জ্বলদর্চি

রাজর্ষি মহাপাত্র ( শিক্ষক, গবেষক, প্রবন্ধকার, ইতিহাসবিদ, তমলুক )/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ২৩

রাজর্ষি মহাপাত্র ( শিক্ষক, গবেষক, প্রবন্ধকার, ইতিহাসবিদ, তমলুক )


ভাস্করব্রত পতি

"রাঢ়ের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জগতে আঘাত আসে ইসলামীয় যুগে। মধ্য এশীয় ও মধ্য ভারতের দুই শ্রেণির মানুষ এখানে প্রভাব বিস্তার করে। এক, ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সৈনিকশ্রেণি এবং দুই, মহাজনশ্রেণি। এই অঞ্চলের ভূস্বামীগণের অনেকে আগন্তুক সৈন্যদলকে স্বাগত জানিয়েছিল। আফগান ও মুঘলেরা জঙ্গল ও নিমকি-মহাল সমূহ, ভূমরাজ্যগুলির বিজয় সমাপ্ত করে জমির খাজনা মুদ্রায় নিরূপিত করে। স্বয়ম্ভর গ্রামকেন্দ্রিক ভূমিব্যবস্থায় মুদ্রানীতির প্রচলন বাংলার নিজস্ব গণমালিকানার ধারণা নির্বাসিত করে ফিউডাল ধারণার সৃষ্টি করে। জমিদারশ্রেণি থেকে ভূমিজ কৃষক ও গ্রামীণ শিল্পী সম্প্রদায় সকলেই মধ্যযুগীয় নগরমুখী সভ্যতায় আকৃষ্ট হয় এবং মুদ্রানীতিতে বলীয়ান মহাজনশ্রেণির হাতের পুত্তলিকায় পরিণত হয়" ---

এই বিবরণ মিলবে ইতিহাস গবেষক রাজর্ষি মহাপাত্রের কলমের আঁচড়ে। তাঁর কলম নীলকন্ঠ পাখির মতো বার্তা আনে। না দেখা, না শোনা, না জানা -- লুক্কায়িত ইতিহাসের। তাঁর কলম আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় নিমজ্জমান। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তিনি ইতিহাস অনুসন্ধানের অন্যতম পথপ্রদর্শক। অজানা মেদিনীপুরকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে এনেছেন তাঁর অসংখ্য লেখায়। এটা সম্ভব হয়েছে মেদিনীপুরের প্রতি অদম্য ভালোবাসা এবং নিয়মিত ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মনের রেওয়াজ করতে থাকার ফলে। এর নিরিখে তিনি হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। আসলে তিনি তো অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার অনালোকিত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি নিয়ে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। মধ্যযুগের মেদিনীপুর কেন্দ্রিক গবেষণায় তিনি একজন তরুণ বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন ইতিহাস বোদ্ধাদের কাছে। 

শাহজাহানপুত্র শাহসুজা, শেরশাহ, শোভাসিংহ, মহামতী আকবর, সুবেদার শায়েস্তা খাঁ, নবাব আলীবর্দী খাঁ, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, আওরঙ্গজেব প্রমুখ নবাব রাজাদের সঙ্গে মেদিনীপুরের সম্পর্ক কেমন ছিল তা জানতে ইচ্ছে করে সকলেরই। সেই পুরোনো দিনের হারিয়ে যাওয়া ঘটনার তথা ইতিহাসের টুকরো গেঁথে তথ্যের মালা বানিয়েছেন রাজর্ষি মহাপাত্র। মোঘল, পাঠান, ফরাসী, পর্তুগিজ, মগ দস্যু, আফগানদের হাতে মেদিনীপুর কতখানি চর্চিত এবং জর্জরিত ছিল, তার অনুসন্ধানে তিনি সফলতা পেয়েছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরে ঋদ্ধ করেছেন মেদিনীপুরের ইতিহাসচর্চার ব্যাকরণকে। আর এহেন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছেন মেদিনীপুরের ইতিহাসের বৈয়াকরণ।
অনালোচিত, অনালোকিত এবং অনুল্লেখিত ইতিহাস নিয়ে লিখে চলেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন অসংখ্য বই। যেগুলি ইতিহাসপ্রেমী বোদ্ধাদের কাছে পরম আকর। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গৌরবজনক স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এবং সেইসাথে বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে অবিরত কাজ করে চলেছেন অক্লান্তভাবে। লিখেছেন অজস্র গবেষণামূলক প্রবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু মূল্যবান বই। আরও কিছু বই প্রকাশের অপেক্ষায়। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে লাভ করেছেন 'সুজন সম্মান' ও 'ধ্রুপদী লেখক সম্মান'।

রাজর্ষী মহাপাত্রের লেখা ইতিহাস অনুসন্ধান বিষয়ক বইগুলি হল -- স্বাধীনতা আন্দোলনের কয়েকটি অধ্যায়, মেদিনীপুরে জাতীয় আন্দোলন ভিন্ন সুর : রাজ থেকে স্বরাজ, তাম্রলিপ্ত তমলুক : ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ইতিহাসের আলোকে বাংলা, মধ্যযুগের মেদিনীপুর ইত্যাদি। এই 'মধ্যযুগের মেদিনীপুর' এর বিষয়ে লিখতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, "এখানে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিশেষত ইসলামীয় সাহিত্য, তবে হিন্দু কবিদের রচনারও উল্লেখ করা হয়েছে। ওঁদের লেখার মধ্যে ঐতিহাসিক উপাদান খোঁজার চেষ্টা করেছি। শিল্প স্থাপত্য নিয়ে সামান্য আলোচনাও আছে। মধ্যযুগের মেদিনীপুরে নানারকম পরিবর্তন আসছিল। এগুলি শুধু রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে নয়, এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন। যার রূপরেখা দিতে চেষ্টা করেছি। মধ্যযুগের বাংলায় তথা মেদিনীপুরে সম্ভবত সব থেকে বড় পরিবর্তন আসে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে ও ভক্তি আন্দোলনের ফলে। যা সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। এতে ওই সময়ে মেদিনীপুরের পরিবর্তন বোঝা সহজ হবে বলে মনে হয়। ষষ্ঠদশ শতক থেকেই মুসলিম অভিভাবকদের সঙ্গে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা আসায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা যেমন বাড়ে তেমনি বৈচিত্র্যও আসে"।

এছাড়া তাঁর সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যাও অজস্র। মেদিনীপুরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি (অধ্যাপক ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি সম্বর্ধনা গ্রন্থ) [যুগ্ম সম্পাদনা], পরম প্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র এবং আমরা (কালীপদ পাল প্রণীত) [যুগ্ম-সম্পাদনা], মেদিনীপুরের নির্বাচিত কবিতা সংগ্রহ (যুগ্ম সম্পদনা), পুষ্পাঞ্জলী, জাতীয় শিক্ষক নির্মল মাইতি সম্মাননা পুস্তিকা, (অন্যতম সম্পাদক), বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন ও দ্রোহকাল (যুগ্ম সম্পাদনা), হেরিটেজ তথ্যপঞ্জী - পূর্ব মেদিনীপুর (নির্বাহী সম্পাদক), তমলুক পৌরসভা তথ্যপঞ্জী (কার্যকরী কমিটির সদস্য), অনন্য দেশসেবক অজয়কুমার মুখোপাধ্যায় (মুখ্য সম্পাদক), তাম্রলিপ্ত কথা, সম্পাদক তাপস মাইতি (সহযোগী সম্পাদক), স্মারক সম্ভার : প্রসঙ্গ মেদিনীপুর (যুগ্ম সম্পাদনা), নির্বাচিত বিপ্লবী কলম ( যুগ্ম সম্পাদনা), নির্বাচিত প্রবন্ধ ( ইন্দুভূষণ অধিকারী প্রণীত) [ যুগ্ম সম্পাদনা], আগুনের পরশমনি (যুগ্ম সম্পাদনা), স্মৃতির আঘ্রাণ (শিবম অধিকারী স্মারক গ্রন্থ) [যুগ্ম সম্পাদনা] ইত্যাদি।

রাজর্ষি মহাপাত্রের লেখা ইংরেজি বইগুলির সংখ্যাও কম নয় -- Tamuralipta As A City Port and A Trading Centre, Tamluk During the Sultanate And Mughal Rule, Tamalipta - Tamluk In Arechaeology And History [Joint Edited], Essays on Indian Folk Life And Culture by Dr. Pradyot Kumar maity (Joint Edited) এবং Boy Revolutionary of Indian by Isanchandra Mahapatra, B.L।

এইসব ইতিহাসাশ্রিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের বাস্তবতা এবং গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাজর্ষি মহাপাত্র উল্লেখ করেছেন, "ঐশ্বর্যের বিষয় বিশ্লেষণ নয়, রাজনৈতিক জটিলতা, বহিরাগতের রাজক্ষমতা দখলের লড়াই, স্থানীয় ক্ষমতাশীল ভূস্বামী ও জমিদারদের কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে সাধারণ জনজীবনের কথা। স্থান পেয়েছে সেকালের জনজীবনের বৈচিত্র্যময় নানা বৈশিষ্ট্য, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, শিল্পের বিকাশ, অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য"।

বর্তমানে 'পূর্ব মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনী'র যুগ্ম সম্পাদক। এই সংস্থার প্রকাশিত পত্রিকা 'সাহিত্য সম্মেলনীর'ও যুগ্ম সম্পাদক। সেইসাথে 'তাম্রলিপ্ত, ময়নাগড়, কাশীজোড়া মহিষাদল হেরিটেজ কমিটি'র কার্যকরী সম্পাদক পদে রয়েছেন। সমাজ ও সংস্কৃতির আগ্রহী পাঠক এবং লেখক রাজর্ষি মহাপাত্রের জন্ম ১৯৬৭ সালে। পরিবারের মধ্যেই ছিল সুস্থ এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। সেই ঘেরাটোপের মধ্যে একটা শৃঙ্খলাপরায়ন জীবন অতিবাহিত করার সুযোগ তাঁর হয়েছে। স্বাধীনোত্তোর যুগে এই পরিবারের একজন ডাঃ অতুলচন্দ্র মহাপাত্র ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁরই সুযোগ্য নাতি রাজর্ষি মহাপাত্র। স্বাভাবিকভাবেই রাজর্ষির লেখার বিষয়বস্তুতে অনেকাংশে স্থান পেয়েছে অগ্নিগর্ভ তমলুকের ইতিহাস। যা ঋদ্ধ করেছে মেদিনীপুরকে। যা পিপাসা মিটিয়েছে মেদিনীপুরকে জানার এবং চেনার আগ্রহী পাঠকদের।

একসময় হাওড়ার অনন্তপুর সিদ্ধেশ্বরী উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। এখন নন্দকুমারের বেতকল্লা মিলনী বিদ্যানিকেতন (উ. মা.) ইতিহাস শিক্ষকরূপে কর্মরত। শিক্ষকতা তাঁর পেশা। কিন্তু নেশা আষ্টেপৃষ্ঠে ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মননশীল ভাবনা এবং লেখনী নিয়ে জড়িয়ে থাকা। সে নেশায় আজ বুঁদ তিনি। এর পাশাপাশি তিনি ইণ্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেস, ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক স্টাডিজ, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ ইত্যাদি বিভিন্ন ইতিহাস গবেষণা সংস্থার সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এবং যুক্ত। একসময় তাম্রলিপ্ত মহাবিদ্যালয় ও শ্যামপুর সিদ্ধেশ্বরী মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে দীর্ঘদিন অতিথি অধ্যাপনারও কাজ করেছেন। ইংল্যাণ্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজেক্ট অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে কাজ করার সুবাদে ইতিহাস গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এককথায় আদ্যোপান্ত ইতিহাস বিষয়কে নিয়ে তাঁর জীবনের পথচলা। 
সাল তারিখ, রাজা রাজড়া, রাণী, নবাব, প্রজা, রায়ত জমি, রাজ্যপাট, গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্র, দলিল দস্তাবেজ, খাজনা, কর, দখল, অত্যাচার, বিদ্রোহ, লড়াই, আন্দোলন -- এ সবই তো ইতিহাসের ভিত্তিভূমি। আর এখানেই মাথা গলিয়ে দিয়েছেন তিনি। দুচোখ দিয়ে খুঁজে বের করছেন অমূল্য সব মনিমুক্তা। তারপরে সেইসব ইতিহাসাশ্রিত তথ্যপ্রমানগুলো নিয়ে তাঁর দুহাতের আঙুলগুলো খেলা করে সাদা কাগজের গায়। ফুটে ওঠে ইতিহাসের দিকদিগন্ত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপিকা ড. রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায় মূল্যায়ন করেছেন রাজর্ষি মহাপাত্র সম্পর্কে। তিনি লিখেছেন, "ইতিহাস মানে রাজা মহারাজার বা সম্রাটের যুদ্ধবিগ্রহ, রাজ্যজয়, ঐশ্বর্য বিলাসের বিশ্লেষণ নয়। রাজনৈতিক জটিলতা, বহিরাগতের রাজক্ষমতা অধিকারের লড়াই, কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে স্থানীয় ভূস্বামী জমিদারদের বিদ্রোহও ইতিহাসের উপজীব্য। পাশাপাশি জনজীবনের অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজনীতি, ধর্ম, শিল্প-সংস্কৃতি ঋদ্ধ করে ইতিহাসকে। বিশেষ করে মধ্যযুগের ইতিহাস এমনই বিচিত্র উপকরণে গড়ে উঠেছে। মেদিনীপুর জেলার মধ্যযুগের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু মেদিনীপুরের মধ্যযুগের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি উল্লেখযোগ্য বাংলা বই নেই। ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু পাঠক, ছাত্রছাত্রীদের সেই অভাব পূরণ করতেই মেদিনীপুর জেলার ভূমিপুত্র ইতিহাস গবেষক রাজর্ষি মহাপাত্র রচনা করেছেন মধ্যযুগের মেদিনীপুর"।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments