জ্বলদর্চি

গৌর বৈরাগী /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল— ১৫  

গৌর বৈরাগী

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা


এখন তো প্রায়ই চোখে পড়ে— সবে লিখতে এসেই বই প্রকাশে উৎসাহী হয়ে উঠছেন কবি-লেখকেরা। সেদিক থেকে বিরল একজন গল্পকার গৌর বৈরাগী। সত্তরের বছরগুলি থেকে নিয়মিত গল্প লিখেও তাঁর প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৭ সালে। সেই বইও প্রকাশিত হল তাঁর লেখক বন্ধুদের উৎসাহে। বোঝা যায় লেখার ব্যাপারে যতটা উৎসাহী লেখক, ততটা আগ্রহ নেই প্রচারে। লক্ষ করবার মতো গ্রন্থনাম— ‘গৌর বৈরাগীর গল্প’। প্রকাশক অনুষ্টুপ। হাজার খানেক গল্প লিখেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ গল্প আজও অগ্রন্থিত। 

দরিদ্র পাটকলকর্মী পরিবারের সন্তান লেখকের শৈশবে সাহিত্যের কোনও আবহ ছিল না। ছোটোবেলায় প্রবল আগ্রহ থাকলেও গল্প পড়বার সুযোগ ছিল না। লাইব্রেরির সদস্য হওয়ার মতো সামান্য পয়সাও ছিল না তখন। পাঠ্যপুস্তকের গল্পগুলিকে পড়তেন গোগ্রাসে। পাড়ার একজনের বাড়িতে আসত মাসিক ‘উল্টোরথ’ পত্রিকা। কাগজওয়ালার কষ্ট লাঘব করে দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর কাছ থেকে পত্রিকাটি নিয়ে নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। আর তারই মধ্যে কয়েক ঘণ্টায় দ্রুত পড়ে ফ্যালার চেষ্টা করতেন পত্রিকায় প্রকাশিত আখ্যানগুলি। এভাবেই পাঠ্যবইয়ের বাইরে সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। সাহিত্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা হয় এই সিনেমা পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প-উপন্যাসের সূত্রে।           
সত্তরের উত্তাল সমাজ-রাজনৈতিক আবহে লিখতে এসেলেন তিনি। আর প্রথম গল্পের বই প্রকাশের কিছু আগেও বড়ো রকমের বদল এল সমাজ-মানসে। সবে তখন বিশ্বায়নের জোয়ার এসেছে মধ্যবিত্তের যাপনে। বাংলার সমাজ-রাজনৈতিক ইতিহাসের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। পরিবর্তনের সময়। সমাজ-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অনিবার্য প্রভাব মানুষের প্রাত্যহিকতায়। এই বদলে যাওয়া সময় ও সমাজ নিয়ে লেখা তাঁর গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল সংযোজন। শ্রমজীবী, প্রান্তিক, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন যাপনচিত্র তাঁর গল্পে নতুন চেতনার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে। উপস্থাপনায় গুণে প্রতিদিনের অতি চেনা মানুষরা অন্যভাবে হাজির হয়েছে গৌর বৈরাগীর গল্পগুলিতে। সহস্র প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের নিরন্তর মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা মর্যাদার সঙ্গে উঠে এসেছে। 

বাবা পাটকলে কাজ করতেন। তিনি নিজেও কিছুদিন পাটকলে চাকরি করেছেন। পাটকল শ্রমিকদের কথা তাঁর বহু গল্পে এসেছে। সম্ভবত সমসাময়িক আর কারও গল্পে পাটকলের ভিতরের চিত্র এবং পাটকল শ্রমিকদের এহেন যাপন বিষয় হয়ে ওঠেনি। আজ নয়, সেই সত্তরের বছরগুলি থেকেই পাটকলের দুর্দশা। মাঝে মাঝে বন্ধ থেকেছে। শ্রমিকেরা ডুবে গিয়েছেন দারিদ্র্যে। সেই দারিদ্র্য যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা বোঝা যায় তাঁর এই পর্বের গল্পগুলি পড়লে। 

যেমন ‘বাইরে মাইকের শব্দ’ (১৯৮১)। পুজোর অঙ্গ হিসেবে এবার কমিটি একটা জনদরদী কাজ করতে চায়। একজন অসুস্থ মানুষকে ডাক্তার দ্যাখানোর ব্যবস্থা করে দেবে তারা। শহরের মস্ত বড়ো ডাক্তারকে কমিটির সভাপতি নিয়ে চলেন নির্দিষ্ট বাড়িতে। লেখক নোংরা গলিপথের চমৎকার বর্ণনা করেছেন। 

“পাতা ইঁটের বদলে কাঁচা মাটির গলি। ছাদ সরে গিয়ে বাড়ির মাথায় এল টালি আর করোগেটেড টিন। চালে সবুজ কুমড়ো গাছে হলুদ ফুল। রাঙ চিতার বেড়ার পাশে সাদা টগর। কালো রঙের কাঠের গরাদের জানলা। বাড়িগুলো গলিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তার ওপর কাঁচা নর্দমা খেতে খেতে গলিটার আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি। ... সেমি লিকুইড, রেডিস, জিয়ার্ডিয়া তার সঙ্গে ব্যাসিলারি। নর্দমার ধারে না করে রাস্তার মাঝখানে ওই নোংরাটা। লম্বা পা বাড়িয়ে ‘ওটা’ ডিঙ্গোতে ডিঙ্গোতে পকেট থেকে পরিষ্কার সাদা রুমালটা বার করলেন ডাক্তারবাবু। কিন্তু নাকে চাপলেন না। আবার পকেটেই। তারপর বললেন, আর কতদূর!” 

অত্যন্ত অস্বস্তিদায়ক চিত্র। বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অসামান্য পরিবেশ রচনা করেছেন লেখক। পরিচ্ছন্ন, নোংরা গা-ঘুলিয়ে দেওয়া একটা পরিবেশে শিক্ষিত পাঠকের প্রবেশ ঘটছে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে।  

ডাঃ সেন একটা বাড়ির উঠোনে হ্যালান দিয়ে বসে থাকা বৃদ্ধকে পরীক্ষা করলেন। অ্যানিমিয়া, অপুষ্টি জনিত নানান সমস্যা। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় ভুল ভাঙিয়ে দিল বৃদ্ধটি। সে রুগী নয়। চমকে ওঠেন ডাক্তারবাবু। পরিষ্কার টিউবার কুলোসিস। জ্বর, কাশি।  

বিস্মিত ডাক্তারবাবু এবার আবছা আলোয় এগিয়ে চললেন তক্তপোষের দিকে। “আধো অন্ধকারে চাদর মোড়া একখানা শরীর। মুখটুকুই শুধু বাইরে। মুখের মধ্যে মুখ নেই। মাংস নেই। ত্বক নেই। শুধু নাকের ঠেলে ওঠা বঙ্কিম আদল। সিঁথিতে আবছা লাল। ম্যাল নিউট্রিশন। এ কেস অব পারনিসাস অ্যানিমিয়া।” 

শুধু ডাক্তারের নয়, পাঠকেরও বিস্ময়ের বাকি ছিল আরও। স্টেথো বার করে পরীক্ষার জন্য চাদর সরালে চমকে উঠতে হয়। শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকা আরও একটা শরীর। শুকনো শীর্ণ স্তনের বোঁটায় দুটো ঠোঁট। এক টুকরো মাংস পিণ্ড। বিখ্যাত ডাক্তার রোগীর বুকের শব্দ শুনতে গিয়ে স্তব্ধ! “জীবনে এই প্রথম বার তিনি পাটকলের একজন মজুরের কাছে ভয় পেলেন। যদি আবার ভুল হয়ে যায় রুগী চিনতে। দ্বিতীয় ভুল। তাই খুব ফিসফিস করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে রুগী।” 

এই গল্পে লেখক শহরের সবচেয়ে নামী ডাক্তারকে হারিয়ে দিয়েছেন সামান্য এক পাটকলকর্মীর কাছে। লেখকের বাস্তব জ্ঞানের শিল্পিত রূপায়ন স্তম্ভিত করে। লোকটির মধ্যে দারিদ্র্য আছে, অসহায়তা আছে কিন্তু হতাশা নেই। বাইরে তখন মাইকের শব্দ। আর ঢাকের। জাঁকজমকপূর্ণ দামী পুজো কমিটির সমাজ সেবার এই ভড়ংকে লেখক তুলে ধরেছেন। তার পাশাপাশি দারিদ্র্যের অবর্ণনীয়, নির্মম হাঁ মুখ! যে মুখকে ঢেকে দিতে পারে না পুজোর প্রাচুর্য, উৎসবের সমারোহ আয়োজন।

তবুও একে দারিদ্র্যের গল্প বলে দেগে দেওয়া ঠিক হবে না। এখানে দারিদ্র্য আছে ঠিকই, কিন্তু দারিদ্র্য মানুষের জীবনকে সংকীর্ণ করতে পারেনি। অসহায় করেছে শুধু। মনে পড়ে পাটকল শ্রমিকের পরিবার নিয়ে লেখা ‘হাঁসের গল্প’ (১৯৮৩)-এর কথা। সেখানে দারিদ্র্যের অন্য একটি মুখ। সেখানে দারিদ্র্য মানুষগুলোকে শুধু অসহায় করেনি, কিছুটা সংকীর্ণও করেছে। তবে তাঁর অধিকাংশ গল্পের চরিত্ররা দারিদ্র্যকে মেনে নিয়ে হাসি মুখে বাঁচে। দারিদ্র্যের সঙ্গে সহবাস করে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে না। 

এক বিপর্যস্ত মূল্যবোধকে লেখক তুলে ধরেন তাঁর চরিত্রগুলির ভিতর দিয়ে। আর এর জন্য কখনও-বা দায়ী করেন দারিদ্র্যকে। অর্থনৈতিক স্থিরতা না থাকলে প্রাত্যহিক যাপন সুস্থ ও উন্নত হতে পারে না। তিনি মনে করেন— মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়নি। অর্থনৈতিক চাপে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। পারিবারিক-আত্মিক সম্পর্কের মধ্যে এক অসহায় জটিলতা অনিবার্য হয়ে আসছে।  

মানুষের একাকীত্ব, অসহায়তা তাঁর গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আসলে আমরা একাই তো! প্রত্যেকেই একা! নিবিড় বন্ধুতায়ও ঘা দিয়ে যায় একাকীত্ব। এই একাকীত্ব সময়-সম্পৃক্ত। গভীর আন্তরিকতায় লেখক তুলে ধরেন চারপাশের একা এবং অসহায় মানুষদের পৃথিবী। একাকীত্ব থেকেই মানুষ হয়ে ওঠে অতীতচারী। আঁকড়ে ধরতে চায় স্মৃতি।   

‘সেই জ্যোৎস্নায় গোলক ও আমরা কয়েকজন’ (১৯৮১) গল্পে অমিত খুঁজে ব্যাড়ায় তার অতীতকে। কৈশোরের দিনগুলিকে। পুরনো বন্ধুদের। এক এক করে বন্ধুদের বাড়িতে যায়। কৈশোরের সেই দিনটার কথা বলে। সেদিন সন্ধ্যায় বন্ধুরা সকলে মিলে গঙ্গায় নেমেছিল। সঙ্গে ছিল ভীতু সাঁতার না-জানা গোলক। সেখানে হঠাত হারিয়ে গিয়েছিল গোলক। সকলে সেদিন বলেছিল— “এই দিনটার কথা কোনদিন ভুলব না”। সেই ভীরু গোলকের সন্ধান করে অমিত। বন্ধুরা সকলে জানায় গোলকের সঙ্গে দ্যাখা হয়েছিল। গোলক এখন মস্ত বড়োলোক। কিন্তু অমিত তো এখনকার বড়োলোক গোলককে নয়, খুঁজছে সেদিনের বোকা ভীতু, সাঁতার না-জানা গোলককে। সেদিনের জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া গঙ্গাকে।  

বন্ধুরা সকলে কাজে ব্যস্ত। অমিতের সঙ্গে সৌজন্য দেখিয়ে সামান্য কথাবার্তার পর নিজেদের কাজের দোহাই দিয়েছে। কার মেয়ের পরীক্ষা, কারও-বা বেরোনো আছে, কেউ দরকারি কাজ করবে। অমিতকে পরে কখনও আসতে বলে।
আসবে কিনা তার জবাব দেয়নি অমিত। সেই জবাবের প্রতীক্ষাও করে না কেউ। সকলেই এখন বড়ো ব্যস্ত দরকারি কাজে। আর অমিতের দরকারের কোনও মূল্য নেই। একটা স্মৃতি খুঁজে বেড়ানো বড্ড অদরকারি আজকের দুনিয়ায়। গোলক নিছক স্মৃতি নয়। গোলক একটা স্বপ্নের নাম। গোলক একটা আকাঙ্ক্ষার নাম। একটা কাঙ্ক্ষিত সময়ের নাম। তবুও ব্যস্ত সময়ের ভিড়ে অমিত খুঁজে বেড়ায় আরেকটা সময়কে। 

আজকের সময়ে মানুষেরা সকলে ছিন্নমূল। তারা শিকড়ের টান, নাড়ির টান অনুভব করে না। অমিতের মতো কেউ কেউ আজও ফিরতে চায় অতীতের এক সরল-সাহসী বন্ধুতায়। 

গৌর বৈরাগীর গল্পে উঠে আসা জীবন নেহাতই সাদামাটা, আটপৌরে। মানুষেরাও সমাজের কেউকেটা নয়। অতি নগণ্য সাধারণ জীবনের মধ্যেও লুকিয়ে আছে কত কত গল্প! গৌর সেই সব গল্পকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরেন রসিক পাঠকের সামনে। জীবন-যুদ্ধে অসফল মানুষের ভিড় দ্যাখা যায় তাঁর গল্পে। সফলকাম মানুষের কথাও বলেছেন গৌর। কিন্তু অসফল, মাথা হেঁট করা, নিচু স্বরে কথা বলা, কুণ্ঠিত, প্রতিবাদহীন মানুষেরাই বুঝি লেখকের নিবিড় আত্মীয়। তাদের যাপনেও কোনও তীব্রতা নেই। মানুষ বড়ো অসহায়। বিভিন্ন কারণে অথবা অকারণে অসহায়। এই অসহায়তাবোধ থেকেই উঠে এসেছে বহু গল্প। তাঁর গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে বিপন্নতা, অসহায়তা। যেখান থেকে মানুষের মুক্তি নেই। হয়তো এটাই জীবন-যাপনের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য।  

‘বিপদ’ (১৯৮৬) গল্পে শচীনের বিপদ। বড়ো গভীর আমূল নাড়িয়ে দেবার মতো বিপদ। একা সামাল দেবার ক্ষমতা নেই তার। এই মহা বিপদে যে বাঁচাতে পারে তার কাছে দৌড়েছে সে। বহু চেষ্টা চরিত্র করে যদিও-বা তার কাছে পৌঁছনো গেল, কিন্তু সে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারল না। সে অন্য একজনের কাছে চিঠি লিখে পাঠাল শচীনকে। শচীন এক একজনের কাছে যায় বড়ো আশা নিয়ে। এবার বুঝি সমাধান হবে। প্রত্যেককেই সে বলে তার বিপদের কথা। সকলেই শুনে আহা আহা, চুক চুক করে। তারপর অন্যের কাছে পাঠিয়ে দেয়। শচীন সেখান থেকে বেরোতে বেরোতে শুনতে পায় হাসি ঠাট্টার শব্দ। যে মানুষটি শচীনের বিপদে সমব্যথী হয়েছিল। সে-ই মুহূর্তের মধ্যে আনন্দে উতরোল হয়ে উঠছে। সকলেই অভিনয় করছে এখন। আমরা যে অন্যকে সাহায্য করতে চাই, উপকার করতে চাই— তা আসলে একটা ভান। 

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শচীনের দৌড়নোর কথা বলা হয়েছে। বারবার এসেছে ‘বিপদ’ শব্দটি। কিন্তু একবারও লেখক বিপদের বর্ণনা করেননি। কী ধরনের বিপদ তার ইঙ্গিতও দেননি। নিজের সমস্যার সমাধান করতে হয় নিজেকেই। কেউ সঙ্গে নেই। কেউ থাকে না।

শচীনের অন্তর্গত উদ্বেগ ও উত্তেজনাই গল্প। শচীন সময়ের প্রতিনিধি। অধিকাংশ মানুষকেই দৌড়োতে হয় ক্লান্তিহীন হতাশা নিয়ে। এও বুঝি বেঁচে থাকার অনিবার্য অঙ্গ। বিপদ একজন শচীনের নয়। বিপদ অগণিত শচীনের। আর তাই ‘বিপদ’ একজন শচীনের গল্প হয়ে থাকল না। বাংলার অগণিত অসফল শচীনের গল্প হয়ে উঠল। এভাবে লেখক তাঁর গল্পে একটা বড়ো প্রেক্ষাপটকে আলোকিত করে তোলেন। তাঁর গল্পের চরিত্ররা বিশেষ একজন হয়ে থাকে না। তারাও সময়েরই দ্যোতক হয়ে ওঠে। সময়কেও ছাড়িয়ে যায়। গৌর বৈরাগীর মুনশিয়ানা এখানেই। 

আমরাই তো শচীন। গ্রিক পুরাণের সিসিফাসের মতো আমরা প্রতিদিন পাথরটাকে ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের মাথায় তুলি। আবার গড়িয়ে নীচে চলে আসে পাথর। আবারও আমরা উপরে তোলার চেষ্টা করি। ক্লান্তি নেই। জীবন ক্লান্তিকে রেয়াৎ করে না। লেখক তাঁর বিভিন্ন গল্পে এই সত্যটিকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। 

গৌর বৈরাগীর বহু গল্পে সেই অর্থে কোনও গল্প নেই। কোনও ঘটনা বা চরিত্রের উপর আলো নেই। এতসব না-থাকার ভিতর দিয়েও কীকরে একটি নিখুঁত গল্প হয়ে ওঠে তা বোঝা যায় তাঁর লেখাগুলি পড়লে। তাঁর অধিকাংশ গল্পে ঘটনা বা চরিত্র প্রাধান্য পায়নি। গুরুত্ব পেয়েছে একটি ভাব। সেই বোধ এবং ভাব থেকে উঠে এসেছে গল্পগুলি। লেখক বিষয়ের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেন আঙ্গিক এবং উপস্থাপন ভঙ্গিকে। তাই এক-মুখীন এই গল্পগুলিতে বিশেষ কোনও একটি চরম-ক্ষণ থাকে না। থাকে গভীর ইঙ্গিতধর্মিতা। তাই নিছক বিবৃতিমূলক হয়ে যায় না তাঁর গল্প। লেখকের ব্যক্তিত্ব এবং জীবন-দর্শন গল্পগুলিকে সংযত করে তোলে।        

ঘটনার মধ্যে কোনোরকম দুর্বলতা ঘেঁষতে দেন না লেখক। গল্পের প্রয়োজনে ঘটনা বিন্যাস থাকে। কিন্তু ঘটনাতে শেষ হয় না গৌর বৈরাগীর গল্প। দৃঢ়নিবদ্ধ এই গল্পটি শেষ পর্যন্ত ভাবাশ্রয়ী এবং ইঙ্গিতময়। এটাই গল্পের রসকেন্দ্র। মূল আকর্ষণ। আত্মসর্বস্ব অহংচর্চাকে বিদ্রুপ করেছেন লেখক এই গল্পে।     

এক আশ্চর্য নীরব কলরবে (lonely Crowd) ভরে যাচ্ছে চারপাশ। যে জমিতে আগে একটি পরিবার বাস করত, আজকের ফ্ল্যাট-যাপনে সেই জমিতে অনায়াসে জায়গা করে নিচ্ছে পঁচিশটি পরিবার। একই বিল্ডিং-এ থেকেও তেমন করে কেউ কাউকে চিনি না। নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার পরিসর কমে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যেও কী সহজে আমরা নিজেদের একা করে নিতে পারছি। বেঁচে থাকার তাগিদে প্রাত্যহিকতার সবই করি। করতে হয়। কিন্তু তাও এককভাবে। অভিনয় যেন। স্মরণীয় তাঁর ‘মূকাভিনয়ের একদিন’ (‘দিবারাত্রির কাব্য’, ২০০১) গল্পটি। উল্লেখ করা যেতে পারে— এই নামে তাঁর একটি গল্পসংকলনও (২০০৪) প্রকাশিত হয়েছে। 

আমরা তো প্রতিনিয়ত একে অপরের সামনে অভিনয়ই করে থাকি। সেই অভিনয়ও ক্রমশ মূক হয়ে যাচ্ছে। কারণ অভিনয়ের পাত্র-পাত্রীরা, মানুষরা বোবা হয়ে যাচ্ছে। শহরের একটি পরিবারের গৃহকর্ত্রী অর্চনার একদিনের জীবনচর্যায় সেই মূক ও বোধির মানুষদের, সময়ের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষদের কথা বলেছেন লেখক এই গল্পে। অর্চনা বাড়ির বাইরে খুব একটা যায় না। সাংসারিক কাজকর্ম করে। তাই সময়ের উত্তাপ তার হৃদয়কে পুড়িয় দেয়নি। মানসিক অনুভূতিগুলো হারায়নি তার। কলিংবেলের শব্দে তার বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। অসময়ে ঘরে ফিরলে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে শরীর খারাপ খোঁজে সে। এমনকি মুখ দেখে ক্ষিধেও টের পায়। “ক্ষিধেরও শ্রেণী-বিভাগ করতে পারে সে। ভাত-ক্ষিধের দৃষ্টি একরকম, চা-ক্ষিধের আবার আলাদা। এই যেমন অর্চনার মনে হল এক গ্লাস স্কোয়াশের শরবত হলে খুশি হবে মোম।” 

কিন্তু যান্ত্রিক মানুষদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে সেও যন্ত্রের মতো, অভ্যাসের বশে কাজকর্ম করে। কলিং বেলের শব্দে আইহোলে চোখ রাখে। বিধ্বস্ত-ক্লান্ত মেয়ে-ছেলে-স্বামী ফিরলে চা-টিফিন ইত্যাদি করে দেয়। যন্ত্রের মতো মাত্র আট মিনিট বারো সেকেন্ডে লাল করে পরোটা ও আলু ভেজে মেয়েকে দেয়। ছেলের বাথরুম থেকে ফ্রেস হয়ে বেরোনোর আগেই তৈরি করে ফেলে সস্‌ দেওয়া এগ-চাউ। টিভির দিকে তাকিয়ে কলিং বেলের শব্দের জন্য অপেক্ষা করে থাকে সে। এভাবেই দিন কাটে তার। বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লেখক খুব সচেতনভাবে বিন্যস্ত করেছেন গল্পটি। অর্চনাই শুধু কথা বলে গেছে। স্বামী-পুত্র-কন্যা কারো মুখেই একটিও সংলাপ বসাননি লেখক। তথাকথিত গল্পহীন এ গল্পের আঙ্গিকেও তথাকথিত গল্পহীনতাই ফুটে উঠেছে। গভীর নিরীক্ষাতেই গল্পটি ডিসকোর্সের রূপ পেয়েছে। আর এই নিরীক্ষাই গল্পের গৌর বৈরাগীকে চিনিয়ে দেয়।   

গৌর বৈরাগীর অধিকাংশ গল্পের পটভূমি মফস্‌সল। মানুষজনও মফস্‌সল শহরের। মফস্‌সলেরও জৌলুসচিত্র নয়, ম্লান যাপন ঘুরেফিরে আসে তাঁর গল্পে। সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির ঢেউ খুব তাড়াতাড়িই আছড়ে পড়ে মফস্‌সলে। পরিবর্তনশীল মফস্‌সল-জীবনের বিচিত্র রূপ তাঁর গল্পগুলি। শহর বা গ্রামজীবনের গল্পও কিছু কম লেখেননি তিনি। কিন্তু তাঁর স্বস্তি এবং সিদ্ধি বোধহয় মফস্‌সল। 

গৌর বৈরাগী উপন্যাস লেখেননি। তাই হয়তো বৃহত্তর পাঠকের কাছে সেভাবে পৌঁছোতে পারেননি। তবে লেখক মহলে আদৃত, সুপরিচিত এবং মান্য তিনি। গল্পের আয়তনও খুব বড়ো নয়। তিনি বিশ্বাস করেন কিছুদিন পরে মুদ্রিত মাধ্যমে সাহিত্য পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। মোবাইল, ল্যাপটপে পড়বেন সবাই। সেখানে টানা গল্পের প্রতি বিশেষ আগ্রহ থাকবে না পাঠকের। এই কারণে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে অণুগল্প। অণুগল্পকে যথেষ্ট মান্যতা দেন তিনি। বহু অণুগল্প লিখেছেন। সমসাময়িক লেখকদের অনুগল্পকে এতটা গুরুত্ব দিতে দ্যাখা যায় না। 

গৌর বৈরাগীর এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের অধিকাংশই শিশুকিশোরদের। ‘সোনার কলমে’ লেখা ছোটোদের গল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। তাঁর গল্পের অন্যতম একটি প্রিয় চরিত্র রাজামশাই। এই রাজামশাই কোনও রাশভারী মানুষ নন। একজন কুণ্ঠিত হাবাগোবা লোক। তাঁর পায়ের চটি ছেঁড়া, সেপটিপিন দিয়ে আটকানো। গায়ের ফতুয়াটারও একটা দিক ছেঁড়া। পরনে মলিন ধূতি। একমাত্র পুরনো পাগড়ীটা তাঁর রাজকীয় ঐতিহ্য বহন করে। তিনি পান্তাভাত খেতে ভালোবাসে। তাঁর ছায়াও চুরি হয়ে যায়। তিনি দ্যাখেন পশ্চিমদিকে সূর্যোদয় হচ্ছে। তাঁর আমগাছে আমড়া ফলে, আর আমড়া গাছে আম। সেই রাজামশাইকে সবাই ধমকায়। তাঁর মন্ত্রী, সেনাপতি এমনকি সাধারণ প্রজারাও ধমক দেয়। এই অদ্ভুত রাজামশাই চরিত্রটিকে নিয়ে ইচ্ছে মতো খেলতে পারেন লেখক। তিনি রূপকথার রাজামশাই একদমই নন। রূপকথার রাজামশাইয়ের সীমাবদ্ধতা থাকে। তাঁর নেই। ধীমান পাঠক বুঝতে পারেন এই রাজামশাইয়ের গল্পগুলি শুধু ছোটোদের নয়। আবার ছোটোদেরও। রাজা মশাই আসলে হয়তো বিবেক। কখনও কখনও পাঠক অনায়াসে চিনেও নিতে পারেন রাজামশাইকে। গৌর বৈরাগী অন্তত পঞ্চাশটি গল্প লিখেছেন এই রাজামশাইকে নিয়ে। বাংলা সাহিত্যে এরকম চরিত্র আগে দ্যাখা যায়নি। হয়তো-বা বিশ্ব সাহিত্যেও দুর্লভ এহেন রাজামশাই।  

তাঁর নামের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘গল্পমেলা’। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর আবাল্যের চন্দননগরে গল্পচর্চার এই সংগঠনটি রমরমিয়ে গল্প নিয়ে নানান কাজ করে চলেছে। বাংলা গল্প নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এই ‘গল্পমেলা’। সম্ভবত এরকম নিয়মিত গল্পচর্চাকেন্দ্র বাংলায় আর নেই। আর সেখানে গৌর বৈরাগীকে অন্য চেহারায় দেখতে অভ্যস্ত গল্পকাররা। একজন প্রকৃত গল্প-সমালোচকও তিনি। তাঁর এবং তাঁর গল্পমেলার ছত্রছায়ায় নিজেদের আজও প্রস্তুত করে চলেছেন কত কত তরুণ গল্পকার। 

গৌর বৈরাগীর গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য সরলতা ও ব্যঞ্জনামুখ্যতা। সেখানে তাত্ত্বিক দার্শনিকতা নেই। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা নেই। আছে এক গভীর জীবন-উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিকে প্রকাশ করবার জন্য লেখক কোনও চমক বা প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ করেন না। তুলির একটি মাত্র রেখায় ছন্দিত করে তোলেন জীবনের সাত রঙ। সেই রঙে বিচ্ছুরিত হয় মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মায়া। লক্ষ করবার মতো ভাষা-ব্যবহার। আভরণহীন, অনাড়ম্বর ভাষায় চিত্রিত করেন আটপৌরে জীবন। জীবনের অসহায়তা। পাতার পর পাতা বর্ণনা ছাড়াই জীবনের সারাৎসার মূর্ত করে তোলেন আপাত সামান্য বিষয়কে নির্ভর করে। এখানেই লেখকের শিল্পসিদ্ধি। প্রতিটি গল্পেই লেখক প্রমাণ করেছেন তাঁর স্বাতন্ত্র্য। আজও সমান দক্ষতায় লিখে চলেছেন নতুন নতুন গল্প। সেই সব গল্পে আঁকা হচ্ছে জীবনেরই বিচিত্র অভিজ্ঞান। জীবনকে ভালোবাসেন তিনি। গল্পের ভিতর দিয়ে জীবন লেখেন। জীবন খোঁজেন। সেই খোঁজার সঙ্গী হয়ে যান তাঁর পাঠকও। তাই গৌর বৈরাগীর শিল্পসফল গল্পগুলির প্রতি উদগ্রীব হয়ে থাকেন পাঠক। আজও।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো। লেখা চলতে থাকুক, বিশ্বজিৎ দা।
    সুরশ্রী

    ReplyDelete
  2. গৌর বৈরাগীর গল্পের ক্ষেত্র মফস্বল বললে বোধহয একটা দিক অনাবৃত থাকে।মফস্বলকে কেন্দ্র করে দেশভাগ ও তার পরবর্তী জনজীবনের গভীরে একটা বিশাল পরিবর্তন এবং তার রসায়ণ, তিনি এত সুন্দর বুনেছেন, তা দেখা যায় না।অন্তত আমি পড়িনি।তিনি যে আত্মজীবনী লিখছেন, সেখানেও বিষয়টা খুব পরিষ্কার।লেখাটা ভালো হয়েছে।তোমার এই লেখাটায় গৌরদার নিজস্বতা ফুটে উঠেছে।ভালো থেক।

    ReplyDelete