিখুঁতভাবে রাগটি গেয়ে শোনানোর পরে তানসেন বললেন "তুমি সঠিকভাবেই রাগের গায়কীরীতি রপ্ত করেছ দেখে আমি আনন্দিত। আগামীকাল ও তার পরের দিন অর্থাৎ মাঝখানে আর দুদিন সময় আছে"।                   

সময় এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে চতুর্দশ দিন সময় পেরিয়ে আজ পঞ্চদশ দিন। সারা দিল্লিবাসী জেনে গেছে আগামীকাল দেওয়ান-ই-আমের সম্মুখস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সংগীত সম্রাট দীপক রাগ গাইবেন, যে রাগের প্রভাবে অগ্নি প্রজ্বলিত হবে। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয়েছে এই কারনেই যে দেওয়ান-ই-আমের দরবার কক্ষে এত লোকের স্থান সংকুলান হবে না। বেগম সাহেবারা থেকে দাসী-বাঁদী, হাবসী খোজা প্রহরীরা সকলেই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে কখন আগামীকাল সকালে বহু প্রতীক্ষিত এই অনুষ্ঠানটি হবে।   

আজ সকালে যথারীতি যমুনাতে স্নান সেরে কন্যা সরস্বতীকে মেঘমল্লার রাগের তালিম দিলেন। সরস্বতী নিখুঁতভাবে মেঘমল্লার রাগটি আয়ত্ত করেছে দেখে নিজেই কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। সরস্বতী নিজের কক্ষে চলে যাবার পরে প্রাতঃকালীন আহার সমাপনান্তে তানসেন পুনরায় সংগীত কক্ষে প্রবেশ করে সার দিয়ে রাখা বীণাগুলি একে একে হাত দিয়ে একটি বিশেষ ধরনের বীণা হাতে তুলে নিয়ে কোলের উপরে বসিয়ে রেওয়াজ শুরু করলেন। কয়েকদিন পূর্বেও বীণাগুলির উপর ধুলোর আস্তরণ পড়ে ছিল, কিন্তু রূপোয়াতীর হাতের ছোঁয়ায় সেগুলি চকচক্ করছে। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবেননি এই বীণা তাঁকে হাতে তুলে নিতে হবে। এই সময়ে রূপোয়াতীর কথা তাঁর মনে পড়লো। সেদিনের পরে তার সাথে আর দেখা হয়নি।       

এই সেই রুদ্রবীণা যে বীণার তারগুলি আগামীকাল তানসেনের অঙ্গুলি স্পর্শে ঝঙ্কৃত হয়ে প্রকৃতিতে রুদ্ররূপের সৃষ্টি করবে। তানসেনের মনে পড়ে গেল বহু দিন পূর্বের কথা যেদিন হরিদাস স্বামী তাকে বলেছিলেন "তোকে তো সব শিক্ষাই দিলাম এবং সমস্ত শিক্ষাই ভালভাবে আয়ত্ত করেছিস কিন্তু আজ তোকে আমি এমন একটি রাগের তালিম দেবো যে রাগের তালিম আমি ইতিপূর্বে কাউকে দিইনি"। এই বলে তিনি একটি বীণাযন্ত্র হাতে নিয়ে বলেছিলেন "চেয়ে দেখ এই বীণার নাম রুদ্রবীণা। মা পার্বতীর অনুপ্রেরণায় স্বয়ং মহাদেব সপ্ততার বিশিষ্ট এই বীণার সৃষ্টি করেছিলেন এবং তাঁর নামানুসারে এই বীণাকে রুদ্রবীণা বলে। এই রুদ্রবীণা ঝঙ্কারে তোকে তালিম দেব 'দীপক' রাগের"। এই বলে হরিদাস স্বামী সেই বীণা হাতে নিয়ে বাজাতে বসলেন। তার অঙ্গুলিস্পর্শে সাতটি তারে যেন প্রাণের জোয়ার এলো। একসময় রামতনু অনুভব করলেন বাতাস ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন "গুরুদেব বন্ধ করুন"। পরে গুরুদেব বলেছিলেন "এই রাগের গায়কীরীতি কেবলমাত্র তোকেই জানালাম, আর এই রাগকে প্রশমিত করতে হলে মেঘমল্লার রাগ বাজাতে হবে"। এরপরে যখন আশ্রম ছেড়ে রামতনু ঘাউস মহম্মদের কাছে শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন তখন হরিদাস স্বামী তার যত্নের এই বীণাটি রামতনুকে দিয়ে বলেছিলেন "এটা তুই নিয়ে যা। এই বীণা বাজানোর তো আর কাউকে পাব না, তোর কখনো হয়ত কাজে লাগবে"। স্মৃতির পাতায় একে একে সব ভেসে আসছে।                                 

সকাল থেকে প্রথমে রুদ্র বীণার তারগুলি পরীক্ষা করে সঠিকভাবে সেগুলিকে বাঁধলেন। এরপর শুরু করলেন তাঁর রেওয়াজ। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রুদ্রবীণার ঝঙ্কারে সমস্ত হাভেলি গমগম করতে লাগলো। তাঁর রেওয়াজ যখন শেষ হলো তখন সূর্যদেব পশ্চিম দিগন্তে অস্ত গেছেন। আজ তিনিও মনে মনে খুব উত্তেজিত, কারণ আগামীকালের অনুষ্ঠানের সফলতার উপরে প্রমাণিত হবে তাঁর গুরু হরিদাস স্বামী ও ঘাউস মহম্মদের শিক্ষা ও সম্মান। আসমুদ্রহিমাচলে প্রমাণিত হবে তানসেনের সমকক্ষ সঙ্গীতসাধক আজ পর্যন্ত জন্মায়নি এবং ভবিষ্যতেও জন্মাবে কিনা সন্দেহ। তিনি যে সম্রাট আকবরের প্রধান গায়কের পদের যোগ্যতম ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে সেকথা প্রমাণ করে কুচক্রীদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে হবে। স্থির করলেন আজকের রাত্রে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে দেহমনে সজীবতায় ভরপুর হয়ে আগামীকালের অগ্নি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবেন।                
                                                                ক্রমশঃ

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments