জ্বলদর্চি

ক্রিপ্টোকারেন্সী ও তার অভিঘাত-১/বাসুদেব গুপ্ত

ক্রিপ্টোকারেন্সী ও তার অভিঘাত

বাসুদেব গুপ্ত

পর্ব ১

ক্রিপ্টোকারেন্সি: কি ও কেন?
টিভি খুললেই ক্রিপ্টো। ইউটিউব খুললেই ক্রিপ্টো। মনে হচ্ছে টাকা পয়সা নিয়ে একটা কিছু হচ্ছে। সেই শুনেছিলাম কবেকার টিউলিপের গল্প, সেরকম না কি? এদিকে পোস্ট-এস্থেটিক সব বিজ্ঞাপন, যার অধুনা নাম ছোট্ট করে শুধু ‘এড’। “বহুত হারড নেহি, সিমপ্ল হ্যায়” চলচ্চিত্রের বিখ্যাত মনোরঞ্জক নায়ক গট গট করে এন্ট্রি মারে, এসেই তার চেলাদের ব্যাপারটা নিয়ে লেকচার শুরু করে। তারা সব ওটিটি স্যাম্পল। কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল না, তাদের গলায় রুপোর চেন, হাতে ট্যাট্টু, চামড়া ফুটে বেরোচ্ছে বিচ্ছিরি ভয় দেখানো ড্রাগন, আর চোখের তারায় আঁকা ডলার, খুব রিচ হবার লকলকে স্বপ্ন। মফস্বল শহরের অগুন্তি বেকার বা ছুটকো কাম করা যুবক বাহিনী। সমাজ, সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়, মারপিট করায়, মিছিলে নিয়ে যায়, কিন্তু কাজ দেয় না। আজ তাদেরই মত দেখতে, তাদেরই মত চুল ছেঁটে, তাদেরই মত পোষাকে, টপ হিরো এসে শেখায়, কেমন করে মাত্র ১০০ টাকা দিয়েই তারা খুলতে পারে ক্রিপ্টো একাউন্ট। আজ যা একশ কাল তা লক্ষ,আর পরশু হয়ত ওই সব নতুন শব্দ মিলিয়ন বিলিয়ন, লড়ে গেলে সবই হবে। মাত্র একশ টাকা, তাই থেকেই শুরু হবে সেই আর্থিক বিপ্লব। যাবার আগে নায়ক বলে যায় “ কুছ তো বদলেগা”, মুখগুলি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 
প্রতিটি টিভি চ্যানেলে এখন স্মার্ট ঝকঝকে ক্রিপ্টোর বিজ্ঞাপন। ইউটিউব চ্যানেলে চাঁদার টাকায় চালানো প্রগতিশীল, উদারপন্থী এবং এন্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট এঙ্কররাও এখন প্রতিবাদের প্রোগ্রাম থামিয়ে মাঝে মাঝেই ক্রিপ্টোর বিজ্ঞাপন ঢুকিয়ে দেয়। লাউডস্পিকার বাজানোর মতো, সর্বত্র একটি বার্তা রয়েছে: ক্রিপ্টো কিনুন, বদলে ফেলুন। ১০০ টাকা, ১০০ টাকা, খরচ করুন এবং কয়েন কিনুন৷ একই সঙ্গে বিভিন্ন সংবাদপত্রে, পত্রিকায় এমনকি লিটল ম্যাগাজিনেও ক্রিপ্টোর জয়গান করে প্রবন্ধের ছড়াছড়ি। কীভাবে ক্রিপ্টো ব্যাঙ্কিংএর জগদ্দল পাথর, সরকারের খবরদারি, স্বাধীনতাকে দাবিয়ে রাখার আইন এবং আন্তর্জাতিক প্রোটোকলের শৃঙ্খল থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করে, সে সম্পর্কেও প্রতিদিন লেকচারলেখ ছাপা হয় দেশে বিদেশে। যত না তৈরী হয় হাসপাতাল, ব্যাংক বা বিশ্ববিদ্যালয়, তার থেকে অনেক তাড়াতাড়ি ব্যাঙএর ছাতার মত গজিয়ে ওঠে রোজ নতুন নতুন ক্রিপ্টো বেচার কম্পানী। আর খেলা যখন শুরু, তখন পিরামিডপন্থী পনজি স্কিমও মাঠে নেমে পঞ্জিকা ছাপিয়ে ফেলছে চটপট। 100 টাকা লগ্নী করুন, তারপর ইচ্ছেমত টাকা দিয়ে বিটকয়েন কিনুন এবং বন্ধুদের রেফার করুন। যদি তারাও লগ্নী করে, তাহলে আপনি পাবেন ক্যাশব্যাক। ক্রিপ্টো থেকে কিছু পান বা না পান, যতদিন এই গপ্পোটা ছড়াতে পারবেন, টাকা পেতে থাকবেন। 
বড্ড সবুজ টাকাবাজির ঝলক আর ধোঁয়া। কি হচ্ছে ব্যাপারটা একটু জানা দরকার। আমাদের সকলেরই। তাই ধোঁয়াশা কিছুটা পরিষ্কার করার জন্য এই লেখা। 

ক্রিপ্টোকারেন্সি কি? খায় না মাথায় দেয়?
অর্থই অনর্থের মূল, কে না জানে? অথচ আমাদের জাগতিক জীবনের সব অর্থই আসে ওই অর্থ থেকে। সম্পদ মাপার মানদণ্ড অর্থ। আমাদের অর্থের কান্ডারী আমাদের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সে ঠিক করে দেয় আমাদের কারেন্সী মুদ্রার মান, তাকে বলি রুপী। সব বিনিময়, কেনা, বেচা, সঞ্চয়, লগ্নী, লাভ ক্ষতি, শুল্ক, মাশুল, আয়কর জি এসটি সব কিছুর একক ভারতীয় রুপি বা টাকা। আবার অন্য দেশে কোথাও ডলার, কোথাও পাউন্ড, ইয়েন ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে এইরকম বিভিন্ন কারেন্সি আর তাদের বিনিময় মূল্যের ওপর। 
 এদিকে ক্রিপ্টো আর্থিক ব্যবস্থা একটি স্বতন্ত্র সীমানাহীন, আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা যার লেনদেনের একক হল ক্রিপ্টোকারেন্সি। অনেকের মতে ব্যাপারটা একবারেই আজগুবি, আবার অনেকের মতে বৈপ্লবিক। বিটকয়েন হল সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রিপ্টোকারেন্সি। নয় নয় করে ক্রিপ্টো প্রজাতির সংখ্যা এখন দশ হাজারেরো বেশী। বিভিন্ন বিভিন্ন এক্সচেঞ্জে তার কেনা বেচা হয়। কেউ সস্তা কেউ অসম্ভব দামী। কিন্তু আদতে তাদের মৌলিক তত্ত্ব এবং টেকনোলজি একটা থিওরির ওপর দাঁড়িয়ে। ক্রিপ্টো বুঝতে গেলে সেই তত্বটা ঠিক করে বোঝা দরকার। একটু খটমট লাগতে পারে, তবু অনুরোধ এর পরের প্যারা গুলো লাফিয়ে যাবেন না। আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ত ঠিক হবে এই খটমট তত্ত্ব দিয়ে। আমরা মানে সবাই, পৃথিবীর যত মানুষ, সবাই। আসুন ব্যাপারটা আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করি। 
 ক্রিপ্টো টাকা ডলারের মতই একরকম মুদ্রা কিন্তু তাকে হাতেও ধরা যায় না বা পকেটে বা ওয়ালেটেও রাখা যায় না। এটি একটি পুরোপুরি ডিজিটাল ক্যাশ। আপনারা পেটিএম বা গুগল পের দৌলতে এখন অনেকেই বুঝে গেছেন কি ভাবে ডিজিটাল ক্যাশের আদানপ্রদান হয়। আপনার কোন দিন ব্যাঙ্কে বা এটিমে গিয়ে টাকা না তুললেও এখন দিব্যি চলে। আপনার ব্যাঙ্কের কাছে আপনার একাউন্টের পাশে একটি সংখ্যা থাকে যা হল আপনার ব্যালান্স। ব্যালান্সে যত টাকা দেখায়, ব্যাঙ্কের কাছে তত টাকার নোট কখনই থাকে না। কিন্তু আপনি চাইলে ব্যাঙ্ক আপনার যত টাকা আছে দিতে বাধ্য। যদি এখন সবাই মিলে টাকা চায়, তখন অবশ্যই ব্যাঙ্ক ফেল করবে, এবং আপনি কত টাকা শেষে পাবেন তা নির্ভর করবে দেশের শাসকদের খেয়াল খুশির ওপর। 
সাধারণ টাকা পয়সা সরকারি টাঁকশালে কাগজে ছাপা হয় বা ধাতুতে ঢালাই হয়। আর ব্যাঙ্কের কাউন্টারে বা এটিএমে কিছুটা রাখা থাকে। দরকার হলে আপনি সেই ক্যাশ তুলতে পারেন। ক্রিপ্টো কিন্তু পুরোপুরি ডিজিটাল ক্যাশ। কোথাও ছাপা হয় না বা মুদ্রা ঢালাই হয় না। কিন্তু ঠিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলির মতো মালিকানা রেকর্ডগুলি একটি ডিজিটাল লেজারে সংরক্ষণ করে রাখা থাকে। সাধারণ ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থায় এই লেজারের ভার থাকে ব্যাঙ্কের ওপর। তারাই এতে টাকা যোগ করে বিয়োগ করে, সুদ কাটে বা জমা করে। ঠিক তেমনি ক্রিপ্টোর লেজারে লেখাজোখা করতে পারে কেবলমাত্র ক্রিপ্টো কারেন্সি সিস্টেম যাদের অনুমোদন দেবে তারা। মজার কথার শুরু এখান থেকেই। অনুমোদিত অংশগ্রহণকারী যে কেউ হতে পারে। আপনিও হতে পারেন, সরকারের কোন এজেন্সীও হতে পারে, দুনিয়ার যে কোন দেশের যে কোন লোক যে কোন ক্রিপ্টোর লেজারে যোগ বিয়োগ করতে পারে। 
কিন্তু সত্যিই তো যে খুশি হলেই হয় না, সে যে অর্থ নিয়ে ন্য় ছয় করবে না তার একটা গ্যারান্টী তো চাই। ক্রিপ্টোর ক্ষেত্রে এর জন্য একটা যোগ্যতা পরীক্ষায় আপনাকে পাস করতে হবে এবং সেই পরীক্ষা আপনাকে দিতে হবে প্রতিবার, যখনই আপনি এই লেজারে লেখা পড়া করবেন। আর ক্রিপ্টোর ভাষায় এর জন্য আপনাকে হতে হবে মাইনার বা বাংলায় বলা যেতে পারে খোদক। মাইনার বা মাইনিং কথাটা খেয়াল রাখবেন, ক্রিপ্টোর এটা একটা অদ্ভুত আবিষ্কার। এ ব্যাপারে বিশদ আলোচনা নীচে করব।
 অনেক রকম ক্রিপ্টো মুদ্রা আছে, তার মধ্যে বিটকয়নের নাম সবাই জানেন। বিটকয়েন (₿) হল একটি ক্রিপ্টো মুদ্রা। আর এর জন্য কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা প্রশাসক লাগে না। বিটকয়েনের একটা নেটওয়ার্ক আছে (নেট বা ইন্টারনেট যা সবাই জানেন, এটা সেরকমই একটা নেটওয়ার্ক)। এই নেট দিয়ে একজনের থেকে আরেকজনের কাছে এই মুদ্রা পাঠানো যেতে পারে। প্রতিটি লেনদেন কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ক্রিপ্টোগ্রাফির মাধ্যমে যাচাই করা হয় এবং সব ঠিকঠাক হলে ব্লকচেইন নামে একটি পাবলিক ডিস্ট্রিবিউটেড লেজারে রেকর্ড করা হয়। তত্ব যদি ঠিক থাকে, তাহলে এতে কারচুপির বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাই নেই। 
বিটকয়েনের ইতিহাস জটিল রহস্যে মোড়া। 2008 সালে সাতোশি নাকামোতো নামে একজন কাল্পনিক ব্যক্তি ঘোষণা করেন তিনি একটি নতুন মুদ্রা ব্যাবস্থার উদ্ভাবন করেছেন। যতদূর জানা যায় এটি একটি ছদ্মনাম এবং এর পিছনে আছে কয়েকজন কম্পিউটার বিশারদের একটি টিম। নাকামোতোকে শনাক্ত করার অনেক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিছু লোক এমনকি টেসলা ও স্পেসেক্সের মালিক এলন মাস্ককেও নাকামোতো বলে অনুমান করেছিল। 28 নভেম্বর 2017-এ একটি টুইটে তিনি পরিষ্কার অস্বীকার করে বিবৃতি দেন, তিনি মোটেও নাকামোতো নয়। 2019 সালে, সাংবাদিক ইভান রাটলিফ দাবি করেছিলেন নাকামোতো নাকি বিখ্যাত ড্রাগ ডিলার পল লে রূ। কিন্তু তার কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। 
ক্রিপ্টো কয়েনের দাম
একটি ক্রিপ্টো কয়েনের দাম আকাশ ছোঁয়া হতে পারে। যেমন এক BTCর দাম প্রায় 50000 US$। যেহেতু অগ্যত্যা সবই একটি একক ক্রিপ্টো কয়েন কিনতে পারে না, তাই মানুষের কেনার সুবিধের জন্য সেন্ট বা পয়সার মত পাওয়া যায় মিলিবিটকয়েন (1/1000) এবং সাতোশি (1/100000000)। 
কিছু বিখ্যাত ক্রিপ্টো কারেন্সির মার্কেট ভ্যালু ( লেখার সময়)
বিটকয়েন BTC $38,869.16 Ethereum ETH $2,628.81 টেরা LUNA $84.55 কার্ডানো ADA $0.842 সোলানা SOL $87.26 Avalanche AVAX $75.09 পোলকাডট DOT $16.96 Dogecoin DOGE $0.1232.
ভারতে কোথায় ক্রিপ্টো পাওয়া যায়?
 Zebpay, Unocoin, Coinsecure, Bitcoin-India, Btcxindia, Ethexindia, Bitxoxo-এর পাশাপাশি অন্যান্য এক্সচেঞ্জ এবং ওয়ালেট সরবরাহকারী Gatehub সহ বহু সংখ্যক বিশিষ্ট ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে আপনি ভারতে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে পারেন।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. How does one deal with this coin! You can hoard it alright and then can you buy some commodity with it?

    ReplyDelete