জ্বলদর্চি

অতল /সন্দীপ দত্ত

অতল

সন্দীপ দত্ত


সিগারেটের ভঙ্গিতে বিড়ি ধরাল সুচাঁদ। তারপর গত সাতদিনের জমে থাকা গালভর্তি পাকা দাড়িতে আলতো হাত বুলিয়ে রামেশ্বর মুখুটিকে বলল,"মনে তো অনেক প্রশ্নই ঘাই মারে বাবু। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি বলুন তো?"
        রামেশ্বরের ডান জঙ্ঘায় চামড়া কামড়ে গজিয়ে ওঠা কুলের বিচির মতো রাঙা ফোঁড়াটা সদ‍্য সদ‍্য ফেটেছে। কিন্তু ব‍্যথা এখনও মরেনি। রামেশ্বর আঙ্গুলের চুমো দিয়ে জায়গাটাকে ভালবেসে বললেন,"এক এক করে বল্। আমি আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেব। তুই শুধু সাহস করে করতে থাক।"
      তবু ভয় পায় সুচাঁদ। বুক কাঁপে। জিভ শুকিয়ে যায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবলে। চেহারাটা তার বোকা বোকা অথচ পেটভর্তি প্রশ্ন দিল ভগবান। জমে জমে ভেতরটা যখন আইঢাই করে,বের করলেই কেলেঙ্কারি। আজব গরো! "গরিব মানুষের অত প্রশ্ন কীসের রে? আসবি,খাটবি,মজুরি নিয়ে চলে যাবি। ব‍্যস,হ‍্যাপা শেষ। অত বিদ‍্যেবোঝাই বাবুমশাই হয়ে কী লাভ তোদের? পশু হয়ে জন্মেছিস,পশুর মতো থাক না। আবার মানুষের দিকে হাত বাড়াস কেন? মানুষের সঙ্গে তোরা পারবি?" জটাধরবাবুর কথাগুলো মনে পড়ে গেল সুচাঁদের। তখন সুচাঁদ জটার চালকলে বেগার শ্রমিক। পশুর মতো খাটে,কাজে ভুল হলে মালিকের লাথি খায় আর জটা তার সাংগঠনিক সভায় গাল ফুলিয়ে নির্মল হেসে বলে,"মানুষের মানসিকতায় সমতাটা যদি না থাকে,তাহলে সেটা সামাজিক দূষণ। গরিবদেরকে যদি আমরা মানুষ বলে জ্ঞান না করি,তাদের পাশে না দাঁড়াই,তাহলে সমাজের একটা বড় অংশ পিছিয়ে পড়ে। যা ভবিষ‍্যতের জন‍্য শুভ নয়। গরিবদেরকে মান‍্যতা দেওয়া আজকের দুনিয়ায় একটা বড় কাজ। টাকা যদি সবার কাছে না থাকে,তার ফল যে কী ভয়ংকর,কল্পনাও করা যায় না। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই এখন আমাদের প্রথম লক্ষ‍্য।"
চালকলের মালিক জটাধরের সেই চোখা চোখা ভাষণ শুনে সেদিন সুচাঁদ তার পায়ের তলায় মাটি পেয়েছিল একটু। ভেবেছিল সুদিন আসছে। খুব তাড়াতাড়িই বকেয়া মিটবে আর দৈনিক মজুরিও বাড়বে কিছুটা। কিন্তু কোথায় কী? অপেক্ষা করে করে ছ'মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর একদিন সাহস দেখায় সুচাঁদ। জটাধরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে,"গরিবদের জন্ম হয় কেন? এর জন‍্য সমাজের উঁচুতলার মানুষগুলো দায়ী নয় কি?"
       ব‍্যস,আগুন ধরে গেল সুচাঁদের মাথা গোঁজার চালাঘরটায়। ঘর পুড়ল,দোর পুড়ল,শালি ধানের ছোট্ট গোলা পুড়ল,আর পুড়ল তার বুকের একটা অংশ। যেখানটাতে বসত করত চম্পা। পুড়ে গেল সুচাঁদের পোয়াতি বউটা। সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে তখনও মাসখানেক বাকি। গাঁয়ের লোক তড়িঘড়ি হাসপাতাল নিয়ে গেলেও চম্পা বাঁচেনি। পেট কেটে ডাক্তার বিকলাঙ্গ শিশুটিকে হাতে তুলে দিয়েছিল সুচাঁদের। সেই শিশুও ছ'মাস পর মারা যায়। তারপর চালকলের কাজ গেল সুচাঁদের। বকেয়া তো পেলই না,উল্টে জটাধরই চোক রাঙিয়ে বলল,"জান চাস তো ভাগ এখান থেকে। ক'দিন কামাই করেছিস খেয়াল আছে? খুব হিসেব শিখেছিস,না? আমার লোকসানের হিসেব মেটাতে পারবি? সে হিম্মত আছে তোর?"
কলের সহকর্মি গোবর্ধন সুচাঁদকে বলল,"ভগবানের মার। সহ‍্য করা ছাড়া উপায় নেই গো!"
তিলক বলল,"গরিবদের কখনও প্রশ্ন করতে নেই। তাদের স্বরযন্ত্রের শিখাটা জন্মের পর পরই কমিয়ে দিতে হয়। ওটাই তো আকর। বড়লোকের সুখ আর গরিবের দুঃখ।"

জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
        সেই থেকে সুচাঁদ রামেশ্বর মুখুটির পায়ের তলায়। এখানেও সে শিং ভেঙে দেওয়া নিরীহ গরুর মতো মাথা নামিয়ে ঘাস খায়,ডানা কেটে নেওয়া বুলবুলির মতো শেখানো গান করে। খুব ছোটবেলায়,তার বয়েস যখন পাঁচ-ছ'বছর,মায়ের দুধ ছাড়বে ছাড়বে করেও ছাড়তে পারছে না,বাবা হরিময় একখান কথা বলেছিল তাকে। "মায়ের দুধ যতই চোষ বাপ,বুদ্ধি তোর কেড়ে নেবে বড়লোক। গরিবের গভ্ভে জন্মেছিস,গরিব বাপ তোর,মানুষ বলে মান‍্যি করবে কি? এ সমাজে মেয়েমানুষ আর গরিবমানুষ,শব্দদুটোর অত দমভারি কেন জানিস? আসলে,দুর্বলের ওটা হল ঢাল। মানুষ। ঐটুকু বলেই সমাজ যেন দায় সেরে দেয়। ধনীদের কাছে মেয়েরা আর গরিবেরা কখনও মানুষ হতে পারে কি?"

        বাবার কথা মনে পড়লে আজও চোখে জল আসে সুচাঁদের। হক কথাই বলেছিল বাবা। এ পৃথিবীতে যার যত টাকা,তার তত আয়েশ।তাদের কাছে মেয়েরা আর গরিবেরা হয়ে যায় পদার্থ। মেয়েদের নিলাম হয় শরীর আর গরিবের শ্রম। এখানে এসেও তাই সুচাঁদের শোষণই জুটল। রামেশ্বরের হাতির মতো শরীর। সে শরীরে রোজ তেল মাখাতে হয় সুচাঁদকে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ,দলাইমলাই করতে হয় নিয়ম করে। বর্ষার ছাতি,রোদ্দুরের ছায়া,সুচাঁদ যেন যন্ত্র।আর চাকাকে ঘোরনোর জন‍্য সেই যন্ত্রের তেল হিসেবে মজুরি নয়,সামান‍্য মাড়ভাত। তা-ই খেতে পারেনা সুচাঁদ। বউ চম্পাকে মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার ছোট্ট চালাঘরটা। ছোট হলেও যেটা তার নিজের ছিল। ভিটেমাটির সাথে আর মনে পড়ে তার শালি ধানের ক্ষেতটাকে। সুচাঁদের সেই জমি এখন বন্ধ‍্যা। মাটি ফেটে চৌচির,ফলন নেই। যোনিদেশ খুবলে খুবলে ঘা করেছেন রামেশ্বর। আর ক'দিন পরেই ও জমিতে হিমঘর বানাবেন তিনি। জমিটা জোর করেই কেড়ে নিয়েছেন রামেশ্বর। "তুই একা বোকা মানুষ। জমি জিরেত নিয়ে শুধু শুধু ল‍্যাজেগোবরে হয়ে কী লাভ তোর? বরং ওটা আমায় লিখে দে সুচাঁদ। তোর সারাজীবনের ভার তো নিলুমই।"

সুচাঁদ কতবার বলেছিল,"জমিটাতে ফসল ফলান বাবু। ওতে শালি ধান ভাল হয়। মা আমার শালি ধানের পিঠে বানাতো পৌষে। কী তার সোয়াদ!"
রামেশ্বর বলেন,"আজগুবি গল্প বলবার আর লোক পেলিনা সুচাঁদ? তোর ঐ বন্ধ‍্যা জমিতে আমি কী চাষটা করব শুনি?"
এসব ভাবলেই পেটটা ছোট হয়ে আসে সুচাঁদের। খিদে হারিয়ে যায়। সাশ প্রশ্মানন‍্য মাড়ভাতটুকুও পড়ে থাকে অনেকটা। 

        সেই রামেশ্বর আজ সুচাঁদকে বললেন,"প্রশ্ন কর।" 
          প্রশ্নের কথা শুনলেই ইদানিং দুরুদুরু করে বুক। গরিবরা প্রশ্ন করলেই যে এ পৃথিবীর বড়লোকদের নাভিশ্বাস ওঠে। তবু মনিবের কাছে সাহস পেতেই সুচাঁদের আবার সেই পুরনো স্বভাবটা ফিরে এল। রামেশ্বরকে সে জিজ্ঞেস করল,"আচ্ছা বাবু,বন্দিজীবন আর বন্ধ‍্যাজীবনের যন্ত্রণা কি এক?"
"মানে?" চমকে গেলেন রামেশ্বর। "তোকে আমি এইসব জিজ্ঞেস করতে বলেছি?"
"বলুন না বাবু?" সুচাঁদ নাছোড় হয়।
"বন্ধ‍্যাজীবনের যন্ত্রণাই বেশি। গর্ভ নষ্ট করলে ফলন কমে। ফলন কমলে জীবন হয়ে ওঠে উরাট। উরাট বিবর্ণ। চোখের জলের মতো। দুঃখের গভীরতা যেখানে মাপা যায় না।"

         শিশুর মতো কাঁদে সুচাঁদ। বুড়ো অথর্বের মতোন ভীষণ একা লাগে নিজেকে।

Post a Comment

0 Comments