জ্বলদর্চি

ড. বিমল কুমার শীট (শিক্ষক, ইতিহাস অন্বেষক, বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩৩

ড. বিমল কুমার শীট (শিক্ষক, ইতিহাস অন্বেষক, বেলদা, পশ্চিম মেদিনীপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

সে বহু দিন আগের ঘটনা। হঠাৎ গ্রাম জুড়ে হৈ চৈ। সবাই ছুটছে পুকুর পাড়ে। কি একটা পাওয়া গেছে। পুরোনো দিনের কিছু। সবাই দেখতে চায়, জানতে চায়, বুঝতে চায়। স্বভাবতই একরত্তি একটা 'গাঁয়ের টকা'রও উৎসাহ ছিল সেদিন। চোখে অপার বিস্ময়! মনে অজস্র ভাবনা! কল্পনার রঙে রঙিন কচিপানা মুখটা। লক্ষ্য তখন মাটি খুঁড়ে পাওয়া অমূল্য রতনটিকে দেখার। কিসের তৈরি, কে তৈরি করেছে, কেন তৈরি করেছে, কবে তৈরি করেছে, কিজন্য তৈরি করেছে -- এমনি হাজারো দিকভ্রান্ত প্রশ্নের জাল আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছুট খনন স্থলের দিকে। উত্তরের আশায়। জানবার আগ্রহে।

দাঁতন ২ ব্লকের সাবড়া গ্রাম। এখানেই ছিল সেই বড় পুকুর। মজে যাওয়া পুকুরের নতুন করে খনন হচ্ছিল। সেই খননের সময় এখানে পাওয়া যায় ওড়িয়া ভাষায় লেখা তামার লিপি। এটি পাওয়ার খবরেই গ্রাম জুড়ে হুলুস্থুলু কাণ্ড। অবশেষে এই লিপিই সন্ধান দিয়েছিল যে, গ্রামের এই পুকুরটির খনন হয়েছিল ১৪৫৯ সালে! কয়েক'শ বছর আগে। সেদিন একটা সামান্য তামার লিপি দিয়েছিল এক অনাকাঙ্ক্ষিত, অনালোচিত এবং অনভিপ্রেত ইতিহাসের সন্ধান।

সেই 'গাঁয়ের টকা'ই ড. বিমল কুমার শীট। ছোটবেলায় সেই খননের কাহিনী শুনেছিলেন 'গাঁয়ের টকা'টি। খননের ইতিহাস তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল সেসময়। মাটির তলায় চাপা পড়ে থাকা লুক্কায়িত ইতিহাস জানার অদম্য ইচ্ছে সেদিন থেকেই উঁকি দিত মনের কোনে। বড় হয়ে ছোটবেলায় পুষে রাখা ইচ্ছেকে মান্যতা দিতে ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা। ইতিহাস নিয়ে গবেষণা। ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। আর ইতিহাস নিয়ে দৃপ্ত লেখনী চারণা।

১৯৬৬ র ২৪ শে অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন সাবড়া গ্রামে। বাবা গোপালচন্দ্র এবং মা কেদরী শীটের সন্তান। এখন থাকেন বেলদা শহরে। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক পাঠের পর এগরা ঝাটুলাল হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর স্কটিশ চার্চ থেকে ইতিহাস নিয়ে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। কলেজে পড়াকালীনই পেয়েছিলেন অধ্যাপক প্রভাতাংশু মাইতি, অসিত সেন, সমর মল্লিক, শিবাজী কয়ালদের আন্তরিক সান্নিধ্য। ইতিহাসের প্রতি সেই ছোটবেলার প্রেম পরিপুষ্ট হয়ে ওঠে এঁদের সাহচর্যে। Modern History তে স্নাতকোত্তর পড়ার সময় সুযোগ পান অধ্যাপক বিনয়ভূষণ চৌধুরী, বরুণ দে, বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়, হরি বাসুদেবন, গৌতম ভদ্র, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় , অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর সেন, অসীম দাশগুপ্ত, নির্বান বসু, সুরঞ্জন দাস, রজৎকান্ত রায় প্রমুখদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকার। এইসব পরমপ্রাপ্তি তাঁকে তাঁর স্বপ্নপূরনের পথ আলোকিত করে দিতে পেরেছিল। এই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ২০০৩ সালে অর্জন করেন Ph D ডিগ্রি। অধ্যাপক ড. নির্বান বসুর অধীনে এই গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মেদিনীপুরের এক মুক্তিকামী যোদ্ধার জীবনালেখ্য -- "Birendranath Sasmal And A New Trend In Bengal Politics"! দেশপ্রাণের কীর্তি তুলে ধরে গৌরবান্বিত করেছেন মেদিনীপুরের মাটি।
তাঁর কলমের আঁচড়ে ইতিহাসের তথ্য উদ্ভাসিত হয়। গ্রামগঞ্জ থেকে শহরতলির আনাচ কানাচ, পুকুরডোবা থেকে রাজা রাজড়ার লীলাক্ষেত্র, বৈপ্লবিক কার্যকলাপ থেকে রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস তাঁর নখদর্পনে। চিন, রাশিয়া, ভিয়েতনামের ইতিহাস নিয়ে কচকচানি করেননা তিনি। নিজের জন্মভূমি তথা মাতৃভূমি তথা নিজের জেলা মেদিনীপুরের ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইতিহাস তাঁর গবেষণার উপজীব্য‌। আর এভাবেই তিনি গর্বিত করে চলেছেন মেদিনীপুরের মাটি, মেদিনীপুরের গরিমা আর মেদিনীপুরের ঐতিহ্যকে।

কখনো প্রচারের আলোয় থাকেননা নেকুড়সেনি হাইস্কুলের এই ইতিহাসের শিক্ষক। নিজেকে ভাবেন ইতিহাস অন্বেষক। ছোটবেলায় পড়া স্কুলের সামনে একটা দোকানে খবরের কাগজ আসতো। তিনি পড়তেন। তখন সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে উপসম্পাদকীয় লিখতেন সুনীতি ঘোষ। অনুপ্রাণিত করতো সেইসব লেখা। কখনো হাতের কাছে ঠোঙা পেলে তিনি খুঁজতেন রশদ -- পড়ার Material! তাই এহেন মানুষটির কাছেই "যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন" প্রবচণটির সার্থকতা পেয়েছে বলা যায়‌।

ইতিহাসকে ভালোবাসেন। পুরোনো ইতিহাস খুঁজে জনসমক্ষে তুলে ধরতে পছন্দ করেন। নিয়মিত ইতিহাস চর্চা করতে নিজেকে আন্দোলিত করেন। একটা অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে নিজের জেলা মেদিনীপুরের তত্ত্বতালাশে মজে থাকেন দিবারাত্র। তাঁর কথায়, 'ইতিহাস অন্বেষণ মানে আগে নিজের বসতভূমির চৌহদ্দির ইতিহাস খোঁজা এবং জানা জরুরী। তারপর অন্য এলাকার ইতিহাস। সর্বাগ্রে জানতে হবে নিজেকে"। এই জানার আগ্রহের নিত্যদিনের কলমপেশা উদ্যোগ তাঁকে অচিরেই করে তুলেছে 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। মেদিনীপুরকে আলোকিত করার তাঁর প্রচেষ্টা, অধ্যবসায়, তিতিক্ষা এবং ধৈর্য আগামী প্রজন্মের কাছে অন্যতম শিক্ষনীয়।

পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের আজীবন সদস্য হয়েছেন ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মননের লালনপালনে। এছাড়া এই একই লক্ষ্যে Institute of Historical Research এবং All India History Congress এর সদস্য হয়েছেন। সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, আশুতোষ কলেজ, বনহুগলী কলেজ, বেথুন কলেজ, হীরালাল কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে গবেষণাধর্মী পেপার পাঠ করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গবেষণার আকরভূমি ছিল মেদিনীপুর কেন্দ্রিক। এছাড়াও All India History Congress এর বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়, পাঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাতিয়ালা) আয়োজিত অধিবেশনে মেদিনীপুরের নানা বিষয় নিয়ে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সময়ে।

১৯৯৫ তে All India History Congress এ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন 'An Unfinished Link Road Plan In India From Contai Station Road to Contai'। বেলদা থেকে কাঁথি পর্যন্ত অনাঘ্রায়িত রেলপথ আজও তৈরি হয়নি। সেই ইতিহাস উঠে এসেছে তাঁর গবেষণায়। ১৯৮৯ তে তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলে ধরেন দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও কাঁথি মহকুমা ইউনিয়ন বোর্ড বর্জন আন্দোলন বিষয়ে। ১৯৯৬ তে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে 'Role of the Midnapore Workers Association of the Freedom Struggle of Midnapore District 1933-1938', ১৯৯৭ তে বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে 'Activities of Birendranath Sasmal' এবং ১৯৯৮ তে পাতিয়ালার পাঞ্জাবী বিশ্ববিদ্যালয়ে 'Birendranth Sasmal against Amalgamation of South Western Midnapore with Orissa' বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ তুলে ধরে আলোকজ্জ্বল করেন মেদিনীপুরের সংগ্রামী ইতিহাস।

তাঁর লেখনী থেকে বেরিয়ে এসেছে 'ভারত তথা বিশ্বের ঐতিহাসিক দিনপঞ্জী', 'মেদিনীপুর প্রতিভা', 'দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল ও বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন', 'বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো : একটি জীবনালেখ্য', 'বীরেন্দ্রনাথ শাসমল : স্রোতের তৃণ' বইগুলি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে মেদিনীপুরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেই রক্তঝরা ইতিহাস তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন মননশীল ভাবনা আর নিগূঢ় অনুসন্ধানের ঘেরাটোপে। যার পরতে পরতে মেদিনীপুরের ইতিহাস বিধৌত প্রতিচ্ছবি।

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

2 Comments

  1. ভাস্কর দা তোমার সৌজন্যে আমাদের পরম প্রিয় বিমল স্যার -এর জীবনীর অনেক কথা জানতে পারলাম। তিনিই প্রথম আমাদের শিখিয়েছিলেন ইতিহাসকে ভালোবেসে কিভাবে সহজ করে শিখে নিতে হয়। খুব ভালো থাকবেন স্যার 🙏🙏🙏🙏

    ReplyDelete