জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--৫০/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫০

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

গোপালদা-র তীর্থভ্রমণের বিষয়ে পূর্বে কিছু উল্লেখ করা হয়েছে। বয়সের ভারে কোনওসময়েই ন্যুব্জ হননি, তীর্থদর্শনের প্রবল উৎসাহ ছিল তাঁর মধ্যে। আর এই উৎসাহের বশবর্তী হয়েই ৺কেদারনাথ থেকে কন্যাকুমারী কিংবা দ্বারকা থেকে কামাখ্যা ব্যাপী প্রধান তীর্থগুলি ভ্রমণ করেন। ১৮৯০ সালের মার্চ মাসে তিনি শ্রীশ্রীমাকে গয়াধামে নিয়ে যান। আবার ১৮৯০-৯১-এর শীতকালে হরিদ্বারে কুম্ভ উপলক্ষে উপস্থিত ছিলেন। ১৮৯৭ সালের নভেম্বর মাসে রায়পুরে পৌঁছান কোন্নগরের নবাই চৈতন্যবাবুর সঙ্গে। পরে দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে বের হন এবং ১৮৯৮ সালের ২৩ মার্চ স্বামী সুবোধানন্দ ও স্বামী নির্মলানন্দের সঙ্গে মঠে ফিরে আসেন। দার্জিলিংয়ে যান ১৮৯৯-এর শেষ দিকে, ৫ নভেম্বর ফিরে আসেন মঠে। ১৯০০ সালে স্বামীজী ভারতে ফিরে আসার দিন কয়েক পর কয়েকজন গুজরাতি ভদ্রলোকের সঙ্গে দ্বারকায় যান এবং পরের বছর ৭ ফেব্রুয়ারি মঠে ফিরে আসেন। 

 গোপালদা শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে সামান্য ব্যায়াম করতেন। তাঁর শরীর সব মিলিয়ে ভালোই ছিল। অন্যের সেবা গ্রহণ করা তাঁর মনঃপূত ছিল না। জগদীশ্বরের অসীম কৃপায় তিনি এমন অবস্থাতে কখনও পড়েন নি যাতে স্বাস্থ্যের অবনতিতে অন্যের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যেই ছিল তাঁর সন্তুষ্টি। 

 অবশেষে শেষের সেদিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। দেহত্যাগের কিছু আগে তিনি পেটের অসুখে ভুগছিলেন। এর প্রতিকারার্থে রোজ একটু ব্যায়াম করতেন। কিন্তু জরাজীর্ণ শরীরকে এভাবে রক্ষা করা সম্ভব নয় বুঝে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে কাতর প্রার্থনা জানান, “প্রভু, আমায় এই কষ্ট থেকে মুক্তি দাও।” ঠাকুর তাঁর এই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। কথিত আছে, শেষ অসুখের সময় তাঁর অলৌকিক দর্শন হয়েছিল। তিনি দেখলেন শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর সামনে গদাহস্তে আবির্ভূত হয়েছেন। বিস্ময়াভিভূত গোপালদা ঠাকুরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ঠাকুর উত্তর দেন, “আমি এবারে গদাধররূপে আবির্ভূত।” যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ একবার বাবুরাম মহারাজকে ( স্বামী প্রেমানন্দ ) বলেছিলেন --“এই যেসব ধর্মটর্ম দেখচিস এই সমস্ত কিছুই থাকবে না -- ঠাকুর সব খেয়ে ফেলবেন। বাবুরাম মহারাজকে একবার বলতে শোনা যায় -- “বুড়োগোপালদাদা ( অদ্বৈতানন্দ ) দেহ রাখবার আগে ঠাকুরকে দেখলেন, গদা কাঁধে গদাধর। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কাঁধে গদা কেন? ঠাকুর বল্লেন, আমি গদাধর, এবার এইরকমই, সব ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়ব।” (প্রেমানন্দ-প্রেমকথা )
 ২৮ ডিসেম্বর, ১৯০৯ সাল, মঙ্গলবার ( ১৩ পৌষ, ১৩১৬ বঙ্গাব্দ ) অপরাহ্ণ ৪টা ১০ মিনিটে বেলুড় মঠে দেহত্যাগ করেন অদ্বৈতানন্দজী। বয়স হয়েছিল একাশি বছর। স্বামী প্রেমানন্দজী পত্রে লিখছেন --“২৮ শে ডিসেম্বর (১৯০৯ ) মঙ্গলবার বেলা ৪৷৷ ঘটিকার সময় গোপালদাদা স্বধামে গমন করেছেন। সামান্য জ্বর হয়েছিল মাত্র। কেহ ঠাওরাইতে পারে নাই যে, এত শীঘ্র তিনি দেহরক্ষা করিবেন। শেষ সময়ের মুখকান্তি অতি সুন্দর! শ্রীশ্রীপ্রভুর ভক্তের লীলাই এক আশ্চর্য। সে সময়ে মতি ডাক্তার উপস্থিত ছিল। লেবু-দুধ খেলেন। মতিবাবুকে নমস্কার করে হাসিতে হাসিতে দেহত্যাগ!”
 স্বামী বিবেকানন্দ বয়সে অদ্বৈতানন্দজীর তুলনায় পঁয়ত্রিশ বছর কনিষ্ঠ ছিলেন। বয়সে এতখানি বড় হয়েও স্বামীজীর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। কারণ স্বামীজীকে নেতা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং। অন্যদিকে স্বামীজীও এই বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। স্বামীজী একবার অদ্বৈতানন্দজীকে খ্যাপানোর জন্য একটি মজার ছড়া রচনা করেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই ছড়ার মধ্যে নিহিত ছিল এই প্রবীণ সন্ন্যাসী সকলের কাছে কত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তার বার্তা। স্বামীজী চাইতেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা সংস্কৃত শাস্ত্র বিষয়ে পারঙ্গম হয়ে উঠুন। এজন্য অদ্বৈতানন্দজীকে সংস্কৃত ব্যাকরণ লঘু কৌমুদী পড়তে বলেন। স্বামীজীর এই অনুরোধকে অদ্বৈতানন্দজী আদেশ বলে মেনে নিয়ে এর পঠনপাঠন শুরু করেন। মাঝেমধ্যে তাঁকে মজা করে ব্যঙ্গও করতেন স্বামীজী।  বলতেন, “আপনি একটি বৃদ্ধ ষাঁড়ের মতো যে কিনা শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে এসে ভিড়েছে‌।” একদিন স্বামীজী তাঁকে বললেন, “গোপালদা আপনি দিনকে দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন। সতর্ক হোন।‌ এখন আপনার অবশ্যই দুধ ও ফল খাওয়া শুরু করা উচিত। এর ফলে আপনি নবজীবন লাভ করবেন এবং আপনার হাড়ে মরচে পড়বে না। যতই হোক, আমাদের মধ্যে আপনি বয়সে সকলের চেয়ে বড়। সুতরাং আগামীকাল আমরা আপনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুগ্ধে ধৌত করব।” পরের দিন স্বামীজী ও অন্যান্য সন্ন্যাসী ভাইয়েরা প্রায় দশ কেজি দুধ ঢেলে দিলেন অদ্বৈতানন্দজীর মাথায় এবং তারপর গঙ্গাজল দিয়ে তা ধুয়ে দিলেন। এরপর নতুন বস্ত্র পরিয়ে বিভিন্নরকম পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হল। স্বামীজী সোল্লাসে বললেন, “দাদা, আজ থেকে আপনি মঠাধীশ। মঠের সমস্ত দায়িত্ব আপনার।” এগুলো সব করা হয়েছিল মজার ছলে। একবার স্বামীজীর পোষা হাঁসগুলির একটি সপ্তাহখানেক ধরে রোগ ভোগের পর শ্বাসকষ্টে মারা যায়। এই ঘটনায় স্বামী অদ্বৈতানন্দজী স্বামীজীকে বলেছিলেন, “মশাই, এই কলিযুগে বাস করার কোনও অর্থ নেই যেখানে বৃষ্টি ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার কারণে হাঁসের ঠাণ্ডা লাগে এবং ব্যাঙে হাঁচি দেয়!” 
 ১৯০১ সালে স্বামীজী অদ্বৈতানন্দজীকে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যতম অছি হিসাবে ঘোষণা করেন। পরে তিনি সঙ্ঘ - সহাধ্যক্ষ হন।  ১৯০২ সালের ৪ জুলাই স্বামীজীর মহাসমাধিলাভের সময় অদ্বৈতানন্দজী উপস্থিত ছিলেন। তিনিই প্রথম নাড়ি দেখেন এবং দেখামাত্রই বলে ওঠেন,“হায়! কী দাঁড়িয়ে দেখছ? এক্ষুনি বরানগরের ডাক্তার মহেন্দ্র মজুমদারকে খবর দাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁকে নিয়ে এস।”

 অদ্বৈতানন্দজী অধ্যাত্মপথে যাত্রা শুরু করেছিলেন বেশ কিছুটা বিলম্বে। কিন্তু তাঁর অপরিসীম ধৈর্য, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠা এই ঘাটতি দূর করে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত পূর্ণতালাভের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যাঁরা একটু অধিক বয়সে পৌঁছে অধ্যাত্মপথে এগনোর তাগিদ অনুভব করেন, তাঁদের কাছে অদ্বৈতানন্দজীকে রোল মডেল হিসেবে স্থাপন করেছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। বস্তুতপক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানদের জীবন পর্যালোচনা করলে শেষমেশ শ্রীরামকৃষ্ণের মহিমাই উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কারণ এঁদের মধ্য দিয়ে নানাভাবে তিনিই প্রকাশিত হয়েছিলেন। অনন্ত ভাবময় ঠাকুর ছিলেন ভাবের জগতের রাজা। তাঁর ভাব সমুদ্রের এক প্রবল তরঙ্গ স্বামী অদ্বৈতানন্দ।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments