জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৫৬/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৫৬

এই ছড়িয়ে পড়া জীবনটাকে আর কোনদিন গুছিয়ে নিতে পারব? সম্ভব নয়। এখন নতুন করে ভাবা, নতুন করে বাঁচা। ভবিষ্যৎ ভাবিনা, বললেও ভবিষ্যৎ তো মিথ্যে হয়ে যাবেনা। তার মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতেই হবে। আর তার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। জীবন কখনো থেমে থাকে না।  কেউ সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে চলে, কেও দুঃখ কষ্টের বোঝা সঙ্গে নিয়েই সামনে পা বাড়ায়।

                দীপ আজ একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে লন্ডন গিয়েছিল। এই কনফারেন্স ১২ বছর অন্তর হয়। দীপ একটা বড় আকারের গবেষণা করছে। অন্যরা যেখানে ৩০ থেকে ৫০ জনের ওপর কাজটা করে, দীপ সেখানে ৫০০ জনের ওপর গবেষণা করছে। তাই ওকে এই কনফারেন্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
      এখন প্রায় রোজ সকালে একা একা বেড়াতে যাই। একদিন পথ হারিয়ে  ফেললাম। আগেই বলেছি  এখান কার বাড়িঘর একই রকম দেখতে। রাস্তাও একই রকম। তবে প্রতিটি রাস্তা বা লেনের ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। নামটা আমার দেখা  হয় নি। ভাবছি, কী করব? হঠাৎ উল্টোদিকের ফুটপাত ধরে ট্র্যাকশুট পরা এক ভারতীয় মহিলাকে হাঁটতে দেখে ইশারায় কাছে ডেকে বললাম, আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। উনি বললেন, কোই বাত নেই, অ্যায়সা হোতা হ্যায়। ওনাকে কোয়াপে(বাজার) পৌঁছে দিতে বললাম। উনি বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন।  হাঁটতে হাঁটতে অনেক কথা হল। ভদ্রমহিলার নাম ‘কুলদীপ’,গুজরাটি শিখ। বহুবছর এদেশে বাস করছেন। ছেলে-মেয়ে, নাতি-পুতি নিয়ে ভরা সংসার। সামনের মঙ্গলবার আমাকে একটা জায়গা যাওয়ার জন্য বললেন। আমি রাজি থাকলে ওইদিন যেন ১১ টার সময় এই কোয়াপের এখানে অপেক্ষা করি। ফিরতে ৩ টে বাজবে। দেখা যাক, দীপ বাবলি কি বলে।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
      আজ সেফিল্ড নামে এক জায়গায় পার্টি আছে, যাওয়া হবেনা। দীপের এক  জায়গায় ইন্টারভিউ আছে। তাছাড়া আজ রাতে এখানে আরও একটা পার্টি আছে, ওরা যাবে। আগামিকাল দীপ খান সাহেবকে নিয়ে এখানের মাঠে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাবে। ওখান থেকে ফিরে রাতে পার্টিতে যাওয়া হল। এখানে একজন নেফ্রোলজিস্টের সঙ্গে আলাপ হল। খান সাহেবের বিষয়ে কথা বললাম।  আগামিকাল ওনার বাড়িতে পার্টি আছে। খান সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বললেন। ওনার নাম দীপঙ্কর (পদবি ভুলে গেছি।)।উনি বললেন, আমরা নুন ছাড়া অন্য কোনও খাবার নিষেধ করিনা। ডালও খেতে মানা নেই। সব খাবার পরিমাণ মত খেতে হবে।রক্তে পটাশিয়াম থাকলে কিছু ফল নিষেধ থাকে।
      এখানে প্রায় দু’মাস আসা হয়ে গেল। আজ ডার্বিতে একজনের বাড়িতে  পার্টি আছে। খান সাহেব যাবেন না, ওনার জন্য রান্না করে রেখে আমরা চারজন গেলাম। এখানে বাঙালি অবাঙ্গালি,  বেশ কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হল। নিনাদিও  এসেছেন, সবসময় আমার খেয়াল রাখছেন। নিনাদি ডাক্তার, অনেকদিন আগেই রিটায়ার্ড করেছেন। ওনার আর একটি পরিচয় উনি বাংলা সিনেমার একসময়ের নায়িকা ও গায়িকা বাসবী নন্দীর ছোট বোন। আমাকে খুবই ভালবাসেন, স্নেহ করেন। আর আকজন আছেন, সুপ্রীতিদি। ওনার স্বামীরও দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। বাড়িতেই ডায়ালিসিস হয়। এখানে কতরকম সুযোগ সুবিধা রয়েছে। আমাদের দেশে এসব ভাবতেই পারি না। আর সুযোগ থাকলেও তার ব্যয়ভার বহন করা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়।

      কয়েকদিন ধরে খান সাহেব দাঁতের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন। বার বার নুনজলে কুলকুচি করছেন। দীপকে বলতে ও বলল, তেমন হলে দাঁত তুলে ফেলতে হবে, তার জন্য ডেন্টিস্টের এপো্য়েন্টমেন্ট নিতে হবে। বাবলি তাই করল। যাবার  দিন কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাঁর নাকি আর ব্যথা নেই। আমি রেগে গিয়ে বললাম, আমাকে আর শরীরের বিষয়ে কিছু বলবে না। তখন ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হলেন।

    দিনগুলো নানা কাজের মধ্যে কেটে যাচ্ছে। জারার জন্য বেশ কয়েকটা সোয়েটার বানালাম, সময় কাটানোর জন্য। মেদিনীপুরে ফিরতে ইচ্ছে করছে না।  কিন্তু ফিরতে তো হবেই। আমরা কত খুশি ছিলাম, সুখি ছিলাম। বকুল বাড়ি এলে আমরা তিনজনে একখাটে শুয়ে টিভিতে খেলা দেখতাম। বিকেলে ও গরম ডালপুরি কিনে আনত। তিনজনে মিলে খেতাম। উনি অবশ্য একটার বেশি খেতেন না। আমরা মা ছেলে সিনেমা, ক্রিকেট, আরও কত বিষয় নিয়ে গল্প করতাম। যখন আমি ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম, ও বলল, মা তুমি রোজ আমার সঙ্গে ফোনে দুঘণ্টা  করে কথা বলবে। আমি টাকা পাঠাচ্ছি, তুমি সব বাংলা ম্যাগাজিন, পেপার কিনে সারাদিন পড়বে। দেখবে ডিপ্রেশন পালিয়েছে।
    আজ গ্রামের বাড়িতে ফোন করে জানলাম, খান সাহেবের ছোটমামা মারা গেছেন। খান সাহেবের থেকে ৩/৪ বছরের বড় ছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই মারা গেছেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়টুকু পাওয়া যায় নি।  খবরটা ওনাকে জানানো ঠিক হবেনা, তাই বললাম না।

    এবার  ইদ প্রায় নিঃশব্দেই পার হয়ে গলে,  কিছুই বুঝলাম না। আশেপাশে লোকজন, কোলাহল কিছু নেই। নতুন জামাকাপড় পরা ছেলেমেয়েদের সালাম করতে আসা। নামাজে যাওয়া এসব কিছুই নেই। একটু অন্যভাবে ইদ হল। অবশ্য আমরা গতবছরও ইদের নামাজ ছাড়া কিছুই করিনি। ভবিষ্যতে করবও না। ছেলে ইদ বকরিদে বাড়ি আসে না। তাই কিছু রান্নাও  করিনা। বাড়িতেই নামাজ হল।  জারার স্কুলে ইদের নতুন ড্রেস পরে যেতে বলেছিল। বাবলি বিরিয়ানি রান্ন করল।
      এখন সকাল ৭ টা, কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। আমি চায়ের কাপ নিয়ে বসে আছি। ঠাণ্ডার জন্য এখানে চায়ের কাপ খুব বড়। কফিকাপ আরও বড়। বাইরে কফিসপে ঢাকা দেওয়া বড় গ্লাসের মত কাগজের কাপে কফি দেয়। কাপে চুমুক দেওয়ার জন্য একটা ফুটো থাকে। কফি খেতে খেতে ঠাণ্ডা না হয়ে যায়, তাই এই ব্যবস্থা।
      সে যাইহোক, খান সাহেব উঠলে হাঁটতে বের হব। রোজ বেড়ানো ওনাকে এখন নেশায় পেয়েছে, এখানে ফুটপাত ধরে হাঁটতে বেশ লাগে। কোথাও সবুজ ঘাসের ওপর লাল টুকটুকে চেরিফল ঝরে পড়ে আছে। কোথাও সারি সারি অ্যাপেল গাছে অ্যাপেল ঝুলছে। লোকালয়ের মধ্যে হলে বাড়ির সামনে কত রকমের ফুল ফুটে রয়েছে।  এক একটা গোলাপের সাইজ দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি!

    আজ হাটতে বেরিয়ে একটা পারকে ঢুকে ছিলাম, ওয়ালাটন পার্ক। গতবারে  এই পারকেই ওয়ালাটন ক্যাসেল দেখতে এসে ছিলাম। ক্যাসেলের ভেতরের কিছুটা অংশ দেখে ছিলাম, পার্কে ঘোরা সম্ভব হয়নি। লেক, লেকে হাঁস ও কত রকম জলচর পাখি ভাসছে। হাঁস গুলো আমাদের দেখে পাড়ে উঠে এল খাবারের লোভে। কিন্তু আমরা তো কিছু খাবার নিয়ে আসিনি। ওঃদের কথা তো জানা ছিল না। পরের বার নিয়ে আসব। রয়েছে মস্ত বড় বড় সবুজ প্রান্তর, যার শেষ কোথায় জানিনা। কোথায় সবুজ মাঠে হরিণের দল ঘাস খাচ্ছে। জঙ্গলের মত বড়  বড় গাছও রয়েছে। লেকের পাড়ে বসার বেঞ্চে বসে কিছুক্ষন জিরিয়ে নিলাম। নইলে খান সাহেবের হাঁটতে কষ্ট হবে।
    বিকেলে ওনার জন্য আবার হাঁটতে বের হলাম। নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে  পেতে উনি  আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এখানে আসার পর অনেক শারীরিক অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। উনি বলেন, এ সবই ওপরওয়ালার দয়া। বিশ্বাস নিজের নিজের, তাই যদি হয়, তবে তাঁর করুণায় যেন একজন নতুন মানুষকে নিয়ে দেশে ফিরতে পারি। এখানে না এলে  ওনাকে এতখানি সুস্থ করে তোলা সম্ভভ হত না। যে কটা দিন বেঁচে আছি, যেন  সুস্থভাবে বাঁচি। 
    এখন সময় সকাল ৭ টা ২০, দীপ বেরিয়ে গেছে। ওরা মা আর মেয়ে তৈরি হচ্ছে। খান সাহেব এখনও বিছানায়। আমি অনেকক্ষণ উঠেছি। চা খাওয়া হয়ে গেছে। জারাকে খাইয়ে দিলাম। রান্নাঘরে টুকটাক কাজ করলাম। আজ রাতে দুজনকে ডিনারে  নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। একজন আমার পূর্ব পরিচিত। তবে সামনা সামনি পরিচয় হয়েছে এখানে এসে। তিনি হলেন পুষ্পদি(পুস্প রায়), আর একজন সুপ্রিতীদি। ওনার কথা আগেই বলেছি। পুস্পদি লন্ডনে থাকেন, নটিংহামে সুপ্রিতীদির বাড়িতে উঠেছেন।
                                    ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments