জ্বলদর্চি

রাসোৎসব / ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪৫

রাসোৎসব 

ভাস্করব্রত পতি

'কার্তিকী পূর্ণিমায় বৃন্দাবনে গোপীদের সাথে শ্রীকৃষ্ণের যে নৃত্যলীলা তাই রাস।' —এভাবেই 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' তে ব্যাখ্যা করেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীমদ্ভাগবত (১৩১৫) তে পাই, 'রাসো নাম বনর্তকীযুক্তো নৃত্যবিশেষঃ'। আবার গীতগোবিন্দতে রয়েছে ‘রাসে হরিমিহ বিহিত বিলাসম্ স্মরতি মনঃ'।
রাস > পুং [ / রস + অ (ঘঞ) – ভা ]

বৈষ্ণব দর্শন অনুযায়ী কৃষ্ণ হলেন পরমাত্মা এবং রাধা হলেন জীবাত্মা। এই দুইয়ের মিলনই হল রাসলীলা। সেখানে বৃন্দাবন হল মানব শরীর। 'রাধা' শব্দের অর্থ হল যিনি আরাধনা করেন। যা আরাধয়তে সা রাধা'। আবার কৃষ্ণ অর্থে যিনি আকর্ষণ বা কর্ষণ করেন। 'ব্রজ' হল পথ। 'গোপী' অর্থাৎ যিনি গোপনে গোবিন্দ ভজনা করেন। এসবই রূপক অর্থে। বৈষ্ণব মতে শ্রীরাধা আসলে শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। যেখানে আয়ান ঘোষ (রাধার স্বামী) হলেন সংসার আসক্ত এক জীবনের প্রতিভূ। তেমনি রাধার শাশুড়ি, ননদ (জটিলা ও কুটিলা) হলেন কামনা বাসনার দ্যোতক। ললিতা এখানে রাধার চলার পথ প্রদর্শক। সংসার জীবনের থেকে মুক্তিলাভের আশায় আয়ান ঘোষের পত্নী শ্রীরাধা পরকীয়া প্রেমে মজেছেন শ্রীকৃষ্ণের সাথে।

তারাপদ মাইতি লিখেছেন, "কার্তিকী পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একটি প্রধান ও বঙ্গদেশের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। ইহা শ্রীকৃষ্ণের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম। পুরাণে আছে এদিন কৃষ্ণ রাধিকা বৃন্দাবনে গোপিনীমণ্ডলে নৃত্যোৎসব করেছিলেন। এরই স্মারক হিসেবে কার্তিকী পূর্ণিমা থেকে তিনদিনব্যাপী রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত এই উৎসবের উল্লেখ প্রাচীন কোন গ্রন্থে নেই। উৎসব উপলক্ষ্যে মন্দির অথবা গৃহের ঠাকুর ঘর থেকে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ আসেন সম্মুখস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে এতদুপলক্ষ্যে নির্মিত মঞ্চোপরি স্থাপন করা হয়। অনেক স্থানে বাঁধান মঞ্চ থাকে। মঞ্চোপরি রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের চতুষ্পার্শে মাটির তৈরি নানা দেব দেবীর মূর্তি সাজান হয়। মঞ্চের সামনে খাটান বা ঝোলান থাকে কাগজ ও শোলার তৈরি নানা প্রকার ফুল পাতা ও পশুপাখীর মূর্তি। তিনদিন ধরে শ্রীকৃষ্ণের যথাবিহিত পূজার্চনা করা হয়।

বৈষ্ণব দর্শনে পাই, ষোলো হাজার (মতান্তরে ১০০ কোটি) গোপ গোপিনীর তত্ত্ব। আসলে ষোলো কলার পূর্ণতা পেতেই পরমাত্মা এবং জীবাত্মার একসাথে স্থিতিশীল হওয়া। এই স্থিতিলাভই তো রাসলীলা। অনেকের মতে কৃষ্ণ এবং রাধার আটজন করে সখা সখী (বরযাত্রী ও কনেযাত্রী) মিলে হয় ষোড়শকলা (পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রীয়, পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় এবং ষড়রিপু মিলে হয় ১৬টি)। এই প্রতি কলা পিছু হাজার জন নিয়েই তো ষোলো হাজার গোপ গোপিনী। আসলে এই ষোলো করার পূর্ণতা পেতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার এক রসে স্থিতিলাভের অবস্থাই হল রাধাকৃষ্ণের মিলন তথা রাসযাত্রা।

রাসলীলা বিষয়ে বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ 'বৈষ্ণব তোষিণী'তে পাই ‘পরমরসকদম্বময় রাসঃ'। আবার শ্রীধর লিখিত টিকাতে রয়েছে 'মণ্ডলীরূপেন ভ্রমতাং নৃত্য বিনোদো রাসো নাম'। শ্রীমদ্ভাগবতের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এগুলি পরিচিত 'রাসপঞ্চাধ্যায়ী' নামে। রাসলীলা আসলে ব্রজলীলার অন্তর্গত এবং ‘প্রাভব প্রকাশ' রূপে গণ্য হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন 'রাধা পূর্ণশক্তি এবং কৃষ্ণ পূর্ণশক্তিমান'।

'চণ্ডীদাস'-এ (অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত, ১৩৮৫) পাই --  '(সুন্দরী) নিকুঞ্জে আসি করিল বিবিধ রাস'। 'বিলাস' বা 'রসকেলি' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে রাস। আর রাসযাত্রা বোঝাতে উল্লেখ করতেই হয় ভারতচন্দ্রের উক্তি 'সে দেশে কি রস আছে, এ দেশেতে রাস'। এ হল রাসরূপ খেলা বা রাসকেলি। আর রাধা কৃষ্ণের এই পবিত্র রাসলীলা পূর্ণতা পায় রাসপূর্ণিমায়। অর্থাৎ কার্তিকী পূর্ণিমায়।

দু ধরনের রাস উৎসবের পরিচয় মেলে -- নিত্যরাস ও মহারাস। এছাড়া বাসন্তীরাস নামেও এক রাসের কথা মেলে জয়দেবের গীতগোবিন্দতে। আর নিত্যরাসের কথা আছে আদিপুরাণে এবং মহারাসের কথা আছে শ্রীমদ ভাগবততে। যদিও শারদরাসের প্রসার সবচেয়ে বেশি। কার্তিকী পূর্ণিমায় রাসোৎসব হলেও পশ্চিমবঙ্গের এই লৌকিক উৎসবটি অবশ্য অন্যান্য সময়েও আয়োজিত হয়ে থাকে। সাধারণত রাধাকৃষ্ণের রাস হয় বলেই আমরা জানি। যদিও অন্যান্য দেবতারও রাসোৎসব হয়ে থাকে।

"রাস তাস জোরের লাঠি / তিন নিয়ে পানিহাটি"-- পানিহাটির নামকরা রাস উৎসব নিয়ে এই লোকছড়া আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। রাজ্য জুড়েই বিভিন্ন এলাকায় চলে রাস উৎসব। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপে কৃষ্ণচন্দ্র রায় বৈষ্ণবীয় রাসের অনুকরণে কার্তিকী পূর্ণিমায় শাক্তরাসের সূচনা করেছিলেন। তাই এ সময় এখানে শাক্তদেবীর বড় বড় মূর্তিপূজা আয়োজিত হয়। কেউ কেউ বলেন কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তর পুরুষ গিরিশচন্দ্র এই উৎসবের সূচনা করেন। তবে শান্তিপুরের রাস পুরোপুরি বৈষ্ণবীয়। এখানে ৪ দিনের রাসোৎসবে তৃতীয় দিন হয় আড়ং রাস বা ভাঙা রাস। আর শেষদিন হয় ঠাকুর তোলা বা ঠাকুর নাচানো। এখানে ভাঙারাসের শোভাযাত্রা 'রাইরাজা' সবচেয়ে জনপ্রিয় যা বিগত ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। কোচবিহারের মদনমোহন দেবের রাসোৎসব খুব জমজমাট। যদিও এখানে কোনো রাধিকামূর্তি নেই। মদনমোহন মন্দিরের সদর দরজার সামনে লাগানো হয় রঙিন ঝালরে মোড়া রাসচক্র। যা অনেকটাই মুসলিম দের তাজিয়ার মতো। এই রাসচক্র বংশপরম্পরায় তৈরি করেন মুসলিম শিল্পী মহম্মদ আলতাফ মিয়ার পরিবার। মল্লরাজ বীর হাম্বির ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে রাসমঞ্চ বানিয়ে রাসোৎসব শুরু করেন। হুগলীর বলাগড়ের শ্রীপুরের রাসে এই বঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন বারোয়ারী পূজা হয়। খড়দহের রাসের ভোগে দেওয়া হয় ছোলা গুড় কলা। চারদিনের উৎসবের শেষদিনে গোষ্ঠবিহার অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। সবশেষে হয় বিরাট ভোগপর্ব। এটিই এখানকার প্রধান বৈশিষ্ট্য। পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর পঁচেটগড়ের রাস পেরিয়েছে ৫০০ বছর। বেলিয়াবেড়ার চোরচিতায় ১৮০১ তে জমিদার বৈদ্যনাথ দত্ত রাসের সূচনা করেন। যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ময়ূরভঞ্জের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জ। তিনি এখানে আসতেন হাতিতে চেপে। ময়নাগড়ের বাহুবলীন্দ্র পরিবারের নৌরাসযাত্রা সারা পৃথিবীতে আর কোথাও হয়না। 

রাজ্যের অন্যান্য যেখানে রাসমেলা হয় সেগুলি হল -- নবদ্বীপ, শাস্তিপুর, দাঁইহাট, মায়াপুর, হাতীশালা, বড়চাদঘর, উলুবেড়িয়া, বালিদেওয়ানগঞ্জ, মহিষগোট, কৃষ্ণনগর ) দ্বীপা, আটঘরা, নওপাড়া, কান্দী, বনগাঁ, মাদারী,  সাইবনা, দত্তপুকুর, দলুইপুর, বারুইপুর, ভাটপাড়া, শিখরপুর, খড়দহ, হরিনাভি, বৈদ্যপুর, মঙ্গলডিহি, কোটা, বিষ্ণুপুর, মানকানালী, নিকুঞ্জপুর, দলদলী,  গোড়াসোল, ছাগুলিয়া, পুরন্দরপুর, তালঝিটকা, কোতুলপুর, মদনমোহনপুর, জয়পুর, অযোধ্যা, ব্রজরাজপুর, গোঁসাইপুর, জামতড়া, আদ্রা, কোচবিহার, শালবাড়ী, বরুণা, পানিহাটি, ময়না, পঁচেটগড় ইত্যাদি। বেশিরভাগ রাসমেলায় নানা ধরনের খাবার ও সামগ্রী বিকোয় যা বেশ অভিনব। ময়নার রাসমেলায় থালাবাতাসা, কদমা, নবদ্বীপে ছানার জিলিপি, অমৃতি, শান্তিপুরে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল সবচেয়ে আগ্রহের জিনিস।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments