জ্বলদর্চি

দোল খেলা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬২

দোল খেলা

ভাস্করব্রত পতি 

“কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত, আমি বসন্তে মরি”– বসন্তের আঙিনায় এসে যখন কচি পাতার খোঁজে মন উতলা হয়ে ওঠে তখন স্বভাবতই ফাগের রঙে দেহ রাঙিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে" -- যেন সেকথাই বলে চলেছে রক্তচক্ষু কোকিল। ফাল্গুন এলেই গুণগুণ করে মনের কোণে গানের বোল ওঠে। আসলে এই ভরা ফাল্গুনে ফাগের সাথে হোলি খেলতে ইচ্ছে করে যে। 

বাঙালীর তেরো পার্বণের হেঁসেলে দোলের স্থান অন্যতম। দোল আজ 'দোল উৎসব'। সেই উৎসবের সুর চুঁইয়ে মন নেচে নেচে গেয়ে ওঠে “আজ হোলি খেলবো শ্যাম তোমার সনে”। ঘন নীলাকাশ আর তার কোলে বেড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত পলাশ ফুলের মেলামেশা। লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া ফুল আর শীতের মিঠেকড়া আবেশ—যেন দোলের এক অন্যরূপ। শীত যেন এসময়টা হারিয়ে গিয়েও পিছু ছাড়েনি । স্নিগ্ধ আবেশে উচাটন মন তাই গেয়ে ওঠে “খেলবো হোলি রঙ দেবোনা তাই কখনও হয়, এসো এসো বাইরে এসো ভয় পেয়োনা ভয়।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কথা ও কাহিনী'তে দোল উৎসব নিয়ে কবিতা লিখেছেন। মীরার ভজনেও দোলের কথা রয়েছে। বাংলা এবং হিন্দি সিনেমাগুলোতে তো আখছারই হোলি খেলার দৃশ্য চিত্রায়িত হয়ে আসছে। ভারতীয় লোকসংস্কৃতির অঙ্গণে দোল উৎসব যে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কিন্তু দোল উৎসবের তাৎপর্য বা তার পিছনে কি ইতিহাস রয়েছে, তা আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই এমতাবস্থায় একটু বরং উঁকি মারা যাক দোল উৎসবের গোপন ডেরায়। 
ঐতিহাসিকদের মতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রথম দোল উৎসবের সূচনা করেছিলেন। ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী আবার অন্য মত। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু যখন ভক্ত প্রহ্লাদের উপর রেগে গিয়েছিলেন, তখন ভক্ত প্রহ্লাদকে রক্ষা করার জন্য হোলিকা নামে এক রাক্ষসীকে ভস্ম করে দেন ভগবান বিষ্ণু। সেই রাক্ষসী হোলিকার ভস্ম হয়ে যাওয়া ছাই থেকেই শুরু হয় হোলি খেলা। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শ্রীকৃষ্ণ দোলনায় আরোহন করতেন। সেই দোলনা থেকেই 'দোল' শব্দের উৎপত্তি। আসলে দেবতার অনুগ্রহ লাভের জন্য আমরা যে দোল পালন করি তাই দেবদোল। ভারতের অন্যান্য যায়গায় দোল উৎসবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় আয়োজিত দোল উৎসবের অনেক ফারাক। এখানে এই উৎসবে লুকিয়ে আছে দৈবিক আচার অনুষ্ঠান।

আজও দোলের আগের দিন রাতে আমরা জ্বালি চাঁচরি। তা জ্বালার আগে পূজা করা হয় শ্রীকৃষ্ণের। পদ্মাপুরাণ অনুযায়ী দোলপূর্ণিমার আগে শুক্লা একাদশী থেকেই শুরু হয়ে যায় দোল উৎসব। তা শেষ হয় দোল পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা পঞ্চমী তিথিতে। দেবতারা যদি পাঁচদিন ধরে দোল খেলে তবে তাকে বলা হয় 'পঞ্চম দোল'। আর আট দিন ধরে খেললে তাকে বলা হয় ‘অষ্টম দোল'। আজও বহু মন্দিরের এই দুই ধরণের দোলের প্রচলন রয়েছে।

কিন্তু বিজ্ঞান বলে বসন্তের রঙিন দিনগুলোয় যাতে কালান্তক বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি লাভ করা যায় তার জন্য খেলা হয় দোল। মাখা হয় রঙ আর আবির। আবির আসলে নাকি বসন্তের প্রতিষেধক। কিন্তু আজকাল রঙ এবং আবিরে নানা ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফলে তা ত্বকের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। রেওয়াজ এসেছে রঙ মাখানোর পর মিষ্টিমুখ করার। পশ্চিমবঙ্গে দোল উৎসব যতখানি প্রাণবন্ত, অন্যান্য রাজ্যে তা যেন একটু বেশিই গতানুগতিক। শান্তিনিকেতনের দোল উৎসবে যেন চিরনতুনের ডাক দেওয়ার উৎসবই উদ্ভাসিত। এখানকার বসন্তোসবে যেন আবিরের সাথে পলাশ, শিমূল আর কৃষ্ণচূড়ার সখ্যতা বিরাজমান। মূক মুখেও তখন বুলি ফুটে ওঠে বলে— “রাঙিয়ে দিয়ে যাও”।

মাঘের শ্রীপঞ্চমীর সন্ধ্যা থেকেই বসনৃতোৎসবের সূচনা হয়ে যায় নবদ্বীপের নানা মঠ মন্দিরে। যা ফাল্গুনী পূর্ণিমা পেরিয়ে চৈত্র পূর্ণিমার রাতে বসন্ত রাসে গিয়ে শেষ হয়। আর চলে বসন্তকীর্তন। নবদ্বীপ, মায়াপুর সহ বর্ধমানের বহু যায়গায় শুরু হয়ে যায় শ্রীকৃষ্ণ ও মহাপ্রভুর নামগান নিয়ে পথ পরিক্রমা। বসন্ত রাগে চলে কীর্তন পরিবেশন। আর দোলের সময় চারিদিক হয়ে ওঠে নানা বর্ণের আবীরে রঙিন। আসলে দ্বাদশমাসে বিষ্ণুর দ্বাদশযাত্রার মধ্যে অন্যতম হল এই দোলযাত্রা। ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল। যদিও তিনি কখনও রঙ নিয়ে আতিশয্য দেখাননি। 

বাসুদেব ঘোষ, রূপ গোস্বামী, উদ্ধব দাস, শিবরাম দের লেখনীতে এসেছে রাধাকৃষ্ণের দোল। নয়নানন্দ ঠাকুর লিখেছেন চৈতন্যের দোল -- 
"কা কহুঁ আজুক আনন্দ ওর
ফুলবনে দোলত গৌর কিশোর 
নিত্যানন্দ গদাধর সঙ্গে
শান্তিপুর নাথ গাওই রঙ্গে
সহচর ফাগু ফেলই গোরা গায়
ধায় ই শুনি সব লোক নদীয়ায়
খোল করতাল ধ্বনি হরি হরিবোল
নয়নানন্দে আনন্দ বিভোর"।

ফাল্গুনী পূর্ণিমায় চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব উপলক্ষে বিভিন্ন মন্দিরে পালিত হয় 'রঙদোল'। সেসময় নবদ্বীপে রাধাকৃষ্ণের দোল হয়না। তবে গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবনচন্দ্রের দোল খেলা দোল পূর্ণিমায় হয়না। এখানে হয় উত্তরা ফাল্গুনী তিথিতে। তেমনি বর্ধমান রাজের এলাকায় দোল খেলা হয় দোলপূর্ণিমার পরের দিন। কল্যানিতে সতীমাতার দোলমেলা হয় দোলপূর্ণিমাতেই। ঘোষপাড়া কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মহা মিলন উৎসব এটি। 
"সতীমার উপরে সেবা রাখিবে বিশ্বাস
সেরে যাবে কুষ্ঠ ব্যাধি, হাঁপানি, শূল, কাশ।
কৃপা হলে ভরে তার ঘটে অঘটন
অন্ধ পায় দৃষ্টিশক্তি বধিরে শ্রবণ"।
দোল উৎসব হতো বলেই নয়াগ্রামের জঙ্গলঘেরা এলাকায় গ্রামনাম হয়েছে দোলগ্রাম। যা গ্রামনাম সৃষ্টিতে অভিনব। শান্তিপুরে দোল উৎসবে পালিত হয় 'ডালি উৎসব' বা 'ডালি ধরা'। যা আসলে জামাইয়ের সম্মানে বিভিন্ন রকমের ডালি ধরানো। বৈশাখী পূর্ণিমার রাতে শান্তিপুরে শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণের মূর্তি ফুলে ফুলে সাজিয়ে 'ফুলদোল' পালিত হয়। শান্তিনিকেতনে কবিগুরু প্রথম বসন্ত উৎসবের সূচনা করেছিলেন। যা আজও বিরাজমান।

নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠে দোল পূর্ণিমার পরে হয় তৃতীয় দোল, চতুর্থ দোল, পঞ্চম দোল, সপ্তম দোল থেকে দশম দোল। যা কিনা জাওয়াট হোলি, বর্ষাণা হোলি কিংবা নন্দগ্রাম হোলির মতোই জনপ্রিয়। পূর্ণিমার দশদিন পরে হয় দশম দোল। এটির প্রচলন করেন ফণিভূষণ গোস্বামী, রামকন্ঠ গোস্বামী এবং পাঁচুগোপাল গোস্বামীরা। এই দশম দোলে মহাপ্রভুকে বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সহ দোলনায় দোলানো হয়।

“রাঙা পলাশ ফুল, হলুদ গাঁদার ফুল, এনে দে এনে দে নইলে, বাঁধবো না বাঁধবো না চুল”— খোঁপায় পলাশ বেঁধে, হলুদ শাড়ি কিংবা সাদা কুর্তা পাজামার সাথে তালে তাল মিলিয়ে জিন্স, টপ পরেই কিশোর কিশোরীরা মেতে ওঠেন ফাগের সাথে। অনেকেই আবার আরও একধাপ এগিয়ে ‘পানাহার’-এও মজে যান। তবুও এতটুকুও ম্লান হয়নি দোল উৎসবের। মনের সাথে মনকে মেশাতে, প্রাণের সাথে প্রাণকে মেশাতে বুকের সাথে বুক মেশাতে আর হৃদয়ের সাথে হৃদয় মেশাতে আজ বাঙালীর এই লৌকিক পার্বণটি বড় কাছের হয়ে উঠেছে।



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments