জ্বলদর্চি

বড়াম পূজা / ভাস্করব্রত পতি

বড়াম পূজা / ভাস্করব্রত পতি 



পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫৬

বড়াম পূজা

ভাস্করব্রত পতি 

বড়াম ঠাকুর তথা বড়াম দেবী হলেন মানুষকে রক্ষা করা পশুদেবী। তিনি বাঘের পিঠে চড়ে যাতায়াত করেন। আর বন্য শ্বাপদদের হাত থেকে গৃহপালিত জীবজন্তুদের রক্ষা করেন। দেবী চণ্ডীর মতোই উপাসকদের ধনসম্পদ প্রাপ্তির সুযোগ এনে দেন। 

মূলতঃ জঙ্গল সীমান্তবাংলা তথা ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় বড়াম ঠাকুরের পূজার চল রয়েছে। পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলাতেও পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় এই দেবীকে। কোথাও বড়াম চণ্ডী, কোথাও ষাড়ম চণ্ডী, আবার কোথাও বড়াম বুড়ি, চড়াম বুড়ি, বড়াম মাঈ বলা হয়ে থাকে। কোথাও বা গরাম থানও বলে। আসলে গ্রামের থান থেকেই গরাম থান (গ্রাম> গরাম)। গ্রামের প্রধান দেবতা হিসেবে পূজিতা হন বড়াম ঠাকুর।

বড়াম হল গ্রাম দেবতা। যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তি পূজা দিতে পারে। সারা সপ্তাহ পূজা হতে পারে কিংবা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনেও পূজা হতে পারে। তবে পৌষ সংক্রান্তির দিন পূজা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। এই উপলক্ষে ঘুড়ি ওড়ানোর চল আছে মেদিনীপুর শহরে।

ঝাড়গ্রামের আঁধারিয়া গ্রামে চলছে বড়াম ঠাকুরের আরাধনা। ছবি -- সঙ্গীতা সাহু

বড়াম ঠাকুরের অবয়বে তিন ধরনের পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগই বড়াম বলতে গাছের গোড়ায় থাকা বিভিন্ন আকারের মাকড়া পাথরের খণ্ড। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের আকৃতি থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা থাকে না। সেক্ষেত্রে চোখ এঁকে দেওয়া হয়, মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়। কল্পনায় বুঝিয়ে দেওয়া হয় এ পাথর খণ্ডের নিচে থাকা ছোট পাথরের টুকরোটি আসলে বাঘের মূর্তি। এই মূর্তির সাথে থাকে পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া। আরেক প্রকার বড়াম ঠাকুরের অবয়ব হল কোনো উঁচু স্থানে রাখা বড় বড় হাতি ঘোড়ার মূর্তি। একেই বড়াম জ্ঞানে পূজা করা হয়। তৃতীয়ত ইদানিং বড়াম ঠাকুরের নারীমূর্তি বানানো হয়েছে। কোথাও পূর্ণাবয়ব, কোথাও বা আবক্ষ মূর্তি। ঠিক যেন দেবী দুর্গা। যাকে বলা হয় বনদুর্গা। কোথাও বাঘের পিঠে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন দেবী অথবা বাঘের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অথবা দেবীর পায়ের তলায় শায়িত দুর্দমনীয় শার্দুল। তাঁর ডান হাতে কাটারি এবং বাম হাতে গাছের ডাল। হাতে কঙ্গন। তৃতীয় নয়নও পরিলক্ষিত হয় দেবীর কপালে। শিবের ত্রিশূলও বড়াম থানে একসাথে রয়েছে কিছু এলাকায়। আসলে দুর্গার সাথে শিবের অবস্থান বোঝাতে এহেন উপস্থিতি।

বড়াম ঠাকুরের পূজা করেন সাঁওতাল ও লোধারা। এই পূজারীদের বলা হয় 'লায়া' বা 'দেহরি'। এছাড়া পূজা করতে দেখা যায় ভুঁইঞা, কাহার, ঘাসি, ডোম, খাঁটি, কোঁড়া, মাল, মাহালি, মাঝি, ঘড়িয়াল, খেড়ে, বাউরী, খয়রা, কদমারা। এইসব দিনদরিদ্র মানুষজনের উপাস্য দেবতা এই বড়াম ঠাকুর। বহু বর্ণহিন্দুদের দেখা গেছে বড়ামের পূজা করতে। এঁদের মধ্যে যাঁরা পূজা করেন তাঁরা 'শুকুল' বা 'মঙ্গল' পদবীর ব্রাম্ভণ। এনারা কিন্তু শাক্ত দেবীর পূজার্চনা করেননা। এঁরা দেবীর কাছে বলী দেননা। এঁদের কাছে দেবী চণ্ডী বা জয়দুর্গা হিসেবেই পূজিতা হন। গ্রামের মুখিয়া বা মুখ্যারাও পূজা করে থাকেন। বংশপরম্পরায় পূজকদের পূজা করার রেওয়াজ রয়েছে।

মেদিনীপুর শহরের আনাচে কানাচে বহু স্থানে বড়াম দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। সাঁওতাল, ভূমিজ, লোধারাই বড়ামের পূজারী হলেও ইদানিং অবশ্য অন্যান্য উচ্চ বর্ণের মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। মূলতঃ পৌষ সংক্রান্তির রাতে পূজা হয়। তেমন কোনো অভাবনীয় লৌকিক প্রথা না থাকলেও একদম ঘরোয়া ভাবেই আরাধনা করতে দেখা যায় বিভিন্ন যায়গায়। মদ, হাঁড়িয়া, মহুল খেয়ে রাতভর চলে নাচগান।

গ্রাম্য এলাকায় এখনও প্রাচীন রীতিনীতি অনুসৃত হলেও আধুনিকতার প্রলেপ পড়েছে শহরাঞ্চলে। এ প্রসঙ্গে ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যার বিশ্লেষণ উল্লেখযোগ্য - "শহরাঞ্চলের প্রতিমা পুজোয় বড়াম দেবী কিছুটা পৌরাণিক দেবদেবীর মত মর্যাদা পাচ্ছেন। তথাকথিত ব্রাহ্মণ পূজারী কিছু কিছু মন্ত্রও ব্যবহার করছেন। যেখানে বর্ণ ব্রাহ্মণের পুজো, সেখানে বড়ামদেবী চণ্ডী, দুর্গা, জয়দুর্গা প্রভৃতি আর্য দেবতার ধ্যানে পুজিত হচ্ছেন। এখানে আদিবাসী রীতি নীতি অনেকটাই বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে মূর্তি পুজোয় ব্রাহ্মণেতর ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে। তাই কোনো কোনো থানে। পরিপূর্ণ আমিষ কিংবা সম্পূর্ণ নিরামিষ উপচারও দেখা যাচ্ছে। অনেক থানেই বলি হয় না, মদ ব্যবহৃত হয় না, এমন কি চাল ভাজা, কলাই ভাজারও ব্যবহার নেই। এ সব ক্ষেত্রে আদিবাসী নৃত্যের প্রসঙ্গই নেই। পরিবর্তে শহুরে মাইক, ব্যাণ্ডপাটী ও আধুনিক নৃত্যের আসর জমে ওঠে। এ সব থানের পুজোর নৈবেদ্য উচ্চহিন্দুর পুজোর মতোই। এমনকি হোম যাগও হচ্ছে।" 

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এই বড়াম পূজায় কোনো মন্ত্র বা লৌকিক বিধান নেই। শাস্ত্রীয় অনুধাবন নেই। স্রেফ বিশ্বাস, ভক্তি আর শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে পালিত হয় পূজা। তবে ইদানিং ব্রাম্ভণ্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে এই আদিবাসী সংস্কৃতিতে। ফলে উধাও হয়ে যাচ্ছে আদিবাসী রীতিনীতি। মেদিনীপুর শহরে এক বড়াম ঠাকুরের পূজায় উচ্চারিত হয় মন্ত্র -- "ওঁ দেবীং মাতরং নিজমদাঘূর্ণং ত্রিলোচনা; দ্রষ্ট্রোভীমমুখীং জটালিবিলসং মৌলীক পালা জম্। বন্দে দেবীং বড়ামং মাতরং ব্যাঘ্রবাহনাং বনদুর্গাং সর্বকাম সমৃদ্ধি দাম ৷৷ নবযৌবনসম্পন্নাং মঙ্গলচণ্ডীকায়াং শুভাননাং। দেবীং শ্রী শ্রী বডামচণ্ডীং ত্রিভুবনসুখপ্রদাং নমো। ওঁ নমো বড়ামচণ্ডীকায়ৈ নমো।” স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, দিন বদলের সাথে সাথে মানুষের লৌকিক ঘরানারও পরিবর্তন ঘটছে। গাছের তলাতেই অবস্থান বড়াম ঠাকুরের। ফলে পূজাও হয় গাছের তলায়। বড়াম ঠাকুরের পূজায় সবাই যোগদান করতে পারেনা। কোথাও কোথাও বড়াম থানে পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া দেওয়া হয়। শুয়োর, ছাগল, মুরগি বলিও করা হয়। শুয়োরের মাথার মাংস নিয়ে মদে ডুবিয়ে উৎসর্গ করা হয় দেবীকে।

ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা এই পূজার আচার অনুষ্ঠানের বর্ণনায় জানিয়েছেন, "সর্বত্রই বার্ষিক পুজোর দিনে বড়ামকে নৈবেদ্য দেওয়া হয় পবিত্র হেড়ে, তাড়ি বা মদ। তার সঙ্গে থাকে টানামিঠাই, পার্টিগুড়, চিঁড়ে, মুড়ি, কলাই ভাজা, জনুর ভাজা প্রভৃতি। এর সঙ্গে পাঁঠা, হাঁস, মুরগী, পায়রা, কপোত প্রভৃতি কোনো না কোনো পশু পাখি প্রতিটি থানেই বলি হয়। কোনো কোনো থানে হয় ভেড়া কিংবা শূকর। এর সঙ্গে বড়াম পুজোর প্রধান যে অঙ্গ নাচ-গান-বাজনা— যা আগের সন্ধ্যা থেকেই আরম্ভ হয়ে যায় গ্রামে গ্রামে। পুজোর দিনে নরনারী মিলিতভাবে বিচিত্র সব নাচ করে গান ও বাজনার তালে তালে। বার্ষিকী পুজোয় গ্রামের বয়স্কেরা প্রায় সকলেই শুদ্ধাচারে থাকে। পুজো না হওয়া পর্যন্ত অনেকেই নির্জলা উপোস করে। পূজান্তে তাঁরা মদ বা হেড়ে পান করে ও নাচগানে মেতে ওঠে। কোনো কোনো থানেই পুজোর বলির মাংস রেঁধে মদের চাট করা হয়। কোথাও বলির সামান্য মাংস রান্না করে মদের বোতলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং দেবীকে নিবেদন করেই তা ভক্তরা গ্রহণ করে। এই সব থানে কোনো কোনোটির আচার অনুষ্ঠান লক্ষ্য করবার মতো—থানের পার্শ্ববর্তী কোনো নদী বা ঝরণা বা জলাশয় থেকে হাতি ঘোড়া নাচিয়ে শোভাযাত্রা করে বারি বা ঘট আনা হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ সকলেই যোগ দেয়। কোনো কোনো থানে পূজারী বা কোনো ভক্তের ঝুঁপার বা ভর না হওয়া পর্যন্ত ঘাটে বারি তোলা হয় না। কোনো কোনো থানে পূজান্তে খিচুড়ি ভোগ পাতা পেড়ে দল বেঁধে খাওয়া হয়। তাতে বর্ণ হিন্দুদের কারো কারো নিমন্ত্রণ থাকে।"

কিন্তু কিভাবে এলো এই শব্দটি? ড. মোহিনী মোহন মাইতি উল্লেখ করেছেন, "সৃষ্টিকর্তা মহাবিষ্ণু ব্রম্ভাণ্ড সৃষ্টির পর জীবের সৃষ্টি করেন। প্রথম জীব ব্রম্ভার সৃষ্টি হয় তাঁর নাভি পদ্ম থেকে। তারপরে সৃষ্টি হয় বিষ্ণু এবং মহেশ্বরের। অতএব বয়সের দিক থেকে ব্রম্ভা হলেন বড় (Elder)। আমার মনে হয় সেই বড় শব্দের রূপান্তর হয়ে বড়াম শব্দের উৎপত্তি। কারণ ব্রম্ভা ঠাকুরের পূজা এখনও অনেক যায়গায় দেখা যায়।" তবে 'বড়াম' নামকরণ হয়েছে বলা যায় 'বুড়ি' থেকে। যেহেতু এটি মহিলা দেবতা। গ্রামের মানুষ তাঁদের পোষা গৃহপালিতদের বাঁচানোর জন্য শরণাপন্ন হত বয়স্কা তথা বুড়ি দেবীর কাছে। তাই 'বড়াম' নামকরণ।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

0 Comments