জ্বলদর্চি

দেশান্তরী-২/হিল্লোল রায়

পর্ব-২
দেশান্তরী 

হিল্লোল রায়

হোক না মোচন দুঃখের বোঝা

জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হবে; দেশের ও দশের হয়ে নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করতে হবে; মানব কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে হবে; সার্থক মানুষের মত মানুষ পরিচয় দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে - এই ইচ্ছাটা আমার বহুদিনের। ইচ্ছাটা প্রবল আকার ধারণ করে আমি যখন হাবড়া হাই-স্কুলের নবম শ্রেনীর বিজ্ঞানের ছাত্র। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার উপরোক্ত কল্পনার সংগে বাস্তবের মিলন ঘটাতে হবে। ঈশ্বরের কাছে নীরব প্রার্থনা জানিয়েছিলামঃ আমাকে এমন শক্তিটুকু দিতে যার সাহায্যে আমি সৎ-নিরপেক্ষভাবে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় আত্মীয় স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীর বিরুদ্ধ শক্তির বিপক্ষে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারি। ঈশ্বর হয়ত আমার এই নীরব প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।

জানি না, অমোঘ অলৌকিক কোন শক্তির অধিকারী আমি কিনা ! কিংবা ঈশ্বরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোন গোপন মানস যোগ আছে কি না ! কারণ আমার আজ পর্যন্ত যতগুলো প্রার্থনা তাঁর কাছে করেছি, তা সবই পূরণ করতে পেরেছি। তাঁর আশীর্বাদ কিংবা সহায়তা আমার পাথেয় না হলে কল্পনার ইমারত সৌধ ধূলিসাৎ হয়ে যেত। পরিগ্রহ করত মলিনতা। ছোটবেলায় একটা গল্পে পড়েছিলাম “অলৌ্কিক শক্তি যে কি তা বোঝানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়; এমন কি যিনি এই শক্তির অধিকারী, তিনি নিজের মধ্যেই এই শক্তির প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে পারেন না। শুধুমাত্র এই শক্তির বাহ্যিক প্রকাশেই শক্তির অনুভূতি প্রস্ফূটিত হয়।”

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
আমার এ লেখাটা হয়ত কাব্যিক পর্য্যায়ে পড়ে যাচ্ছে কিংবা অতিমাত্রায় কাল্পনিক বলে পাঠক সমাজ মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে নীরব ধিক্কার জানাচ্ছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক ও ঈর্ষাব্যঞ্জকও বটে। তথাস্তু ! অন্তর্যামী এবং আত্মজীগিষু মন নিয়ে নিজের মনে প্রশ্ন করলেই এর উত্তর পাঠক সমাজ এমনিই পেয়ে যাবেন। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় ধৈর্য্য সহনশক্তি-সহানুভূতিশীল মন দরকার। তা না হলে নৈব নৈব চ! এই ধরণের কোন শক্তির প্রয়োগ হয়তো ঈশ্বর আমার উপর আরোপ করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টা ও সুযোগ-দানেই আমার অগ্রগমন। নিজস্ব বলতে কায়িক শ্রম ও যথাস্থানে তার সুষ্ঠু প্রয়োগ।

আবার প্রসংগ ছাড়া হয়ে যাচ্ছিলাম। পিতৃবিয়োগের পর পিতৃবংশের স্নেহবঞ্চিত হয়ে মাতুলালয়ে আমরা তিন ভাই (এবং আমিই বড়) ও মা আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। সম্পত্তিবঞ্চিত ও পৈ্তৃক গৃহবিতাড়িত আমাদের এই চার জনের পরিবার কেবলমাত্র চোখের জল, পাড়া-প্রতিবেশীর বিরূদ্ধাচরণ ও ভৎর্সনা সম্বল করে আর্থিক জর্জরিত মাতুলালয়ে মাথা গুঁজবার ঠাঁই পেয়েছিল। সেটা অক্টোবর ৬, ১৯৫২ সালের কথা। নানা ঝড়ঝঞ্ছা মাতুল পরিবারের উপর দিয়ে গিয়েছে তখন থেকেই। অর্ধাহারে-অনাহারে, ছিন্নবস্ত্র পরিধানে মামাদের সংগে আমাদেরও দিন কেটেছে। মা-দিদিমার চোখে রোজই জল দেখতাম। তারা অনাহারে থাকলেও আমাদের বুঝতেই দেন নি আমাদের সাংসারিক অসচ্ছ্বলতার কথা, অভাব-অনটনের ইতিহাস। একটু বড় হলেই বুঝতে শিখি সব কিছুই-বিশেষ করে আমাদের পারিবারিক বিপর্য্যয়ের ঘটনা। জীবনে কোনোদিন সুখের মুখ দেখতে পাবো কি না ভগবানকে প্রশ্ন করেছি, বার বার। সংক্ষিপ্ত উত্তর পেয়েছি, “ধৈর্য্য ধরো, বৎস, ধৈর্য্য ধরো।”

তাঁর প্রতিশ্রুতি ভগবান বাস্তবায়িত করবার সু্যোগ দিয়েছেন। আজ সেই লব্ধজ্ঞানের ভিত্তিতে বলতে পারি সৎ এবং একনিষ্ঠভাবে যে কোন কাজ করলে- তার ফসল একদিন পাওয়া যাবেই। কাজ মানেই সাধনা। সাধনার বাহ্যিক প্রকাশ ক্ষমতার সুষ্ঠু এবং সময়োচিত প্রয়োগেই মানবজীবনের সফলতা।

পিনাকেতে লাগে টংকার, এলো হৃদে ঝংকার

দুঃখের ইতিহাস কারো শুনতে ভালো লাগে না, সখ করে কেউ শোনাতেও চায় না। কিংবা আমার এ লেখা পড়ে সম্পূর্ণ ইনিয়ে -বিনিয়ে আষাঢে গল্প বলে তুড়ি দিয়েই উড়িয়ে দেবে। যাই হোক, আমার দুঃখ আমার বুকের মধ্যেই চাপা থাক। দুঃখের গল্প বিশেষে আমার ব্যক্তিগত পরিবারের ঘটনা কাউকে জানাবার সদিচ্ছাই আমার নেই। মাঝে মাঝে দুঃখের আগুনটা বেশী মাত্রায় জ্বলে ওঠে বুকের মধ্যে। সদম্ভ প্রকাশের চেষ্টা করলেই আমার বুকটা কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তখন প্রকাশ করতে না পারলে ব্যথাটা যেন বুকের মধ্যে গুমরে কেঁদে মরে, আর ছাইচাঁপা আগুন কিংবা তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলতে চায় না। তখনই আংশিক প্রকাশ করেই দুখানল নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করি। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই ব্যাপারটা সম্পূর্ণই বিজ্ঞানভিত্তিক বোঝা যাবে। উনুনের গনগনে আঁচের উপর জল ভর্তি করে হাঁড়ি চাপালে আগুনের প্রভাবে জল বাষ্পান্তরিত হয়ে যায়। কিন্তু সেই বাষ্পকে তার বহির্মুখী গতিকে রুদ্ধ করে দেয় হাঁড়ির উপরকার ঢাকনী। তখন অভ্যন্তরস্থ বাষ্প নীরব হয়ে থাকতে পারে না। সহজে প্রকাশ করবার জন্য নিজের মধ্যেকার সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করে তোলে। এই শক্তির প্রকাশ অল্পক্ষণের মধ্যেই হাঁড়ির মুখ চেপে কন্ঠরোধকারী ঢাকনীকে বর্হিমুখী করে তোলে। আর তখনই এই সঘন শক্তির আত্মপ্রকাশের সার্থকতা। জানি না আমার নিজের ক্ষেত্রে এই শক্তির প্রয়োগ ও প্রকাশ ক্ষমতার আপেক্ষিক বেগ কতখানি ! তর-তম-র মধ্যে নিশ্চয়ই।

সঠিক ঘড়ির কাঁটার সময় মনে করতে পারছি না। তবে ডাইরী-লেখার বদ অভ্যাস থাকায় দিন-তারিখ গুলো উল্লেখ করতে পেরেছি। বেংগল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (শিবপুর) জীবনের শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই ২১শে মার্চ, ১৯৭৪ সাল, বৃহস্পতিবার। ফাইন্যাল ইয়ারে আমি ছিলাম সেনগুপ্ত হলের আবাসিক। বি.ই.কলেজে থাকাকালীন দাদুর একটা চিঠি পেয়েছিলাম আমার আমেরিকা আসবার ব্যাপারে তোড়জোড় করার জন্য। সেনগুপ্ত হলের রুম নং ৯৮ এর ঠিকানায় ডাক-বিভাগের দাক্ষিণ্যে চিঠিটা আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল জানুয়ারী ৪, ১৯৭৪ শনিবার।

দাদুর চিঠি থেকে এটুকু আভাস পেয়েছিলাম যে আমেরিকা এলে চাকুরী পেতে আমার কোনই অসুবিধা হবে না এবং আমার খাবার তালিকায় মাংসকে অনুপস্থিত রেখে আনুসঙ্গিক খাবারের দিকে উৎসাহী হতে হবে। এটা আমার উপর স্নেহপরবশ দাদুর সাবধানবাণী বিশেষ করে ১৯৭৩ সালের এপ্রিল ২ থেকে এপ্রিল ৩০ পর্যন্ত আমি “জন্ডিস” রোগে ভুগেছিলাম। খাবার তালিকা ডাক্তারের পরামর্শ অনু্যায়ী তৈ্রী করে নিতে হয়েছিল। সালফার-ড্রাগস, পেঁয়াজ, ফ্যাট-অয়েলস্-বাটার -ইত্যাদিকে উহ্য রেখে এই তালিকা। মাংসের স্থান ও এই তালিকায় দেওয়া হয় নি। কাজেই আমেরিকা এলে মাংস না খেয়ে থাকা যায় না। সুতরাং দাদুর এই সাবধান বাণী মনে রেখে আমেরিকা আসবার ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম ঐ চিঠি পাবার পর থেকেই।

ক্রমশঃ


Post a Comment

1 Comments

  1. সুন্দর লিখছেন। চলুক

    ReplyDelete