জ্বলদর্চি

দেশান্তরী-৩/ হিল্লোল রায়


দেশান্তরী-৩/ হিল্লোল রায়


দেহ-মনের সুদূর পারে, দিনটা বাজে বীণার তারে

প্রস্তুতি তো মনে মনে নিলেই হয় না- ওটাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। ভারতবর্ষে থাকতে হাবড়া -শিবপুর(বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) এবং হাবড়া -বনগাঁ ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ হয় নি। কাজেই কেবলমাত্র সংস্পর্শ কতকগুলো শুকনো অক্ষরে লেখা বই ও ম্যাগাজিন এবং স্বল্প সংখ্যক বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই সীমিত ছিল। তবে এদের সঙ্গে ঠিক আমার মনোজগতের ভাব-ভাষা প্রকাশ করার সাক্ষাৎ প্রকাশ কিংবা সুযোগ অল্পই মিলেছিল। একটা ধারণা মনের মধ্যে দানা বেঁধেছিল আমেরিকা আসতে গেলে অন্তত ইংরেজিতে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার সামর্থ টুকু রাখতে হবে। ইংরেজি/বাংলা/হিন্দি/সংস্কৃতে আমার হাতের লেখায় শিক্ষকেরা বলতেন “মুক্তাক্ষর”। হয়ত সেইজন্যই সব কিছুই আমি হাতে লিখে রাখতে ভালবাসতাম এবং এখনও তার থেকে কোন চ্যুতি হয় নি। হাই স্কুল জীবনে পঞ্চম শ্রেনী থেকে শিক্ষকদের আদেশে স্কুল পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিতে হয়েছিল হাইয়ার সেকেন্ডারী পাশ করা পর্যন্ত। আমার কাছে এখনও সেইসব "জ্যোতি” ম্যাগাজিন সযত্নে সংগৃহীত আছে। ছয় বছর বয়সে আমার বাংলা এবং ইংরাজী কবিতা লেখালিখিতে হাতেখড়ি।


আমেরিকায় কাজ চালানোর মত যদিও ইংরাজীতে প্রকাশ করার গুণটুকু নিজের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে ছিল তবুও কেমন যেন সাহস পেতাম না। তাই দেশে থাকতে নিজের এই সামর্থ্যকে পরিমাপ করবার প্রচেষ্টায় সহায়তা নিয়েছিলাম আমার আবাল্য-কৈশোর বয়সের বন্ধু শ্রী সঞ্চয় ঘোষের। সেইসময় তিনি ভারতীয় মানক সংস্থা, কলকাতা শাখা; ইংরাজীতে ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস ইনস্টিটিউশন, ক্যালকাটা ব্র্যাঞ্চ পাবলিক রিলেশনস এ্যান্ড এ্যাডমিনিস্ট্রেশনে কর্মরত। অকপটে স্বীকার করছি, বন্ধুবর সঞ্চয় ঘোষের আন্তরিক সহযোগিতা ও সময়োচিত উৎসাহ দান আমার আমেরিকা আসবার ব্যাপারে অব্যর্থভাবে কাজ করেছে। দেশে থাকতে ভিসা জোগাড় করবার ব্যাপারে নিজে অনেকক্ষে্ত্রে ডিসিশান নিতে পারতাম না আমার সন্দেহবাতিক মন থাকায়। সেক্ষেত্রে সঞ্চয় ঘোষের উৎসাহই ছিল “ট্র্যানকুইলাইজার”।


সঞ্চয় ঘোষের "আমি” নামক এই বন্ধুকে প্রেজেন্টেশান হিসাবে দেওয়া ১৯৭৪ সালের সবুজ ডাইরীখানার ১১ই এপ্রিল, ১৯৭৪

তারিখের পাতাটা আজ গর্বে জ্বলজ্বল করছে। এই সবুজ ডাইরীখানাই আমার অনুগত সংগী। বেশ মনে আছে, কলকাতা -১৬ (৩ এ শেক্সপীয়ার সরণী) তে অবস্থিত মার্কিণ দূতাবাসে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ঐ ১১ই এপ্রিল ১৯৭৪ ই সর্বপ্রথম পদার্পণ। নিজের সুপ্ত ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে না পারলে যা হয়। ১০ই এপ্রিল, ১৯৭৪ বুধবার রাত্ থেকেই আমার চোখে ঘুম ছিল না।

আমেরিকান কনস্যুলেট অফিসে যাব- নিজের বক্তব্য যদি ভাল করে ইংরেজিতে প্রকাশ করতে না পারি? কি লজ্জায়-ই না পড়ব ইত্যাদি আর ও অনেক কিছু। তাই শেষ রাত থেকেই (তিনটে নাগাদ সম্ভবতঃ) নিজের প্রকাশভংগীকে নিজের মনের মধ্যেই তালিম দিচ্ছিলাম। সেই সংগে আমেরিকা আসবার উৎসাহটা যাতে বেসুরো না হয়ে যায় সেইজন্য নিজের মনকে তৈ্রী করতে লাগলাম। মামাদের আমেরিকায় অবস্থানকাল ও জীবনযাপন টেপরেকর্ডারে বেঁধে রাখা অক্ষরগুলোর দিকে দৃষ্টিভঙ্গীকে খুব কাল্পনিকভাবে জিইয়ে রেখেছিলাম।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
আমার লাগি জাগো হে ভগবান


সূর্য্যিমামার হাতছানি ও “আর্গোসী” (হাবড়া-হিজলপুকুরিয়া-২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ) থাকাকালীন শোবার ঘরটাকে প্রথম প্রত্যূষে সূর্য্যিমামার সস্নেহ আলিঙ্গন আমার প্রাণবীণায় জানিয়ে দিল বিছানা ত্যাগ করে প্রাত্যহিক কাজ সেরে নাও। যখন উঠলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৬-৩০ মিনিট । কাগজপত্র গুছিয়ে নিলাম। অনুসরণ করলাম “ওঠ শিশু, মুখ ধোও, পর নিজ বেশ।” প্রস্তুত তো হলাম। বেশ উৎসাহব্যঞ্জক হাসি ও গুরুজনদের আশীর্বাদ মনে মনে পেলাম বলে মনে হল। রওনা হবার আগে আর্গোসি-তে ঠাকুর ঘরে গিয়ে নীরব প্রার্থনা জানালাম। “আমার আমেরিকা যাবার ইচ্ছাটাকে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করতে দাও। বিশেষ বিশেষ কতকগুলো কারণেই আমার ও দেশে যেতেই হবে। আমায় শক্তি দাও আমার মনোবাসনাকে চরিতার্থ করবার।” প্রার্থনা জানিয়েই আর্গোসি ত্যাগ। এরপর সকাল ৭-১২ মিনিটের ট্রেনে হাবড়া স্টেশন থেকে শিয়ালদহ এলাম। নিজের হাতে ঘড়ি না থাকায় সময় জানবার জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করছিল। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অফিসন্মুখী হাজার হাজার যাত্রীর ভীড় ঠেলে শিয়ালদহ স্টেশনের চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম দিয়ে শহর কলকাতায় আসছি। প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি তখন জানাল এখন সময় সকাল ৮-৩০ মিনিট। সূর্য্যিমামার প্রখর তেজ যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল। আর্গোসি থেকে প্রাতঃকালীন ফলাহার তখন পেট থেকে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে বলে মনে হল। গায়ের লোমকূপগুলো বিন্দু বিন্দু ঘামের নীরব দর্শক হয়ে মজা দেখছিল। একটু শশব্যস্ত হয়ে ভীড় ঠেলে শিয়ালদা স্টেশন থেকে ১২নং এসপ্ল্যানেডগামী ট্রাম ধরলাম। মিনিট পঁচিশের মধ্যেই এসপ্ল্যানেড । মাঝখানে অবশ্য ভদ্রবেশধারী দুই ভদ্রলোকের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি চলছিল ট্রামের মধ্যেই। আমার হাতের ব্যাগটা ঐ ধাক্কার আলিংগন পেয়েছিল এবং আমায় উপদেশ দিল “একটুখানি সরে দাঁড়াও।”

এসপ্ল্যানেড এর চতুর্মূখী মোড় থেকে আমি বাঁক নিলাম স্টেটসম্যান পত্রিকা-অফিসের পিছন দিকে অবস্থিত “আনার চেম্বার” বিলডিংয়ের দিকে। এই বাড়িতেই ভারতীয় মানক সংস্থার কলকাতা শাখা। লিফট আনুকূল্যে দু মিনিটেই আনার চেম্বারের চতুর্থ হলে পৌঁছুলাম কারণ এই তলেই আমার বন্ধু সঞ্চয় ঘোষ কর্মরত। ওঁর চেম্বারে ঢুকতেই আকর্ণবিস্তৃত হাসি (ক্রিস্টাল টুথপেস্টের বিজ্ঞাপণ হাসিখানা) ও উষ্ণ অভর্থনা পেলাম। “চা” না “কফি”, “টা”-টা অবশ্য সম্পূর্ণই তোমার ইচ্ছাধীন-এতগুলো অফার মুহূর্তেই পেয়ে যাব আশা করতে পারি নি। নিজের দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে ওঁর মুখোমুখি চেয়ারখানাকে সস্নেহে আলিংগন করলাম। ওঁর ঘড়িতে তখন সকাল ৯-১৫ মিনিট। আমার আগমনের হেতুটাও একফাঁকে শ্রীমানকে জানালাম। ওঁর কাজের ফাঁকে গল্প ও চা এর সংগে টা গুলোর সদগতি চলছিল।

“তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ, তোমাদের অফুরন্ত সুযোগ আছে, ইঞ্জিনিয়ার মানুষ তোমরা...গড়বে-পিটবে-ভাঙ্গবে দেশকে ইত্যাদি ইত্যাদি...আর আমরা তো ছেঁড়াকাঁথার মানুষ, নুন-জল-ডাল সংস্থান করতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করব।” সঞ্চয় ঘোষের মুখের এ উক্তি সখেদে। তবুও আমেরিকা আসবার ব্যাপারে আমার উৎসাহের জোয়ার ভাঁটার মধ্যে সঞ্চয় ঘোষের স্নেহসঞ্চাত উপদেশ শিবরাত্রির সলতের মতোই জ্বলছিল। ওঁর অফিসের বন্ধু-বান্ধবকে ফর্ম্যালিটি বজায় রেখে নীচে নামছি লিফট দিয়ে। এখন আমার সংগী হাত-ব্যাগ ও শ্রীমান সঞ্চয় ঘোষ।

ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments