জ্বলদর্চি

একটি গাছের মৃত্যু ও বুধন /বিজয় চক্রবর্তী

একটি গাছের মৃত্যু ও  বুধন  

বিজয় চক্রবর্তী


একটি জমজমাট গল্প লেখার চেষ্টা করছি 
কিন্তু কিছুতেই জমছে না । প্লটগুলি ভো কাট্টার মতো গুল্লি পাকিয়ে মাথা থেকে বার হয়ে যাচ্ছে । এই যেমন কয়েক লাইন লিখে কেটে দিলাম । মন মতন হলো না....

‘নিতান্ত অবহেলার পাত্র লারান কিস্কু ,কোমরে গোজা খৈনির ডিব্বা ,সাইকেলের কেরিয়ার থেকে ছিঁটকে  পড়া  সিমেন্টের ব্যাগ ।তার থেকে বের হয়ে আসা করনিক ,মশলা মাখানোর কড়াই  ।বালি সিমেন্টের মিশ্রন শক্ত হয়ে লেগে আছে কানায় ।এর একটু দুরে চিত হয়ে শুয়ে আছে সে । সাইকেলটি অক্ষত আছে ।আপাত দৃষ্টিতে লারান শান্তিতে শুয়ে আছে ,লাল মোরাম রাস্তার ধুলিতে । আজ রাত এখানেই থাকবে । কাল সকালে কেউ না কেউ খুঁজে পাবে তাকে । 

    পছন্দ হলো না । এমন তো মাঝে মাঝে ঘটে । যারা সকালে উঠে খবরের কাগজ গেলে তাদের কাছে এ গল্প নতুন নয় ,প্রতি মাসে একটি দুটি এমন ঘটনা ঘটে ।

  নতুন করে প্লট বানাতে শুরু করলাম । যেটুকু মনে আসছে লিখে রাখি । একটু বাড়িয়ে পরে ফেসবুকের কোন একটি গ্রুপে দিয়ে দেওয়া যাবে ।

‘জঙ্গলের মধ্যে জেলা শহর ,আড়ে বহড়ে বাড়ছে । কোন ঠাসা হয়ে পড়ছে জঙ্গলের জন্তু জানোয়ার । দু পাশে ঘন শালজঙ্গল চিরে মহুলবনীর দিকে চলে গেছে প্রধান মন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা ।যেখান থেকে পিচ উঠে তলার খোয়া বের হয়েছে ।তার ডানদিকে একটি পায়ে চলা পথ জঙ্গল চিরে চলে গেছে দুর কোন সাঁওতাল গ্রামে । ওই পায়ে চলার পথের প্রথম অংশ বেশ ফাঁকা ।পাঁচ শাতশো মিটার যাবার পর দুপাশের শিয়াকুল কাটার বাড়বাড়ন্ত লক্ষনীয় । তাছাড়া শাল পাতার ফাঁক দিয়ে পশ্চিম আকাশের লাল ছটা মোরাম রাস্তায় পড়ে এক মোহময়ী আবেশ তৈরী করেছে । সবুজ গালিচার উপর লাল ফিতার রাস্তা । লাল পাড় শাড়ি আর লাল ফিতায় চুল বেঁধে দিনমনি যখন নাচে তখন কি সুন্দর ই না লাগে । লারান ভালো ধামসা বাজায় ,দিনমনি নাচলে লারান একটু জোরেই ধামসাকে আঘাত করে ।লারান তার সাইকেলের প্যাডেলে একটু জোরেই চাপ দেয় ।এখনো  তিন চার কিলোমিটার যেতে হবে তাকে ।

   এই যা আবার লারান । না না ওঁকে নিয়ে আবার গল্প কি ? এ সব তো ঘটেই থাকে । অমন লারানকে নিয়ে হাজারটা গল্প ছড়িয়ে আছে এই সব জঙ্গলের দেশে । নতুন কিছু ভাবতে থাকি ।গল্প আজ লিখতেই হবে এবং সেটি হওয়া চাই বেশ জমজমাটি । না এবার আর কাটলাম না ।উপরের অংশ গুলি যে পাতায় লেখা আছে সেটি উল্টে অন্য পাতায় অন্য কিছু লিখতে শুরু করলাম । 

‘এমন সুন্দর বিকাল শুধু রূপকথায় মেলে । একঝাঁক সাদা পায়রা সকালের সোনালী রঙ মেখে ধান ক্ষেতের মধ্যে তালগাছের মাথার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে । পায়রাগুলো সাদা পেয়াজা তুলোর মতো মেঘের ফাঁক গলে আসা চকচকে সোনারোদ মেখে এক অদ্ভুত আলোর ঝলক তুলছে মাঝে মাঝে । পায়রাগুলি থাকে হরিবাবুর পোলট্রি ফার্মের ছোট ছোট খাচায় ।পোলট্রির মতো নয় ,দিনের বেলায় ওরা স্বাধীন । না না এসব দেখার জন্য কেউ সেখানে নেই। ঐ ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যে লালমাটির রাস্তা চলে গেছে সেই রাস্তা বরাবর সোজা জঙ্গলের দিকে চলে গেলে প্রথমে পাবেন বেশ কয়েকটি মহুলগাছ । ওগুলি বুধনদের গাছ । যদিও জায়গাটি সরকারী কিন্তু ঐ গাছের ফল বুধনদের পরিবারের লোকজনই বংশ পরম্পরায় ভোগ করে ।বুধনদের গাছগুলির পর দুটি বাঁশ ঝাড়। সেটি পেরিয়ে আরও চার পাঁচশ মিটার গেলে একটা মাঠের মতো । চ্যাটাং পাথরের মাঠ। দু-একটি ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ এবং কিছু পার্থেনিয়াম ও ইউপটেরিয়ামের ঝোপ উকি দিচ্ছে ।দু চারটে পলাশের মোটা পাতা উকি দিচ্ছে দক্ষিন পুর্ব কোনে । রাস্তাটি মাঠকে বেড় দিয়ে পশ্চিম থেকে পুবের দিকে জঙ্গলের দিকে চলে গেছে আর মাঠ পেরিয়ে প্রথম বাড়িটি বুধন দের । গ্রামের শুরু বলা যায় । গ্রামে পন্চাশ ষাট ঘর বসতি । অধিকাংশ মাটির বাড়ি । শুধুমাত্র বুধনদের বাড়িটি ইটের। প্লাস্টার বিহীন ,ছাদ টালির । গ্রামের লোক সবাই চাষবাস করে । চাষের গরু ,গাই গরু ,মুরগী আছে কমবেশী সকলেরই । বুধনদের গরু না থাকলেও বেশ কয়েকটি মোরগ আছে । মোরগ গুলিকে  বেশ যত্নে রাখে বুধনের বাবা । কুসুমডিহার লড়াই এ বুধনের বাবা অনেকবার জিতেছে ।গ্রামে শুধু এই কারনেই তার বেশ প্রতিপত্তি । তাছাড়া সে ঝাড়গ্রামে রাজমিস্ত্রির কাজ করে ,সারা গ্রামে একাই সে হেডমিস্তিরি । অন্য যে কয়জন তার সাথে যায় ,তারা জোগারে । বুধনের বাবা গাছ ভালোবাসে। একদিন  ঝাড়গ্রাম থেকে বাড়ি  ফিরে বুধন কে বলল আজ তিনটি জ্যান্ত শাল গাছ কে কেটে ফেলতে হোল। অনেক বেড় ।আমাদের জঙ্গলেও অমন মোটা গাছ আর দেখা যায় না । বোঙ্গা থানের শাল গাছের মতো মোটা। ওখানে নাকি শপিং মল হবে ,পেল্লাই বাড়িটির সামনে গাছগুলি অনেক বাঁধা তৈরী করছে। তৈরি হলে সে  এক দেখবার মতো জিনিস হবে ।চার তলা বিল্ডিং, জামাকাপড় ,খাবার  সব কিছু পাওয়া যাবে  আর সবখানে ঠান্ডা বাতাস ভরা থাকবে । বুধনের বাবা একদিন নিয়ে যাবে তাকে ঠান্ডা বাতাস খেতে,কথা দিয়েছে।তবে শাল জঙ্গলের বাতাস ও বেশ ঠান্ডা। বিশেষ করে খালের পাশের বোঙ্গা থানের সামনে হেলানো মহুল গাছের ডালে বসে থাকতে খুব ভালোবাসে বুধন। ঐ গাছ কেটে ফেলার ঘটনার কয়েকদিন পর একদিন মায়ের সাথে কাঠ কুড়াতে গেলে সে তার মাকে জিগ্গাসা করে গাছেদের আমাদের মত রক্ত আছে কিনা? তাদের লাগে কিনা ।মা বলেন ঔই জন্যই শুকনো কাঠ কুড়ানোই নিয়ম ।আসলে শাল গাছের গায়ে জমাট রক্তের মত রস দেখেছে সে ।শীতের শুরুতে গাছের বাকল ফেটে অনেক জমাট রক্ত বের হয় । তাদের নিশ্চয় খুব ব্যাথা লাগে ।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
 একদিন বাবুলের বাবা তার উঠানে উপড়ে যাওয়া আম গাছ কাটছিল ।গাছটিতে একটিও পাতা ছিল না ।  কাটা ডাল থেকে লালাভ হলুদ আঠা বের হচ্ছিল । বলল ,কাকা ওর লাগছে ,রক্ত বের হচ্ছে । কাকা বলল ,ধুত গাছের আবার রক্ত হয় নাকি!
   তবে কি মা জানে না ? বুধন মনে মনে ভাবল । 
বাবা নিশ্চয় জানবে। 
রাতে ফিরলে বাবার কাছে গাছেদের রক্ত থাকে কিনা জেনে নেবে সে ।বাবা শহরে যায় ,বাবুলের বাবার চেয়ে অনেক বেশী জানে । আর একজন কে জিগ্গাসা করা যায় মাস্টার মশাই কে । কাল রবিবার ,পরশু ছাড়া জানা যাবে না ।তার আগে বুধনের বাবা সব বুঝিয়ে দেবে ।বুধনের বাবা সুন্দর গল্প করে । পিলচু হারাম ,পিলচু বুড়ির কথা । জঙ্গলে বাঘ আসার কথা আর হাতিদের কথা । হাতিদের কাছে একবারের জন্য নিয়ে যায়নি বুধনের বাবা । হাতি ঠাকুরের মুখামুখি হতে নেই কিন্তু পাশের বাড়ির বাবলু সাতবার হাতি দেখেছে ।
   সন্ধ্যা হব হব । সোলারের আলোটি এতক্ষনে  জ্বলে উঠল। । সোলারের লাইট থেকে একটি তার তাদের ঘরে এসেছে । একটি বাল্ব জ্বলে। ঐ বাল্ব ছাড়া অন্য লাইট ,ফ্যান চালালে কারেন্ট বেশী পুড়বে । আবার কারেন্ট অফিসের লোক এসে লাইন দেবে কেটে । সোলারের আলোয় ঘরের দাওয়ায় বুধন পড়তে বসে ।তার বাবা এত সময়ে গ্রামে চলে এসেছে । গ্রামে ঢোকার মুখে যে পোলট্রি ফার্ম আছে ওখানে কৃষ্ন মান্ডির ঠেক ।ছোট চালাঘর । প্লাস্টিকের পাউচে দেশী ,হাড়িয়া ,চাট এসব বিক্রি করে । যে দিন বুধনের বাবা হাড়িয়া খেয়ে ফেরে একটু দেরি হয় । সাইকেল টা ঠেলে নিয়ে আসে । পা একটুও কাপে না । কথা কম বলে ,তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে । একদিন অন্যকিছু খেয়ে এসেছিল ,বাড়ি এসে সে কি বমি..ওর মা সেদিন বিস্তর দমে বাখান দিয়েছিল সেদিন । তারপর আর কোন দিন হয় নি । 
   আজ বেশ দেরী হয়ে গেল । এত রাত কখনো করে না বুধনের বাবা । বুধনের আর মাত্র কয়েকটি অংক বাকী আছে । একটু পর থেকে ওরা দুজন  মিলে গল্প করে । মা পাশে বসে শালপাতা সেলাই করে থালা বানাই । বার বার মা সেলাই থামিয়ে সামনের রাস্তার দিকে চাইছে । বুধন কে বলল চল তো কিষ্ন কাকার ঠেকে একবার দেখে আসি । বেরোনোর সময় বলে গেছিল ,আজ  মলের ছাদ ঢালাই হবে। ফিস্টি আছে । দুপুরে খেয়েই ফিরে আসবে । দুজনে যখন কৃষ্নকাকার ঠেকে পৌছাল ঠেক প্রায় ফাঁকা । 
না ঠেকে আসেনি। রাস্তায় বিপদ হোলো না তো ? 
নিতাই ,শমভু বেশ খানিকটা এগিয়ে দেখে এলো । না কোন খবর নেই । 
  অনেক দিন আগে একবার এরকম হয়েছিল । রাতে ফিস্ট ছিল ,ঝাড়গ্রামে থেকে গেছিল ।আজও হয়ত তাই । কাল সকালে ঠিক ফিরে আসবে । 


  এখন সমস্যা হলো গল্পের করুন পরিনতি মানে বুধনের বাবার কিছু হওয়া দরকার ,না হলে গল্পটি জমাবে না । সকালে  সুস্হ দেহে ফিরে এলে গল্পটি আর গল্প রইল না । পড়ে যদি একটু কষ্ট না হয় কিম্বা মজা না পায় কিম্বা কিছু অনুভব না হয় তা হলে গল্প কিসের ? একটি সাঁওতাল ছেলে চাষবাস ভুলে রাজমিস্ত্রি।পেশা পরিবর্তন ,সাধারন ঘটনা । শহর আড়ে বহড়ে বাড়ছে ,মহীরুহ শাল মহুল উধাও হচ্ছে রাতারাতি -এও নিতান্ত সাধারন ঘটনা ।আজ যদি হাড়িযার পরিবর্তে অন্যকিছু এই ধরুন ফরেন লিকার খায় -একটু বেশী ,ফিস্ট ছিল যে এটিও হামেশাই ঘটে ,ঘটে চলেছে ঘটবে । মনে রাখার মতো কোন গল্প লেখা হলো না । দু পাতা করুনা ভরা চোখে দেখে উল্টে রাখলাম । 

   মনটা খচখচ করছে । প্রথমে যেখানে লেখা শুরু করেছিলাম পড়া শুরু করলাম ।কাল সকালে কেউ না কেউ খুঁজে পাবে তাকে , দুটি স্টার মার্ক দিয়ে ফিরে এলাম সাদা ধবধবে নতুন পাতায় । আমি যে পেনটায় লিখি কালি ফুরিয়ে গেল । নতুন করে কালি ভরে অভ্যাস বসত ঝাড়া দিলাম । সাদা খাতার পাতা ভরে গেল ফোটা ফোটা কালির বিন্দু রেখায় । লেখা শুরু করলাম ...

    সারারাত শুয়ে ছিল লারান ,মোরামের গন্ধ মেখে ,শাল আর বুনো কুলের শিশির মাখা পাতার আঘ্রান নিয়ে।সকালের একচিলতে সুর্য রশ্মি যখন ওর মুখে এসে পড়ল 
ঠিক সেই সময় একটি মটর সাইকেলে দুজন লোক এসে থামলো ওর সামনে । 
কাল রাতের ঘটনা । 
দাতাল টা এদিকেই এসেছে । 
অফিসে খবর দে ।
একজন এগিয়ে এসে ওর ব্যাগটি তুলে নিল । ব্যাগের মধ্যে প্লাস্টিকে মোড়া কয়েকশ টাকা আর ব্যাঙ্কের পাশবই । নাম নারান কিস্কু ,বয়স একত্রিশ ,গ্রাম -নতুনডিহি ।ফোন ......
ফোন করা হলো ,ঝোপের মধ্যে বেজে উঠলো । 
  নতুনডিহিতে হারুর বাড়ি না? মাস্টারের হুলা পার্টির ছেলে। 
হারু কে ফোন করল একজন । হারু জানালো ও চেনে । বুধনের বাপ ।
তাড়াতাড়ি খবর দাও । ওর বাপকে পাওয়া গেছে ।
বিট বাবু এসে পৌঁছেছে। পুলিশ আসছে । ওরা বডি তুলবে । বুধনের মা গ্রামের লোক সবাই এসে পৌঁছেছে। কান্নার দমক থামলে বিটবাবু বোঝান ,পাঁচ লাখ টাকা পাবে ..ছেলে পুলিশে চাকরি পাবে ,স্পেশাল হোমগার্ড। চিন্তা কোরো না ,কালকেই আ্যাকাউন্টে তোমাদের টাকা পৌছে যাবে । 

  মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া মায়ের পাশে এতসময়ে দাড়িয়ে ছিল । বাবার দেহ কয়েক জন মিলে বড় রাস্তার দিকে নিয়ে গেল । শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দিকে চেয়ে বুধনের মনে পড়ল গাছেদের রক্ত আছে কিনা,ওদের ব্যাথা করে কিনা..বাবাকে আর জিগ্গাসা করা হোল না…..

Post a Comment

0 Comments