আমি আমার মতো
পর্ব -১০
সুকন্যা সাহা
সরস্বতী পুজো স্পেশাল
সরস্বতী পুজোটা পুরোপুরি টিনএজ স্পেশাল । হলুদ পাঞ্জাবী আর মায়ের শাড়িতে হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা দুই কিশোর কিশোরীর চোখাচুখি আর প্রথম স্পর্শের শিহরণ। কিশোর বেলা কলকল, ছল ছল, অকারণ হাসি আর খুনসুটির দিন। সরস্বতী পুজোয় প্রথম কৈশোরে পড়া বয়ঃসন্ধির ছেলেদের, মেয়েদের স্কুলের সামনে সাইকেল নিয়ে ভীড় জমানো আর প্রথম ঝাড়ি মারার দিন। মেয়েদের স্কুলের ডাকসাইটে কড়া দিদিমণিদের কাছেও এদিন ছাত্রীদের বয়ফ্রেন্ডরা বিশেষ রকমের ছাড় পেতো। এরকম আরো নানা রকম স্পেশাল সরস্বতী পুজোর স্মৃতি লেখা থাকে মনের ডাইরিতে । প্রথম প্রেমের প্রথম গোলাপ ফুল ডাইরির পাতায় শুকিয়ে গেলেও রয়ে যায় রঙ্গীন স্মৃতির ঘ্রাণ ।
রোজকার দেখা গাবলু গুবলু দু বেনুনি ঝুলিয়ে স্কুলে যাওয়া পাশের বাড়ির মেয়েটা মায়ের শাড়িতে হঠাৎ কত্ত বড় হয়ে যায়!প্রথম বসন্তের বাতাস এসে জানান দেয় যৌবন আর বেশী দূরে নয়। সরস্বতী পুজোর দিন পাড়ার বাংলা মিডিয়াম সরকারী স্কুলই ভালো।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
কনভেন্ট স্কুলগুলোর গায়ে যতই বিলিতি গন্ধ থাকুক , সরস্বতী পুজোর বাংলিয়ানার ফ্লেভার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত । ইস্কুলের গেটের ভিতর ঢুকলেই সেই খিচুড়ি - লাবড়ার মম গন্ধ আর ভিয়েন বসিয়ে তৈরী করা রসে হাবুডুবু পান্তুয়া ... জাস্ট ফাটাফাটি।মনে আছে ক্লাস নাইনে প্রথম সরস্বতী পুজোর দায়িত্ব পাওয়া। একদল যেত ঠাকুর আনতে; একদল পুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই কার্ড নিয়ে স্কুলে স্কুলে নেমন্তন্ন করতে যেত।ছেলেরাও আসত আমাদের স্কুলে। মেয়েদের স্কুলে নেমন্তন্ন করতে যাওয়ার উৎসাহ উদ্দীপনা খানিক বেশী ছিল।আমি ছিলাম ডেকরেশান বিভাগে। মনে আছে আগের দিন বেশ রাত্তির পর্যন্ত চলেছিল আলপনা আর খইয়ের মালা দিয়ে হলঘর সাজানোর কাজ । ছিল রংবেরঙয়ের কাগজের শিকলি লাগানোর কাজ ।
শ্বেত শুভ্র বসনা দেবী
শ্বেতলংকারা ভূষিতা
শ্বেতাম্বরা ধরা নিত্যা
শ্বেতগন্ধনুলেপনা ...
স্কুলের সাজানো শেষ করে বাড়ির ঠাকুর সাজানোর কাজ থাকত । অনেক রাতে আলপনা দিয়ে শুতে যেতাম । পরদিন খুব ভোরেই শ্রীপঞ্চমী ।ঝুড়িতে গাঁদা ফুল পলাশ ফুল, আর আম্রমঞ্জরী রাখা থাকত খোলা ছাদে । সারারাত ওষ পড়ে তাজা হয়ে থাকত ফুলগুলো । ওই ফুলে অর্চনা হবে দেবীর । খুব ভোরে উঠে কাঁচা হলুদ মেখে স্নান সেরে শাড়ি পড়ে ঠাকুমার সঙ্গে পুজোর যোগাড়ের কাজে লাগতাম। ঠাকুর মশাইও আসতেন ভোর ভোর। পাড়ার প্রতিটা বাড়িতেই পুজো হত । সন্তানেরা সবাই লেখা পড়া করে যে ।
সরস্বতী মহাভাগে /বিদ্যে কমললোচনে / বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী / বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে ... পুরোহিত মশাইয়ের মন্ত্রোচ্চারণ, সঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি। খাগের কলম দোয়াত । পাঠ্য পুস্তকে ফুল। মাগো বিদ্যা দিও মা । এ বছর যেন পরীক্ষার ফল ভালো হয়। আমাদের বাড়িতে সরস্বতী পুজোয় একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল। ছোটোদের কপালে বেশ করে চন্দন লাগিয়ে দিয়ে কলাপাতায় রাখা খাগের কলমের ওপর উপুড় হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে হত ... পুরোহিত মশাই বলতেন ,
টং টং সরস্বতী / নির্মল বরনে/ শিবে জটা / গজমতী হার ... মন্ত্রের শেষে কপাল তুলতে হত । যার কপালে খাগের সরু কলম যতক্ষণ বেশি আটকে থাকবে তার লেখাপড়া তত ভালো হবে। বলা বাহুল্য আমার কপালে কলম আটকে থাকত অনেকক্ষণ...বাড়ির পুজো সেরে স্কুলে যাওয়া । মায়ের শাড়ি গয়ানায় বড় বড় ভাব। আঁচল উড়িয়ে ওই একটা দিন রাজেন্দ্রানী । হাঁ করে থাকা প্রেমিক-যুবক কুলের হিরোইন । আরেকটু বড় যারা চিঠি আদান প্রদান, লুকিয়ে সিনেমা (মোবাইলের এত রমরমা ছিল না তাই ), প্রথম প্রেম , প্রথম স্পর্শ।প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই একটা আলাদা শ্রী , আলগা লাবণ্য থাকে । এই সরস্বতী পুজোর দিন যেন সেটা বড় বেশী করে চোখে পড়ত।কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোচিং এ যাওয়া । সে আবার আরেক এপিসোড ... "আমার যা কিছু প্রথম তার সাক্ষী এই সরস্বতী পুজো"... এটা বোধহয় অনেকেরই মনের কথা ।সরস্বতী শুধু বিদ্যার দেবী নন । সুরেরও দেবী।তাই পাড়ার সরস্বতী পুজোয় সন্ধ্যেবেলা ফাংশান বা জলসা ছিল বাধা ।পাড়ার ছেলেমেয়েরাই গান, নাচ, নাটক যে যা পারত করত । তাতেই জমে উঠত সন্ধ্যেগুলো।
সায়েন্স কোচিং , অঙ্কের ক্লাস
ছোটো খুনসুটি নাইন্টিন প্লাস
পড়ার ফাঁকে মেসেজে চোখ
দেখা করবি ? ক্লাস শেষ হোক
সেই তো একই ক্যালকুলাস !
রোজই তো করি, আজ মিনিবাস
পাশাপাশি সিটে হাতে হাত তোর
হলুদ ওড়না চোখে স্বপ্নভোর
হারিয়ে যাব , যেদিকে দুচোখ যায়
একান্তে ইকো পার্কের ঠিকানায় ...
ইনবক্স ভরে মেসেজে মেসেজে
হলুদ ওড়না দাঁড়ায় বাস স্টপেজে ...
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে 👇
0 Comments