পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব
পর্ব -৫১
পাটাবিন্ধা
ভাস্করব্রত পতি
"শ্রী ভৈরব সাড়া দেন গুড় গুড় রব।
পরগনার ভূমি জল কেঁপে ওঠে সব।।
বৈজ্ঞানিক তত্বদর্শী কোন কোন জন।
এ বাক্যে বিশ্বাস নাহি করে কদাচন।।
ভূমিকম্প বলি তারে করে উপহাস।
ওড়গোন্দা শ্রী কৈলাশ করেনা বিশ্বাস।।
যার নাম ভূমিকম্প সেই তো ভৈরব।
ভূমির ভিতরে থাকি করে মহারব"।।
শিলদার শিক্ষক অমরেন্দ্রনাথ মজুমদারের লেখা "রঙ্কিনী মাহাত্ম্য"তে বাবা ভৈরবের বিবরণে মেলে এক বিচিত্র ধারার লৌকিক উৎসবের সন্ধান। বিজয়া দশমীর পরের দিন ঝাড়গ্রামের বিনপুর ২ ব্লকের শিলদার ওড়গোন্দাতে ভৈরব থানে আয়োজিত হয় দুদিনের লৌকিক উৎসব 'পাটাবিন্ধা'। আদিবাসী সাঁওতালদের "কুম্ভমেলা" হিসেবেই বিখ্যাত এটি।
পাটাবিন্ধা' উৎসবের প্রকৃত নাম 'পাট্টা বিধৌ পরব'। এখানে 'পাট্টা' অর্থে নিজস্ব জমির দলিল দস্তাবেজ। যে জমি সম্পূর্ণ নিজের। অর্থাৎ এই মেলা একান্তভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনের নিজস্ব লৌকিক ঘরানার পরিচায়ক। ৭০ এর দশকে এই উৎসবের পরিচালনায় গঠিত হয় ১২ মৌজার আদিবাসীদের নিয়ে বিশেষ কমিটি। তখন যুক্ত হয় পাঁড়শুলি, লেদাশোল, চুয়াপাহাড়ি, মেছুয়া, কসমলা, কামারবান্দি, শ্যামপুর, রাজদহা, বড়আড়া, চম্পতি, বিরিডাঙ্গা এবং ডাকাইশোল গ্রামের আদিবাসীরা। পরে আরো ৫ টি মৌজা যুক্ত হয়ে ১৭ মৌজার বাসিন্দাদের কমিটি হয়।
'পাটাবিন্ধা' উৎসবের লৌকিক দেবতা হলেন বাবা ভৈরব। শিলদা থেকে বাঁকুড়া যাওয়ার পথে ডানদিকে মেলার মাঠ। ফাঁকা মাঠের মাঝখানে বাবা ভৈরবের থান। মাটি থেকে প্রায় সাড়ে চার ফুট উঁচু ত্রিরথ আকারের ভিত্তিভূমি। মাকড়া পাথরের তৈরি। অসম্পূর্ণ নির্মান। সেখানে গাছের নিচে দেবতার অধিষ্ঠান। সাঁওতালী ভাষায় আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি সারিধরম হাঁসদা জানিয়েছেন এই বাবা ভৈরবের অসম্পূর্ণ থানের পেছনে থাকা অলৌকিক কাহিনীর কথা। তাঁর কথায়, "কোন এক সময় জাগ্রত দেবতা বাবা ভৈরব, সাত রুক্ষ মাটিকে বেছে নেন। তাই রাতারাতি ওড়গোন্দার মাটিতে মন্দির গড়তে চেয়েছিলেন। দূর থেকে পাথর আনার জন্য গরু’র গাড়ী ব্যবহার করেন। কিন্তু মোরগ ডাকা ভোর সকাল হতেই সেই কাজ সফল হয়নি। সমস্ত পরিকল্পনা বিফলে যায়। থেকে যায় স্থাপত্যের নিদর্শন"। কথিত যে, বিশ্বকর্মা এই মন্দির নির্মাণে হাত লাগিয়ে ছিলেন।
বাবা ভৈরবের থানে যাঁরা পূজা করেন তাঁদের বলা হয় 'পাহান'। আড়াই ফুট উঁচু পোড়ামাটির খোলের ওপরে পোড়ামাটির ভীষন দর্শনের দেবতার মুখ। সেই মুখ কিন্তু খোলা বা হাঁ করা। দেবতার চোখ, মুখ, কান থাকলেও হাত বা পা নেই। একসময় নাকি এই বিগ্রহের ছিল সোনায় মোড়া দাঁত। যা পরবর্তীতে ইংরেজ লুঠেরারা লুঠ করে নিয়ে যায়। দেবতার মাথাতেও ছিদ্র রয়েছে। সকলের বিশ্বাস যে, এই ভৈরব থান আসলে কোনো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির একটা খোলা মুখ। ঐ মাথার খোলামুখ থেকে আগ্নেয়গিরির কিছু কিছু চিহ্নের সন্ধান মেলে। একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজ উছলে ওঠে সেখানে। আর পোড়ামাটির মূর্তি তথা বাবা ভৈরবের গায়ে সৃষ্টি হয় বিন্দু বিন্দু ঘাম। মানুষের বিশ্বাস যে, ঐ সময় বাবা ভৈরব মাটির তলদেশ দিয়ে মিলিত হতে যান রঙ্কিনী দেবীর সঙ্গে। যিনি একসময় স্থানীয় আদিবাসীদের বাঁচিয়েছিলেন মোঘলদের আক্রমনের হাত থেকে। এই 'গুরু গুরু' শব্দ উৎপাদনের ঘটনা ঘটে আশ্বিনের মহালয়ার পরে ষষ্ঠী থেকে সপ্তমীর মধ্যে যেকোনও একটি দিনে। আসলে এখানকার মানুষ মনে করেন, এই ভৈরব থানের সঙ্গে মুসাবনির রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরের মধ্যে গোপন সুড়ঙ্গ মাধ্যমে যোগাযোগ রয়েছে। আর রঙ্কিনী দেবী হলেন বাবা ভৈরবের শক্তি, তথা ভৈরবী। গুরু গুরু ডাক শুনলেই বাবা ভৈরবের মাথায় জল ঢালা হয়, শাঁখ বাজানো হয়।
যাঁরা মানত করে পূজা দেন এখানে, তাঁরা স্থানীয় বঁগা পুখুরি তথা দেবতা সৃষ্ট পুষ্করিণী বা ঠাকুরের পুকুরের জলে স্নান সেরে এসে বাবা ভৈরবের পূজা দেন। পূজার উপকরণ হল নারকেল, ধূপ, সিঁদুর, চাঁদমালা ইত্যাদি। মেলার সময় সারি সারি দোকান বসে যায় পূজার উপকরণ বিক্রির। মানতকারীরা মোরগ, পায়রা, ছাগলও বলি দেন।
কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের দশমীতে যদুবংশীয় বীরপুরুষ হুদুড়দুর্গাকে হত্যা করেন উচ্চবর্ণের নারী দুর্গা দেবী। প্রতারণা করেই হত্যা করা হয়েছিল তাঁকে। এই দেবী ছিলেন ‘দেবাংশী’ নারী। আসলে সে সময় লাল মাটির এলাকার সাঁওতালরা পরিচিত ছিলেন 'যদুবংশী' হিসেবে। এঁদের মহা বিক্রম নেতা ছিলেন বীর হুদুড়দুর্গা। আর উচ্চবর্ণের প্রতিনিধিরা পরিচিত ছিল ‘দেবাংশী’ নামে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল আদিবাসী তথা যদুবংশীয়দের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা। এসব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছিল হুদুড়দুর্গা। সেই হুদুড়দুর্গার সঙ্গে এঁটে ওঠার সাধ্যি ছিলনা দেবাংশীদের। তাঁরা তাঁদের বাদ্যযন্ত্র 'ভুয়াং'য়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতো অস্ত্র। আর যদুবংশীয় পুরুষরা মেয়েদের পোশাক পরে থাকতো ফাঁকি দেওয়ার জন্য। কেননা তাঁরা জানতো যে দেবাংশীরা মহিলাদের গায়ে কখনও হাত তোলেনা। তখন ছলেবলে কৌশলে হুদুড়দুর্গাকে হারানোর ফন্দিফিকির করতে শুরু করে দেবাংশীরা। সে সময় পরিকল্পনা মাফিক দেবতারা যাবতীয় শক্তি ও ক্ষমতা একত্রিত করে এক নতুন নারী শক্তির সৃষ্টি করে। হুদুড়দুর্গার বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে দেবতাদের সম্মিলিত সৃষ্ট নারী দেবীই দুর্গাদেবী। তিনিই মোহিনী রূপ ধারণ করে হুদুড়দুর্গার নিজস্ব পরিমণ্ডলে প্রবেশ করে ছলনার আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেন তাঁকে। সেইসাথে ঐ দেবাংশীরা নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে যদুবংশীয়দের। অর্থাৎ আদিবাসীদের। এই ভয়ঙ্কর এবং যন্ত্রনাময় ঘটনার স্মরণে আদিবাসীরা পালন করেন 'দাঁশায় পরব'। দুর্গাপূজার চারদিন ধরে পালিত হয় দুঃখের উৎসব 'দাঁশায়'। দশমীর দিন তাঁরা শোকপালন করেন। আর দশমীর পরের দিন একাদশী তিথিতে হয় 'পাটাবিন্ধা'। দ্বাদশীর তিথি সম্পূর্ণ ভাবে কেবল আদিবাসীদের দখলিকৃত থাকে। দুদিনের এই লৌকিক উৎসব আদিবাসীদের কাছে এক অনন্য ভালোবাসার এবং ভালো লাগার প্রতিভূ হিসেবে বিবেচিত হয়।
'পাটাবিন্ধা' মেলা কেন ওড়গোন্দাতেই হচ্ছে, তার কারণ সম্পর্কে গবেষক চিন্ময় দাশ লিখেছেন, "ওড়গোন্দার একদিকে মানভূম, অন্যদিকে সিংভূম। শিলদা বা ওড়গোন্দাকে ল্যাটেরাইট অঞ্চলের সূচনাভূমি বলা যায়। শিলদার পূর্বকালের নাম 'সাওন্তভূম' বা 'সাঁতভূম'। এখনও লোক 'সাঁতভূম' নামটি ব্যবহার করে থাকেন। সাঁওতাল জাতির অবস্থানভূমি হিসাবেই 'সাওন্তভূমি'। মেলার কেন্দ্রস্থলে অধিষ্ঠিত বাবা ভৈরবনাথ। আদিবাসীদের দাবি, ইনি আসলে সাঁওতাল আদিবাসীদের দেবতা মারাংবুরু। হুদুড়দুর্গার নিহত হবার পর বিদ্ধস্ত সমাজকে পুনর্গঠন করার লক্ষ্যে মারাংবুরুর থানে বছরে একবার মিলিত হতেন আদিবাসীরা। শারদীয়া শুক্লা একাদশী তিথিতে। নিজেদের সমাজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, সংহতি অটুট রাখতে সেই সমাবেশের সূচনা হয়েছিল হয়তো। কালক্রমে সেটি মেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। তরুণ তরুণী, যুবক যুবতীদের পারস্পরিক মেলামেশা, জীবনসাথী নির্বাচন, পারিবারিক স্বীকৃতি ও বিবাহ -- এসবই লক্ষ্য এই মেলার। একবার অন্তত অযোধ্যা পাহাড়ে শিকার পরবে যেতে হয় সব আদিবাসী যুবককে। যুবতীদের পাটাবিন্ধা মেলায়। কেবল সাবালকত্ব নয়, এর সাথে জড়িয়ে থাকে মর্যাদার অভিমান"।
আদিবাসীদের নিজস্ব এই লৌকিক উৎসবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বোধহয় এখানকার বইয়ের দোকানগুলি। অজস্র দোকান। অসংখ্য ক্রেতা। ৯৯% বই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে। মেলায় আগত মানুষজনের বই কেনার তাগিদ অবাক করার মতো। যেন বইমেলা! কলকাতা বইমেলা ছাড়া অন্য কোনো মেলায় এতো সংখ্যক বইয়ের সম্ভার দেখতে পাওয়া যায়না। ওড়গোন্দার এই পাটাবিন্ধা মেলা ছাড়া দেখা যাবে না কোথাও। অসংখ্য খাওয়ার হোটেল, আদিবাসী সম্প্রদায়ের ব্যবহৃত পোশাকের দোকান, মদ, হাঁড়িয়া, দড়ির খাটিয়া, তীর, ধনুক, টাঙ্গি, কুড়ুল, কেঁদরি, বাঁশি, ধামসা, মাদলের দোকান হাজির হয়ে যায়। সারা পশ্চিমবঙ্গ সহ ভিন রাজ্যের আদিবাসীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। দুদিনের মেলা। আছে নাচ গান খানা পিনা আর দেদার মজা। বড় বড় লাক্সারি বাস ভাড়া করে বহু দূরদূরান্ত থেকে আসেন মানুষজন।
এখানে দেদার বিকোয় মাংস পিঠে। ৫০ টাকা পিস। অসংখ্য খাওয়ার হোটেল। লাগামছাড়া মদ, হাঁড়িয়া, মহুলের অভাব নেই। সেইসাথে ডাঁই করা শতমূলী গাছের শেকড়। বাখর বড়ি তৈরির অন্যতম উপকরণ। একসময় এই মেলায় গনবিবাহ চালু ছিল। যা ছিল "রাজা রাজি" বিয়ে। এখন আর হয়না। আসলে বদলে যাচ্ছে মেলার চরিত্র। বদলে যাচ্ছে লৌকিকতার উপচার। বাবা ভৈরবের পূজোর শেষে হাতে হাত মিলিয়ে আদিবাসী ছেলে মেয়েরা বাঁশি, কেঁদরি, জয়ঢাক, ধামসা, মাদল, ঘড়ির শব্দকে মেখে কাঠিনাচ, পাতানাচ, দাঁশায় নাচের তালে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। এখানেই শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোয় তাঁরা খুঁজে নেয় মনের মানুষ। আসলে আদিবাসী মানুষজন নিজেদের ক্ষীয়মান অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দেবতার সামনে Life Partner বানানোর প্রথা চালু করে। এটি তারই অঙ্গ।
1 Comments
বা বেশ...এই ভৈরব কি বাঙলার আদি শৈব সংস্কৃতির শিব-লিঙ্গ মোটিফের প্রতিভু হতে পারে?...যা পরে পাথর ছেড়ে মানুষের মূর্তিতে ,শিব পার্বতীতে রুপান্তরিত হয়।
ReplyDelete