জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৪৬/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৪৬

ক্রমশ ভিড় বাড়তে শুরু করল। বাস এসে দাঁড়াল ১০ টা ৪০ মিনিটে। হুড়োহুড়ির কোনো ব্যপার নেই ,সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই মতই বাসে উঠে ড্রাইভারের কাছে টিকিট কেটে জানালা ধারে বসলাম। এই বাসের যাত্রাপথ হল নটিংহাম থেকে ওয়ার্কশপ। ওয়ার্কশপ পর্যন্ত রিটার্ন টিকিটের মূল্য ৫ পাউণ্ড। ১০ পাউণ্ড দিয়ে আমরা দুজনের দুটি টিকিট কেটে নিয়েছি। শহর ছাড়িয়ে বাস ছুটে চলেছে গ্রামের বুক চিরে। রেপসিড কেটে নেওয়াতে দুপাশে নেড়া মাঠ দেখতে পাচ্ছি। এক জায়গায় দেখলাম সবুজ আলুক্ষেতে জল সিঞ্চন করা হচ্ছে অদ্ভুত কায়দায়। স্প্রিং এর সাহায্যে অনেক ওপরে উঠে কুয়াশার মত ছড়িয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে শূকরের ফার্ম, ছোট ছোট গ্রাম ও জঙ্গল দেখতে পাচ্ছি। বাসের প্যাসেঞ্জার যে যার গন্তব্য স্থানে নেমে যাচ্ছেন। আমরা বুঝতে পারছিনা কখন বোতাম টিপব। জানা না থাকলে মুসকিল। কারণ আগের স্টপেজ ছাড়ালেই পরের স্টপেজে নামার জন্য হাতের কাছে থাকা বোতামে চাও দিতে হবে। খান সাহেব পাশের এক ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, আরও দুটো স্টপেজের পর। কিন্তু সেই নিগ্রো ছেলেটি ড্রাইভারকে কি জিজ্ঞেস করে পরের স্টপেজে জঙ্গলের মধ্যে নেমে গেল। দুটি জাপানি যুবকও ড্রাইভারকে কী যেন জিজ্ঞেস করে সিটে  এসে বসল। পিছন থেকে বাংলা কথা শুনতে পাচ্ছি। ভিক্টোরিয়া বাস ষ্টেশনে তিনজন বাঙালি ছেলেমেয়েকে দেখেছিলাম, ওরাই বাংলায় কথা বলছে।
      ইতিমধ্যে আমাদের বাস সেরউড বনের ভিতরে এসে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা আগের স্টপেজেই জানিয়ে দিয়েছিলেন এর পরেই সেরউড ফরেস্ট। দেখলাম বেশকিছু বাস ও প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সঙ্গে অনেকেই এখানে নামলেন। সেই বাঙালি ছেলেমেয়েগুলিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওরা বাংলাদেশী। নটিংহামে থাকে। সামান্য পথ হেঁটে আমরা ভিজিটর সেন্টারে পৌঁছালাম। এখানে বেশ কয়েকটি রেস্টুরেন্ট, ইনফরমেশন সেন্টার, টয়লেট, মিউজিয়াম, গিফটসপ ইত্যাদি রয়েছে। একটা ওক গাছের তলা ঘিরে কাঠের বেঞ্চ করা আছে। সেখানে অনেকে  বসে আছেন। খান সাহেব এখানে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ফেরার সময় ঠিক করে ফেলেছেন।  ১টা ৪৬ শে ও ৩টে ৩৫ শে নটিংহাম ফেরার বাস রয়েছে।  উনি শেষ বাসে ফেরার ঝুঁকি নিতে চান না, ১টা ৪৬ এর বাসেই ফিরবেন। এখন ১২টা বাজে। লেডিস টয়লেট দেখতে পাছিনা, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলাম ইনফরমেশন সেন্টারের পাশেই লেডিস টয়লেট রয়েছে। টয়লেটে ঢুকতে আবার বাংলাকথা শুনতে পেলাম পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি দুজন সাড়ি পরা ভদ্রমহিলা একটি হুইলচেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে কথা  বলছেন। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করে জানলাম,  বছর ৫০ এর ভদ্রমহিলা ডাক্তার, সঙ্গের বৃদ্ধা ওনার মা। ওনারা ডার্বিতে থাকেন। ছেলে বারমিংহাম ইউনিভার্সিটিতে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে। তাকে ওখানে ড্রপ করে মাকে নিয়ে সেরউড ফরেস্ট বেড়াতে এসেছেন। আমি জানতে চাইলাম কখন ওনারা ফিরবেন? ভদ্রমহিলা জানালেন, সঙ্গে গাড়ি আছে, বারমিংহাম থেকে বিকেলে ছেলেকে তুলবেন, ফেরা নিয়ে তাড়া নেই। আরও বললেন আমরা চাইলে আমাদের নটিংহামে ড্রপ করে দেবেন। আমি খান সাহেবকে ডেকে ওনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ভালই হল, বাস ধরার তাড়া রইল না। একটু বেশিক্ষণ  বেড়ানো যাবে। তাছাড়া উনি আগে একবার এসে ছিলেন, তাই দেখার জায়গাগুলো চেনেন।

      দেখার বলতে মানুষ মূলত এখানে হাঁটতে আসেন। সবুজ জঙ্গলের পথে  পায়ে হেঁটে কিম্বা সাইকেলে মানুষ বেড়ান। ভদ্রমহিলা, মানে মিসেস দত্ত ইনফরমেশন সেন্টারে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলে ম্যাপ দেখে আমরাও হাঁটতে শুরু করলাম। গভীর জঙ্গলে বিশাল আকৃতির ওকগাছ আর বার্চগাছ(Birch tree)বেশি সংখ্যায় রয়েছে। জনশ্রুতি রবিন হুডের বাহিনী ওকগাছের গুড়ির গর্তে লুকিয়ে থাকত। গুড়ির গর্তগুলো এত বড় আকারের যে সেখানে অনায়াসে একজন মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে। এই জঙ্গলের বিশেষ আকর্ষণ ‘মেজর ওক’। হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই ওক গাছের সামনে এসে তারের বেড়ার গা ছুঁয়ে দাঁড়ালাম। কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। পাশে ফাঁকা জায়গায় পেতে রাখা কাঠের বেঞ্ছে বসে বয়স্ক মানুষ কয়েকজন রোদ মাখছেন, ওঁদেরই নাতিনাতনি হবে হয়ত, কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে  রবির হুডের মত মাথায় ক্যাপ পরে হাতে তিরধনুক নিয়ে নকল যুদ্ধে মেতেছে। আবার আমাদের চোখ এসে স্থির হয়ে জায় মেজর ওকে। আমাদের মত আরও কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে  অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন প্রায় হাজার বছরের  প্রাচীন ওক গাছটির দিকে। গাছের বিস্তৃত শাখাপ্রশাখাগুলিকে লোহার পাইপ দিয়ে  সাপোর্ট দেওয়া রয়েছে(১৯০৯ সাল থেকে)।গাছের মোটা কাণ্ডগুলির ওপর পিচের মত কিছু চাপান দেওয়া আছে।১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই ওক গাছটিকে বলা হত ‘ককপেন ট্রি’। এর তলায় মোরগ লড়াই হত, তাই এই নাম ছিল।  ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে মেজর হেম্যান রুক নামে একজন প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ এই জঙ্গলের প্রাচীন গাছগুলির ওপর একখানি বই লিখেছিলেন।সেই জন্যই সব থেকে প্রাচীন এই ওক গাছটির নাম হয় ‘মেজর ওক’।
      বাসে দেখা জাপানি ছেলেদুটি মনোযোগ দিয়ে সাইন বোর্ডের লেখা  পড়ছে। এখানে পাখির কলতান ছাড়া আর কিছু শোনা বা দেখা যাচ্ছে না। সেরউড শব্দের অর্থ ‘বৃক্ষময় ভূমি’। জঙ্গলের নাম শুনলে মনে হয়  এখানে অনেক বাঘ,ভাল্লুক ইত্যাদি হিংস্র পশুর বাস। বোর্ডের ছবি দেখে বুঝলাম এখানে হরিণ, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, খরগোশ, বিভিন্ন ধরণের পাখি ও কীটপতঙ্গ রয়েছে। একটি পাথরের প্লেটে লেখা রয়েছে, ‘আমার গুড়িগুলি গর্তে ভর্তি। এই গর্তে বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ ও প্রাণী ঘুমচ্ছে। আমার ওপর চড়লে ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে’।
      আমরা যেখান থেকে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, প্রায় একঘণ্টা পরে সেখানেই ফিরে এলাম। আরও কিছুক্ষণ হাঁটা যেত, কিন্তু মাসিমা, মানে মিসেস দত্তর মায়ের কথা ভেবে বেশি দূর গেলাম না। একটা জায়গায় বসে সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে মিউজিয়ামে ঢুকলাম। মিসেস দত্ত ও মাসিমা আগেই ঢুকে ছিলেন। ওখান থেকে বের হয়ে একটা গিফট সপে ঢুকলাম। কয়েকটা জিনিস কিনে একসঙ্গে সবাই বেরিয়ে এলাম। এরমধ্যে মিসেস দত্তর ছেলে ফোন করে জানায়,  তার আরও ঘণ্টাদুই দেরি হবে।
      উনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন ‘রুফোরড কাউনট্রি পার্ক’এ সেরামিক  ফেস্তিভ্যাল হচ্ছে। আমাদের ফেরার পথেই পড়বে। তাই ওখানে যাওয়া ঠিক হল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ওই পার্কে পৌঁছে গেলাম। জঙ্গলের মধ্যে গাড়ির সমারোহ দেখে বুঝলাম এখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়েছে। মেনরোড থেকে  জায়গাটা কিছুটা ভিতরে। গুমটির মত ছোট্ট টিকিট ঘর থেকে টিকিট কেটে আমরা ভিতরে গেলাম।  মাসিমার দেখার ইচ্ছে ছিল না। তাই ওখানেই বসে পড়লেন। এরই এক ফাঁকে মাসিমা তাঁর কষ্টের কথা একরাশ বিরক্তি সহকারে আমার কাছে উগরে দিলেন। ওনার স্বামী পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। প্রায় বিদেশ টুর করতেন। দুই ছেলেমেয়েকেই বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন এবং পাঠিয়েওছেন। মাসিমার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। মেয়ে ডাক্তার, সে এখানে থাকে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, সে থাকে আমেরিকায়। স্বামী মারা গেছেন ৫ বছর পূর্বে। কলকাতার বাড়িতে একা থাকতেন কাজের লোকের ভরসায়। বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমরে  চোট পেয়েছেন, তাই হুইল চেয়ার সঙ্গি। দেশে আত্মীয়স্বজনরা খোঁজ রাখেন, কিন্তু কারো পক্ষে সবসময় থাকা সম্ভব নয়। তাই ওনাকে তাঁতির মাকুর মত  কলকাতা থেকে ব্রিটেনে ৬ মাস, আবার দেশে ফিরে আমেরিকা যাওয়া। ওখানে ৬ মাস কাটিয়ে আবার দেশে ফিরে ব্রিটেন যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া। এই বয়সে ওনার এরকম জীবন ভাল লাগছে না। তাঁর দেশে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে। এখানে মেলামেশার লোক নেই। মেয়ে, জামাই, নাতি, সবাই বেরিয়ে গেলে তাঁকে সারাদিন একা কাটাতে হয়। অনেক কষ্ট ওনার। শুনে বুঝলাম যারা  ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকলে গর্ব অনুভব করেন, তাদের এই হয়রানি ও কষ্টের কথাগুলো ভেবে দেখা দরকার। তবে ছেলেমেয়েরা নিজেরা বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের বাধা না দেওয়া উচিত। কারণ তাদের নিজের নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের আছে।
      একটা ভাঙ্গা মঠের ভিতরে বাইরে, পার্কের বিভিন্ন জায়গায় সেরামিকের  জিনিস সাজানো আছে। বিভিন্ন কলেজের ছাত্রছাত্রীরা তাদের তৈরি জিনিস সাজিয়ে নিয়ে বসেছে। এক জায়গায় দেখানো হচ্ছে কী ভাবে সেরামিকের জিনিস তৈরি করা  হয়। এক এক জন এক এক রকম আর্টের ওপর কাজ করেছেন। এত সুন্দর সব জিনিস যাকে বলে চোখ জুড়নো, মন ভোলানো। বিভিন্ন আকৃতির বিভিন্ন আকারের পাত্র যেমন রয়েছে, তেমন আদ্ভুত আকৃতির সুন্দর সুন্দর শো-পিসও রয়েছে। কী জানি কত দাম? জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। তবে মনে মনে মিসেস দত্তকে ধন্যবাদ জানালাম এইরকম একটি অভিনব মনোমুগ্ধকর মেলায় নিয়ে আসার জন্য।
        একটা আশ্চর্য জিনিস দেখলাম, ছাদ উড়ে যাওয়া মঠটি ভাঙ্গাচোরা হলেও টাওয়ারের ওপর মস্ত ঘড়িটা অক্ষত এবং এখনও সঠিক সময় দিচ্ছে। ভিতর  থেকে একটা প্যাসেজ দিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি, কিচিরমিচির আওয়াজ শুনে ওপরে তাকিয়ে দেখি ছাদ ও দেওয়ালের কোনায় ছোট ছোট এক ধরণের পাখি মাটি দিয়ে বাসা বানিয়েছে। বাসা থেকে মুখ বের করে বসে থাকা তিনটি পাখি আকারে কিছুটা চড়াই পাখির মত হলেও রং আলাদা এবং গোলগাল চেহারা।
    গাইড বুকে দেখেছিলাম এই পথে আরো কিছু দেখার জায়গা রয়েছে। কিন্তু সে সব দেখার মত হাতে সময় নেই। মিসেস দত্ত কারপার্ক থেকে গাড়ি বের করে নিয়ে এলে, মাসিমা মেয়ের পাশে আর আমরা দুজন পিছনের সিটে বসে সিটবেল্ট বেন্ধে নিলাম। অল্প সময়ের মধ্যেই নটিংহামে পৌঁছে গেলাম। একেবারে কোয়ার্টারের পাশেই আমাদের ড্রপ করে দিলেন। কিন্তু হাতে বেশি সময় না থাকায় চা পানের অনুরোধ সবিনয়ে ফিরিয়ে দিলেন।

ক্রমশ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments