জ্বলদর্চি

ছোট মকর: টুসু উদযাপনের সূচনার দিন /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৫০

ছোট মকর: টুসু উদযাপনের সূচনার দিন

সূর্যকান্ত মাহাতো


"অঘ্রান মাসের সংক্রান্তি জঙ্গলমহলে "ছট মকর"(ছোট মকর) নামে পরিচিত ও পালিত হয়। দিনটি চাঁউড়ি(চাউনি) নামেও পরিচিত। বাড়িতে বাড়িতে এই দিন সন্ধ্যেবেলা নানা রকমের পিঠা তৈরি হয়। তার মধ্যে অন্যতম হল 'পুর পিঠা'। নতুন খেজুর গুড় মাখিয়ে সেই পিঠা সবাই বেশ মজা করে খায়।"

ঘাটালের এক শিক্ষকমশাই জঙ্গলমহলের এক স্কুলে চাকরিসূত্রে এসেছেন। তিনি স্কুলে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের কছে জানতে পারলেন আজ "ছোট মকর"। "মকর" তিনি জানেন। কিন্তু "ছোট মকর" বলেও কিছু যে হয় বা আছে এমনটা তো তিনি কখনো শোনেননি। তাই 'ছোট মকর' আসলেই কী তা জানার জন্য আমাকে ধরলেন সন্ধ্যেবেলা। তখন আমি উপরের কথাগুলোই শোনালাম। শুনে উনি বললেন, "তাহলে কি 'মকর' দুটো? ছোট এবং বড়?"

বললাম, "হ্যাঁ। পৌষের সংক্রান্তি 'বড় মকর' নামে পরিচিত। কারণ ওই সময় মহা ধুমধাম করে 'মকর' উৎসব পালন করা হয়। তার একমাস আগে অঘ্রানের এই সংক্রান্তি হল 'ছোট মকর'। পিঠা বানানো ও খাওয়াই হল এই 'ছোট মকরের' উৎসব পালন।"

উনি বললেন, "কেবল এটুকুই! কোন লোকাচার পালন হয়? না, শুধুমাত্রই পিঠা উৎসব?"

বললাম, "পিঠা উৎসবটাই প্রধান। তবে কোন রকম আচার ধর্ম পালন করা যে হয় না এমনটা নয়। এদিন বাড়ি ও উঠোন ছঁৎ, ছড়া বা গোবর জল দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। দুয়ারে আলপনাও আঁকা হয়। তবে ওইটুকুই। মূলত পিঠা খাওয়াটাই মূল। তবে এসব ছাড়াও অন্য আরো একটি কারণ আছে। যেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।"

উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন,  "সেটা কী?"

বললাম, "ছোট মকরের দিনটি হল টুসু গানের আনুষ্ঠানিক সূচনার দিন। টুসু ব্রতের সূচনাও হয় এই দিন। এই দিনে কোথাও কোথাও ঘরের কুলুঙ্গিতে একটা 'সরা' রাখা হয়। তাতে গোবরের নাড়ু ও পিটুলিগোলা ছিটিয়ে দেওয়া হয়। ছড়িয়ে দেওয়া হয় কিছু গাঁদা ফুল। এটাই হলো টুসুর প্রতীক। কোথাও আবার ঘট পাতা হয়। কোথাও ছোট কুণ্ড তৈরি করে তার মধ্যে গোবর দেওয়া হয় এই দিন (সীমান্ত বাংলার লোকযান/শ্রী সুধীর কুমার করন, পৃষ্ঠা ১৯৩)।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "তার মানে টুসু গানের আনুষ্ঠানিক সূচনা এই অঘ্রাণের সংক্রান্তিতেই হয়?"

বললাম, "হ্যাঁ।" উনি তখন বললেন, "টুসু গানগুলো আসলে কেমন?"

বললাম, "আশুতোষ ভট্টাচার্য তো পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছেন, টুসু গান কোন পূজার গান নয়, ব্রতের গান নয়, এমনকি আচার মূলক সংগীতও নয়, সেই গান হল জীবনের গান। টুসু হল উপলক্ষ্য, জীবনই হল গানের লক্ষ্য। (তুষু ব্রত ও ক্ষেত্র সমীক্ষা/ ড: রবীন্দ্রনাথ সামন্ত, ভূমিকা অংশ, পৃষ্ঠা- ৭)
সেই সঙ্গে টুসু গান ঝাড়খণ্ডের নিরালঙ্কার ও প্রাণতত্ত্ব গীতও বটে। (ঝাড়খণ্ডের লোক সাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত পৃষ্ঠা ১৪৪)"

জানতে চাইলেন, "টুসুগানে কি টুসুর মাহাত্ম্য কথা বর্ণিত হয়?"

বললাম, "না। টুসু গানে কোন মাহাত্ম্য কথা বর্ণিত হয় না। এই গানে শুধুমাত্র একটা অঞ্চলের সামগ্রিক জীবনের ছবিই প্রস্ফুটিত হয়।"

শিক্ষক মশাই জানতে চাইলেন, "টুসু উৎসবও কি একরকম শস্য উৎসব? জঙ্গলমহলে একাধিক উৎসবই তো শস্য উৎসব। যেমন 'জাওয়া', 'করম' প্রভৃতি..."

বললাম, "হ্যাঁ। সুকুমার সেন তো তাই বলেছেন, টুসু উৎসব তিষ্যানক্ষত্রে অনুষ্ঠিত শস্য উৎসবের আবহমান ধারা। তবে জঙ্গলমহলে পালিত দেবদেবী বা উৎসবগুলোর বেশিরভাগই হল কৃষি উৎসব। সেখানে দেবী দুর্গাও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ কলকাতা শহরের বুকে মহা ধুমধাম করে যে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় সেটাও তো একটা কৃষি উৎসবই। বোধনের দিন নবপত্রিকার প্রতিষ্ঠা ও পূজা তো তারই প্রমাণ।"

শিক্ষক মশাই আমার কথাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। ব্যঙ্গের একটা হাসি হেসে বললেন, "মুখে যা খুশি আসে বলে দিলেই হল! দেবী দুর্গা কে, আর কেনই বা তার আরাধনা সে কথা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। দুর্গা উৎসবকে 'কৃষি উৎসব' বলে একটা মনগড়া কথা বলে দিলেই হল! এমন গাঁজাখুরি কথা কে বলেছে?"

একটু হেসে বললাম, "ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, "প্রকৃতপক্ষে দুর্গা পূজা নবপত্রিকারই পূজা। অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নানা শাস্ত্রীয় ও পৌরাণিক উপকরণে আজ তা ভারাক্রান্ত ও জটিল হয়ে উঠলেও তার মূল উদ্দেশ্য সম্পদশালিনী ধরিত্রীরই পূজা (তুষু ব্রত ও গীতি সমীক্ষা/ ডাঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত, ভূমিকা অংশ, পৃষ্ঠা- ৫)। এছাড়াও দেবী চণ্ডীকে 'মার্কন্ড' পুরাণে 'শাকাম্ভরী' বলা হয়েছে। এই 'শাকাম্ভরী' শব্দের মানেও তো, যিনি শাক-সবজি দিয়ে নিজেকে ভরিয়ে রাখেন। সুতরাং কৃষি উৎসব কেবল জঙ্গলমহলেই প্রচলিত এমনটা কিন্তু নয়।"

উনি বললেন, "'জাওয়া', করমের সঙ্গে টুসু উৎসবের কি সেরকমভাবে কোন পার্থক্য আছে?"

বললাম, "মিলও যেমন আছে,  অমিলও তেমন আছে। মিল বলতে 'জাওয়া' ও 'টুসু' দুটোই হল মেয়েলি ব্রত উৎসব। আবার অমিল বলতে 'জাওয়া' হল শস্যের 'জন্ম' উৎসব, আর টুসু হল শস্যের 'মরণ' উৎসব। (ঝাড়খণ্ডের লোক সাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, পৃষ্ঠা ১৪৮।) কারণ 'তুষ' থেকে 'টুসু' শব্দটি এসেছে। এই 'তুষ' হল, মৃত ধানের প্রতীক।"

বললেন, "শস্যের 'মরণ উৎসব' মনে করা হয় কেন?"

"কারণ হল, মকরের দিন টুসুর বিসর্জন হয়। সেটা মৃত্যুরই প্রতীক। তাছাড়া শবদেহ নিয়ে যাওয়ার সময় যেমন খই ছড়ানোর রীতি আছে, টুসু ভাসানেও খই ছড়ানো হয়। কোথাও কোথাও যেভাবে টুসুর চৌডলকে চারজনে কাঁধে তুলে নিয়ে যায়, সেটাকেও অনেকটা চারজনে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতীকের মতোই মনে করা হয়।"

"তবে কি এটা শোক উৎসব?"

"না। এটা শোক উৎসব নয়। বরং অনেক বেশি প্রাণবন্ত আনন্দ উৎসব। আসলে মৃত্যুর পর শস্যের পুনর্জীবন বা নবজীবন লাভের কামনাতেই এমন আনন্দোচ্ছ্বাস ঘটে থাকে।"

"পুনর্জীবন বা নবজীবন লাভ কীভাবে?"

"আসলে টুসু পূজা হল তুষের পূজা। সেখানে একটি 'খলা' বা 'সরা'র উপর যেভাবে 'তুষ' দিয়ে তার উপর গোবরের নাড়ু, পিটুলিগোলা হলুদ জল দেওয়া হয় তাতে শস্যের নবজীবন লাভের প্রত্যাশাই করা হয়।"

"এখানকার মাটির তৈরি টুসুগুলো তো খুবই সুন্দর। একেবারে পুতুলের মতো।"

"টুসুর এই মূর্তি পূজার প্রচলন একেবারে আধুনিক। তাও সব জায়গায় নয়। ঝাড়গ্রাম সহ ধলভূমের কিছু এলাকায়, এমনকী বাঁকুড়া জেলার টুসুর 'কুম্ভ' মেলা বলে পরিচিত "পোরকুল" এও এখন এই মূর্তি পূজার একটা আধুনিক চল তৈরি হয়েছে। আগে কোন মূর্তি ছিল না। কেবল 'মাটির সরা', 'ছোট একটা কুন্ড', এবং 'বাঁশের ডালি' তার মধ্যে তুষ আর গোবরের নাড়ু এবং পিটুলিগোলা ছিটানো, উপরে কিছু গাঁদা ফুল ছড়িয়ে দেওয়া। চিরকাল এটাই হল টুসুর প্রতীকি রূপ। কোথাও আবার রঙিন কাগজ, সলা ও বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি করা চতুর্দোলা বা চৌডলও টুসুর প্রতীক রূপে ব্যবহৃত হয়। এখন মূর্তি পূজা হলেও তুষ, গোবরের পিন্ড এবং পিটুলিগোলা রাখতেই হয়। তবে এখনকার এই মূর্তি রূপটির আগমনের কারণ হিসাবে অনেকেই ভাদু মূর্তির প্রভাবের কথাই বলে থাকেন। তবে এই বিষয়ে 'পোরকুল' অঞ্চলে একটা "লোকগল্প"ও শোনা যায়। তুলসীচরণ মন্ডল মহাশয় "মুকুর" পত্রিকার ৩য় সংখ্যায় "পরকুল মেলায় টুসু" শিরোণামে একটি লেখায় সেই গল্প শুনিয়েছেন।"

"কী সেই লোক গল্প?"

বললাম, "অনেক আগে নাকি পরপর দু বছর দুটি মেয়ে স্নান করতে এসে ডুবে মারা গিয়েছিল। সেই ঘটনার পর অনেকেই মনে করেন যে, এবার হয়তো প্রতি বছর একটি করে মেয়ে জলে ডুবে মারা যাবে। এমন একটা সংস্কার মনের মধ্যে তৈরি হতেই মায়েরা এর পর একটি মাটির তৈরি পুতুলকে কন্যা রূপে পরকুলে নিয়ে গিয়ে স্নানের পর ডুবিয়ে দিত। পরবর্তী সময়ে এই মাটির পুতুলই নাকি টুসু বলে পরিচিত হয়।"


"কেবলমাত্র নারী পুরুষ সকলেই কি এই টুসু পূজা করে থাকেন?"

বললাম, "না। টুসু হল, মেয়েলি ব্রত। তাই কুমারী মেয়েরাই এই পূজা করে। কিন্তু গানে নারী পুরুষ সকলেই অংশগ্রহণ করতে পারে। এবং করেও থাকে। টুসু তাই কেবল শস্যের দেবীই নন, তিনি জঙ্গলমহলের মানুষের একান্ত আপনজনও। বিশেষত নারীদের কাছে তিনি তো মাতা, কন্যা, ভগ্নি, সহচরী, বান্ধবীর সমান। টুসুর এই মানবী রুপ টুসু গানে গানেও দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।

চলবে...
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments