জ্বলদর্চি

ছয় দশকের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উদার আকাশ : ফারুক আহমেদ /খাজিম আহমেদ

ছয় দশকের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উদার আকাশ : ফারুক আহমেদ 

খাজিম আহমেদ

একজন তরতাজা তরুণের সম্পাদিত ‘উদার আকাশ’ উৎসব সংখ্যা ২০০৯-এর এই ‘সাবালক’ সংখ্যাটি অনির্বচনীয় এক আনন্দে আচ্ছন্ন করে দিল। আধুনিক সমস্যাদীর্ণ জীবনের নানান স্তরকে স্পর্শ করে এমন একটি ‘সম্পূর্ণ’ পত্রিকা সংকলন পেতে দেশ-বিভাগের পর প্রায় ৬০ বছর কাবার হয়ে গেল। কেন এমনতর একটি ‘সিরিয়াস’ মন্তব্য করতে আগ্রহী হওয়া গেল তার বাস্তব ও বুদ্ধিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ করতে গেলে ফেলে আসা ছয় দশকের দিক-নির্দেশক ঘটনাগুলোর ওপর অতি সামান্য আলোকপাত জরুরি। বিষয়টি অপ্রতর্ক এবং গুরুত্ব অবশ্যই অপ্রমেয়।
মূলত ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪৭ সালতক কলকাতায় বাঙালি মুসলিম বিদ্বৎসমাজের একটি বিরাট অংশ বসবাস করতেন। তাঁদের মননশীল জীবনচর্চার ফলে বাঙালি মুসলিম জাতিসত্তার অবস্থান ছিল বিশেষভাবে মর্যাদাবাহী। বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলায় মুসলমানরা কাঙাল হয়ে গেলেন। নবোত্থিত ‘মুসলিম এলিট’ শ্রেণি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঝাড়েবংশে চলে গেলেন— এই অবস্থাটির চমকপ্রদ বর্ণনা দিয়েছেন জঁহাবাজ পণ্ডিত সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি বলেছেন, ওদেশে ‘ডাঙর ডাঙর চাকুরীগুলো খালি’। ফলে সেই ‘ড্রীমল্যান্ডে’ গেলেই চাকরি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি প্রায় এদেশে শূন্য হয়ে গেল। এমন অবস্থায় এ বঙ্গে যে মুসলমানরা রয়ে গেলেন তাঁদের মধ্যে এক সামাজিক শূন্যতা, মানসিক নিষ্ক্রিয়তা এবং হতাশাবোধ গ্রাস করল।
এমনতর পরিস্থিতিতে এই বঙ্গের বৌদ্ধিক জগতে মাত্র রয়ে গেলেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অগ্রপথিক, মহানায়ক কাজী আবদুল ওদুদ, দার্শনিক পণ্ডিত হুমায়ুন কবীর, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অগ্রচারী সৈনিক রেজাউল করিম, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং ইসলামি ভাবানুষঙ্গের বিষয়গুলো আঁকড়ে ধরে রইলেন এম আবদুর রহমান। ‘তরুণপত্র’ এবং ‘সঙ্কল্প’ পত্রিকার মারফত কাজী আবদুল ওদুদ ‘বুদ্ধির মুক্তি’ এবং প্রগতিশীল ধ্যানধারণাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রশ্নে ১৯৭০ সালতক ক্রিয়াশীল ছিলেন। বিজন বিভুঁই কলকাতায় তাঁর মৃত্যুদিনে তাঁকে সমাধিস্থ করার সময় মাত্র ১১ জন শুভানুধ্যায়ীর উপস্থিতি আমাদের হতচকিত করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই মহাবেদনার দিনে শ্রী অন্নদাশঙ্কর রায় উপস্থিত ছিলেন। হুমায়ুন কবীর ত্রৈমাসিক ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রে (১৯৩৯-১৯৬৯) যে অসাধারণ নান্দনিক বোধ, মর্যাদা ও গাম্ভীর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন তা সাধারণের অনুধাবনযোগ্য বিষয় নয়। তিনিই প্রথম এশীয় দার্শনিক যাঁকে ‘হাবার্ট স্পেনসার’ বক্তৃতামালায় বক্তব্য পেশ করার জন্য গভীর সম্মানের সঙ্গে আহ্বান জানানো হয়েছিল। তিনি ‘Now’ পত্রিকার মানকে এমন একটি উচ্চতায় তুলেছিলেন সেটি অচিন্ত্যনীয়। অধ্যাপক কবীর ছয়ের দশকের শেষদিকে ‘নয়া বাঙলা’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। সম্পাদক ছিলেন অচ্যুত গোস্বামী। যদিচ চোখের সামনে দেখেছি মূলত ‘নয়া বাঙলা’-র পুরো বিষয়টি দেখভাল করতেন কাজী আবদুল ওদুদ এবং হুমায়ুন কবীরের অশেষ স্নেহভাজন সাহিত্যিক আবদুল জব্বার। তাঁর অকাল প্রয়াণ আমাদের মুহ্যমান করে তুলেছে। ‘Quest’ পত্রিকার মারফত আজীবন সত্যের সন্ধান করেছেন রবীন্দ্রবেত্তা দার্শনিক আবু সয়ীদ আইয়ুব। অধ্যাপক রেজাউল করিম বাঙালি জাতির বিবেক হিসেবে বিগত শতাব্দীর নয়ের দশক পর্যন্ত বৌদ্ধিক চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্ণময় জীবনের অধিকারী সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা আলাদা করে কাহন কাহন বলা বাতুলতামাত্র। এম আবদুর রহমান ইসলাম বিষয়ক আলোচনাগুলো গার্ডনার লেন থেকে প্রকাশিত খাইরুল আনাম খাঁ সম্পাদিত ‘পয়গাম’ আর ‘মোহাম্মদী’ সংবাদপত্রের মারফত আমাদের সামনে পেশ করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল হীনমন্যতায় আচ্ছন্ন একটি জাতিসত্তার সামনে তাঁদের ‘তহজীব’ ও ‘তমুদ্দন’-কে তুলে ধরা। চাঁদনি চক থেকে প্রকাশিত ‘নেদায়ে ইসলাম’ এবং ম্যাকলিয়ড স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত মওলানা রফিকুল হাসানের ‘কোরান প্রচার’- ধর্মীয় কাগজ হিসেবেই প্রকাশিত হচ্ছিল। সাহিত্যচর্চার অবকাশ এবং সুযোগ এই দুটি পত্রিকায় ছিল না। যদিচ শেখ নাসির আহমেদ পত্রিকা দুটোতে মুসলিম মনীষীদের কথা ক্বচিৎ-কদাচিৎ আলোচনা করতেন। মূলত খাইরুল আনাম খাঁ, গাওছুল আনাম খাঁ (বিশ শতকের বাঙলার ‘ইমাম গাজ্জালী’-মওলানা আকরাম খাঁর রক্তজাত বংশধর) এবং গাজনফার রেজা চৌধুরীর দ্বারা ক্রমানুসারে সম্পাদিত ‘পয়গাম’ এবং ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকাতেই মুসলিম স্বার্থ সংক্রান্ত যৎকিঞ্চিৎ লেখাজোখা প্রকাশিত হত। বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষে পত্রিকা দুটির মালিকানা মেদিনীপুর জেলার আবদুল জলিল তরফদারের হাতে চলে যায়। ঠিকানারও পরিবর্তন ঘটে, প্রথমে কলুটোলার ফিয়ার্স লেনে। কিয়ৎকাল পরে ২৬/১ মার্কেট স্ট্রিটে। বিশেষভাবে ‘পয়গাম’ সংবাদপত্রের মারফত এই বঙ্গের অগণন তরুণ সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, আবদুল জব্বার, আবু আতাহার এই কাগজটির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন। বশীর আল হেলাল, কবিরুল ইসলাম, সামসুল হক, আবুল কাশেম রহিমউদ্দিন, রফিকউল্লাহ, আবদুর রাকিব এবং ‘প্যালেস্টাইন থেকে আরব’ গ্রন্থের লেখক সৈয়দ আবদুল বারী ‘পয়গামে’র ঈদ সংখ্যায় নিয়মিত লিখতেন। পরিবর্তনে সাড়া দেবার এই মানসিকতার জন্ম নিতে প্রায় কুড়ি বছর সময় লেগে গেছিল। আগ্রহের বিষয় কিছু মুসলিম মহিলাও এই সময়ে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এঁদের উৎসাহিত করার জন্য ‘বেগম’ পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে মরিয়ম আজিজ বিশেষ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।
সাম্প্রদায়িক প্রচারণার অভিযোগে মুসলিম সম্পাদিত পত্রিকার সম্পাদককে গ্রেফতার করার নজির বেশ কয়েকবার ঘটেছে। দুটো উদাহরণ পশ্চিমবঙ্গ থেকেই দিচ্ছি। ১৯৬৮ সালের ২৬ এপ্রিল ‘পয়গাম’ সম্পাদক আবদুল জলিল তরফদারকে পুলিশ প্রথমে গ্রেফতার করে, দ্বিতীয়বার ৩ জুন এবং বিচার চলাকালীন ৬৫ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১ জুলাই তৃতীয়বার তাঁকে দফতরে কর্মরত অবস্থায় গ্রেফতার করে। ‘ইনসাফ’ (ইলিয়ট রোড থেকে প্রকাশিত) নামক একটি বাংলা পত্রিকার তেজি, জেদি সম্পাদক প্রয়াত আহমদ রশিদ-ও গ্রেফতার হয়েছিলেন সেই সময়। অভিযোগ সাম্প্রদায়িক প্রচার। ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা এবং নানাবিধ ‘ইনজাস্টিস’-এ তিতিবিরক্ত শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজ প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁদের নিজস্ব একটি আধুনিক দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র। ‘দেশকাল’ এবং তাঁদের নিজস্ব সমস্যা সম্পর্কে মুসলমানরা যে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন, সেটি তাঁদের সচেতনতারই লক্ষণ। কিন্তু আখেরে আজও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, বাংলা ভাষা ব্যতিরেকে অন্য ভাষাভাষী ভারতীয় মুসলমানদের ‘নিজস্ব’ দৈনিক সংবাদপত্র রয়েছে। একদা যে এই কলকাতাতেই ছিলেন মওলানা আকরাম খাঁ, মওলানা মুজিবর রহমান, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন, আবুল কালাম শামসদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদ, তা নয়া প্রজন্ম ওয়াকিবহাল নন।
বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলায় সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ‘মীযান’ এবং 'নতুন গতি' নামক একটি পত্রিকা কোনও কোনও মহলে সামান্যতম পরিচিতি পেয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এ বাবদে ‘কলম’ নামক পত্রিকাটি অসাধারণ সাহস এবং গভীর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, ব্যক্তিনিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ-আর্থ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণ পত্রিকাটিকে বিশেষ মর্যাদার ‘তখতে’ বসিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় তথা শাসকবর্গের অনীহার ফলে একটি উপেক্ষিত জাতিসত্তা যখন ক্রমশ হতাশার অন্ধকারে প্রায় নিমজ্জমান তেমন সময়ে সাপ্তাহিক পত্রিকাটির সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে মুসলমানদের সামনে সমস্যা সমাধানের সূত্রগুলোকে সটান হাজির করেছেন। তাঁর সম্পাদিত প্রতি বছরের ঈদ সংখ্যা ‘কলম’ অবশ্যই অসাধারণ গুণমানসম্পন্ন। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, সংকলনগুলোতে কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধাবলি অশেষ প্রাধান্য পেয়ে থাকে। আকড়া থেকে প্রকাশিত ‘প্রগতি’ নামক একটি পত্রিকা এবং মধ্যমগ্রাম থেকে একদা প্রকাশিত মুন্সি আবদুর রহিম সম্পাদিত ‘কালদর্পণ’ পত্রিকাও মুসলিম মানসে প্রভাব ফেলেছিল। এবাদুল হক ও এমদাদ উল হক সম্পাদিত ‘আবার এসেছি ফিরে’ আমাদের বিস্মিত করে কীভাবে তিন দশক ধরে এমন একটি যথার্থ সুসম্পাদিত সাহিত্য পত্রিকা লাগাতার প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বেশ কয়েক দশক থেকে প্রকাশিত হচ্ছে 'রঙধনু' সম্পাদক জয়নুল আবেদীন এবং 'চাতক' সম্পাদক শেখ মফেজুল। মুর্শিদাবাদ জেলার নতুন প্রতিভার আত্মপ্রকাশ ঘটছে নিয়মিত এই দুই পত্রিকার মারফত। এস এম সিরাজুল ইসলাম ‘বুলবুল’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে বহু তরুণ-তরুণীকে সাহিত্যচর্চা আর অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭০-এর দিকে ‘সুন্দরবন সমাচার’ নামক একটি পত্রিকা দক্ষিণ ২৪ পরগনার মুসলিম জীবনের পরিচয় তুলে ধরতে আগ্রহী ছিল। ‘ঝংকার’ নামক একটি পত্রিকার প্রকাশও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ‘দামাল’ নামক পত্রিকাটিও উপেক্ষণীয় ছিল না। ‘দীপন’ সম্পাদক এন জুলফিকার, ‘সমকালের জিয়নকাঠি’ সম্পাদক নাজিবুল ইসলাম মণ্ডল, ‘দিবারাত্রি কাব্য’ সম্পাদক আফিক ফুয়াদ, ‘আলোর ফুলকি’ সম্পাদক আনসার উল হক, 'বাংলার রেনেসাঁস' সম্পাদক আজিজুল হক মণ্ডল দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে নিয়মিত প্রকাশ করছেন উন্নত মানের বলিষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকা। পত্রিকাগুলোর সাহিত্য আকাশে বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হয়েছে ইতিমধ্যেই। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থও প্রকাশ করেছেন এইসব পত্রিকার সম্পাদক তাঁদের নিজস্ব প্রকাশন সংস্থা থেকে। শিশুসাহিত্যিক আনসার উল হক উভয় বঙ্গে তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থের জন্য বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠেছেন।

এবার অপরিসীম গুরুত্বের জায়গাটিতে ফিরে আসি। আগে বলেছি, প্রায় দু’দশক প্রস্তুতির পর এ বঙ্গের বাঙালি মুসলিম সমাজ পরিবর্তনে সাড়া দেবার মানসিকতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ আগ্রহী হতে শুরু করে। এর মূলে ছিলেন আবদুল আজীজ আল্‌-আমান। ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক জনাব আবদুর রাউফ-এর একটি মূল্যায়ন এখানে পেশ করব। স্বাধীনতার পর এপার বাংলার বাঙালি মুসলমান জীবনের ওপর প্রথম উপন্যাস লেখেন আবদুল আজীজ আল্‌-আমান। উপন্যাসটির নাম ‘শাহানী একটি মেয়ের নাম’, ‘সোলেমানপুরের আয়েষা খাতুন’, নামে তাঁর গল্পগ্রন্থেও গ্রাম বাংলার মুসলমান সমাজ ও জীবনের ওপর লেখা একাধিক গল্প রয়েছে। (এগুলোই পরবর্তী সময়ে ‘খাল বিলের গল্প’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল)। ... এই কাজ নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক।” ‘জাগরণ’ এবং দু’পর্যায়ে ‘কাফেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা এবং ‘হরফ প্রকাশনী’-র মারফত একটি লেখক গোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটাতে প্রাণপাত ‘কোশেশ’ করেছিলেন। ‘গতি’ নামক পত্রিকাটির মারফত তিনি সাংবাদিকতা-চর্চার সূত্রপাত করছিলেন। তাঁর মহান উদ্দেশ্য ছিল একটি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করা। তাঁর অকাল মৃত্যু সেই মহৎ প্রয়াসটিকে রুদ্ধ করে দেয়। তিনি কবি কাজি নজরুল ইসলামকে উভয় বঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাঁর  উত্তরসূরি এমদাদুল হক নূর সম্পাদনা করছেন 'নতুন গতি' পত্রিকা এবং 'মাসান্তিক নতুন গতি' ম্যাগাজিন। প্রতিবছর 'নতুন গতি ঈদ সংখ্যা' প্রকাশিত হচ্ছে এবঙ্গে সর্ববৃহৎ ঈদ সংখ্যা হিসেবে। সাহিত্য বিকাশে এবং লেখক তৈরির কারখানা হিসেবে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে পাঠক দরবারে। 'নতুন গতি' পত্রিকার উদ্যোগে সাহিত্য সম্মেলন এবং বনভোজন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে বছর বছর। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থানটিকে এমন একটি উচ্চতায় স্থিত করেছেন যে তা স্পর্শ করার ‘তাকৎ’ বা ‘কলজে’ কারুর নেই। শুধু লিপিকুশলতা নয়, পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধ্যের এমন সমন্বয় ক্বচিৎ-কদাচিৎ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠে। তাঁর উপন্যাস এবং ছোটগল্পগুলোর নির্মাণকৌশল নিয়ে কোনও আলোচনা করছি না। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে মনস্বিতার দ্বারা অর্জিত যে সম্পদ ঢেলে দিয়েছেন তা অতলান্ত। বাংলার মাটি, মানুষ আর মুখের চিত্রাঙ্কনে আবদুল জব্বার অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ‘বুভুক্ষা’, ‘বাংলা চালচিত্র’, ‘মুখের মেলা’, ‘মোরগ ডাকা ভোর’, ‘রূপের আগুন’, ‘ঝিনুকের নৌকো’, ‘অনিন্দ্যসুন্দর’, ‘জনপদজীবন’, ‘পল্লীর পদাবলী’, ‘লাজবতী’ সর্বোপরি ‘ইলিশমারির চর’-এ কী বিচিত্র জীবনকে তিনি চিত্রিত করেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। ‘অশোক ফিরদৌস’ আর ‘জাহাঙ্গীর ফিরদৌস’ ছদ্মনামে কত প্রবন্ধ যে ‘পয়গাম’ পত্রিকায় লিখেছেন তার হদিশ কেউ রাখে না। ১৯৮০ সালের পর থেকে জনাব আবদুর রাউফ প্রত্যক্ষ রাজনীতি ছেড়ে মেধাভিত্তিক সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। আজকের পশ্চিমবাংলায় ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে এবং সমাজ পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়ে যে সামাজিক দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রাখছেন তা নিঃসন্দেহে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে অনুকরণযোগ্য বিষয়। ১৯৮৮ সালে বর্ষ ৩৩, সংখ্যা ১: জানুয়ারি-মার্চ ‘বর্তিকা’পত্রিকার সংখ্যাটি ছিল ‘মুসলিম সমাজ ভাবনা’। বর্তিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মণীশ ঘটক। সম্পাদক মহাশ্বেতা দেবী। ‘মুসলিম সমাজ ভাবনা’ সংখ্যাটি সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই অধমের ওপর। বিভাগ-পরবর্তী পশ্চিমবাংলায় এই ধরনের উদ্যোগ ছিল এটিই প্রথম। অসাধারণ ঐতিহাসিক তাৎপর্যবাহী একটি বিষয়। এই মহৎকৃত্যটি সম্পাদনাকালে আবদুর রাউফ এই অনুজকে অশেষ সহযোগিতা করেছিলেন, যে ঋণ বহন করা সহজসাধ্য নয়। (স্মর্তব্য ‘বর্তিকা’র এই সংখ্যাটি ১৯৮৮ থেকে ২০০৮ তক চারবার পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে।) উপরন্তু আধ ডজন বিশাল গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ছেপে এই অকিঞ্চিৎকর প্রাবন্ধিককে উভয় বাংলার বিদ্বৎসমাজে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন। বহু নতুন সম্ভাবনাময় প্রতিভাকে তিনি খুঁজে বের করেন।
একটি পত্রিকা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ওপরের ভূমিকাটি করতে হল এই কারণে যে ঘোরতর সাম্প্রদায়িকতায় ক্লিষ্ট পরিবেশে দেশ খণ্ডিত হওয়ার পর পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের প্রতিকূল অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানো খুব সহজ কাজ ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের একটি বিরাট অংশ মুসলমানদের সংখ্যালঘু জাত মনস্তাত্ত্বিক অভিযোজনের সমস্যাটিকে খুবই লঘু করে দেখছিলেন, এমনকী পাত্তাও দিচ্ছিলেন না। এক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম হিসেবে গৌরকিশোর ঘোষের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করার যোগ্য। বিগত শতকের ৮০-এর দশকের শুরুতে ‘আজকাল’ দৈনিক সংবাদপত্রের মারফত তিনি পশ্চিমবাংলার মুসলমান-জীবনকে ‘অপরিচয়ের আড়াল’ থেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবী আর গৌরী আইয়ুবের সদর্থক ভূমিকার বিষয়টিও আমাদের মনে রাখতে হবে। তাঁরা ‘নবজাতক’- পত্রিকার মারফত সেক্যুলার জীবনচর্চার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এই দুই মহীয়সী মহিলা ‘কমপোজিট কালচার’-এ বিশ্বাস রাখতেন।

ফেরা যাক ‘উদার আকাশ’ পত্রিকাটির প্রসঙ্গে। আলোচনার শুরুতেই বলে রেখেছি আলোচ্য সংখ্যাটি ‘সাবালক’ একটি সাহিত্য সংখ্যা ২০০৯। সাহিত্যনির্ভর-জীবননির্ভর প্রত্যেকটি বিষয় গুরুত্বসহকারে ঠাঁই পেয়েছে। বিগত ৬০ বছরের যে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার উত্তরপুরুষে বর্তেছে তার ফলশ্রুতিতেই এটা সম্ভব হয়েছে। আমি যে পথ চিনি না এমন সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদকে। বিচিত্র বিষয়ভিত্তিক একুশটি প্রবন্ধ, নয়া নির্মাণের চেষ্টাজাত সতেরোটি গল্প, একটি অণু উপন্যাস, একটি বড় গল্প, একটি কাব্য নাটক, পাকিস্তানের একটি অত্যাধুনিক গল্পের তুলতুলে অনুবাদ, চুয়াল্লিশটি কবিতা দুটো সংক্ষিপ্ত ভ্রমণকাহিনি, একটি সাক্ষাৎকার, একটি রম্যরচনা, স্যাটায়ারধর্মী ‘সম্পদের অধিকার’ নামক একটি রচনা, অন্যছবিতে আয়লার অভিশাপে বিধ্বস্ত সুন্দরবনের হামেহাল, বিপন্ন মানুষদের জীবনচিত্র, অস্কারজয়ী এ আর রহমানের বিকাশের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ওপর একটি রচনা, নেপোলিয়ন বলেছিলেন, সুস্থ মা, ফলশ্রুতিতে সুস্থজাতি—এতদ্বিষয়ে স্বাস্থ্যভাবনায় ‘অ্যান্টিনেটাল কেয়ার’ শীর্ষক ডাঃ দীপক দাসের মানবানুভূতিতে সিক্ত একটি রচনা, চারটি ছড়া, সর্বোপরি ফালা ফালা করে চিরে বিশ্লেষিত হয়েছে পূর্বেই প্রকাশিত কয়েকটি অভিনব সংখ্যা। শিরোনাম ‘পাঠকের কলম’। পৃষ্ঠা ২১৬। আকার একটি প্রমাণ সাইজ ‘জনসন’ টালির সমান। রফিকুল হকের প্রচ্ছদ ভাবনা ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’। অনিন্দ্যসুন্দর। হালকা তুলির টানে অমর লাহার অলংকরণ মার্জিত, প্রেক্ষাপটের সঙ্গে বহুলাংশে জুতসই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘রাজপ্রেস’ মুদ্রণ বিষয়ক আধুনিক প্রকৌশল ব্যবহার করেছেন সাধ্যমতো। ‘উদার আকাশ’-এর এটি কাঠামোগত পরিচয়। এমনবিধ বিষয়গুলোতে সম্পাদক ফারুক আহমেদের তদারকি সজাগ থেকেছে।
প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর গুণমান সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোচনা করতে প্রয়াসী হওয়া গেল। প্রখর মেধাসম্পন্ন সমাজবেত্তা প্রাবন্ধিক সুনন্দ সান্যাল ‘ভোট জালিয়াতির পরিবর্তে পাল্টা জালিয়াতি চাই না’—শীর্ষক আলোচনায় জনগণের সামনে সঠিক দিশার সন্ধান দিয়েছেন। চিরন্তন সতর্কতা ব্যতিরেকে পুনরায় রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে জোচ্চুরি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়ন্ত সিংহ ‘ভারতের দলিত রাজনীতির ভবিষ্যৎ’ গতিবিধি নিরুপণ করতে গিয়ে পুরো ভারতের দলিত-ইতিহাসকে প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেটিই স্বাভাবিক ছিল। সোহরাব হোসেন ‘ছোটগল্পের অবয়ব’ নামাঙ্কিত আলোচনাটিতে অপ্রত্যক্ষভাবে বিশেষ একটি দায়িত্ব পালন করেছেন। নতুন লেখকদের এই পদ্ধতিগত ও কাঠামোগত আলোচনাটি অনেকটাই পথ দেখাবে। ‘শিক্ষার দুর্দশা’ নামক আলোচনায় সুজাতা অধিকারী ফোঁপরা হয়ে যাওয়া শিক্ষানীতির অসামান্য মানবিক বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি উদ্ধৃতির বরাত দিয়ে যে সিদ্ধান্ত টেনেছেন—তাতে শিহরিত হয়ে পড়ি। ‘ইতিহাস, মিথ, রাজনীতি: সেইমাস হিনির কবিতা’—বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট গবেষক ও অধ্যাপক ড. আমজাদ হোসেন ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন তা দুর্ধর্ষ। ‘আয়ার্ল্যান্ডের সংখ্যালঘু ক্যাথলিকদের সঙ্গে যে বৈষম্য ও অবিচার করা হচ্ছে, তাতে তিনি (হিনি) ক্রুদ্ধ ও বেদনার্ত না হয়ে পারেন না।’ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার বিষয়টি নতুন নয়। ইউরোপে খ্রিস্টান শাসিত দেশগুলোতে ধর্ম বিষয়ক নীতিই চূড়ান্ত অনুদার ও একপেশে। ক্যাথলিকরাও অজস্র প্রোটেস্টান্টদের অবলীলায় হত্যা করেছে। এদের নীতি ছিল — Quij us regioej us religio (he who rules the country nay settlethe Religi on) -Thirty years war (1618-1648) নামক গ্রন্থে পুরো ফ্রান্সে এক লক্ষ মানবাত্মাকে (প্রোটেস্টান্ট) লোপাট করে দেওয়ার বীভৎস বর্ণনা দিয়েছেন। প্রতিবাদ দরকার। অপরাজেয় হিনিরাই ক্ষোভে-প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এর থেকে এদেশে আমরা কী শিক্ষা নেব। ‘বাংলার কৃষি: সমাজ ও সাহিত্য’ নামক আলোচনায় ইমানুল হক অজস্র তথ্য দেওয়ার পর যখন বেদনার্ত হয়ে বলে ওঠেন যে কৃষকদের জীবন আর সাহিত্যে উঠে আসবে না, তখন বিস্মিত হই না— কেননা পুরোপুরি কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা তরুণও যদি তার শ্রেণিকে পরিত্যাগ করে তাহলে আর আশা রাখবেন কার ওপরে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইমানুলের বাক্য গঠনের রীতি ভীষণ স্মার্ট আর ঝকঝকে। সুতপা মুখোপাধ্যায়ের ‘রাধা অনন্যা’ শিরোনামের আলোচনাটি অভিনিবেশ সহকারে পড়লাম। তাঁর কহতব্য বিষয়টি কী সেটিই স্পষ্ট হল না। অথচ উপশিরোনামে রয়েছে ‘বঙ্কিমচন্দ্রে মুসলিম প্রীতি’। বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম প্রীতি নিয়ে, মুসলমানদের কি আর কোনও আগ্রহ আছে। আমার তো মনে হয় না। “রাজসিংহতে বঙ্কিমচন্দ্র আওরঙ্গজেবকে ধূর্ত, কপটাচারী, পাপে সঙ্কোচশূন্য, স্বার্থপর” হিসেবে চিত্রিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসগুলোতে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে ভেবেছিলেন তিনি ‘হিন্দু বাহুবল’-এর পক্ষে সোচ্চার এবং বাঙালি তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মহান ব্রতে লিপ্ত হয়েছেন। এসব কাসুন্দি ঘেঁটে আর লাভ নেই। নার্গিস সাত্তার-এর ‘প্রিয় ডিরোজিও’ (১৮০৯-১৮৩১) মাত্র ১ পৃষ্ঠার একটি খুদে লেখা। অথচ কী মমতায় তিনি সন্দর্ভটি নির্মাণ করেছেন। আদতে আমি নিজেও একজন ডিরোজিওপ্রেমী। ‘বামপন্থা থেকে অবামপথে ত্রাসে সন্ত্রাসে তিন দশক’ নামক রাজনৈতিক নিবন্ধে মেকি বামপন্থী তথা ভদ্র ধড়িবাজদের উলঙ্গ করেছেন অকাল প্রয়াত রবীন বিশ্বাস অদ্ভুত মুনশিয়ানায়। ‘শিশুর শৈশব হারিয়ে গেছে’ নিবন্ধে হাবিবুর রহমান মল্লিক বিপন্ন শৈশবের বিজ্ঞান নির্ভর আলোচনা করেছেন। অভিভাবকবর্গের বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। নাসিম-এ-আলম-এর বিশ্বাস ভিন্নধারার বাংলা কবিতা ‘আমাদের শেষতম আশ্রয়’। বিষয়টি তর্ক প্ররোচক। অন্যেরা ভিন্নভাবেও ভাবতে পারেন। আলোচনাটি কিন্তু বিশেষভাবে মনোরম। ওয়ালিউর রহমান ‘এলো খুশির ঈদ’—নামক ক্ষুদ্র নিবন্ধে ইসলামি বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন। এই ধরনের আলোচনার জন্য তিনি অধিকারী ব্যক্তিত্ব। ‘পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সমাজে গৃহস্থ নারী জীবনের হাল হদিশ’ লেখিকা সুলতানা ওয়াজেদা। এই ধরনের একটি আলোচনা ভীষণ জরুরি ছিল পত্রিকাটির নিজস্ব মর্যাদার জন্য। উপরন্তু নারীজীবনের হাল হকিকৎ সম্পর্কে সুলতানা ওয়াজেদা যতখানি আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টির একেবারে গভীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাবেন— একজন পুরুষ লেখকের পক্ষে বোধহয় ততটা সহজ হবে না। এর জন্যই ইতিহাস, এবং সময় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে হাত ধরে নিয়ে এসেছিল। অর্থনীতিবেত্তা রতন খাসনবিশ ‘রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন চিন্তা’ নিয়ে যে সন্দর্ভটি রচনা করেছেন তা অসাধারণ। বস্তুত এমন শক্ত লেখা, বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিজাত সিদ্ধান্ত হররোজ কেউ রচনা করেন না। সম্পাদক ফারুক আহমেদকে ধন্যবাদ এই কারণে যে লেখাটির কদর তিনি অনুধাবন করেছেন।
‘পলাশীর ২৫০ বছর: বিশ্বাসঘাতকতা এবং তারপর’, আলোচক আমিনুল ইসলাম। আমিনুলের কয়েকটি ইতিহাস নির্ভর লেখা অন্যত্রও পড়েছি। কঠোর পরিশ্রমী। প্রত্যক্ষ, অপ্রত্যক্ষ বহু উপাদান তিনি তাঁর আলোচনায় ব্যবহার করেন। আলোচ্য ‘বিতর্কিত’ প্রবন্ধটিতে সেই দায়িত্ব পালনে বদ্ধপরিকর।
কবি ও গল্পকার এম. নাজিমের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাল্গুনী বিশ্বাস। কী অসাধারণ, নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন এম. নাজিম। বিশেষ একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, “ক’জন নামধারী মুসলিম লেখক প্রশংসাকাতর অক্ষম আর পদলেহী সস্তাখ্যাতি এবং বিখ্যাত হতে প্রলুব্ধ। ... মুসলিম জীবনকে বিকৃত ধিকৃত কলঙ্কিত করে দেখাতে এদের কলমের কেরামতি আর কালোয়াতির জুড়ি নেই।” কী নির্মম বিশ্লেষণ। আবুল বাশার সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছেন, “... উত্থান পর্বে ওর সব লেখাই ... মুসলমানদের জন্য ছিল নৈরাশ্যজনক হীন অপমানের বার্তাবাহক। আঘাত ছিল অপ্রত্যাশিত। শুশ্রূষা ছিল না।” সেই সময় এই আবুল বাশারই লিখেছিলেন যে মুসলমানরা শুধুমাত্র ‘‘কাছাছল আম্বিয়া কেতাব (পুঁথি) পাঠক। সঙ্গে মিলবে ‘হিন্দি’ সিনেমার গানের সস্তা মুদ্রণের ভুলে ভরা পাতলা এক বিঘত বই।” মুসলমান ঘরে রবীন্দ্রনাথকে নাকি পাওয়া যাবে রবীন্দ্রজন্মের দুশো পঁচিশ বৎসরের উৎসবের দিনে। কাজি আবদুল ওদুদ আর আবু সয়ীদ আইয়ূব ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম দুই বিশ্লেষক, সেটা আবুল বাশারের জানা ছিল না। সেটিই ছিল স্বাভাবিক কেননা এত উন্নতমানের ‘কালচার’-এর সঙ্গে তাঁর কোনও পরিচয় ছিল না। হক কথাটি বলার জন্য এম. নাজিমের হারাবার কিছু নেই।

বড় গল্প, গুচ্ছগল্প, কাব্য নাটক, অণু উপন্যাস এবং কবিতার বিষয়ে আলোচনা করার মতো অধিকারী ব্যক্তি এই আলোচক নন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ‘ক্রিয়েটিভ লিটারেচার’ সম্পর্কে আগ্রহী পাঠক সজ্জনদের মধ্যে থেকে কেউ না কেউ এই আলোচনা করবেন। বিষয়টি সার্থক হয়ে উঠবে। রুদ্রদেব মিত্র আর শান্তি বর্ধনের ভ্রমণ কাহিনি সুখপাঠ্য। শান্তির লেখাটি তথ্যসমৃদ্ধও বটে। মহিউদ্দিন সরকারের রম্যরচনাটি অবশ্যই রমণীয়। পাঠ নিয়ে মুগ্ধ হলাম। মুশা আলি এ আর রহমানের জীবনের একটি অংশকে কেবল ধরতে চেয়েছেন। খুব সম্ভব এটি বিস্তারের আরও সুযোগ রয়েছে। মধুময় পাল ‘সম্পদের অধিকার’ শীর্ষক রচনায় সমকালীন রাজনৈতিক নেতৃবর্গের ভণ্ডামি আর শয়তানির পরিচয় তুলে ধরেছেন। লেখক সমাজমনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন।

‘পাঠকের কলম’ বিভাগটি অনবদ্য। ‘উদার আকাশ’-এর পূর্বে প্রকাশিত সংখ্যাগুলোর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ পত্রিকাটি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা করিয়ে দেয়। শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, সমাপিকা সরকার, শেখ সদর আলি, সুরাইয়া সুলতানা, সুবীর রায়চৌধুরী আর সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনাগুলি চিঠি নয়, যেন খুদে নিবন্ধ রচনা করেছেন। এই জাতীয় সচেতন পাঠক-পাঠিকা পত্রিকার মান উঁচু পর্যায়ে ধরে রাখার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর কাজ করেন। ‘প্রতিবাদী কণ্ঠ উদার আকাশ’ ‘অফুরন্ত দাগ কাটে দায়িত্বশীল পত্রিকা ভাবনা’, ‘গরুর পেছন এবং সোনার পাথরবাটি’, ‘সাহিত্যাকাশে যথার্থ নিরপেক্ষ’, ‘পত্রিকাটি যে এত উচ্চমানের জেনে চমৎকৃত হলাম’, ‘বিরল প্রতিভার খোঁজে’, ইত্যাকার আলোচনাগুলো আমার চিন্তাভাবনাকে ধনী করেছে। শুধুমাত্র শেখ সদরকে দু’একটা বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। অধ্যাপক আবদুল হাই অধুনালুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের একজন অনন্য সাধারণ ভাষাবেত্তা। বস্তুত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পরে এত বড় পণ্ডিত আর দু’একজনই ছিলেন। অধ্যাপক আবদুল হাই মুর্শিদাবাদ জেলার সন্তান। ভুলবশত অনেকেই তাঁর নামের আগে ড. ব্যবহার করে থাকেন। গভীর বেদনার বিষয় তিনি ঢাকার অদূরে রেললাইনে আত্মহত্যা করেন। বদরুদ্দিন উমরের কথা বোধহয় বিশদ বলার অপেক্ষা রাখে না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রাষ্ট্রবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী এবং গবেষক লেখক। তিনি বর্ধমানের সন্তান। তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তা চেতনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করে। ড. ওয়াকিল আহমদ দু’খণ্ডে ‘উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা’ নামক গবেষণা গ্রন্থের জন্য উভয় বঙ্গে বহুজনবন্দিত নাম। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলার ভগবানগোলার সন্তান।
বর্তমানে খুব সম্ভব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদে আসীন রয়েছেন। আলোচ্য সংখ্যায় প্রকাশিত দুটো লেখা বিস্ময়ে বিমুগ্ধ করেছে। ১. মীরাতুন নাহারের ‘আত্মকথনে দেশভাগ ও সংখ্যালঘু মানস’। বিভাগোত্তর পশ্চিমবাংলার বিপন্ন মুসলিম মানসের যে চিত্র তিনি এঁকেছেন তা শুধু তাঁর ব্যক্তিগত বেদনা নয়। ‘নস্টালজিয়া’য় ভারাক্রান্ত এই আলোচনাটি বেদনার এক বিষণ্ণ কালবেলায় পৌঁছে দেয় পুরো একটি উপেক্ষিত ধর্মীয় সম্প্রদায়কে যাঁরা বিশ্বাস করেন, “একটি সম্প্রদায় হিসেবে তাঁদের নিজস্ব বিশ্বাস ও ঐতিহ্য নিয়ে বসবাস করার অধিকার আছে, তাঁরা কয়েকটি নীতিবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাদের নিজস্ব জীবনযাত্রার পদ্ধতি আছে তাহলে কোনও অন্যায় অবশ্যই হয় না।” (ড. মইন শাকির, ‘সেক্যুলারাইজেশন অব মুসলিম বিহেভিয়ার’)। মীরাতুনের জন্ম ১৯৪৯ সালে। ১৯৬০ সাল নাগাদ তাঁর মনে একটি অচেনা সত্তা এসে হাজির হল। সেটি হল সংখ্যালঘু সত্তা। আজ ষাট বছর বয়সে পৌঁছেও সেই অস্বস্তি তাঁকে তাড়া করে ফেরে, বিপন্নতার মুখোমুখি হন। দর্শনের একজন অধ্যাপিকা হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সংখ্যালঘু সত্তা প্রাধান্য পেতে থাকে। এই বিষয়টিকেই সমাজবিজ্ঞানী মীরা বলছেন, সংখ্যালঘিষ্ঠতাজনিত মানসিক অস্বস্তিকাতরতা। এটা তাঁর একার নয়। ইমতিয়াজ আহমদ লিখছেন, ‘পৃথিবীর এমন কোনও সমাজ নেই, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার না হয়েছে।' বাস্তবে যদিও সাংবিধানিক সমান অধিকারের দাবি করা হয়, তবুও মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামাজিক, রাষ্ট্রিক, আর্থিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইত্যাকার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়। আর এমনবিধ বিষয় রূঢ় বাস্তব বলেই ১৯৬৪ সালে মীরাতুনকে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। অবশ্য পারিবারিক সিদ্ধান্ত হল ‘দেশ ছাড়বেন না।’ ১৯৬৬ সালে লেডি ব্রেবোর্ন কালেজের ছাত্রী হিসেবে পাঠরতা অবস্থায় যে বেদনা ও যন্ত্রণা তাঁকে বিদ্ধ করেছিল— সেই যন্ত্রণা আজও তাঁর সঙ্গী। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কেন এত বিদ্বেষ। এর কোনও জবাব নেই।’ ‘প্রেম নেই’-এর লেখক গৌরকিশোর ঘোষ একদা লিখেছিলেন, “আমাদের অজ্ঞতার দোষে আমরা প্রতিনিয়ত মুসলমানদের মনে যে আঘাত দিয়ে থাকি, সে সম্পর্কে বিশেষ চেতনা কারো মনে দেখিনে, এটাও তো সত্যি।” খুবই বিস্মিত হই যখন লক্ষ্য করি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মধ্যেও মুসলমানদের সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ করা হয়। ‘শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বীজ খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে’ বলে প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বিশ্বাস করেন। কথাটা বোধহয় মিথ্যে নয়। মীরাতুন নাহার সঠিক অনুধাবন করেন যখন তিনি লেখেন, ‘ধর্মপ্রাণ অশিক্ষিত মানুষের কোনও মানসিক সমস্যা নেই।’ সংখ্যালঘু মুসলিমদের স্বদেশপ্রেম নিয়েও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বাতিকগ্রস্ততা রয়েছে। অথচ তাঁরা ভেবেও দেখেন না যে একজন বিশ্বাসী মুসলমানের কাছে স্বদেশপ্রেম হল তাঁর ‘ইমান’বা ধর্মবিশ্বাসের অঙ্গ। মীরাতুন নাহারকে বিশেষ বড় মাপের অভিনন্দন জানানো হচ্ছে আলোচ্য লেখাটির জন্য।
দ্বিতীয় লেখাটি হল, শামিম আহমেদ-এর ‘চতুর্থ মানুষ’। এটি বিশেষ রচনা হিসেবে চিহ্নিত। প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮-এর উৎসব সংখ্যায়। আমাদের আলোচা অংশটি দ্বিতীয় পর্ব। অদৃষ্টপূর্ব এই লেখাটির তৃতীয় কিস্তি বেরুবে বইমেলা সংখ্যায়। সম্পাদক এমনতর ঘোষণা দিয়েছেন। শামিম আহমেদ তাঁর লেখাটির নামকরণ করেছেন, ‘চতুর্থ মানুষ’। কেন যেন আমার আয়ান রশিদ খানের কথা স্মৃতিতে ভেসে উঠল। তিনি একটি বই লিখেছিলেন ইংরেজিতে— ‘A Seventh Man’। এটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম হিসেবেও চিত্রায়িত হয়েছিল। কলকাতার মুসলমানদের দিনযাপনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। শামিম তামাম পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের ক্ষোভ, আশা-হতাশা, নিঃসঙ্গতা, হরেক কিসিমের বিপন্নতার একটি প্রায় অবিশ্বাস্য দলিল তৈরি করে দিয়েছেন। কোনও পিছুটান নেই, প্রাপ্তির কোনও নির্লজ্জ প্রত্যাশা নেই। সে সময়ে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র বা ১৯৯২-এ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তেমনতর সময় থেকেই তাঁকে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে—তার ফলেই কি ‘চতুর্থ মানুষ’-এর দ্বিতীয় কিস্তিটি এতটা ‘বাস্তবের বুকে’র মধ্যে ঢুকে গেছে! হয়তো বা!
শামিমের বেদনা ‘দ্য অরিজিন অব দ্য মুসলমানস অব বেঙ্গল’-এর লেখক জনাব ফজলে রাব্বি সম্পর্কে কেন তিনি খোঁজ রাখেননি যদিচ রাব্বির নিবাস ছিল শামিমের নিজের গ্রামেই। তাঁকে তিনি জানলেন কলকাতায় গিয়ে। এটাই তো সংখ্যালঘিষ্ঠের বেদনা। একেই বলে ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’। কোনও কিছু গর্বের, শ্লাঘার বিষয় থেকে সম্পূর্ণ দূরে রেখে অসভ্য বর্বর হিসেবে চিহ্নিত করতে পারার মহা উল্লাস। বাকি যাঁদের নাম শোনেননি তাঁদের কথা মুর্শিদাবাদের বিশেষত কান্দি মহকুমার ‘স্মরণিকা’গুলোতেও প্রকাশিত হয়। আদতে গ্রামে থাকাকালীন আপনি নেহাতই কিশোর ছাত্র ছিলেন। শামিম আহমেদ ‘মাইনরিটি কমিউনিটির’ সমস্যাগুলোকে তাঁর নিজের জীবন দিয়েই অনুভব করেছন ফলত তিনি একে একে তুলে ধরেছেন, আইডেনটিটির সমস্যা, বাবরি মসজিদজাত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, বস্তিজীবনের অসহনীয় জীবনচিত্র, পেট্রো ডলার-এর আজগুবি কিসসা, বাসস্থানের সমস্যা, দেশদ্রোহিতা, তোষামোদ, শিক্ষাহীনতা, পুরসভার পরিষেবাহীনতা, ওয়াকফ সম্পত্তির তছরুপ, সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসকগোষ্ঠীর দাঙ্গাপ্রবণ মানসিকতা, ‘জেহাদ’ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, ‘ক্রস কালচারাল ডায়ালগে মুসলিম মওলানার ভণ্ডামি’, অনুপ্রবেশ, হেজে মজে যাওয়া আবার ‘বন্দে মাতরম’ প্রসঙ্গ, জনৈক প্রধান সন্ন্যাসীর বীভৎস সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, মুসলমানদের গণনিধন, মাদ্রাসা প্রসঙ্গ, জনৈক শ্রদ্ধেয় লেখকের বদমাইশি, রিজওয়ানুর রহমান, সংবাদপত্র বা প্রচার যন্ত্রের বদমাইশি, ফতোয়া, সলমন রুশদি, সাচার কমিটি, মুসলমানদের অসহনীয় দারিদ্র, চাকরিহীনতা, চতুর্থ মানুষকে না চেনার মানসিকতা, অনীহা এবং স্বধর্মীয় নিজস্ব কিছু সমস্যা। প্রত্যেকটি প্রসঙ্গের যুক্তিগ্রাহ্য উত্থাপন ও বিশ্লেষণ আমাদের চমকিত করে।
শামিম আহমেদ লিখছেন, ‘কিছু কিছু স্কুলে আবার এরকম বিধান জারি করা হয়, মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের পাশ করাবেন না।’ মন্তব্যটি পড়ে কম্পিত হয়ে গেলাম। শামিমের বন্ধু তাঁকে বলছেন, ‘তোর কোনও সমস্যা নেই, তোকে দেখে একেবারেই মুসলমান মনে হয় না।’ এই অভিজ্ঞতাটি আমারও হয়েছিল ‘মওলানা আজাদ কলেজে’ আর ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টেনারি বিল্ডিং’-এর সিঁড়িতে, কফি হাউসের অলিন্দে। প্রিয়ভাজন শামিমের পুরো লেখাটি পড়ার জন্য কিছুদিন ‘ইন্তেজার’ করা যাক। পুরো লেখাটির পর্ণ বিশ্লেষণ করার ‘ওয়াদা’ রইল।
উপসংহারে বলি, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছে মানুষের প্রজাতিক প্রকৃতি। নিঃসহায়রা যদি নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারেন তাহলে সমূহ সর্বনাশ ঠেকানো যাবে। মনে রাখতে হবে, নিজের বিকাশের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ না করলে প্রকৃতি, ঈশ্বর, ইতিহাস বা রাষ্ট্র কোনওকিছুই তাদের একমাত্র উদ্ধারক হতে পারে না। উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক ফারুক আহমেদ তাঁর মেধা ও মনন দিয়ে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়েছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁকে আরও সামনে এগিয়ে আসতে হবে উপেক্ষিত জাতিসত্তার উত্তরণের জন্য।

Post a Comment

0 Comments