জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--৫১/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫১

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


 স্বামী বিজ্ঞানানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণদেব ছিলেন এক চরম আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যাঁর মধ্যে সেই বাল্যবয়স থেকেই ঘটতে দেখা গিয়েছিল প্রবল আধ্যাত্মিকতার স্ফূরণ। তাঁর সমাধি, সঙ্গীত, নৃত্য, কথোপকথন ও গল্পসমূহ, আচার-আচরণ, ব্যঙ্গ,কৌতুক, ছেলেমানুষি সব কিছুর ভিতরেই নিহিত ছিল আধ্যাত্মিকতার সুর। তিনি অবতার বা এক মহান ধর্মীয় আচার্য হিসেবে বিবেচিত হন সাধারণভাবে। কিন্তু আরও গভীরে প্রবেশ করে তাঁর ব্যক্তিজীবনের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি মেললে বিস্ময়াবিষ্ট হতে হয়। যেমন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এক যুবার সঙ্গে কুস্তি লড়ছেন তিনি -- এই দৃশ্যটি নিশ্চয়ই যথেষ্ট আশ্চর্য হয়ে যাওয়ার মতো। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীদের কাছে তাঁদের গুরুর প্রভাবে অতি সাধারণ ঘটনার মধ্য দিয়ে অসাধারণ কিছু ঘটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। কুস্তির মতো একটি ক্রীড়ার মধ্য দিয়েও অনুগামীদের ভিতর তাঁকে আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সঞ্চার করতে দেখা গিয়েছে! শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী বিজ্ঞানানন্দ তাঁর গুরুদেবের সঙ্গে এক আশ্চর্য সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়েছেন এইরকম -- “আমি অনুভব করেছিলাম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ঘরটি অপার শান্তিতে পরিপূর্ণ। সেই শান্তিময় আবহে ভক্তরা তাঁর মুখনিঃসৃত অমৃতকথা শ্রবণ করতেন। তিনি কী বলতেন সেসব আমার স্মরণে নেই, কিন্তু যে তীব্র আনন্দের প্রকাশ ছিল সেইসব কথার ভিতর তা অনুভব করেছিলাম। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতাম সেখানে ও সমস্ত মনযোগ নিবদ্ধ থাকত তাঁর প্রতি। তিনি আমাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করতেন না, আমিও তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতাম না। তারপর একে একে ভক্তরা সব চলে যেতেন, হঠাৎই দেখতাম আর কেউ নেই, আমি সেখানে একাকী। ঠাকুর আমার দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। আমি ভাবলাম এবার আমার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে, তাঁর সামনে প্রণত হলাম।  চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুই কি কুস্তি লড়তে পারিস? আয় তো কেমন কুস্তি লড়িস দেখি।’ একথা বলতে বলতে তিনি উঠৈ দাঁড়ালেন এবং আমার সঙ্গে লড়বার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলেন। তাঁর চ্যালেঞ্জে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে বললাম , ‘এ কেমন ধর্মগুরু!’ কিন্তু উত্তর দিলাম, ‘নিশ্চয়ই, আমি কুস্তি লড়তে জানি।’ শ্রীরামকৃষ্ণ স্মিত হেসে আমার কাছাকাছি চলে এলেন। আমার বাহুদ্বয় ধরে ঠেলতে শুরু করলেন। তখন আমি ছিলাম একজন পেশীবহুল শক্তিমান যুবা। তাঁকে ঠেলে একেবারে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলাম। তিনি তখনও হাসছিলেন এবং আমাকে শক্ত করে ধরে থাকলেন। ক্রমশ আমি অনুভব করলাম আমার শরীরে এক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবেশ করছে যা তাঁর হস্তদ্বয় থেকে অপসৃয়মান। এই স্পর্শ সম্পূর্ণভাবে আমাকে অসহায় করে তুলল। সমস্ত দৈহিক শক্তিরহিত হলাম। অদ্ভুত আনন্দময় ভাবাবেশে আচ্ছন্ন হয়ে আমার কেশরাশি দণ্ডায়মান হল। অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে স্মিত হেসে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুই-ই জিতলি।’ এই বলে তাঁর খাটে গিয়ে বসলেন। আমি বাক্যহারা হয়ে পড়েছিলাম। পরম সুখরাশির ক্রমতরঙ্গ আমায় একেবারে গ্রাস করে ফেলল। আমি এই প্রকৃত সত্যটি অনুভব করলাম যে দৈহিকভাবে ঠাকুর কুস্তিতে জয়লাভ না করলেও তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি আমাকে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত করেছে। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমার পিঠে হালকা চাপড় মেরে বললেন, ‘মাঝে মাঝে এখানে আসিস। শুধু একদিন আসলে হবে না।’ এরপর কিছু মিষ্টি প্রসাদ খেতে দিলেন, প্রসাদ গ্রহণান্তর কলকাতায় ফিরে এলাম। বেশ কয়েকদিন সেই আনন্দের রেশ থেকে গেল। আমি উপলব্ধি করলাম, তিনি আমার মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তি সঞ্চার করেছেন।” ( God lived with them -- Swami Chetanananda, Advaita Ashram, Kolkata )
 পরবর্তী সময়ে স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন -- “ও আগের অবতারে কৃষ্ণের সঙ্গে কুস্তি লড়েছিল। ও খুব সাধারণ ব্যক্তি নয়।”
 স্বামী বিজ্ঞানানন্দজীর গৃহস্থাশ্রমের নাম ছিল হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। উত্তরপ্রদেশের এটোয়ায় ১৮৬৮ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তারকনাথ ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ সামরিক বিভাগে খাদ্য সরবরাহকারী দপ্তরে চাকরি করতেন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে হরিপ্রসন্ন সর্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন। যেহেতু তারকনাথের বদলির চাকরি ছিল, বাচ্চারা সব তাঁদের মা নকুলেশ্বরী দেবীর কাছে বারানসীতে লালিত পালিত হতে থাকে। এখানেই হরিপ্রসন্নর প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হয়। ১৮৭৯ সালে হরিপ্রসন্ন ও তাঁর ভাইবোনেরা তাদের মায়ের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বরের কাছে বেলঘড়িয়াস্থ পৈতৃক গৃহে চলে আসেন। হরিপ্রসন্ন কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৮৮২ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করেন। 
 বাল্যকাল থেকেই হরিপ্রসন্নের মধ্যে ধর্মপ্রাণতা লক্ষ্য করা যায়। সত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। চৌদ্দ বছর বয়সে একবার তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে মায়ের কাছে তীব্র বকুনি খেতে হয়। তিনি প্রতিবাদ করে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! মা কিছুতেই বুঝতে চান না। এমতাবস্থায় পবিত্র উপবীত ছিঁড়ে ফেলে বলেন, “আমি যদি মিথ্যা বলি, তাহলে আমি ব্রাহ্মণই নই।” এই ঘটনায় নকুলেশ্বরী দেবী পরিবারের অমঙ্গলের আশঙ্কায় যুগপৎ ভীত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। আশ্চর্যের বিষয় এর ঠিক পরের দিনই তারযোগে খবর আসে আফগানিস্তানের কোয়েটায় তাঁর পিতা তারকনাথের জীবনাবসান হয়েছে। দুঃখে কাতর মা হরিপ্রসন্নকে বললেন, “তোমার অভিশাপের ফল কী হল দেখতে পেলে তো?” 
 বিজ্ঞানানন্দজীর বাল্যজীবন সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারা যায়। বাল্যকালের একটি ঘটনা তাঁকে প্রায়ই বলতে শোনা যেত। ঘটনাটি এইরকম -- একদিন তাঁদের বেলঘড়িয়ার বাড়ির পিছনে বাঁশঝাড়ের ভিতর থেকে গুলির শব্দ শোনা গেল।  সেখানে দ্রুত ছুটে যান হরিপ্রসন্ন। গিয়ে দেখেন একটি হনুমান গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। তিনি স্পষ্ট শুনতে ও দেখতে পেলেন হনুমানটি করজোড়ে দু'বার “রাম, রাম”উচ্চারণপূর্বক মৃত্যুমুখে পতিত হল। হরিপ্রসন্ন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন হনুমানকুল শ্রীরামচন্দ্রের ভক্ত ও একান্ত অনুগত। মৃত্যুর সময় এরা ভগবান রামচন্দ্রের নাম করে।
 মাত্র সাত বছর বয়সে হরিপ্রসন্ন শ্রীরামকৃষ্ণদেবকে প্রথম দর্শন করেন। সেটা ছিল ১৮৭৫ সাল। বেলঘড়িয়ায় জয়গোপাল সেনের বাগানবাড়িতে তিনি প্রথম ঠাকুরকে দেখেন। সেখানে কেশব সেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন ঠাকুর। হরিপ্রসন্ন তখন নিতান্ত এক বালকমাত্র। বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলেন এবং হঠাৎই তাঁর দর্শন পান। তাঁকে দর্শন করার পর সেখান থেকে কাছেই অবস্থিত তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments