জ্বলদর্চি

ক্রিপ্টোকারেন্সী ও তার অভিঘাত -৩/বাসুদেব গুপ্ত

ক্রিপ্টোকারেন্সী ও তার অভিঘাত
বাসুদেব গুপ্ত
পর্ব ৩

আলোচনা
 স্পষ্টতই, ক্রিপ্টো কারেন্সি, বিট কয়েন ইত্যাদির আবহে এক বিশ্বব্যাপী শিল্প বেড়ে উঠেছে এবং স্টক মার্কেট এবং বেটিং সিন্ডিকেটের মতোই এটা সাধারণ লোকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। সেই সব মানুষ যারা কম খেটে ও কম টাকা খরচ করে চটপট বড়লোক হতে চায়। দেশের সরকার এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীরা সময়ে সময়ে ক্রিপ্টো মুদ্রার বিরুদ্ধে কথা বলে আবার কখনও কখনও সমর্থনও করে। সরকার ক্রিপ্টোকে করের আওতায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার অর্থ ক্রিপ্টো ব্যবহার না করলেও ঠিক অবৈধ আর বলা যাবে না। কিন্তু ক্রিপ্টো কারেন্সি আমাদের কেন প্রয়োজন এবং এটি কোন সমস্যার সমাধান করা হয়েছে তা মোটেও স্পষ্ট নয়। ঠিক যেমন বেটিং সিন্ডিকেট বা স্টক মার্কেটের মাধ্যমে কোন সমস্যাটি সমাধান করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। এরা সবাই টাকা নিয়ে নানা রকম খেলার সুযোগ করে দেয় যার সঙ্গে দেশের উৎপাদন বা জিডিপির কোন যোগাযোগ নেই। তেমনই ক্রিপ্টোও, শুধুমাত্র একটি কার্টেল যা এক ভিন্ন বিকল্প অর্থনীতি তৈরী করে লটারির মতো দ্রুত অর্থ উপার্জন করার লোভ ও মোহে আবিষ্ট করে রাখে। কিন্তু ওয়ারেন বুফেটের মতো ধনী কেউই হয় না। আমাদের মত তৃতীয় শ্রেণীর অর্থনীতির এটাই ভবিতব্য। যেখানে বিদেশে তৈরী হয় গুগল, এপল, মাইক্রোস্ফট, আমাদের মিডিয়াতে যেসব তথাকথিত ইউনিকর্নদের নাম লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, তারা প্রায় সবই হয় দোকান, বা বেটিং চক্র বা কোচিং মাফিয়া। 

ক্রিপ্টোকারেন্সির কিছু সুবিধেজনক দিকও আছে। নীচের সুবিধাগুলি সব জায়গায় খুব আলোচিত ও বিজ্ঞাপিত হয়। 
সহজগম্যতা ও সম্পদের লিকুইডিটিঃ
বলা হয় যে কেউ চাইলেই ক্রিপ্টো কারেন্সি পেতে পারে, এর জন্য কোন ব্যাঙ্কে একাউন্ট খুলতে হয় না। তেমনই ব্যাঙ্কিং এর অযথা বিলম্ব ছাড়াই খুব সহজেই লেনদেন করা যায়। একটি দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে ক্লিয়ারিং হাউস এসে মাঝখানে দেরী করে দেয় ন, ব্যাঙ্ক ইচ্ছে করে টাকা চেপে রেখে বিনিময় মূল্যের ওঠানামার সুযোগ নিতে পারে না। আর নগদ বা ক্যাশ বলে কিছু না থাকায় ব্যাংকে নোট বা ব্যালেন্সের সীমাবদ্ধতার কোনো সমস্যা নেই। সরকারী ছাপাখানায় নোট ছেপে অর্থনীতিকে ম্যানেজ করাও যায় না।
ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা এবং স্বচ্ছতা: 
ক্রিপ্টো প্রক্রিয়াটি একেবারেই বেনামী। সুতরাং, কেউ জানে না কে কাকে কী পাঠায় এবং কখন। অন্য দিকে প্রতিটি লেনদেন স্বচ্ছ কারণ সেখানে কোথাও কোনও মানুষের বা সংস্থার হাত নেই, এবং প্রয়োজনে ব্লক চেইনটি সর্বদা যাচাই করা যেতে পারে যাতে কোথাও কোনও কারসাজি না হয়। 
কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অধীনতা থেকে মুক্তিঃ 
বলা হয় যে ক্রিপ্টো যেহেতু একটি দেশের কোনো ব্যাঙ্ক বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা কোনও ফেডারেল ব্যাঙ্ক ইত্যাদি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, এই মুদ্রা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রকৃতির কোনও প্রভাব থেকে মুক্ত। 
সম্ভাব্য উচ্চ রিটার্ন: 
ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্যমান অকল্পনীয় পরিমাণ রিটার্ন দিতে পারে। BTC শুরু হয়েছিল 50 সেন্টে এবং একসময়ে উঠেছিল 50000 ডলারে। যারা প্রথমে কিনেছিল, তারা অসম্ভব রোজকার করেছে ক্রিপ্টো বাজারে। 
 এই যুক্তিগুলি খুবই সঠিক। কিন্তু তারা কি মানুষের রোজকার কাজে ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রহণ যোগ্যতা প্রমাণ করে? কারা এটি ব্যবহার করবে এবং সাধারণ মুদ্রা ব্যবস্থার সাথে কীভাবে সম্পর্কিত হবে তা নিয়েও কোন পরিষ্কার ধারণা কেউ দিতে পারে না। মনে রাখবেন যে বিটকয়েন একটি সম্পদ হিসাবে সর্বদা একটি বিদ্যমান মুদ্রার সাথে সম্পর্কিত। সুতরাং 50 সেন্ট বা 50000 ডলার মানে এটি ডলারের সাথে সম্পর্কিত এবং এটিকে একটি বিটম্যাপ এক্সচেঞ্জের মতো কোথাও ট্রেড করতে হবে যেখানে লোকেরা এটিকে শেয়ারের মতো কেনার জন্য একটি মূল্য উদ্ধৃত করবে। কাজেই সারা পৃথিবীর সব আর্থিক ব্যবস্থা যদি একটিমাত্র ক্রিপ্টো কারেন্সি না হয় তাহলে বিনিময়মূল্য নিয়ে একটা ভীষণ গোলযোগ শুরু হতে পারে। ভাবুন হাজার হাজার রকম ক্রিপ্টো বাজারে রয়েছে, যাদের বিনিময় মূল্য কারো ১ ডলার বা কারো ৫০০০০ ডলার এবং সেই মূল্য উন্মাদের মত উঠছে নামছে। অবশ্যই এই অবস্থায় সবাই মিলে ক্রিপ্টো ব্যাবহার শুরু করা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। 

অন্যদিকে আমরা ক্রিপ্টোকারেন্সির কিছু অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। 
অস্থিরতা: 
একটি ক্রিপ্টোকারেন্সির বিনিময় মূল্যের কোন গ্যারান্টি নেই। তাই বিশ্বের সবকিছু ক্রিপ্টোতে কেনার জন্য উপলব্ধ না হলে, কেউ ক্রিপ্টো মুদ্রার মূল্যের উপর নির্ভর করতে পারে না। উদাহরণ স্বরূপ BTC 10000 থেকে 50000 US ডলার এলোমেলো ওঠানামার জন্য ব্যবসায়িক ব্যবহারের জন্য কেউই সাহস পায় না। 
নিয়ন্ত্রণ কারীর অনুপস্থিতি: 
ব্লকচেইনগুলি সাধারণত ওপেনবসোর্স সফ্টওয়্যার দ্বারা পরিচালিত এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এই সফট ওয়ার যেহেতু মালিকহীন, তাই কোনো ত্রুটি, ক্র্যাশ, অসদাচরণ বা ইচ্ছাকৃত অপরাধ হলে সংশোধনের কোনো জায়গা নেই। 
অপরিবর্তনীয়: একবার একটি লেনদেন সম্পন্ন হলে, এটি স্টপ বা রিভারস করার কোন উপায় নেই। তাই A যদি X পরিমাণ B-কে পাঠাতে চায় কিন্তু ভুল করে C-কে পাঠিয়ে দেয় , তাহলে সেই পরিমাণ C পেয়ে যাবে এবং কোনো প্রত্যাহার করার সুযোগ পাওয়া যাবে না। যদি এই লেনদেন কোন ব্যাংকে হত, সংশোধন করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল।
সীমিত ব্যবহার: এখন পর্যন্ত ক্রিপ্টো মূলত ধনী লোকের তাদের অঢেল সম্পদ নিয়ে জুয়া খেলার একটা উপায়। তার সঙ্গে বিভিন্ন কম্পানী দরিদ্র লোকদের দ্রুত ধনী হওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্যবসা করা শুরু করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে অর্থপূর্ণ লেনদেনের পরিসর খুব সীমিত। 
অতিমাত্রায় পরিবেশ দূষণ: মাইনিং করতে শেষ হিসেব পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় 110 টেরাওয়াট ঘন্টা শক্তি খরচ হয় বা বিশ্বের শক্তি উৎপাদনের 0.55 শতাংশ। অনুমান করা হয় যে একটিমাত্র ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেন যতটা শক্তি ব্যবহার করে তা একজন গড় আমেরিকান পরিবার এক মাসে ব্যবহার করে। অনেকে বলেন , ব্যাংকিংও প্রচুর শক্তি খরচ করে থাকে। তা ঠিক। কিন্তু যেহেতু প্রচলিত ব্যাঙ্কিং এখনও আছে এবং থাকবে, ক্রিপ্টোকারেন্সির বোঝাটা হয়ে যায় অতিরিক্ত। বিটকয়েন মাইনিং আমাদের ইতিমধ্যেই বিপন্ন আবহাওয়া ও পরিবেশের উপর একটি বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে, ও পরিবেশবিদরা এ নিয়ে খুবই শঙ্কিত।
অতিরিক্ত লেনদেনের সময়: 
ক্রিপ্টো লেনদেন নির্ভর করে হাজার হাজার মাইনারের সফল প্রতিযোগিতার উপর ( ওপরের টেকনলজি বিভাগটা পড়ে দেখতে হবে)। এই সময় কিন্তু অনির্দিষ্ট (বিটকয়েনের জন্য 1 ঘন্টা পর্যন্ত লেগে যায়)। যার ফলে অর্থ লেনদেনর একটা অনুমানযোগ্য বিলম্ব ঠিক করা যায় না। মাইনিং ছাড়াও আরো অনেক নথি ভুক্তকরণের কাজ থাকে যার ফলে শেষ পর্যন্ত এটি একটি খুব ধীর পদ্ধতিতে পরিণত হয়।
একচেটিয়া পুঁজি ও রাজনৈতিক অভিঘাতঃ 
অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি ক্রিপ্টোকে মানবজাতির ত্রাতা হিসেবে প্রচার করে থাকেন। তাঁরা বলেন এর ফলে শক্তিমানের প্রভাব থেকে অর্থনীতি মুক্তি পাবে এবং মানুষ পাবে চূড়ান্ত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। বাস্তব ঘটনাটি কিন্তু একটু আলাদা। মনে রাখবেন মাইনিঙের জন্য প্রচুর পরিমাণে শক্তির প্রয়োজন হয়( একটি বিট কয়েনের জন্য লাগে ১৪৩০০০ বিদ্যুতের ইউনিট। তাই খুব কম সাধারণ মানুষ মাইনার হতে পারে। কেবল মাত্র খুব ধনী দেশ বা সংস্থাগুলি মাইনিঙ্গের ব্যবসায় নামতে পারে। অর্থাৎ সেই ব্যাঙ্কের মতই দাঁড়াল ব্যাপারটা। যে কেউ ব্যাঙ্কার হতে তো পারে না। 
এর সঙ্গে আবার আসে অন্য উপসর্গ। যেহেতু পুরো ব্যাপারটা বেনামীতে চলতে পারে তাই কালো টাকা বা ড্রাগ ও ক্রাইম সিন্ডিকেটেরা চুটিয়ে এই ব্যবসা করতে পারে। যে সব দেশে গণতন্ত্রের কিছু খামতি, আগে সেসব দেশ তাই মাইনিং ব্যবসায় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে উপরে উঠে বসে আছে। এখন পর্যন্ত, চীন এবং রাশিয়া বেশিরভাগ বিটকয়েন এবং খনির সুবিধার মালিক। উদাহরণস্বরূপঃ
1. ডালিয়ান, চীন। মাসিক শক্তি খরচ: $1,170,000 উৎপাদনঃ প্রতি মাসে 750 বিটকয়েন। পৃথিবীর সমস্ত বিটকয়েনের 3% এখানে উৎপাদন হয়। 
2. মস্কো, রাশিয়া মাসিক শক্তি খরচ: $120,000। উৎপাদন প্রতি মাসে 600 BTC 
অপরাধ জগত: 
যেহেতু ক্রিপ্টোকারেন্সি আইনের রেডারের বাইরে এবং অনিয়ন্ত্রিত, এই লেনদেনের পদ্ধতি অপরাধী, সন্ত্রাসবাদী এবং দুর্বৃত্ত দেশগুলির খুব পছন্দ। ব্লক চেইনের প্রকৃতির কারণে কিছু বেআইনি লেনদেন হলে তা বন্ধ করা অসম্ভব। অন্যদিকে আছে ডার্ক ওয়েবের গল্প। আমরা যে ইন্টারনেট দেখি তার আড়ালে আছে একটা অন্ধকার ইন্টারনেট যাকে বলে ডার্ক ওয়েব। মহাবিশ্বের ডার্ক ম্যাটারের মতো অনুমান করা হয় যে গুগল সমস্ত ইন্টারনেটের কেবলমাত্র 12%র খবর জানে এবং বাকিটি ডার্ক ওয়েব। কি হয় এখানে? এটি ব্যবহৃত হয় মাদক ও অস্ত্রের লেনদেন এবং সন্ত্রাসে অর্থায়নের জন্য। আর এরা সবাই এখন মনের আনন্দে প্রতিটি লেনদেন ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে। আমাদের কি বিপদ কোথায় ঘনিয়ে আসছে, আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে যাই। 
শেষ কথা 
 লেখকের মতে বর্তমানে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক উদ্ভাবন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এই পদ্ধতি আমাদের বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারে। আর তার উপরে কোন দুর্বৃত্ত সরকার বা সন্ত্রাসবাদীদের হাতে দিতে পারে অপরিসীম ক্ষমতা যারা নিয়ন্ত্রণ করবে আমাদের ভবিষ্যত। ক্রিপ্টো কেন প্রয়োজন এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই। এটি কোনও সমস্যার সমাধান করে না এবং অপরাধ ও অর্থ লোভকে ভীষণ ভাবে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। লোভে পড়ে ও বিজ্ঞাপন দেখে অনেক সাধারণ মানুষ ক্রিপ্টো কিনছেন। তাঁরা পথে বসার সম্ভাবনা খুব বেশী। অতএব আমি সুপারিশ করবো কি? বোধহয় না।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments