জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৪৯/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৪৯

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 অদ্বৈতানন্দজীর সমগ্র সাধক জীবন কয়েকটি কথায় চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন লাটু মহারাজ। মিশন যেদিন রেজিস্টার্ড হয় সেদিন খবর আসে যে বুড়োগোপালদাদা ( স্বামী অদ্বৈতানন্দ ) পরমধামে গমন করেছেন ( ২৮ ডিসেম্বর, ১৯০৯ )। লাটু মহারাজ এই সংবাদ প্রাপ্তির পর সারাটা দিন কেবল তাঁর প্রসঙ্গই করতে থাকলেন। অনেক কথাই বলেছিলেন। তার স্বল্পাংশটি এইরূপ --“আরে! বুড়োগোপাল দাদা না থাকলে মঠের ব্রহ্মচারীদের ভাতের উপর তরকারী জুটতো না। সেই ত মঠে সব্জীবাগান লাগিয়ে দিলো। সব্জীবাগান করতে বুড়োগোপালদাদাকে কত না খাটতে হয়েছে!... তাঁর মতন ধীরভাবে জপে লেগে থাকতে ক'জন পারে? অনেকেই ত দু-চার দিন জপ করে ফল না পেয়ে জপ ছেড়ে দেয়, বাকী গোপাল দাদা বুড়ো বয়স পর্যন্ত ধৈর্য ধরে জপে লেগেছিলো; তাঁর ধৈর্যের তুলনা নেই। রাখালভাই ত সেই কথাই বলে।” (শ্রীশ্রীলাটুমহারাজের স্মৃতিকথা, শ্রী চন্দ্রশেখর চট্টোপাধ্যায়, উদ্বোধন কার্যালয়) 
 বস্তুতপক্ষে ঠাকুরের দেহত্যাগের পর গোপাল-দার কোনও নির্দিষ্ট বাসস্থান থাকল না। কেননা ইতিমধ্যেই তিনি স্বজনসংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন চিরতরে। বরানগর মঠ স্থাপন হলে তিনি সেখানে এসেই উঠলেন। তবে অন্যান্য অধিকাংশ গুরুভ্রাতাদের মতোই তপস্যাপ্রবণ অন্তর তাঁকে টেনে নিয়ে গেল অধ্যাত্মভূমি ভারতের নানা তীর্থস্থানে। ১৮৮৮ সালে তিনি ৺কেদার ও বদরিকাশ্রম দর্শন করেন। সেখানে গুরুভাই অখণ্ডানন্দ মহারাজের ( গঙ্গাধর মহারাজ ) সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন পর সাক্ষাৎ হওয়ায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে গঙ্গাধর মহারাজ কেঁদে ফেলেন। এই তীর্থ সাঙ্গ হলে গোপালদা বৃন্দাবনে যান এবং কিছুকাল সেখানে অবস্থান করেন। ১৮৯০ সালে পুনরায় গঙ্গাধর মহারাজের সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং দুই গুরুভ্রাতা একত্রে হরিদ্বার-কুম্ভে যান। ১৮৯৪ সালে কাশীতে বংশীদত্তের বাড়িতে থেকে তপস্যা করেছিলেন। এই সময় স্বামী বিরজানন্দ ( কালীকৃষ্ণ মহারাজ ) কাশীধামে গিয়ে প্রমদাদাস মিত্রের বাগানে স্বামী যোগানন্দ, অভেদানন্দ ও সচ্চিদানন্দ প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হন। পরে তিনি অদ্বৈতানন্দ ও সচ্চিদানন্দের সঙ্গে পঞ্চকোশীর দিকে রওনা দেন।
 আবার ১৮৯৬ সালেও অদ্বৈতানন্দ স্বামী ৺কাশীধামে বংশীদত্তের বাড়িতে কঠোর তপস্যায় রত হন। অসম্ভব কঠোর ও শৃঙ্খলাপরায়ণ জীবন যাপন করতেন। গ্রাসাচ্ছাদন হত মাধুকরীর মাধ্যমে, বাস করতেন শিব মন্দির সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে। প্রকোষ্ঠটি সর্বদা পরিপাটি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকত। যদিও সেটিতে শরীরধারণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ন্যূনতম কিছু দ্রব্যাদি ছাড়া কিছুই থাকত না। এই সময়েই পায়ে কাঁটা ফুটে বিশেষ বিড়ম্বনায় পড়েন অদ্বৈতানন্দজী! বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারা যায় মহাপুরুষ মহারাজ ( স্বামী শিবানন্দ ) লিখিত ১৩. ৮. ১৮৯৬ তারিখের একটি পত্রে। সেই পত্রে মহাপুরুষজী প্রমদাদাসবাবুকে লিখেছেন --“আমাদের বৃদ্ধ স্বামী, যিনি ৺বারাণসী-পুরী সেবা করিতেছেন, তাঁহার পায়ে একটি কণ্টক বিদ্ধ হইয়া বিশেষ কষ্ট পাইতেছেন, লিখিয়াছেন। দুই-বার অস্ত্র করিতে হইয়াছে -- উত্থানশক্তি রহিত হইয়াছে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া তাঁহার সংবাদ লইবেন। তিনি কুচবিহারের ৺কালীবাড়ির পশ্চাদ্ভাগে বাবু সাগরচন্দ্র সুরের বাটীতে আছেন। বড়ই কষ্ট পাইতেছেন।” সকলের বিশেষ সেবা যত্নে গোপালদা সেরে উঠে পুনরায় কাশীধামে তপস্যায় মগ্ন হন।

 সত্যপরায়ণতা ছিল গোপালদা'র চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেটা তিনি অর্জন করেছিলেন ঠাকুরের সঙ্গলাভের ফলে। পেটের অসুখের জন্য জনৈক কবিরাজ একবার ঠাকুরকে তিনটি লেবু খেতে বলেন। ঠাকুর গোপালদা-কে লেবু সংগ্রহের নির্দেশ দিলে তিনি অনেকগুলি লেবু নিয়ে হাজির হন। সত্যরূপী ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তিনটি মাত্র লেবু রেখে বাকিগুলি ফিরিয়ে দেন। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। সত্যনিষ্ঠায় অসম্ভব আন্তরিক ছিলেন এবং ওই বিষয়ে পরবর্তী সময়ে মঠের ব্রহ্মচারীদের উৎসাহ দিতেন। কাশীতে তপস্যায় মগ্ন থাকাকালীন ওই স্থান ত্যাগ করে অন্য কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করতেন না। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ পাশ্চাত্য বিজয়ের পর মঠে ফিরে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার কাজে প্রবলভাবে উদ্যোগী হলেন। এই কাজে যোগদানার্থে স্বামীজীর ভালোবাসাময় আহ্বান তাঁকে কাশী পরিত্যাগ করতে বাধ্য করল। উপস্থিত হলেন আলমবাজার মঠে। স্বামীজীর আহ্বানকে উপেক্ষা করে কার এমন সাধ্য! তবে মূল কথা হল গুরুভাইদের ভিতর ভালোবাসার বন্ধন। বিশেষত নরেন্দ্রনাথকে নেতা নির্বাচিত করে গিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং! তাঁর নেতৃত্বকে সর্বান্তকরণে মেনে নিয়েছিলেন সব গুরুভাইই। বুড়োগোপালদাদাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না।

 পরবর্তী সময়ে বেলুড় মঠে বাসকালীন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বুড়োগোপালদাদা কি নিষ্ঠা ও ধৈর্য সহকারে সমস্ত কাজ করে যাচ্ছেন। বহু কাজের তত্ত্বাবধানই তাঁকে করতে হত। তবে মূল কর্মক্ষেত্রটি ছিল সবজি বাগান। মঠের প্রারম্ভিক দিনগুলিতে দৈনন্দিন নানা অভাব পরিলক্ষিত হত। ফলে খাদ্য উৎপাদনের কাজটি করে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই বিষয়ে লাটু মহারাজ এক সময়ে বলেছিলেন, “আরে, বুড়ো গোপাল-দা না থাকলে মঠের ব্রহ্মচারীদের ভাতের উপর তরকারি জুটত না। সবজি বাগান করতে বুড়ো গোপাল-দাকে কতই না খাটতে হয়েছে।” ( শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয় ) শ্রীশ্রীমা'ও তাঁর এই কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। মঠের জমিতে যা কিছু হওয়া সম্ভব সেইসব সবজি -- ঢেড়স, বেগুন, কাঁচকলা -- এই সবই করেছিলেন। ফলে তরকারি সেভাবে কিনতে হত না। এছাড়া শ্রীশ্রীমা'কেও তিনি কিছু কিছু সবজি পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর সবিশেষ যত্ন ও পরিচর্যায় মঠের বাগান তখন পরিপূর্ণ থাকত। সবজি, ফল ও ফুলের বাগান সবই। ফলে পূজার ফুল, ভোগের ফল ও তরকারির কোনও অভাব থাকত না। এই বাগান করা নিয়ে মজার ঘটনাও ঘটত। একসময়ে গোপালদা সবজি বাগান ও অপর এক সাধু ফুলের বাগানের দেখাশোনা করতেন। ফুলের বাগানে সব ব্রহ্মচারীরা কাজ করছে অথচ সবজি বাগানে কেউ নেই, এমন অবস্থা দেখে গোপালদা বললেন, “আহা, নূতন ছেলেদের অত খাটাতে নেই -- ফুল বাগানের মাটি বড় শক্ত। ওরে ছেলেরা, তোরা এখানে এসে কাজ কর -- এই মাটি নরম।” সকলেই জানতেন আসলে সবজি বাগানের মাটি অনেক শক্ত, সেখানে পরিশ্রম বেশি। এমন মন্তব্যে স্বভাবতই সকলের মধ্যে হাস্যোদ্রেক হল। মঠে গো-সেবার কাজও অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করতেন গোপালদা। চা-পান বিষয়ে তিনি বেশ অদ্ভুত মত পোষণ করতেন। নিজে চা পান করতেন না এবং অন্যকেও তা করতে বারণ করতেন। এই নিয়ে রঙ্গরসিকতার আবহ তৈরি হত। তাঁর ধারণা ছিল চা পান করলে রক্ত আমাশয়ে আক্রান্ত হতে হয়। এই বলে একবার একজনকে সাবধান করলেন। তখন উদ্দিষ্টজন উত্তর করলেন, “গোপালদা, যত ফোঁটা চা, তত ফোঁটা রক্ত।” গোপালদাও তখন ব্যঙ্গ করে বললেন, “খুব খা, খুব খা।” হাসিতে ফেটে পড়ল উপস্থিত সকলে।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments