জ্বলদর্চি

টুসু উৎসব ও মেলা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৫৪

টুসু উৎসব ও মেলা

সূর্যকান্ত মাহাতো


"আপনি 'ভবসিন্ধু' নাম শুনেছেন? টুসু পরবের সঙ্গে এর একটা যোগসূত্র আছে।"

"'ভবসিন্ধু!' সে তো সংসার রূপ সমুদ্র! এর সঙ্গে টুসু পরবের কী সম্পর্ক?"

"আছে, আছে। 'ভবসিন্ধু' বলতে আপনি যে সংসার রূপ সমুদ্রের কথা বলছেন, এটা তা নয়। এই 'ভবসিন্ধু' হল বেশ বড় একটি শিলাখণ্ডের দুটি সংকীর্ণ ছিদ্রপথ। যার একটি মুখে ঢুকে অন্য মুখ দিয়ে বেরোতে হয়।"

"তার মানে! এ আবার কেমন 'ভবসিন্ধু'!"

"কে 'আসল' আর কে 'বেজন্মা', সেই পরীক্ষা দেওয়া যায় এই 'ভবসিন্ধু' পারাপারের মধ্য দিয়ে। এলাকাবাসীরা অন্তত এমনটাই মনে করেন। তবে সেটা কেবলই একটা 'ভ্রান্ত বিশ্বাস'। শিলাখণ্ডের একটি মুখে গলে অন্য মুখ দিয়ে বেরোনোটা একটু কঠিন বলেই হয় তো এমন একটা বিশ্বাস গড়ে উঠেছে। বাঁকুড়ার খাতড়া শহরের অদূরেই 'পড়কুল' গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কংসাবতী নদী। সেই নদীর বালিগর্ভেই চাপা পড়ে আছে বেশ বড় ও শক্ত এক 'শিলাখণ্ড'। সেই শিলাখণ্ডের দুটি 'হাঁ' মুখ। বালিযুক্ত প্রবাহিত জলস্রোতের ক্ষয় কার্যের ফলেই সরু গলির মতো এমন অদ্ভুত রকমের ছিদ্রপথ তৈরি হয়েছে। এটাই হল 'ভবসিন্ধু'। ওই ছিদ্রপথের একটি মুখে নিজের শরীরকে ঢুকিয়ে অন্য মুখে গলিয়ে বেরিয়ে নিয়ে আসতে পারাকেই 'ভবসিন্ধু' পার হওয়া বলে। দেখা গেছে তিন বছরের শিশুও 'ভবসিন্ধু' পার হতে পারে না। আবার চল্লিশ বছরের মরদও অনায়াসে পেরিয়ে যেতে পারে।(পৃষ্ঠা ১৭, তুষু ব্রত ও গীতি সমীক্ষা/ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত) একমাত্র 'আসল'-রাই পার হতে পারবে কিন্তু 'বেধোয়া' বা বেজন্মা-রা আটকে যাবে, এমন বিশ্বাস পড়কুল গ্রামের মানুষের মধ্যেও দারুণভাবে রয়েছে।"

"এ তো বিরাট এক 'ভবসিন্ধু'র গল্প শোনালেন! কোথায় আছে যেন বললেন।"
"বাঁকুড়া জেলার খাতড়া শহরের অদূরেই পড়কুল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কংসাবতীর নদী গর্ভে। ওখানে গেলেই 'ভবসিন্ধু' দর্শন লাভ ঘটতে পারে। তবে দর্শন লাভ যে হবেই এমনটা কিন্তু জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ বর্ষার সময় দু কূল প্লাবিত বানে এই 'ভবসিন্ধু' বালিগর্ভে চাপা পড়ে যায়। শীতে জলরাশি ক্ষীন হয়ে পড়লে এলাকার মানুষ মকরের সময় বালি সরিয়ে ফেলে। তখন 'ভবসিন্ধু'র দেখা মেলে। মকরে 'পড়কুল উৎসবে' এই 'ভবসিন্ধু' শিলাখণ্ডের পূজাও দিয়ে থাকেন এলাকাবাসী। তাই পড়কুল মেলায় 'ভবসিন্ধু' পারাপার বা দর্শনলাভ একটা বাড়তি আকর্ষণ বলা যেতে পারে। এই 'পড়কুল' ছিল একসময় টুসু পরবের 'কুম্ভমেলা'। নদীর পারে দূর দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি ঘটত। গানে গানে টুসু ভাসান হত। এখনো উৎসব চলে। রামায়ন, বাউল এর মতো একাধিক গানের আসর বসে। বিরাট বড় সেই মেলায় যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি হয়। তবে ইদানিং মেলার বহর বেশ কিছুটা ম্লান হয়েছে। পাশেই মুকুটমনিপুর জলাধারের তীরে এখন মানুষের ঢল নামে মকরের দিন। সেখানেও বড় রকমের মেলা বসে। এবার তো ড্যামের পাশে 'পরেশনাথ' পাহাড়ে জনপ্লাবন নেমেছিল। বিভিন্ন এলাকার নদী ও খালগুলোতেও টুসু ভাসান উপলক্ষ্যে ছোট ছোট মেলা বসে। আর মেলার পাশে অবশ্যই বসে মোরগ লড়াইয়ের বেশ বড় বড় আসর।"
বলা শেষে একটি গান ধরলাম,

"সীতা বলে দাও ছেড়ে ও রাম কাঁদে বনে
সীতা হরে নিল রাবণে, ও রাম কাঁদে বনে।"

শিক্ষক মশাই বললেন, "সংসার নামক সমুদ্র পারাপার তো আর সহজ কথা নয়। কেউ পারবেও না। আমিও করতে পারব না। তাই এই 'ভবসিন্ধু' পার হওয়ার একটা বাসনা মনে মনে রয়ে গেল। যাইহোক আপনি যে গানটা গাইলেন, তা শুনে মনে হচ্ছে, টুসু গানে রামায়ণেরও বেশ প্রভাব আছে দেখছি।"

"শুধু প্রভাব নয়। টুসু গানের কুড়ি শতাংশ গানই রামায়ণের কাহিনী নির্ভর গান। 'সীতার বনবাস', 'রামের বনবাস', 'রামের বিয়ে', থেকে 'লঙ্কার দাহন', 'স্বর্ণমৃগের কথা' বার বার গানে উঠে এসেছে। তবে রামায়ণের এই গানগুলোতে কোন ধারাবাহিকতা নেই। প্রসঙ্গ ক্রমে যে গান যখন মনে আসে সেই প্রসঙ্গেই গাওয়া হয়। আসলে রামায়ণের প্রভাব তো জঙ্গলমহলে একরকম আছেই। সেই সঙ্গে টুসু গানে বর্ণিত 'রাম' ও 'সীতা' যেন রামায়ণে 'রাম- সীতা' নন। এই রাম ও সীতা জঙ্গলমহলের মানুষের অনেক কাছের। তাদের মতোই যেন মাটির মানুষ। তাদের মতোই সহজ, সরল সাদামাটা এক চরিত্র যেন। তাই তো সীতার দুঃখে সকলেই কাতর হয়ে পড়েন।"
"পঞ্চমাস গর্ভসীতা রাম পাঠালেন তপোবন
রাম লক্ষণ রেখে এলো যেখানে অরণ্যবন।
অরণ‍্যার বনে সীতা একা পাশা খেলেছে
যোগীর বেশে রাবনে এসে সীতা হরণ করেছে।"

"অনেকগুলো গ্রামে দেখলাম পুরুষের দল খোল করতাল নিয়ে হরেকৃষ্ণ নাম করতে করতে নগর কীর্তনে বেরিয়েছে।" শিক্ষক মশাই বললেন, "তবে কি টুসুগানে রাধা-কৃষ্ণেরও একটা প্রভাব আছে? কিন্তু মেয়েদের মুখে রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক কোন গান সেরকম ভাবে তো শুনতে পেলাম না!"

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
"এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত একটা ভালো কথা বলেছেন, আসলে রাধা-কৃষ্ণের প্রভাবে জঙ্গলমহলে যতটা পুরুষেরা প্রভাবিত হয়েছেন, অন্দরমহলের নারীরা ততটা হয়নি। এছাড়াও টুসু গানে লৌকিক প্রেম কথাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি করে, তাই হয় তো রাধা-কৃষ্ণ প্রসঙ্গ এখানে গৌণ।" (ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/বঙ্কিমচন্দ্র মাহাত, পৃষ্ঠা - ১৭২) 

"শুধু রাম কাহিনী নয়, টুসু গানে গানে দূরের 'শহর' কলকাতা থেকে শুরু করে নিকটবর্তী বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, রাণীগঞ্জ, বর্ধমান, পুরুলিয়া ও  ঝাড়গ্রামের মতো ছোট শহরের কথাও বার বার উঠে এসেছে।"

"'শহরের' কথা টুসু গানের উপাদান হয়ে উঠল কীভাবে?"

"আসলে গ্রাম-গঞ্জের মানুষগুলোর কাছে 'শহর' সম্পর্কে নিদারুণ এক কৌতূহল আছে। তাদের ধারণা শহরে কোন সমস্যা নেই। সেখানে কোন দুঃখ নেই। কেবলই সুখ আর আনন্দ। সেখানে সব ইচ্ছাগুলোই সহজে পূরণ করা যায়। বিশেষ করে শহর কলকাতার কথা বারবার গানে উঠে এসেছে।"

"টুসু যাবে রেল দেখতে কলকেতা শহরে
আমায় ছেড়ে যাত‍্যে লারে
উয়ার মন কেমন করে।"

কিংবা-
"কলকাতা যে গেছলে টুসু কি কি গয়না উঠেছে
ইলির মিলির ঝিলির কাটা পায়ে পাতমল পরেছে।"

"আসলে টুসু গানের উপাদানের কোন সীমারেখা নেই। ঘরের 'বাগাল' থেকে শুরু করে 'রাজা-রাণী' পর্যন্ত সকলেই গানে গানে উঠে এসেছে। মকরের পূর্ব দিন ও মকরের দিন জঙ্গলমহলের কোনায় কোনায় টুসু গানের বন্যা বয়ে যায়। এখানকার আপামর মানুষের দুঃখ কষ্টকে সেই সুরের বন্যা ধুয়ে দেয়। নাচে, গানে, হাসি, ঠাট্টায়, আনন্দে কীভাবে যেন কেটে যায় দুটো দিন।"

"তবে মকরের দিন নদী খাল ও পুকুরের ঘাটে, টুসুকে নিয়ে গানের যে লড়াই তা এক আলাদা মাত্রা বহন করে।"

"আমার টুসু মান করেছে ই পাড়ার তমাল তলে
আনরে সন্দেশ থালে করে মান ভাঙাই সবাই মিলে।
উয়ার টুসু মান করেছে উপাড়ার তমাল তলে
আনরে জুমড়া হাতে করে ধাসব রে সবাই মিলে।"

"ও পাড়াতে দেখে এলাম উয়ার টুসু তুঁষ চালে
আমার টুসু বেঞ্চে বসে ইংরেজি পুঁথি পড়ে।"

"আমার তুষু সিনান যাবে/ জোড়া ঢাকো বাজিয়ে
উয়ার তুষু সিনান যাবে/ জোড়া কুকুর লেলিয়ে।"

"আমার টুসু মুড়ি ভাজে চুড়ি ঝলমল করে
তাদের টুসু ছঁচ বা টুসু আঁচল পাতি মাগে।"

"'টুসু' ভাসানের সময় একাধিক টুসু দলের গানে গানে এ লড়াই অনেক সময় শালীনতাও অতিক্রম করে। তখন নানা রকমের অশ্লীল বা 'রং' টুসু গানও গাওয়া হয়। তবে সর্বক্ষেত্রে যে এমনটা ঘটে তা নয়। ক্ষেত্র বিশেষেই  এটা সাধারণত ঘটে থাকে।"

শিক্ষক মশাই বললেন, তবে মকর পরবে আমার সব থেকে ভালো লেগেছে এখানকার খাওয়া দাওয়াতে। বিশেষ করে এখানকার মাহাতদের "মাংস পিঠা"। শাল পাতা কিংবা কলা পাতা দিয়ে বানানো এমন সুস্বাদের পিঠা সত্যিই অমৃত সমান। কত সব পিঠা। নামগুলোও প্রথম শুনলাম। পুর পিঠা, খেজুর গুড়ের পিঠা, লাউ চকলি, সিম পিঠা। তাই মকর পরবকে পিঠা পরব বললেও অত্যুক্তি হবে না বোধহয়।"

এভাবেই গানে গানে টুসু ভাসিয়ে মকর স্নান করে গায়ে নতুন কাপড় পরে আরো একটি বছরের অপেক্ষায় সকলে বাড়ি ফেরার পথ ধরে।

পর্ব ৫০ - ৫৪ এর নিবন্ধগুলোর গান ও তথ্যসূত্র নেওয়া হয়েছে নিম্নে উল্লিখিত গ্রন্থগুলো থেকে।

তথ্যসূত্র: ১) ঝাড়খণ্ডের লোকসাহিত্য/ বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতো
২) বাংলার লোকসাহিত্য, ৩য় খণ্ড/আশুতোষ ভট্টাচার্য
৩) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, ২য় পর্ব/ দেবপ্রসাদ জানা সম্পাদিত
৪) তুষু ব্রত ও গীতি সমীক্ষা/ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত
৫) সীমান্ত বাংলার লোকযান/সুধীরকুমার করণ



Post a Comment

1 Comments