জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৪০/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৪০


আটলান্টিক মহাসাগরের এই বিচে কী নেই? বিভিন্ন ধরণের ভয়ঙ্কর সব রাইড  রয়েছে, বাচ্চাদের জন্য বেলুনবাড়ি, রয়েছে ক্যাসিনো, ওয়াটার ক্লাব। আমি তো ওয়াটার ক্লাবের ভিতরে ঢুকে স্নানের ছবি তুলতে শুরু করেছি, তখন একজন সিকিউরিটি নিষেধ করলেন। আমাদের দেশের মত দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, ক্যামেরা কেড়ে  নেওয়ার ভয় দেখিয়ে নয়, খুবই ভদ্র ও শান্তভাবে নিষেধ করলেন। এখান থেকে বেরিয়ে আরও মজার সব জিনিস দেখলাম। ট্রামে চড়ে এক চক্কর  ঘুরে আসালাম। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ার ও ব্যবস্থা আছে।  আমাদের দেশে ঘোড়ার কাঁধে যে চুল থাকে, তাকে বালি বা বালামচি বলা হয়। এখানে দেখছি ঘোড়ার খুরের ওপরে কাঁধের মত বড় বড় বালামচি রয়েছে। এতটাই বড় যে মাটিতে লুটিয়ে আছে। সমুদ্রের ওপর অসংখ্য সিগাল উড়ে বেড়াচ্ছে, বিচের সামনে অনেক রাজহাঁস ঘুরে বে্ড়াছে। বিচে আসার অনেক আগে থেকেই আইফেল টাওয়ারের চূড়ার মতই  একটা টাওয়ার দেখা যাচ্ছিল। কে যেন বলে উঠলেন, আইফেল টাওয়ার! ব্যাস!  স্থান কাল ভুলে প্রায় সবাই আইফেল টাওয়ার, আইফেল টাওয়ার, বলতে বলতে  ছুটন্ত বাস থেকে হুড়োহুড়ি করে ছবি তুলতে লাগলেন। বিচে এসে দেখলাম,  টাওয়ারটি বিচের ওপ্রান্তে রয়েছে। জানলাম আইফেল টাওয়ারকে অনুকরণ করে এটি তৈরি করা হয়েছে। তবে আমাদের দেশে বহু রাজ্যের সি বিচ দেখেছি, গোল্ডেন সিবিচ ও  দেখেছি। এত সুন্দর করে সাজানো নয়। রাতে এই বিচ যে আলোক মালায় আরও  মোহময়ী হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

    ঘুরে ঘুরে প্রচুর ছবি তুললাম। এরমধ্যে দুবার বাবলির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। গাইডের দেওয়া সময়ে আমরা কারপার্কে গিয়ে বাসে উঠে বসলাম। বাস আমাদের একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে এল। লেখা আছে ‘ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট’ ভাত, চাপাটির সঙ্গে চিকেন, ডাল, সবজি, স্যালাড, আইস্ ক্রিম ব্রিটিশ খাবারও রয়েছে। বুফে সিস্টেম, তাই লাইন দিতে হল। বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ মহিলা ওয়েটারের  কাজ করছেন দেখে বেশ মজা পেলাম। এদেশে বিকেল পাঁচটায় সব বন্ধ হয়ে যায়। খোলা থাকে খাবার আর মদের দোকান।  তাই সারি সারি মালটি পারপাশ স্টোর, মল, দোকান সব বন্ধ। কাচের দেওয়াল ভেদ করে সব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কেনার উপায় নেই। চুরিরও ভয় নেই। এদেশে ডিনারের সময় সন্ধ্যা ৭ টা। যদিও এখনো সন্ধ্যা নামতে অনেক দেরি। আমরাও ৭ টাতে ডিনার করে বাসে উঠলাম। বাস রেস্টুরেন্ট থেকে সামনে এগিয়ে  আমরা বিচের যেখানে ছিলাম তার অপর প্রান্ত দিয়ে বিচে ঢুকল। এখন ভাঁটা, তাই সমুদ্র অনেক দূরে সরে গেছে। তবে বালি দেখতে পাচ্ছি না। কালচে রঙের নুড়ি বিছানো রয়েছে। যাইহোক বাস এসে দাঁড়াল হাইওয়ের ধারে একটি থ্রিস্টার হোটেলের সামনে। হোটেলের নাম ‘ইবস’।আজ আমাদের এখানেই রাত্রিবাস। সকালে এখানেই ব্রেকফাস্ট করে আবার আমাদের নিয়ে বাস রওনা হবে স্কটল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। হোটেলের রুমে ঢুকে একেবারে ক্লিন সাদা বিছানা, ও সবকিছু পরিচ্ছন এবং সাজানো গোছানো দেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু তা তো করা যাবেনা। তাই স্নানে ঢুকলাম, শরীরের ক্লান্তি অনেকটাই দূর হল। হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে নিলাম।সবই আছে। ভেজাচুলে সুয়ে পড়লে জ্বর এসে যাবে। ইতিমধ্যে ক্যামেরার ব্যাটারি ও ফোন চার্জে বসিয়ে দিয়েছি । ফোনে চার্জ ছিলনা বলে বাবলিদের ফোন করা যায়নি। কিছুটা চার্জ হলে ওদের ফোন করলাম। তারপর আগামীকাল কী পরব? সে সমস্ত ড্রেস বের করে রেখে বিছানায় গেলাম।

    সকালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হ্যান্ডব্যগে ভরে নিয়ে, স্নান সেরে একেবারে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম। নিজেরাই সব পাউরুটি টোস্ট করে ডিমের  পোচ বানিয়ে নিচ্ছেন কেউ, কেউ গরম দুধে কর্ণফ্লেক্স ভিজিয়ে নিচ্ছেন। এ ছাড়াও  বাটার, মধু, দুধ, চিনি, ডিমসেদ্ধ, কলা ও মাংসের কি যেন রয়েছে। আমি  হোটেলের রুম থেকে বেরনোর আগে চিড়ে গরমজলে ধুয়ে চিনি দুধ দিয়ে মেখে কৌটোতে ভরে নিয়েছে। কারণ উনি এসব খাবার যদি না খেতে পারেন? অবশ্য কেউই তেমন খাচ্ছেন না, সবাই লুকিয়ে ব্যাগে ভরে নিচ্ছেন। যাতে পাউণ্ড খরচ করে লাঞ্চ না করতে হয়। ওদের দেখে আমি কিছু খেলাম না, সামান্য খাবার ব্যাগে ভরে নিলাম।
    বাসের কাছে যেতে প্রায় সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।  গতকাল সালোয়ার কামিজ পরেছিলাম, আজ ডিপ পিঙ্ক কালারের একটা ঢাকাই  শাড়ি পরেছি, তার সঙ্গে হাল্কা মুক্তোর গহনা। আমি ছাড়া আর একজন সাউথের ভদ্রমহিলা ঝকমকে একটি শাড়ি পরেছেন। বাস ছুটতে শুরু করতেই আমার দৃষ্টি কাচ ভেদ করে দূরকে কাছে পাওয়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। বাসের মধ্যে টিভিতে কখনো হিন্দি সিনেমা, কখনো কার্টুন হচ্ছে। গাইড মাঝে মাঝে জোকস শোনাচ্ছেন। ওহ, একটা কথা বলা হয়নি। ব্ল্যাকপুলে যে রেস্টুরেন্টে ডিনার করে  ছিলাম, সেখানে ‘বীর জারা’ সিনেমার গান বাজছিল-তেরে লিয়ে....। যাইহোক এখানেও তমাল বনি সবার শেষে হোটেল থেকে বেরিয়েছে। কারন ব্ল্যাকপুলে ৫ পাউন্দ দিয়ে দুজনে দুটি সানগ্লাস কিনেছিল, বেরনোর সময় বনিরটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। গতকাল তমাল বারমিংহামের রেস্টুরেন্টে জ্যাকেট ফেলে এসেছে। বনি কয়েকদিন আগে লন্ডনে হ্যান্ডব্যাগ হারিয়ে এসেছে। তাতে পাউণ্ড, বাড়ির চাবি, ফোন, আরও অনেককিছু ছিল। কেন যে এরা এত কেয়ারলেস বুঝিনা।
      আমাদের বাস লেক ডিসট্রিক্টে প্রবেশ করার পর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, এখানকার ক্ষেতগুলি ইটের মত করে স্লেট পাথর সাজিয়ে ঘেরা। এগুলো কৃষি জমি বলে মনে হচ্ছে না। তারপর দেখলাম, ঘরবাড়ি, হোটেল, প্রায় সবই স্লেট পাথরের। বাড়ির ছাদও স্লেট পাথরের। এর কারণ নাকি এই পাথর সূর্যের তাপে তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়ে বরফ গলতে সাহায্য করে। আমাদের বাস  লেক ডিসট্রিক্টের ন্যাশনাল পার্কে এসে দাঁড়াল। সামনে উইন্ডমিয়ার লেক। এই লেকটিকে ‘ইংল্যান্ডের হৃদয়’ বলা হয়। লেকের পাড় থেকে দূরে তাকিয়ে মনে হল, যেন সত্যি নয়, কোনো শিল্পীর আঁকা ছবি। জল,পাহাড়, মেঘ, মিলে মিশে একাকার। জলের কাছে এসে সবার সঙ্গে হুড়োহুড়ি করে লম্বাগলা হাঁসের ছবি তুল্লাম। আমাদের গাইড টিকিট কেটে নিয়ে এলেন, আমরা ক্রুইজের জন্য লাইন দিলাম। এখানেও  আমরা কয়েকজন লাইনের শেষে থাকায় লঞ্চের ভিতরে জায়গা পেলামনা, বাইরে দাঁড়াতে হল,এবং সেটা ভালই হল। লেকের চারদিকটা ভালভাবে দেখতে পাচ্ছি। কত মানুষ বোটে চড়ে নিজের মত জলে বেড়াচ্ছে। কেউ বড়শিতে মাছ ধরছে, একটা মাছ গেঁথে তুলতে দেখলাম। চারপাশের মনভোলানো দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করতে লাগলাম। তবে প্রচণ্ড রোদ, মুখ ঝলসে যাচ্ছে। তবু ভাল, বৃষ্টি হয়নি। হলে গোটা টুরটাই মাটি হত।
    লঞ্চ থেকে নেমে আমরা কয়েকজন একটা স্টলে ঢুকে ছোট ছোট কয়েকটা জিনিস কিনলাম একে ওকে দেবার জন্য। যা দাম হাতে ছেঁকা লাগছে। এখন  এখানে এক পাউন্ড সমান আমাদের ১০০ টাকা। এক পাউন্ডে এদেশে কিছু পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, সিটি সেন্টারে পাউন্ড ল্যান্ড আছে, সেখানে যা কিনবেন দাম এক  পাউন্ড। যাক, এখানের জন্য নিরধারিত সময় ফুরিয়ে যেতেই আমরা আবার বাসে চড়ে বসলাম। বাস আমাদের নিয়ে ছুটে চলেছে। এদিক ওদিক পাহাড় দেখতে পাচ্ছি। এত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আগে কখনো হয়নি। স্কটল্যান্ড এমনিতেই কুকিজ আর বিস্কুটের জন্য বিখ্যাত। দুপুরে এক জায়গাতে বাস থামলে গাইড নেমে গিয়ে দুবাক্স বিস্কুট নিয়ে এসে সবাইকে একটা করে খেতে দিয়ে বললেন, এখানের বিস্কুট খুব ভাল। আপনারা অর্ডার দিতে চাইলে, দিতে পারেন। কয়েকজন অর্ডার দিলেনও। গাইড বললেন এখানেই লাঞ্চ করে নিতে হবে। এখান ছাড়িয়ে গেলে কাছাকাছি আর কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। আমরা খাবার জন্য বাস থেকে যেখানে ঢুকলাম তার নাম, ‘ব্ল্যাকস্মিথ সপ’ এখানে  খাবার, ড্রিঙ্কস, ছাড়াও নানা রকমের শো-পিস রয়েছে। আমরা সঙ্গের খাবার আর কিছু খাবার কিনে নিয়ে  লাঞ্চ করলাম। তারপর কয়েকজন মিলে আশপাশটা ঘুরে দেখতে গেলাম। 
                                    ক্রমশ

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments