জ্বলদর্চি

নূতন শিক্ষা নীতি ২০২০ (NEP- 2020) - কিছু প্রশ্ন /পর্ব-৫/অধ্যাপক সজল কুমার মাইতি

নূতন শিক্ষা নীতি ২০২০ (NEP- 2020)- কিছু প্রশ্ন 

অধ্যাপক সজল কুমার মাইতি

পর্ব - ৫ 

উচ্চ শিক্ষা 

উচ্চ শিক্ষায় GER বা মোট নিবন্ধীকরণের অনুপাত ২০৩৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ অব্দি বৃদ্ধি করতে হবে
নূতন শিক্ষা নীতির অন্যতম উদ্দেশ্য হল উচ্চ শিক্ষায় মোট নিবন্ধীকরণের অনুপাত (GER) বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এবং তা ২০৩৫ সালের মধ্যে বৃত্তিমূলক শিক্ষা সহ ৫০ শতাংশে পৌঁছতে হবে। ২০১৮ সালে এই অনুপাত ছিল কেবল ২৬.৩ শতাংশ।

বৌদ্ধিক বহুমুখী বিষয় শিক্ষা 

শিক্ষা নীতিতে কলেজ লেভেলে বহু বিষয় শিক্ষার জন্য একত্রীকৃত বিজ্ঞান, কলা, মানববিদ্যা,গনিত ও পেশাদারী শিক্ষার সুযোগ থাকবে। সঙ্গে কল্পনাকারী ও নমনীয় পাঠক্রমের ব্যবস্থা থাকবে। সৃজনশীল পাঠ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার যোগবন্ধন ও বহুমুখী প্রবেশ ও প্রস্থানের সুযোগ ও থাকা জরুরি। একটি বৌদ্ধিক ও বহুমুখী বিষয় শিক্ষা চৌখস ব্যক্তি তৈরিতে সাহায্য করবে। এই ব্যক্তিরা একবিংশ শতাব্দীর যোগ্য সকল ক্ষমতার অধিকারী হবে  যাতে তারা কলা, মানববিদ্যা, ভাষা, বিজ্ঞান,সমাজ বিজ্ঞান, পেশাদারী শিক্ষা, কারিগরিবিদ্যা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুনাবলী সম্পন্ন হবে। এর ফলে সামাজিকভাবে যুক্ত হওয়ার দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পায়, সূক্ষ দক্ষতা যেমন যোগাযোগ ক্ষমতা, আলোচনা ও যুক্তিতর্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কোন এক পছন্দের ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রগুলিতে বিশেষত্ব অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধি পায়।

ডিগ্রী শিক্ষা তিন কিংবা চার বছরের জন্য হবে। এরমধ্যে বিভিন্ন পয়েন্টে বহুমুখী প্রস্থানের সুযোগ থাকবে। তার জন্য  উপযুক্ত সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা ও থাকবে। কোনো একটি বিষয় বা ক্ষেত্রে এক বছর সম্পূর্ণ করার পর সার্টিফিকেট দেওয়ার সুযোগ থাকবে। এমনকি বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও পেশাদারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ও। এছাড়া, দুবছর শিক্ষা শেষে একটি ডিপ্লোমার ও ব্যবস্থা থাকবে। অথবা, তিন বছরের শিক্ষান্তে একটি ব্যাচেলার ডিগ্রির ও ব্যবস্থা থাকবে। চার বছরের ব্যাচেলার প্রোগ্রাম অধিক পছন্দসই,  কেননা এখানে ছাত্ররা তাদের পছন্দসই মূল ও আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নজর দিতে পারবে। এছাড়াও তারা বৌদ্ধিক ও বহুমুখী বিষয় শিক্ষায় অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পাবে। একটি Academic Bank of Credit (ABC) তৈরি করা হবে। প্রতিটি স্বীকৃত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের অর্জিত academic score এই ব্যাংকে ডিজিটাল উপায়ে জমা থাকবে। এর পরে যখন কোন ছাত্রকে ডিগ্রি প্রদান করা হবে তখন এই স্কোর মোট স্কোরের হিসেবের মধ্যে ধরা হবে। 

বৌদ্ধিক ও বহুমুখী বিষয় শিক্ষার জন্য সরকারি মডেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। বহুমুখী বিষয় শিক্ষা ও গবেষণা বা Multidisciplinary Education and Research Universities (MERUs) প্রতিষ্ঠা করা হবে সারা দেশে যাতে সর্বোচ্চ মানের বহুমুখী বিষয় শিক্ষাদান করা যায়।

বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে যাতে সর্বোত্তম শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা যায় যার ফলে প্রতিটি ছাত্রই সফলতা পায়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের পাঠক্রম, বিদ্যাচর্চা ও মূল্যায়ন বিষয়ে উদ্ভাবনকারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। উচ্চ শিক্ষার যোগ্যতা মান নির্ধারণের বৃহত্তর ক্ষেত্রে যাতে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে সামঞ্জস্য বজায় থাকে সেদিকে ও নজর দেওয়া হবে। এমনকি এই সামঞ্জস্য যাতে ODL ( Open and Distance Learning), অনলাইন ও প্রথাগত শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার ক্ষেত্রে ও বজায় থাকে তাও নিশ্চিত করা হবে।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শর্তভিত্তিক গ্রেড প্রথায় তাদের মূল্যায়ন প্রথা নিয়ে যাবে। এবং এই প্রথায় উচ্চ স্বার্থযুক্ত প্রান্তিক পরীক্ষার বদলে নিরন্তর ও সামগ্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে এই গ্রেড নির্ধারিত হবে।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি উচ্চমানের সাহায্য কেন্দ্র তৈরি করবে। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট আর্থিক সাহায্য ও পাঠসামগ্রী সাহায্যের ব্যবস্থা থাকতে হবে। পেশাদারী শিক্ষামূলক ও পেশাগত পরামর্শ প্রতিটি ছাত্রের জন্য সহজলভ্য হবে। এমনকি পরামর্শদাতাদের ও শারীরিক, মানসিক ও আবেগের সুস্থতা বজায় রাখা নিশ্চিত করা হবে।

যুক্তিযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপত্য

উচ্চ শিক্ষার জন্য নতুন দর্শন ও স্থাপত্যের ভাবনা ভাবা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি বৃহৎ আকারের হবে। সম্পদশালী, প্রানবন্ত ও বহুমুখী বিষয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বৃহৎ আকারের বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হবে। এগুলি গুচ্ছ উচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র বা জ্ঞানকেন্দ্রে পরিনত হবে যেখানে কমপক্ষে তিন হাজার বা ততোধিক ছাত্র থাকবে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় বলতে এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোঝাবে যেগুলি উচ্চ শিক্ষার বহুমুখী বিষয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এগুলি অস্নাতক ( Undergraduate) ও স্নাতক ( Graduate) পর্যায়ের প্রোগ্রামের জন্য উচ্চমানের শিক্ষাদান, গবেষণা ও সামাজিক কাজে নিযুক্ত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে তিন ধরনের শ্রেণিতে বিভক্ত করা যাবে। গবেষণা কাজে নিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাদানে নিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিগ্রী প্রদানকারী স্বায়ত্ত্বশাসিত কলেজ।

অধিভুক্তির পদ্ধতি পনের বছর ধরে ব্যাপ্ত থাকবে। পর্যায় অনুযায়ী কলেজগুলিকে একটি স্বচ্ছ গ্রেড স্বীকৃতি প্রদানকারী পদ্ধতির মাধ্যমে স্বায়ত্বশাসনের গ্রেড প্রক্রিয়া তৈরি করা হবে। কালক্রমে প্রতিটি কলেজ হয় ডিগ্রী প্রদানকারী স্বায়ত্বশাসিত কলেজে পরিনত হবে, নাহলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে থাকবে। এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাধ্যমে গবেষণার সংস্কৃতি তৈরি করা।

জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান  বা National Research Foundation (NRF) 

দেশব্যাপী গবেষণা ও উদ্ভাবন কাজের প্রসারন ও অনুঘটনের জন্য নতুন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম হবে জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান (National Research Foundation)। এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাধ্যমে গবেষণার সংস্কৃতি তৈরি করতে সক্ষম হবে। সারা দেশে গবেষণার জন্য প্রনোদনা (Incentive) এর ব্যবস্থা থাকবে। ভাল গবেষণার জন্য স্বীকৃতির বন্দোবস্ত থাকবে। অধিক উৎসাহদানের উদ্যোগ ও সাহায্য দেওয়া দরকার বিভিন্ন রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেখানে গবেষণার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। NRF প্রতিটি বিষয় প্রতিটি ডিসিপ্লিনের জন্য প্রতিযোগিতামূলকভাবে যথেষ্ট আর্থিক সাহায্যের বন্দোবস্ত রাখবে। সফল গবেষণার জন্য স্বীকৃতির ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেখানে প্রাসঙ্গিক হবে সেখানে এই গবেষণা সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা মানবকল্যানকামী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রূপায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

ছাত্রদের জন্য আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা 

SC, ST, OBC এবং অন্যান্য সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে দুর্বল গ্রুপের ছাত্রদের জন্য মেধার ভিত্তিতে যথেষ্ট পরিমাণে সাহায্যের উদ্যোগ নিতে হবে। স্কলারশিপ পোর্টালকে আরও বিস্তৃত করা হবে যাতে ছাত্রদের সাহায্য করা যায় ও তাদের দরখাস্ত ট্রাক করতে সুবিধে হয়। বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে তাদের ছাত্রদের অধিক পরিমাণে ফ্রিতে পড়ানোর জন্য এবং স্কলারশিপ দেয় তার জন্য উৎসাহ দেওয়া হবে।

মুক্ত ও দূরশিক্ষা

মুক্ত ও দূরশিক্ষার প্রসারণ ঘটানো হবে। এরফলে GER বা মোট নিবন্ধীকরণ অনুপাত ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। অনলাইন কোর্স ও ডিজিটাল লাইব্রেরির সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। গবেষণায় আর্থিক সাহায্য বর্ধিত করা হবে। উন্নত ছাত্র পরিষেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। অধিক সংখ্যায় ক্রেডিট ভিত্তিক অনলাইন কোর্স বা MOOCs ( Massive Open Online Courses) এর স্বীকৃতি প্রদান করা হবে। এইসকল কোর্সগুলি যাতে শ্রেণিকক্ষে পড়ানো কোর্সগুলির মতো উচ্চতম গুনমান বজায় রাখে তা নিশ্চিত করা হবে।

শিক্ষার আন্তর্জাতিকরন করা হবে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার মাধ্যমে  এবং  ছাত্র ও শিক্ষকদের বিনিময়ের মাধ্যমে। এই কাজের জন্য বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে আমাদের দেশে প্রবেশ ও ক্যাম্পাস খোলার অনুমতি দেওয়া হবে।
 (চলবে) 

সজল কুমার মাইতি।
প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, বানিজ্য বিভাগ, হুগলী মহসীন কলেজ। পূর্বতন অধ্যাপক, গোয়েঙ্কা কলেজ অফ কমার্স এ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন, কলকাতা। চৌত্রিশ বছরের অধিক কাল ইউ জি ও পি জি শিক্ষা দানের অভিজ্ঞতা। বতর্মানে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কলেজের বানিজ্য বিষয়ে সিনিয়র সার্ভিসের একমাত্র অধ্যাপক।



Post a Comment

0 Comments