জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—মাদাগাস্কার /ছিল পণ্ডিত হয়েছে পশুপালক/ চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—মাদাগাস্কার

ছিল পণ্ডিত হয়েছে পশুপালক 

চিন্ময় দাশ
 
কথায় বলে না, দশ চক্রে ভগবান ভূত! বেচারা বকের কপালেও ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল। সেদিন থেকে কী দুর্দশাই না ঘটেছে বকের জীবনে! সেই ঘটনাটাই শোনা যাক আজ। 
মাদাগাসকার হোল নীল সমুদ্রে ঘেরা একটা দেশ। দেশটার গড়ন লম্বাটে। সে দেশের একেবারে ভিতরের অংশ জুড়ে আছে গভীর অরণ্য। সেটাও দেশের এ মাথা ওমাথা জোড়া লম্বা গড়নের। দু’দিকে ছাড় রেখে, একেবারে মাঝখান জুড়ে লম্বাটে অরণ্য। 
আর অরণ্য মানেই নানা রকম জীবজন্তুর বাস সেখানে। তবে, মাদাগাসকারে বিচিত্র সব জীবজন্তু দেখা যায়। যাকগে, আসল গল্পের কথায় আসা যাক। 
অনেক অনেক কাল আগের কথা। বনের ভিতরে এক জায়গায় একটা স্কুল বসে। বনের ভিতরে হরেক জীবজন্তুর বাস। ফসা, লেমুর, প্যান্থার ক্যামেলিন, টমেটো ব্যাঙ (এসব ব্যাঙের আবার পুরুষদের রঙ হলুদ-কমলা, আর মেয়েদের লাল-কমলা), কচ্ছপ, বাদুড় (ফ্লাইং ফক্স— একেবারে শেয়ালের মত মুখ এই বাদুড়দের, তাই এমন নাম), নীলরঙের কোকিল—এমনই সব নানা জীবজন্তু।   
 তাদের বাচ্চারাই হোল স্কুলটার পড়ুয়া। স্কুলে না গেলে, একটু আধটু লেখাপড়া না করলে, চলে না কি? মানুষ না হোক, খানিকটা সহবত তো শেখা দরকার বাচ্চাগুলোর। সেজন্যই সবাই মিলে একটা স্কুল গড়েছে তারা। 
সেই স্কুলের পণ্ডিত হোল বক। সবাই মিলেই পণ্ডিত নিয়োগ করেছে তাকে। কেমন সুন্দর দুধের মত ধবধবে সাদা রঙ বকের। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। হোলই বা সরু, কেমন লম্বা দুটো ঠ্যাং! লাফানো ঝাপানো নাই। রাজার মত দুলকি চালে চলাফেরা করে। 
আর মাথা? কী লম্বা একজোড়া ঠোঁট! আর, বড় কথা হোল, মাথার পিছনে সরু আর লম্বা একখানা টিকি। টিকিটাই বকের পরিচয়। টিকিটাই বলে দেয়, বক হোল এ গাঁয়ের পাঠশালার পণ্ডিত মশাই।
আর বকের গলাখানা? কী লম্বা, কী লম্বা! উঁচিয়ে ধরলে, কত দূর পর্যন্ত সব দেখতে পায়। লম্বা গলা বলেও, পণ্ডিত বাছা হয়েছে বককে। গলা উঁচিয়ে, বাচ্চাগুলোকেও নজর রাখতে পারবে ভালো করে। আর, ছাত্রদের নজর রাখাই কাল হয়েছিল পণ্ডিতের! 
একদিন ক্লাশ চলছে। মালাগাসি ভাষা শেখানোর ক্লাশ। প্রথমে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছেন পণ্ডিত মশাই। ছাত্রেরা সব মন দিয়ে পড়বার, আর ভাষাটা শিখবার, চেষ্টা করছে। 
সবাই মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। কেবল একটি ছাড়া। একেবারে পেছনের সারিতে বসা একটা ব্যাঙের ছানা। গায়ের রঙ মিষ্টি হলদে-কমলা বলে, ভারি দেমাক। কোন দিনই পড়াশোনায় মন থাকে না তার। সারাটা সময় দুষ্টুমি করে কাটায়। হাজার বার বলে দিলেও,  সামনের সারিতে বসানো যায় না বিচ্ছুটাকে। আজও তার চালচলন একই রকম।
পড়ার দিকে তো মন নাইই। উলটে পণ্ডিত মশাইকে নকল করে ভেঙচি কাটছে। বকের লম্বা গলা। সেটা তুলেই গোটা ক্লাস শাসন করেন পণ্ডিত মশাই। ব্যাঙের ছানাটা গলা তুলছে, গলা নামাচ্ছে, ছাত্রদের ধমক ধামক দিচ্ছে। ঠিক যেমনটি করেন পণ্ডিত মশাই। 
তাতে ব্যাঙের ছানাটার পাশে যারা বসেছে, তাদের তো ভারি অসুবিধা হচ্ছেই। মাঝে এমনই বাড়াবাড়ি করছে ছানাটা, গোটা ক্লাশে একটা হুলুস্থুল অবস্থা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ সেই বাচ্চাটার সাথে তাল মিলিয়ে হাসাহাসি করে ফেলছে। কেউবা বিরক্ত হয়ে ব্যাঙকে ধমক দিচ্ছে।
কোন রকমে ক্লাশ শেষ হোল। পণ্ডিত মশাইর মাথা ভারি ঠাণ্ডা। ব্যাঙের ছানাটাকে বললেন—একটু দাঁড়িয়ে যা। সবার শেষে বেরুবি তুই।
সব ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পণ্ডিত বললেন—নিত্যদিন ক্লাশের মধ্যে গোলমাল করতে দেখি তোকে। এমনটা তো ভালো নয়, বাপু। স্কুলে এলে, পড়াশোনা করতেই হবে। আর, পড়াশোনা যদি ভালো না লাগে, তাহলে তো চুকেই গেল। স্কুলে এসো না আর। তাতে তোরও সুবিধে হোল। আমরাও হয়রানির হাত থেকে বেঁচে যাই। দুষ্টু গরুর চেয়ে, শূণ্য গোয়াল অনেকই ভালো।
অন্যদিন স্কুল ছুটি হলে, আনন্দে নাচতে নাচতে ঘরে ফেরে ব্যাঙের ছানাটা। আজ ঘরে ফিরল চোখ ভরতি জল নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে।
তার বাবা মা ছুটে এলো একরাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে। হোল কী তাদের আদরের দুলালের? কোন দিন তো চোখ-মুখ এমন দেখি না ছেলেটার? আজ হোলটা কী?
বাবা-বাছা করে সাধাসাধি করতে লাগল ছেলেকে—কী হয়েছে, সোনা বাবা আমার? চোখে জল কেন আজ? 
বাবা মা যত সাধাসাধি করে, ছেলে ততই কেঁদে ওঠে। বাবা মার প্রশ্ন বাড়ে। চোখের জলে তাদের ছানার মুখ ভেসে যায়। তার পরে বুক ভেসে যায়। তার পরে? তার পরে টপ-টপ করে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে মাটিতে। মাটি ভিজে কাদা হতে থাকে।
অনেক সময় গেল সাধাসাধি আর কান্নাকাটিতে। শেষে বাবা মা বলল—কী হয়েছে, শুধু মুখ ফুটে বলো বাছা আমাদের। এখুনিই হেস্তনেস্ত করে ছাড়ব আমরা। 
ব্যাঙের ছানা তখন গড়্গড় করে বলে যেতে লাগল। পণ্ডিত মশাই তাকে বেধড়ক মারধোর করেছে। গালমন্দ করেছে। স্কুল থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।
ব্যাঙ বাবা-মায়ের তো আগুন জ্বলে উঠল মাথায়। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে স্কুল থেকে? (সবাই জানে, ব্যাঙেদের শরীরে ঘাড় বলে কিছু নাই।) এত বড়ো আস্পর্দা ঐ হতভাগা পণ্ডিতের। একটা গণ্ড মুর্খ। ধিড়িঙ্গে চেহারা। দুটো ল্যাকপেকে ঠ্যাঙ। ওটাকে পণ্ডিতি করতে দেওয়াই মহা মুর্খামি হয়েছে।
ব্যাঙের ছানা তো এটাই চেয়েছিল। মওকা পেয়ে, সে এবার বলল—ঘাড় ধাক্কা দেওয়াটা এমন কী বড় ব্যাপার! আমাকে দুষ্টু গরু বলেছে পণ্ডিত মশাই। 
আর যায় কোথায়? বাবা মা দুজনে মিলে তিড়িংবিড়িং লাফাতে ঝাঁপাতে লাগল। বাবা চেঁচিয়ে উঠল—কী বলেছে! ব্যাঙের ছানাকে গরু বলা? আজ ওর এক দিন, কি আমার এক দিন। আজই ওর পণ্ডিতি করা ঘুচিয়ে ছাড়ব আমি। রাত পোয়াতে দেব না।
মা বলল—শুধু গরু না গো। দুষ্টু গরু বলেছে আমার সোনার টুকরো ছেলেকে। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে আমার। কিছু একটা বিহিত করো তুমি।
ব্যাঙের ছানাটা সারাটা ক্লাশ কী করেছিল, কেউ জানল না। কেউ জানল না, পণ্ডিত মশাই ঠিক কী বলেছিলেন তাঁর সোনার টুকরো ছাত্রটিকে। অভিযোগের পর অভিযোগ ছড়িয়ে পড়তে লাগল গোটা এলাকায়। 
বাবা-ব্যাঙ প্রথমে নিজেদের পাড়ায় গেল। সবাইকে জড়ো করে পণ্ডিতের নামে সাত কাহন করে বলে যেতে লাগল। নিজেই অভিযোগকারী। নিজেই ফয়সালা জানিয়ে দিতে লাগল— আমাদের ছেলেদের পড়াশোনার ব্যাপার, আমরা নিজেরা বুঝে নেব। কিন্তু অমন পণ্ডিত আমাদের দরকার নাই। 
চিরকাল সব ব্যাঙের এক রা। একজন ডেকে উঠলে, সবাই তাতে গলা মেলায়। আজও তাই হোল, আগুপিছু ভাবনা ভাবল না কেউ। সবাই চেঁচাতে লাগল—চুলোয় যাক পড়াশুনো। অমন পণ্ডিতকে রাখা চলবে না। 
এবার ব্যাঙেরা দল বেঁধে চলল ফসাদের পাড়ায়। তারাও তাল মেলালো ব্যাঙেদের সাথে। ব্যাঙ আর ফসার দল এবার হাজির প্যান্থার ক্যামেলিনদের পাড়ায়। বকের নামে উল্টো-পাল্টা বলে কান ভারি করল তাদের। তারাও  দলে জুটে গেল। 
এইভাবে কচ্ছপ, বাদুড়, আরও যারা যারা আছে, তাদের সকলের কাছেও। বেশ বড় একটা বাহিনী গড়ে উঠল সবাইকে জুটিয়ে নিয়ে।
বিশাল বাহিনী চলেছে পথ ধরে। সামনে বাবা-ব্যাঙ। লেমুরের বাড়ি এসে হাজির হোল সবাই। লেমুর হোল ঠাণ্ডা মাথার জীব। সেজন্য লেমুরকে মোড়ল বানিয়েছে সবাই।
বকের নামে হাজার অপবাদ দিল ব্যাঙ। বাকি সবাই তাল মেলালো তাতে। বকের নামে হাজারটা অভিযোগ জানালো ব্যাঙ। সবাই তাল ঠুকলো তাতেও। সাত সাতে উনপঞ্চাশ কাহন বলা শেষ করে, ব্যাঙ বলল—আমাদের একটাই কথা, বককে আর পণ্ডিত চাই না আমরা।
লেমুর বলল—আরে, সে কী কথা? কাজ থেকে কাউকে তাড়াব বললেই কি আর তাড়ানো চলে? না, তাড়ানো উচিত? 
সবাই থমকে গেল মোড়লের কথা শুনে। ব্যাঙ বলল—মানে? কী বলতে চাও তুমি?
--বলতে চাইছি, এক তরফা শুনে কি বিচার করা যায়? লেমুর বলল—তোমাদের কথা শুনলাম। বকের কথাটাও তো শুনতে হবে। 
ব্যাঙ হুঙ্কার দিয়ে উঠল—মানে, তুমি বলতে চাইছ, আমরা এতগুলো লোক, সবাই মিথ্যে কথা বলছি? আমার দুধের ছেলেটা মিথ্যে কথা বলছে? 
লেমুর বলল—আমি কি বললাম, তোমরা মিথ্যে কথা বলছো?
ব্যাঙ চেঁচিয়ে উঠল—আরে না, না। তুমি অমন কথা বলবে কেন? আমরাই মিথ্যে বলেছি সবাই। তাহলে, এবার একটি সত্যি কথা শুনে নাও মন দিয়ে। তুমি থাকো আমাদের মোড়ল হয়ে। তোমার স্কুল থাকুক। বকও থাকুক তোমার পণ্ডিত মশাই হয়ে। শুধু কাল থেকে আমাদের বাচ্চারা কেউ আর ইস্কুলে যাবে না। এটাই আমাদের ফয়সালা।
বেচারা মোড়ল! বড্ড ঘেরায় পড়ে গেল। দশ চক্রে ভূত হয়ে গেল ভগবান। কিচ্ছুটি করবার থাকল না আর। আসামি জানল না, তার অপরাধ কী? বলবার কোন সুযোগও দেওয়া হোল না তাকে। বককে পণ্ডিত মশাইর পদ থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হোল সেদিনই। 
বকের ভারি সমস্যা তৈরি হোল তাতে। ইস্কুলে বাচ্চা পড়ায়। বাচ্চাদের বাড়ি থেকে মাছটা, পোকা-মাকড়টা পেয়ে যেত এত দিন। সেসব বন্ধ হয়ে গেল। পেট চালানো দায়।
বকের দুর্দশা দেখে, মনে ভারি দয়া হোল মোড়লের। অবিচার হয়েছে বকের উপর। সবাইকে ডেকে একটা সভার আয়োজন করল লেমুর। বকের নাম উঠতেই, বাবা-ব্যাঙ তো তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল।  কেউ কিছু বলবার আগেই বলে উঠল—যার পেট, চালাবার দায় তারই। ব্যাঙের ছানাকে দুষ্টু গরু বলেছে বক। ওকে তুমি গরু-মহিষের রাখালের কাজ দিয়ে দাও। সারা দিন গরু-মহিষের পালের পিছন পিছন ঘুরে বেড়াক হতভাগা।
সবাই হইহই করে সায় দিয়ে ব্যাঙের প্রস্তাবে। সেদিনও মোড়লের কিছু করবার রইল না।
পরদিন ব্যাঙকে  ডেকে নতুন কাজের কথা জানিয়ে দিল মোড়ল। বলল—এক দিক দিয়ে মন্দ হোল না, বুঝলে পণ্ডিত। প্রচুর পোকা-মাকড়, কুচো মাছ, গেঁড়ি-গুগলি পেয়ে যাবে মাঠে। পেটের চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। আর একটা কথা চুপিচুপি বলে দিই। 
মোড়ল বলল-- ইঁদুরছানা, এমনকি ব্যাঙের ছানা পেলেও, দু’বার ভাববে না। টুক করে গিলে ফেলবে। কাউকে রেয়াত করতে হবে না। 
বক একটু ঘাবড়ে গেল এ কথায়। কিছু বলতে গেল—কিন্তু …।
--কোন কিন্তু নাই এর মধ্যে। গোলমাল হলে, আমি সামলে নেব। তুমি তোমার মত চলবে। যেমন কর্ম করেছে মুখ্যুর দল, তেমন ফলই পেতে হবে ওদের।
সেদিন থেকে গরু-মহিষের পালের পিছন পিছন ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বককে। গরুর পাল হেঁটে গেল। অমনি ঘাসের ভেতর থেকে পোকামাকড় বেরিয়ে পড়ল লাফ দিয়ে। বকের ইয়া লম্বা একখানা গলা আর ঠোঁট ঝাঁপিয়ে পড়ল সাথে সাথেই। 
মাঠে-ঘাটে আলের গা ঘেঁষে ঘোরাফেরা করে ব্যাঙের ছানারা। বেরিয়ে পড়লেই হোল। বকের মনে পড়ে যায়, একটা বদমায়েস ব্যাঙের ছানার জন্য, পণ্ডিতি খোয়াতে হয়েছে তাকে। কপ করে গিলে ফেলে ব্যাঙের ছানাকে। 
ছিল ইস্কুলের পণ্ডিত মশাই। তা থেকে পশুপালক হয়েছে বক। সেই কাল থেকে, আজও এই জীবিকাই চলছে বেচারা বকের।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments