বাংলা ছোটোগল্পের পালাবদল— ২০
অনিতা অগ্নিহোত্রী
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
অনিতা অগ্নিহোত্রী (জন্ম-১৯৫৬) এমন একজন বিশিষ্ট লেখক, যাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যের সীমানা সম্প্রসারিত হয়েছে। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ আখ্যানগুলি রচিত হয়েছে বহির্বঙ্গের প্রেক্ষপটে। বাঙালি পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে নতুন এক জগৎ। প্রায় অজানা-অচেনা এক ভারতকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। তাঁর হাত ধরেই আমরা চিনেছি ভারতের দীর্ঘতম নদীর গতিপথ (‘মহানদী’) ; মারাঠাওয়াড়ার চাষিদের সংকট এবং আন্দোলনের ইতিকথা (‘কাস্তে’) ; ওড়িশার কালাহান্ডি, মহারাষ্ট্রের গড়চিরোলিসহ ছত্তিশগড়— পুরাণকথিত মহাকান্তারের ব্যাপ্ত চরাচর (‘মহাকান্তার’) ; কচ্ছের রণের লবণ তোলা আগারিয়াদের কথা (‘লবণাক্ত’) ইত্যাদি। তাঁর গল্প-উপন্যাস পাঠে আমাদের ভারত-দর্শন হয়। স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক এবং মানবিক মানচিত্র। মূর্ত হয়ে ওঠে শাশ্বত ভারতবর্ষের আকাঁড়া স্বরূপ। প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁর সাহিত্যগুলি আধুনিক এক ভারতকথা।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা দক্ষিণ কলকাতায়। শৈশবে বাড়িতে সাহিত্যের আবহ ছিল। অক্ষর পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই মুখে মুখে কবিতা বলতেন। মাত্র বারো বছর বয়স থেকে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় কবিতা লিখতেন অনিতা চট্টোপাধ্যায়। ১৯৮২ থেকে ‘অগ্নিহোত্রী’ পদবি ব্যবহার করছেন। তাঁর সাহিত্যজীবনের মূল চালিকা শক্তি মা নমিতা চট্টোপাধ্যায়। মায়ের উৎসাহেই কবিতা থেকে গল্প লিখতে এলেন। প্রথম গল্প ‘স্থানান্তর’ প্রকাশিত হয় দেশ পত্রিকায়। বিশ শতকের আশির বছরগুলি থেকে নিয়মিত গল্প লিখে চলেছেন। তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘চক্রব্যূহ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। উল্লেখ্য তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘চন্দনগাছ’ (১৯৮৭)।
নীতিহীন হিংস্র রাজনীতির চিহ্ন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো, অপরিমিত লোভের আগ্রাসনে অরণ্য-নিধন, পরিবেশ ধ্বংস, উন্নয়নের নামে আদিম অধিবাসীদের সমূলে বিনাশ করে শিকড়চ্যুত করা...ইত্যাদি উদগ্র হয়ে থাকে তাঁর গল্পের স্তরে স্তরে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া সমাজ-রাজনৈতিক ঘটনাগুলি বাংলা গল্পে এত গভীরভাবে আর কেউ নিয়ে আসেননি। বিশেষ করে আদিবাসীদের উপর রাষ্ট্রিক সন্ত্রাসের ছবি বারবার উঠে এসেছে তাঁর গল্পে।
তাঁর ‘ছায়াযুদ্ধ’ (‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, রবিবাসরীয়, ২০০৭) গল্পে এসেছে আদিবাসীদের কথা। সরকার তাঁদের জমি অধিগ্রহণ করেছে জোর করে। আর তা দিয়েছে একটা বহুজাতিক কোম্পানিকে। কোম্পানি তাদের মতো করে পাঁচিল তুলেছিল। আদিবাসীরা সরকারকে সামনে পাননি। পেয়েছেন কোম্পানির লোককে। শ-পাঁচেক লোক তাড়া করে পাহারারত হাবিলদারকে ধরে টাঙ্গি-বল্লমে ফালা ফালা করে দেন। আর তারপর পুলিশ রাউন্ডের পর রাউন্ড গুলি চালায়। বারো জন মৃত, তিরিশজন আহত হয়ে হাসপাতালে। তা নিয়ে শুরু হয় ‘ফিলমি পলিটিক্স’, মিডিয়ার চিৎকার— “স্বাধীনতার পর এখনো গুলিতে এতজন মানুষ মারা যায়নি।”
লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে দশকের পর দশক ধরে আদিবাসীদের নিঃস্ব করে দেওয়া হয়েছে। এক সময় অরণ্য ছিল। বনের ফলমূল শিকড় মধু কাঠকুটো এই সবে ওঁদের দিন চলত। আদিবাসীরা জঙ্গলকে চিরকাল লালন করেছেন বুকের মমতায়। জঙ্গল থেকে এমন সব জিনিস তাঁরা সংগ্রহ করতেন যাতে অরণ্যের কোনও ক্ষতি না হয়। অরণ্যের কাঠবিড়ালি থেকে সাপ— যে কোনও সজীব প্রাণীই বহু আদিবাসীদের খাবার। হিংসা দ্বেষ কোলাহলের সভ্যতার ভিতর আদিবাসী গ্রামগুলি যেন এক-একটি শান্তির নীড়। জঙ্গলের ভিতরেই বসত তাঁদের, কারণ গাছের ঝরা পাতা, ভূপতিত গাছ, মহুলের ফল, বাঁশের কোঁড়— সবকিছুর জন্যই ওদের অরণ্যকে কাছে চাই। কাঠের চোরাচালান শুরু হওয়ার পর জঙ্গল ছোট ও রোগা হয়ে চলে গেল জেলার এক কোণায়।
লেখক দেখিয়েছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত উত্তাপ কীভাবে হারিয়ে যায়। এই গণহত্যার খবরও কয়েক মাসের মধ্যে খবরের কাগজ থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। কিছু মানুষ হাইওয়ের ছোটো একটা রাস্তা অবরোধ করে বসে থাকে দিনের পর দিন। কিন্তু গ্রামে ঢোকার শর্টকার্ট রাস্তা থাকায় সমস্যা হয় না। সরকারও নীরব থাকে। “অনেক সময় নীরবতাই স্মৃতিকে খতম করে দেবার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রেও তাই হল। এসব পাগলামি নিয়ে আমরা কোনো আলোচনা বা বাক্যব্যায় করব না, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে জিতে গেল সরকার!”
এই রাজনৈতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি দাম্পত্য সম্পর্কের টানাপোড়েনই গল্পের মূল আকর্ষণ। পুলিশ অফিসার ঋত্বিক কর্মসূত্রে এখানে। গুলি চালানোর ঘটনা পরে স্ত্রী তিথি তাকে একটু সন্দেহের চোখে দেখত। তাদের সম্পর্কে ফাটল তৈরি হয়েছিল। সেই ফাটলও মুছে যায় একদিন। তারা আগের মতো হাসি ঠাট্টা করে। রাতে ঘুমন্ত ঋত্বিকের মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখে— “কপাল, গাল, ঠোঁট, চিবুক। নাঃ কোনো রক্তের দাগ নেই ঋত্বিকের শরীরের কোথাও। মুছে গেছে।”
গল্পের শেষে তিথি একা ফিরছে কলকাতা থেকে। ঋত্বিক মুম্বাইয়ে। এই ষ্টেশনে ভোর সাড়ে তিনটেয় ট্রেনটা আসে। বাচ্চা-লাগেজ নিয়ে ষ্টেশনে নামার পরে সবকিছু অচেনা মনে হয়। প্রবল বৃষ্টি। কোনও রকমে বাইরে আসে। জুলিয়াস একা দাঁড়িয়ে ভিজছে গাড়ির বাইরে। এই জুলিয়াসের ভাই মারা গিয়েছিল পুলিশের গুলিতে। তাকে তখন কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিল ঋত্বিক। আবার সে জয়েন করেছে। জুলিয়াসকে নিয়ে অযথা আতঙ্কিত হয় তিথি। মিনিট পনেরো পরে সেই আতঙ্কও থাকে না। “তিথির ইচ্ছে করে সে তার মায়াময়, করুণাঘন ডান হাতটি দিয়ে জুলিয়াসের পাথরের মতো পিঠটা ছোঁয়। ইচ্ছে করে, কিন্তু পারে না সে। তার আঙুলে রক্ত, বৃষ্টিজল মাখামাখি হয়ে আছে।”
তিথিও এখন অত্যচারী রাষ্ট্রের, খুনী পুলিশের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছে। আসলে রাষ্ট্র তো একটা শাসন যন্ত্র। সেই যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ সরকারি কর্মচারীরা। আর সেই কর্মচারীর স্ত্রী হয়ে তিথিও শাসনযন্ত্রের শরিক হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত তিথিরও একটা পরিবর্তন ঘটে। উত্তরণও বলা যায়। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অদৃশ্য একটা প্রাচীর তৈরি হয়ে যায়! তা বুঝি আর ঘুচবে না কখনও।
অনিতা আখ্যানে কোনও কৃত্রিম সিচুয়েশন তৈরি করেন না। কোনও কৃত্রিম প্লট সাজান না। তাঁর নিজস্ব জীবন-পথের কথাই তুলে ধরেন। সেই জীবন-পথের অনিবার্য অঙ্গ হয়ে ওঠেন আদিম অধিবাসীরা। অরণ্যচারীদের দুঃখ-সংঘাত ভাঙা-গড়ার অবিরাম ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন।
তাঁর গল্পের আরেকটি জোরের জায়গা রাজনীতি-চেতনা। সেই রাজনীতিবোধও তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই প্রসঙ্গে তাঁর স্বীকারোক্তি— “যেকোনও শিল্পরূপই রাজনৈতিক চেতনার অভিব্যক্তি। অবচেতন থেকে সঞ্চারিত হয় কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ এঁরাই— প্রান্তিক কৃষিজীবী, দিনমজুর, দলিত আদিবাসী জনসমাজ— স্বাধীনতার এত বছর পরও যাঁদের কথা শোনার, বোঝার উপযুক্ত ব্যবস্থা আমরা করে উঠতে পারিনি। কলকাতা শহর ছাড়ার পর এঁদের সঙ্গে কেটেছে আমার জীবনের তিন দশকের বেশি। প্রশাসনে থেকে নিজেকে মানুষের পক্ষে ভাবার মধ্যে তাত্ত্বিক বিসঙ্গতি আছে। সেই দ্বন্দ্বের ভার বহন করেই আমি আমার কাজ ও লেখালিখি চালিয়ে গেছি। নানা টানাপোড়েন অন্তর যেমন দীর্ণ, ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তেমনই বহু লেখা সিক্ত হয়েছে নিজেরই চোখের জলে। এই নিরুপায়, অনিশ্চিত অস্তিত্বই আমার আত্মপরিচয়।” (‘বইয়ের দেশ’, সেপ্টেম্বর ২০২০)
স্পর্শ-কাতর রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখার জন্য সাহস দরকার। প্রশাসন এবং ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের বিরাগ ভাজন হতে কে-ই বা চায়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে যেতে পারে— এরকম বিষয়গুলিকে এড়িয়ে যান অধিকাংশ লেখকেরা। সেদিক থেকেও অনিতা অগ্নিহোত্রীর গল্প সম-সময়ের দলিল হয়ে থাকছে। বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রের রক্তাক্ত চিহ্ন নন্দীগ্রামের ঘটনা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিজীবীদের দ্বৈরথও ভুলে যাইনি আমরা। ওই সময়ে নতুন একটা শব্দের আমদানি হয় বাংলার রাজনীতিতে— ‘বহিরাগত’। ‘বহিরাগত’ (‘বর্তমান’, রবিবার, ২০০৭) নামেই একটা গল্প লিখেছিলেন তিনি। বামপন্থী বুদ্ধিজীবী পূষণের ভাবনায় এগিয়েছে গল্প। সে সরকারের পক্ষে, শিল্পায়নের পক্ষে কিন্তু গুলি চালনার ঘটনার বিরুদ্ধে। মিডিয়ায় তখন বুদ্ধিজীবীদের বাইট। কাগজে প্রকাশিত সেসব বিবৃতিগুলো ভিতু আর ধোঁয়াটে মনে হয় তার। কেউ-ই সরকারের বিরোধিতা করে বলছে না। তার কাছে জানতে চাইলে বিনা দ্বিধায় সে “নিন্দে করত পুলিশি বর্বরতার।” সে খুব আশ্চর্য হয়— “কাগজে যা এসেছে সবই খুব শব্দহীন, পরিশীলিত, আর শত ধৌত অবস্থায়। ইরাক যুদ্ধের সময় এইরকম নিঃশব্দ যুদ্ধ-সংবাদ পরিবেশনা নিয়ে তারা কত আলোচনা করেছিল। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সেই নিপুণ গলা পাড়ার কাগজও শিখে গেল তাহলে।”
সংবাদমাধ্যমকেও পরোয়া করেননি লেখক। পূষণের লেখক-বন্ধু ইমোশনাল আর জেদি অরূপা গিয়েছিল ওখানে। অ্যারেস্ট হয়নি। তবুও সে গ্রামের সীমানার কাছে মাঠে বসে থেকেছে। খবরটা শুনে পূষণের মনে হয়, সেও যেতে পারত অপরূপার সঙ্গে। সকালের খবরের কাগজে বিবৃতি— মাত্র একজন গ্রামবাসী লাঠির আঘাতে আহত। বাকিরা সকলেই ছিল বহিরাগত। আর সেই খবর স্বস্তি দেয় পূষণকে। “যারা পুলিশের মার খেয়েছে তারা সকলেই বহিরাগত— এই ভোরের খবর তাকে আস্থা ও বিশ্বাস যোগায়। ক্ষতিপূরণ যথেষ্ট পাক আর না পাক, ভিতরের লোকেরা নিশ্চয়ই মার খাবে না বেধড়ক। পূষণ নিজেও তো ভিতরেরই মানুষ। আর দশজন অনিমেষের মতন পূষণও খোলা মনে যেতে পারে কবিতা উৎসবে।”
কীভাবে ‘ব্লাডলেস অপারেশন’ করতে পারে প্রশাসন তাও যেমন এসেছে গল্পে, তেমনি ভারতেরর অন্যান্য অঞ্চলের নির্যাতিতদের কথাও আছে। আর অনিতা দেখিয়েছেন কীভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষ শাসিতদের বহিরাগত তকমা দিয়ে আপামর জনগণকে শান্ত করে রাখে। আর কী অনায়াসেই না তা আমরা বিশ্বাসও করি। আর ভিতরের লোক ভেবে স্বস্তি পাই। কেউ আসলে ভিতরের থাকে না। শেষ পর্যন্ত বহিরাগতদের তালিকাটাই লম্বা হতে থাকবে।
প্রশাসনের হিংস্র স্বরূপটি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।
প্রকৃতি-পরিবেশ তাঁর গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে থাকে। তাঁর সাহিত্যের একটা পরিবেশবাদীপাঠ সম্ভব। পরিবেশ ধ্বংসে সব সময় মানুষের হাত থাকে না। প্রকৃতি অনেক সময় নিজেও আত্মঘাতী হয়। তার প্রবল রোষের প্রতাপে মানুষ যেমন তছনছ হয়ে যায়, তেমনি সে নিজেকেও রেহাই দেয় না। সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎসে মানুষের লোভ থাকে না। অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘দেওয়ালের নীচে’ (‘সেরা ৫০টি গল্প’, দে’জ, ২০১৮) গল্পে এসেছে প্রকৃতির অদ্ভুত এক তাণ্ডবের কথা। ছত্রিশগড়ের ঘুর্ণিঝড়ের আবহে গল্পটি বিন্যস্ত। সেখানে অগ্রহায়ণ মাসে এক মারাত্মক ঘুর্ণিঝড় হয়েছিল। তার মর্মান্তিক বর্ণনা করেছেন লেখক। “শহরের সবক’টি গাছ উপড়ে পড়েছে। গোড়া থেকেই মুখগুলি উপরে অঙ্গ তুলে চিৎকার করছে নিঃশব্দে। অতর্কিতে উপড়ে পড়ার ফলে তারা নানা জায়গায় পথ বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষের বাড়ি ফেরার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে শুয়ে-পড়া গাছ—কোথাও টেলিফোন বা বিদ্যুতের তারের উপর ডালপালা পড়ে আরও জটিল করে তুলেছে। অচল অবস্থা। শিকড়গুলি মৃত্তিকা-চ্যুত হওয়ায় খাদ্যরস পৌঁছোতে পারেনি পত্রজালিকায়। ফলে গত কয়েকদিনের মধ্যে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে পাতাসকল। খড়খড়, মড়মড় শব্দ উঠছে বাতাসে— মরাগাছেরই দীর্ঘনিঃশ্বাসের মতন। পাখির বাসা, ডিম, ছড়িয়ে পড়ে আছে পথে। ঘূর্ণিবাতাসের বেগ ছিল ঘন্টায় একশো আশি মাইলের মতন। শহরের কোনো মুক্ত পাখি বেঁচে নেই। মৃত নষ্ট পাখি ও পাখির ডিমে পথ ছয়লাপ। একটিও কাক, একটিও চড়াই কি শালিখ ডাক পাঠাচ্ছে না ভোরের বাতাসে।”
এই দুঃসময়ে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে ছিল। ঘুর্ণিঝড়ের পরে মৃত মানুষ এবং পশুর ক্লিষ্ট গন্ধ সরতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকমাস। পুরো শীতটা খোলা আকাশের নীচে কাটিয়েছিল বেশ কয়েক লক্ষ মানুষ। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছিল জীবন। লখন দুসাদের বউ-মেয়ে গোঁসাইদের দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। পরদিন সকালে সূর্য ওঠার পরে গাছপালা সরে গেলে দেখেছিল সেই আশ্চর্য দৃশ্য। ধসে পড়া দেওয়ালের নীচ থেকে বেরিয়ে আসা সবুজ কাচের চুড়িপরা একটা শ্যামলা হাত! শরীরটা দ্যাখা যায়নি। সেই দৃশ্য দ্যাখার পরে লোকটির মাথার কোষগুলির মধ্যে গড়িয়ে গিয়েছিল যেন নীল কালি।
এক বছর পরে কার্তিক পূর্ণিমার বড়ো মেলায় আবারও মানুষের ঢল নেমেছে। পুরনো গেরস্থালির কাছে এসে বসে লোকটি। এখানেই ছিল গোঁসাইদের দেওয়াল। ওই খানে ছোট্ট মুন্নু হামাগুড়ি দিত। তার মা দোকান সাজাত মেলায়। এখন নতুন দেওয়াল উঠেছে। রঙ হয়েছে তাতে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামলে দৌড় লাগায় মানুষ। আর এক বছর পরে হাহাকার করে ওঠে মানুষটি— “ওই গেল, ওর হাত, ওর হাত গেল...।”
“শহরের প্রাচীন তরুরা সবাই স্বর্গগত। কেবল কৃশ স্বাস্থ্যহীন কিছু ইউক্যালিপটাস ও আকাশিয়া ছায়াহীন নিঃস্বতায় জেগে আছে। মৃত পাখিদের জায়গায় অচেনা, নতুন সব পাখি আসতে আরম্ভ করেছে। কলকাকলির সিম্ফনিতে কান পাতলে রোদনধ্বনি শোনা যায়।”
যে কোনো বড়ো দুর্যোগের পরে একটা সময় মানুষের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। নতুন মানুষ এসে জায়গা করে নেয়। সবই হয়তো চলে আগের মতো। কিন্তু প্রকৃতিতে স্থায়ী ক্ষত থেকে যায়। প্রাচীন বৃক্ষেরা আর কখনও ফিরে আসে না! তার জায়গা নেয় নতুন আকাশমণি ইউক্যালিপটাস ইত্যাদি শাখা-প্রশাখাহীন গাছেরা। সেই গাছ পাখিদের আশ্রয় দিতে পারে না। মানুষকে ছায়া দিতে পারে না। বৃক্ষের বৈভব ও ঐশ্বর্য থাকে না এই সমস্ত দ্রুত বেড়ে ওঠা গাছেদের। এভাবেও পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যায় চিরতরে। ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রাচীন তরুবর!
বহির্বঙ্গ বাংলা সাহিত্যে আগেও যে উঠে আসেনি তা নয়। এসেছে, বার বার এসেছে। হাজারিবাগ, রাঁচি, ভাগলপুর, ঘাটশিলা... ইত্যাদি ; মূলত বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে বাংলায় সাহিত্য রচিত হয়েছে। কিন্তু অনিতা অগ্নিহোত্রী যে সব অঞ্চলকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনা করলেন, তা বাংলা সাহিত্যে এর আগে উঠে আসেনি। এই অঞ্চলের মানুষদের, তাঁদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন। তাঁদের জীবনচর্যার অন্তর্গত ধ্বনি লেখকের হৃদয়তন্ত্রীকে স্পন্দিত করেছে। তাই গভীর মমতার সঙ্গে তাঁদের কথা বলতে পেরেছেন।
অনিতা অগ্নিহোত্রী সর্বার্থেই একজন কমিটেড লেখক। সমাজ-রাজনৈতিক কমিটমেন্ট থেকে গল্প লেখেন তিনি। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন— “আমি যেমন নিউট্রাল নই। আমি সর্ব অর্থে রাজনৈতিক কমিটেড। আমার সাহিত্যও তেমন নিউট্রাল নয়। নিউট্রাল হবে কেন! আমি তো লিখি মানুষের কথা, তাদের কাছে যাই। আমি সেই সমস্ত মানুষের কথা লিখি, যাদের স্বর আমরা আমাদের ড্রয়িংরুমে বসে অথবা আমাদের হাইরাইজ বিল্ডিং-এর টোয়েন্টি সেভেন্থ ফ্লোরে বসে শুনতে পাই না। আমি তো তাদের প্রতি কমিটেড, তাদের জীবনের প্রতি। তাদের সংগ্রামের প্রতি। তাদের কাছে আমি যতই যেতে পারব, নিজের সমস্ত ভেতরের অতীতের যত জমে থাকা ক্লেদ এবং ভুল ধারণা অহমিকা বিসর্জন দিয়ে ততই আমার লেখা শুদ্ধতর হবে। সাহিত্যে নিউট্রালিটির কোনও প্রশ্ন নেই। সাহিত্যকে সর্বদাই হতে হবে বাস্তবের প্রতি, মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ।” (‘শতানীক’, শারদ ১৪২৯)
এই কমিটমেন্ট থেকে তিনি সম-সময় নিয়ে গল্পে লেখেন। সময়ের ক্রোধ হতাশা অসহায়তা তিক্ততা নিয়ে গল্পে লেখেন। ‘পাহাড়’ (‘কোরক’, শারদ ২০২০) গল্পের প্রথমলাইনই চিনিয়ে দেয় গল্পের পটভূমি এবং বিষয়— “ছোট্ট মেয়ে টুপুরের অনলাইন ক্লাস চলছে।” অনলাইনে ক্লাস প্রাক্-করোনা পর্বে যে হয়নি তা নয়। কিন্তু আমরা এই সময়ে বুঝে গেছি ক্লাস বলতে মূলত অনলাইন ক্লাস। শুধু তো ক্লাস নয়, কাজ-কর্মও মূলত অনলাইনে। বাড়িতে বসে। গল্পের শুরুতেই দেখছি একটি পরিবারের সকলেই মগ্ন হয়ে আছে কম্পিউটার স্ক্রিনে। “ভিতরের দুটো ঘরে ছেলে ও বউমার ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলে। শ্রীপর্ণা আর রজত বাইরে ড্রইংরুমে থাকেন তখন। ডাব্লু এফ এইচ। বাড়ি থেকে কাজটার একটা নাম জুটেছে। ওই সময়ে টুপু বাবা কিংবা মায়ের ঘরে ঢুকে না পড়ে, শ্রীপর্ণা সেটা দ্যাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত। ছেলে ধ্রুব সকাল সকাল কাজে বসে গেছে। ব্রেকফাস্টের প্লেট হাতে নিয়েই সে স্ক্রিনের সামনে। বউমা আগাথার কাজ একটু দেরিতে শুরু হয়। সে এখন ঝুপঝাপ করে স্নান সেরে নিচ্ছে। তারপর চুল শুকোবে ড্রায়ারে, হালকা মেকআপ করবে। লকডাউন, অনলাইন কাজ। তবু মেয়েদের প্রেসেন্টেবল থাকতেই হয়।”
এই বর্ণনায় একবারও লেখক করোনার কথা বলেননি। প্যান্ডেমিকের কথা বলেননি। কিন্তু যে ছবিটি এই বর্ণনায় উঠে এসেছে তা একটি পরিবারের কোভিড-আক্রান্ত সময়েরই যাপনচিত্র। আপাত সুখী পরিবারে কতভাবেই না ঢুকে পড়তে পারে সময়ের অসুখ। এই গল্প তারই। এই ফ্ল্যাটবাড়ির কাজের মেয়ে রানীকে বাথরুম ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু সেই বাথরুমেই ঢুকে পড়েছে মেয়েটা। দরজা বন্ধ। সাড়া নেই। এবার চিন্তা শুরু হয় সকলের। সেকি ভিতরে মরে গেল, অসুস্থ অবস্থায় ঢুকল কীভাবে বিল্ডিং-এ ইত্যাদি। ডাকা হয় কারপেন্টারকে। আর তখনই বাথরুম পরিষ্কার করে বেরোয় সে। মাথা টলছে। গায়ে জ্বর। চমৎকার বর্ণনা করেছেন লেখক— “তাকে দেখে যান্ত্রিক সতর্কতায় ছ-ফুট দূরত্বে সরে যায় সকলে”।
পরিবেশ নির্মাণ এই গল্পে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ছোটো ছোটো একটা-দুটো লাইনের মধ্যে দিয়ে লেখক বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন প্রকৃতপক্ষে করোনা-অতিমারি কীভাবে মানুষের মনটাকে বিষাক্ত করে দিয়েছে। রানীর শরীরের কথা জানতে চায় না কেউ। কোনো রকম সহানুভূতি নেই তার প্রতি। উল্টে সকলকে বিপদের মধ্যে ফেলে গেল বলে তাকেই আক্রমণের শিকার হতে হয়।
এই গল্পে সমাজের স্পষ্ট দুটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন লেখক। এই ফ্ল্যাটের একটি পরিবার— যে আসলে মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর রানীর মতো মানুষরা। কলকাতার ধাপার দুর্গন্ধময় নোংরা পাহাড়ের গায়ে বেঁচে থাকা মানুষরা। যদিও তাদের নাকে কোনো গন্ধ লাগে না। তাই তো অনায়াসে ধাপার পাহাড়ের গায়ে লেপটে বসে পান্তাভাত খেতে পারে। তাদের মধ্যে কোনো মাস্ক নেই। ছ-ফুটের দূরত্ব নেই। সবই খোলামেলা সেখানে। তারা জানে কেউ করোনায় মরবে না। মরলে মরবে পেটের জ্বালায়।
গ্রামে-মফস্সলে ঘুরলে বোঝা যায় মাস্ক নিয়ে মানুষের মধ্যে একটা শ্রেণি বিভাজন তৈরি হয়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ-দরিদ্র মানুষ-গ্রামীণ মানুষ করোনা-পর্বেও ছিলেন মাস্কহীন। পুলিশি দাপটে কিছুদিন বাইরে পরলেও পুলিশের আড়ালে মাস্ক-বাদ তাঁরা। আর শিক্ষিত-স্বচ্ছল-শহুরে মানুষের অনিবার্য পরিচ্ছদ রঙিন কাপড়ের মাস্ক।
এটাই দেশের প্রকৃত চিত্র। করোনার আতংকে আড়ালে চলে গেছে আরও আরও অনেক সমস্যা। মৃত্যু ভয়। করোনায় আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর তথ্য আমাদের চোখে সামনে ভাসছে। কিন্তু অনাহারে, অন্যান্য অসুখে মারা যাওয়া মানুষের খবর আমাদের জানা নেই।
অনিতার আখ্যানের একটি বড়ো জায়গা জুড়ে থাকে দারিদ্র্য। তবে অকারণ দারিদ্র্যের জন্য, খাদ্য-সংকটের জন্য হাহাকারের বর্ণনা করেন না। অনুচ্চ স্বরে লেখক তুলে ধরেন সমাজ-বাস্তবতার বিভিন্ন স্তর।
লোকায়ত জীবন-সংস্কৃতির প্রতি বরাবরই বিশেষ আগ্রহ অনিতা অগ্নিহোত্রীর। তাঁর অস্তিত্বে মিশে আছে এই সংস্কৃতি। শুধু বাংলার নয়, তিনি যেখানে গেছেন সেখানকার সাধারণ মানুষদের জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থেকেছেন। তাঁর বহু লেখায় লোকায়ত মানুষদেরই প্রাধান্য। তাদের জীবন-সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর তিনি।
অনিতা অগ্নিহোত্রীর গল্পের ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছোটোবলা থেকেই তিনি জোর দিয়েছেন ভাষাচর্চায়। হেলাফেলায় কাহিনি বয়ন করেন না। গল্পের বিষয় পরিবেশ চরিত্র নির্মাণের মতো তিনি খুব সচেতনভাবে গদ্য-নির্মাণ করেন। তাঁর কাছে শব্দচয়নও খুবই সিরিয়াস একটি ব্যাপার। তাই বিষয় বা চরিত্র নয়, গল্পের আঙ্গিক এবং গদ্যশৈলী তাঁর নিজস্বতাকে চিনিয়ে দেয়।
লেখক দীর্ঘ ৩৬ বছর ভারতীয় প্রশাসনিক সেবায় যুক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শুধু একজন প্রশাসকের চোখে দিয়ে নয়, একজন অনুভূতিশীল মানুষের দৃষ্টি দিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানবিক যাপন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কাছে আমাদের নতজানু হতে হয়। তাঁর গল্পের পরতে পরতে সেই জীবন-অভিজ্ঞতার উৎসার। বাঙালি এই লেখকের অস্তি-রক্ত-মজ্জায় অনেকখানি ভারতবর্ষ ঢুকে গিয়েছে। তাই বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর এই আখ্যানে গ্রামীণ ভারতবর্ষ, লোকায়ত ভারতবর্ষের অনুরণন ধ্বনিত হয়। আর সেই অনুরণনে প্রকট হয়ে থাকে লেখকের রাজনৈতিক বীক্ষা। এখানেই অনিতা অগ্নিহোত্রীর গল্পবিশ্বের বিশিষ্টতা।
1 Comments
বর্তমান সময়ের গল্প বিশ্বে যে কয়েকজন গল্পবলিয়ের শিরদাঁড়া ঋজু,যে ক'জন অকপটে সত্য বলার সাহস রাখেন- অনিতা অগ্নিহোত্রী তাঁদের অন্যতম। প্রবন্ধে কিংবা গল্পে সব ক্ষেত্রেই অনিতা অন্যধারার। সমকালীন আর্থ- সামাজিক- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সরাসরি গল্পে এনে পাঠককে একেবারে সমস্যার কেন্দ্রে হাজির করেন অনিতা।
ReplyDeleteআর বিশ্বজিৎ ওঁর নিজের মত করে গল্পগুলি দেখেন,আমাদের দেখান। অনেক সময়েই সেই দেখা প্রকৃত সত্যদর্শন হয়ে যায়।নির্মল চট্টোপাধ্যায়।