জ্বলদর্চি

যে কথা রেখে এসেছে বালক - জন্মান্তর/শুভদীপ মাইতি

যে কথা রেখে এসেছে বালক - জন্মান্তর

শুভদীপ মাইতি

১.

যে কথা রেখে এসেছে বালক, পূর্ব জন্মে
তার সমস্ত উঠোন জুড়ে লবনাক্ত ঢেউ।
সে ভালো নেই মজে যাওয়া জুনপুটের মতো।
কি ভীষণ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে ভেতরে ভেতর।
ওপরে যিনি নিদান লিখে রেখেছেন
সেই মহামান্য জানেন,
ঝাপসা চোখে বান্দ্রা স্টেশনের দিকে
মাথা নিচু করে ফিরে আসা এক জাতিস্মর;
শুধুমাত্র প্রিয় মানুষের জন্য
কিভাবে প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে, পুড়ে পুড়ে যাচ্ছে;
কি ভীষণ অনুভব, কি ভীষণ শূন্যতা ঘিরে ধরছে,
সে ততো বেশি আঁকড়ে ধরছে প্রিয় মানুষের স্মৃতি।

প্রিয় মানে― সবচাইতে আপন, যে প্রশ্বাসে থাকে ছুঁয়ে।
প্রিয় মানে বুকের ভেতর জারন, চোখে হারানো, তার ভাবনাতেই ডুবে থাকা।
প্রিয় মানে সেই― যার জন্য অপেক্ষা করা যায় হাজার হাজার বছর।

যে কথা রেখে এসেছে জাতিস্মর, পূর্ব জন্মে–
সে জানে, একদিন ঠিক মনে পড়বে। ফিরে আসবে প্রিয়।


২.

জাতিস্মর এক অভিশাপ। চোখের জলে বাড়তে থাকা একটি লবন হ্রদ।
শাপমোচন কিভাবে হয় জানা নেই বলেই, কি ভীষণ শূন্যতায় একা;
বুকের ভেতর মোচড় মারে খাঁ খাঁ ময়াল হাইওয়ে।

প্রিয় মানুষটি প্রতিটি খাঁজে রেখে যাচ্ছে মিথ্যে, চকমকি পাথর
তারপর মুহুর্মুহু বিচ্ছুরণ, আগুন।
এতো ঘৃণা, এতো তঞ্চকতা, মূক ও বধির ধীরে ধীরে পেরিয়ে যাচ্ছে সাঁকো।

জাতিস্মর এক দৃঢ় কঠিন আয়না
জন্মান্তরের মাঝে, ভেতর ও বাহিরে কি নিদারুণ ভেঙে যাওয়া।
জাতিস্মর এক অপেক্ষার নাম। সারাটি জীবন অভিমানে থাকা চিরহরিৎ অরন্য।

চরাচর মায়াজন্ম ভেসে যাচ্ছে গোধূলি বেলায়।
আঁকড়ে ধরছে প্রিয়মুখ, পিছুটান, গভীর অনুভব।

একটি শিকড় শুধু, সাঁকো ছুঁয়ে, সংযোগ ছুঁয়ে থেকো প্রিয়।


৩.

জন্মান্তর আসলে গৌতম দিঘীর মতো,
বারোমাস তার থৈ-থৈ জল।
পূর্ব জন্মের প্রেমিকা যেন টোই-টোই কিশোরী,
পাগলি অথবা ক্ষেপি কিছু একটা হবে।
এই যে ইথার সম্পর্ক, দিঘীটির শান্ত জলের মতো,
লীলাবতী হসপিটালের সেই রহস্যময়ী রমনীটি–
তার দীঘল চোখের চওড়া কাজলের মতো।

সে যেন এই আছে, এই নেই
এই নেই, এই আছে।

একদিকে কখন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাঁধ ভাঙে, নোনাজল ঢুকে আসে,
কখন মহারাষ্ট্রের শৈলশিরায় ধ্বস নামে, জুহু বিচে ভেসে যায় মৃত স্বপ্নরা।

গত জন্মের কথা মনে থাকা, একটি সাংঘাতিক মারণ রোগ,
যার কোন চিকিৎসা নেই।
পরিত্রাণ বলতে একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া, নড়বড়ে সাঁকো।

জাতিস্মর― একটি অদৃশ্য জলন্ত চিতা। কান পেতে শোন, তার কলজে,
করোটি ও যাপন ফাটার শব্দ।
প্রতিটি নিদ্রা হীন রাত্রিতে ভিজে যাচ্ছে বালিশ।

প্রিয় মানুষটি জানেই না,
সমুদ্রের ঢেউ একসময় দূরে সরে গেলেও;
আবার সে ফিরে আসে কাছে।

আসলে গৌতম দিঘি একটি উপন্যাসের নাম হতে পারতো,
শুধু এক জাতিস্মরের জন্য সে উপন্যাস হতে চায়নি।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

৪.

পাহাড় ছুঁতে যাবে বলে এক জোড়া মন বাড়িয়ে রেখেছিল পা,
কতো আয়োজন ভেতরে ভেতরে আঁকা হয়েছিল
প্রিয় মানুষটির জন্য।

কুয়াশা ঘেরা সকালে, ঝিম মেরে থাকে খেজুর রসের গন্ধ মাখা অজানবাড়ির হাট;
চিতি সাপের মতো সরু একটি রাস্তা চলে যায় মতিলাল চকের দিকে।
দু'শো বছর আগের জমিদার শিবপ্রসাদ যেন ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
আমি তার আওয়াজ পাচ্ছি, অনুভব করছি জন্মান্তর, স্পর্শ করছি কি ভীষণ অভিমানে ভারি হচ্ছে বাতাস।

প্রতি রাতে কোনো এক প্রেমিকের অশরীরী কানে কানে বলে যায়, চলে যেতে; প্রিয় মানুষের কাছে।
আমি রাতের আকাশে তারাখসা দেখি। আসলে প্রতিটি উল্কা ভীষণ অযত্নে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নাম।
যে নামে শুধু জমে থাকে কান্না ও চাবুক।

পাহাড় ছুঁতে চাওয়া সেই একজোড়া মন, সত্যি কি এখন আর বাড়িয়ে রাখেনি পা!
দুটি শরীর কি মিশে যেতে চায়নি ভেতরে ভেতরে!

প্রিয় শুধু এক বার মন থেকে বলো―
তুমি ভালো নেই।

৫.

আর কতো ফিরিয়ে নেবে মুখ, আর কতো অস্বীকার প্রিয়!
ভেতরে যে দাবানল, আচমকাই পুড়ে যাই যদি,
তার আগে পুনরায় আদরে সোহাগে বুকে টেনে নিও।

সাময়িক প্রেম নয়, এ বুকে আজীবন আগলে রেখেছি তোমায়।
প্রতিটি রাত্রিতে একটি ক্লান্ত তুমি অবয়ব
আমার কাঁধের ওপর মাথা রেখে শোয়।

কেনো কথা দিয়েছিলে, কতো স্বপ্ন দেখিয়েছ তুমি।
যতোই কঠোর হও, যতো ঘৃণা দাও প্রিয়মুখ,
ফেলে রেখে তোমাকে যাবোনা কোথাও, এক পাও আমি।

বেশি তো চাইনি কিছু, প্রতিটি জন্মে যেন কৈশোরে তোমাকে খুঁজে পাই।
হাজার জন্ম জুড়ে খুঁড়ে দেখো বুক― শুধু তুমি
কিছুই তো চাইনি শুধু এভাবেই ছুঁয়ে থাকতে চাই।

আর কতো কঠোর হবে বলো, আর কতো অস্বীকার প্রিয়!
জন্মান্তর কপালে রেখে, সত্যি যদি  ওপারে চলে যাই
আমার বুকের ওপর, তোমার অশ্রু বিন্দু একটি রেখে দিও।

৬.

একটি দীর্ঘ দূরত্বের সম্পর্কে বড্ডো বেশি ঝরে পড়ছে পাতা।
প্রতিটি মাঝ রাতে প্রিয়র নামের পাশে সবুজ আলোটি জ্বলে থাকে।
বারবার সেদিকেই চলে যায় চোখ। আরও বেশি মহাশূন্য গিলে নিতে চায়।

এ জীবন তোমার নয়, এ ঘর তোমার নয়, এই সংসারে কেউ নও তুমি।
তুমি শুধু পরিযায়ী পাখিদের বুক থেকে খসে পড়া একটি পালক।
মরণোত্তর জীবন ও পূর্বজন্মের মাঝখানে গেঁথে থাকা শিকারের টোপ।

সংগোপনে যে চোরাবালি, মুঠোফোনে দৃশ্যমান সংলাপে প্রিয়র হলুদ আতা ফল, গোলাপী গিরিখাত;
প্রিয়কে দেখিয়েছো তুমিও কৃষ্ণসর্প ফণা, মোবাইলে শিৎকার তুলে;
দুটি আত্মা শান্ত হতো, রাত্রি জুড়ে গাঢ় হতো নগ্নতা এবং কামড়।

প্রতিটি জন্মে তোমায় পেয়েও কেন যে হারাই বারেবার।
এ জীবন উৎসর্গীকৃত তোমায় হে রাঙা বউ
প্রতিটি প্রশ্বাস, অনুভবে কি ভীষণ ছুঁয়ে আছো তুমি,
ফিরে এসো, ফিরে এসো পাগলি আমার আগের মতোই আদরে আবার।

৭.

প্রতিটি সন্ধ্যে মানে, বুকের ভেতর বয়ে যাওয়া শীতল বাতাস। চারিয়ে যাচ্ছে দুব্বো।
মাঝরাতে সমস্ত শরীর জুড়ে দাহ। একটি ভাঙা কম্পাস। একশ তিন ডিগ্রি জ্বর।
নগর বাউলের সুর হাত বুলিয়ে দেয় কপালে। আমি ভাবি প্রিয় আমার বসে আছে মাথার কাছেই। আমি ভুল বকতে বকতে, প্রিয়কে খুঁজতে থাকি। হারিয়ে যাই। অতঃপর ঘুম।
কি ভীষণ সেই ঘুম। গৌতম দিঘীর কালো জলের মতো গভীর সেই ঘুম।
স্বপ্নে দেখছি পাড়ার ছদ্মবেশে আমায় সাজিয়ে দিচ্ছো তুমি।
আমি যিশুর মতো ছড়িয়ে রেখেছি হাত, কতো সাবলীল
তুমি পেরেক ঠুকছো হাত, বুক,কপালে, গলায়।
অসহ্য যন্ত্রণা আমার শরীর জুড়ে। আমি তবুও মুখে কিচ্ছুটি বলছিনা।
মনে মনে শুধু বললাম, হে প্রভু ওকে ক্ষমা করো।

দেবায়ুষ আজ জিজ্ঞেস করলো 'বাবা জাতিস্মর মানে কি'?
আমি কিছু বলার আগেই, কোন এক অদৃশ্য ঠোঁট ফিসফিস আমার কানে বললো, 
জাতিস্মর মানে― গুঁড়ো জোনাকি আলো, চোখে ছুঁইয়ে গেছেন ঈশ্বর।

Post a Comment

1 Comments