জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— গ্রীণল্যাণ্ড (এস্কিমো)/জাদুগর ঠাকুমা /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প— গ্রীণল্যাণ্ড (এস্কিমো)
জাদুগর ঠাকুমা

চিন্ময় দাশ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। লেখাজোখা নাই কতকাল আগের। 
বিশাল একটা এলাকা। কিন্তু জনমনিষ্যিটিও যেন নাই কোথাও। অবশ্য থাকবেই বা কেন? থাকবেই বা কী করে? আলো কোথায় এদেশে? আট প্রহরে (এক প্রহর= তিন ঘন্টা) প্রহরখানিক মুখ দেখা যায় সূয্যিঠাকুরের। বাকি সময় কুচকুচে কালো রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার চার দিকে।
সূয্যিঠাকুর নাই। তাই, তাপ-উত্তাপও নাই এ দেশে। কী ঠাণ্ডা কী ঠাণ্ডা! সেই ঠাণ্ডায় সব জমে কাঠ। যে দিকে তাকাও, সব বরফ আর বরফ। সাদা রঙের বরফ দিয়ে মোড়া গোটা দেশটা। 
থাকবার মধ্যে আছে কেবল বড় বড় দুটো বাড়ি—সাদা বাড়ি আর কালো বাড়ি। অনেকগুলো পরিবার বাস করে বাড়ি দুটোতে। ছেলে-মেয়ে বুড়ো-বুড়ি সারা বছর সব্বাই সেঁধিয়ে থাকে বাড়িটার ভিতর। 
গ্রীষ্মকাল এলে, তখন ভারি আনন্দের দিন। সারা বছরে সেই তিনটি মাস বাইরে বের হয় লোকেরা। বড়রা তখন শিকারে যায়। স্লেজগাড়ি আছে সবার। কুকুরও আছে অনেক। গাড়িতে কুকুর জুতে নিয়ে, দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে দুই বাড়ির পুরুষেরা।
এক বছর এক ঘটনা ঘটল। হয়েছে কী, তখন গরমকাল। দুই বাড়ির লোকেরাই শিকারে বের হয়েছে। দেখা গেল, সাদা বাড়ির লোকেরা হরিণ শিকার করেছে অনেক বেশি। তেমন কিছু জোটেনি কালোবাড়ির কপালে। তারা বলাবলি করতে লাগল—এমনটা হোল কী করে? নিশ্চয় কিছু চাতুরি করছে ওরা। সাদারা নিশ্চয় ঠকাচ্ছে আমাদের। 
কেউ বলল— শিকার না পেলে, সারা বছর চলবে কী করে আমাদের? বউ-বাচ্চাদের মুখে কী দেব? 
এমনি নানান কথা। নানান মন্তব্য। ভারি চিন্তায় পড়ে গেল লোকগুলো। তারপর শুরু হল পরামর্শ। শেষমেষ ঠিক হোল, মেরে ফেলা হবে সাদা বাড়ির লোকগুলোকে। 
একজন বলল—তবে এখন না। বরফ পড়া শুরু হোক। বাড়ি ফিরবার একেবারে মুখে মুখে। তখন করতে হবে কাজটা। ততদিনে আরও কয়েকটা হরিণও মারবে ওরা। তখন সেগুলোও আমরা পেয়ে যাব।
কথাটা মনে ধরল সকলেরই —ঠিক বলেছ তুমি। বাড়ি ফিরবার মুখে কাজটা করলেই সুবিধা। বরফ পড়ার কারণে, বাড়ির লোকেরা খুঁজতে আসতেও পারবে না ওদের।
সেটাই স্থির হোল। কালোবাড়ির লোকেরা অপেক্ষা করে রইল, কখন বরফ পড়া শুরু হয়। 
ক’দিন বাদেই শুরু হোল বরফ পড়া। বাঁধাছাঁদা শুরু হোল দু’তরফেই। সারা দিন ধরে শিকারের মাংস রাঁধা হোল বেশ যত্ন করে। খাওয়া-দাওয়া সেরে জব্বর ঘুম দেওয়া হবে। তারপর ভোর হলেই বাড়ির পথে রওণা দেবে সবাই।
আলো নিভতেই, কালোবাড়ি ঝাঁপিয়ে পড়ল সাদাবাড়ির লোকেদের উপর। সাদারা ভাবতেই পারেনি, এমনটা হতে পারে কোন দিন। তৈরি ছিল না তারা। তাতে যা হওয়ার, তাই হোল। সামাল দেওয়া গেল না। একেবারে কচুকাটা হয়ে মারা পড়ল সবাই।
এবার কালোবাড়ির লোকেরা ভাবনায় পড়ল সাদাদের কুকুরগুলোকে নিয়ে। কুকুরগুলো তো ঘরে ফিরে যাবে। তখন কারও আর বুঝতে বাকি থাকবে না কিছু। সব ফাঁস হয়ে যাবে। ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে তাতে। 
অগত্যা একটাই রাস্তা। এক এক করে মেরে ফেলা হোল সবগুলো কুকুরকেও। 
দারুণ আনন্দে সকাল হোল। দুই বাড়ির শিকার এক জোট করে, ফূর্তিতে নাচতে নাচতে ঘরে ফিরে চলল কালোবাড়ির লোকেরা। 
বরফ পড়া শুরু হয়েছে। তার মানে, ঘরে ফিরে আসবে শিকারে যাওয়া সব পুরুষেরা। সাদাবাড়ির মেয়ে বউ বাচ্চা সবাই বসে আছে পথ চেয়ে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এক দিন গেল, দু’দিন গেল। কেটে গেল তিন দিনও। কেউ ফিরল না ঘরে। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
তখন তারা কালো বাড়িতে গিয়ে জানতে চাইল—হ্যাঁগো, তোমরা ফিরে এলে। আমাদের লোকজন কোথায়? 
কালোবাড়ির জানা ছিল সাদাবাড়ি আসবে। জবাব তৈরি করাই ছিল তাদের। চটপট করে বলল—কী করে বলি, বল তো? খানিক দূর তো এক সাথেই এলাম। একটা পাহাড়ের কাছ পর্যন্ত। তার পর হোল কী, ওরা অন্য রাস্তায় মোড় নিয়ে চলে গেল। কেন গেল, কারণ কিছু বুঝতে পারলাম না। তার পর থেকে আর দেখা হয়নি আমাদের সাথে।
একজন বলল—কোথায় আর যাবে। ফিরে তো আসতেই হবে। তোমাদেরও তো করার কিছু নাই। অপেক্ষা করো কিছু দিন।
পথ চেয়েই দিন কাটছে সাদা বাড়ির। কিন্তু কেউ এলো না। 
ওদিকে হয়েছে কী, কালোবাড়ির একটি ছেলে বিয়ে করেছিল সাদা বাড়িতে। শিকার থেকে ফিরে, বউকে নিয়ে সে বেড়াতে এসেছে শ্বশুরবারিতে।
রাতে খেয়েদেয়ে শুয়েছে সবাই। গল্প করতে করতে ছেলেটা ফিসফিস করে সব ঘটনা বলে দিল তার বউকে। পাশেই ছিল মেয়েটার ভাই। তার কানেও গিয়েছে সব কথা। 
এমন নৃশংস কাজ করে না কি কেউ? রাগে মাথা গরম হয়ে গেল ভাইটার। হিতাহিত ভুলে, একটা ছুরি আমূল বসিয়ে দিল ছেলেটার বুকে। 
হই হই পড়ে গেল সাদা বাড়িতে। কী হবে এখন? সকাল হলে, কালো বাড়ির লোকেরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাদের উপর। কাউকে আর বাঁচতে হবে না তখন। পুরুষেরা গেছে। এবার বাকিদেরও যেতে হবে আজ।  ভয়াণক একটা হইচই শুরু হয়ে গেল সারা বাড়িতে। পুরুষরা বলতে গেলে, কেউ বেঁচে নাই। সামাল দেবে কে? এবার বাকিদেরও মারা পড়তে হবে।
এক বুড়ি শুয়ে ছিল ঘরটার কোণে। সে বলল—বেশি চেঁচামেচির সময় নয় এটা। ঠাণ্ডা মাথায় সামাল দিতে হবে সব কিছু। যা করবার ভেবেচিন্তে করতে হবে। 
--করবার আর আছেটা কী এখন? বেঘোরে মারা পড়তে হবে সবাইকে। সবারই এক কথা।
বুড়ি বলল—মরা তো একেবারে শেষ কথা। সেটাই আগে ভাবছো কেন? বাঁচবার কথা ভাবো আগে। চেঁচামেচি করে বিপদ বাড়িয়ে লাভ কী? যা বলছি, শোন চুপ করে। 
বুড়ি উঠে বসল—পুরুষরা গেছে। এবার বাচ্চাগুলোকেও মেরে ফেলবে ওরা। বংশই লোপাট হয়ে যাবে আমাদের। এখুনি পালাতে হবে আমাদের। ভোরের আলো ফোটার আগেই। আলো ফুটলে, আর রেহাই নাই কারও।
--সেটা তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু পালাবো কী করে? একটা কুকুরও তো নাই আমাদের!
সত্যিই একটা কুকুরও আর তাদের নাই। সবগুলোকেই মেরে ফেলেছে কালোবাড়ির লোকেরা। আর এই বরফের মধ্যে কুকুর ছাড়া, পালাবার কথা ভাবাও যায় না। বুড়ি মুচকি হেসে বলল—কুকুর নাই তো কী হয়েছে? কুকুরদের বিছানাগুলো তো আছে।
আসলে হয়েছে কী, জাদুবিদ্যা জানত বুড়ি। অনেক কিছুই করবার কেরামতি ছিল তার। আর, থাকবার মধ্যে ছিল হাতের লাঠিখানা। যেটা ধরে থুত্থুড়িয়ে চলাফেরা করত বুড়ি। 
কুকুরদের বিছানা বলতে খড়ের গাদা। ঠুক ঠুক করে সেখানে গেল বুড়ি। হাতের লাঠিটা গাদার খড়ের উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বুলোতে লাগল। 
লাঠি ঘোরাচ্ছে আর বিড় বিড় করছে মুখে। বাড়ির লোকেরা হাঁ করে চেয়ে দেখছে, করছেটা কী বুড়ি!
সত্যিই, কেরামতি আছে  বুড়ির। লহমার মধ্যে কী অবাক কাণ্ড! গাদার এক একটা খড় থেকে জেগে উঠতে লাগল এক একটা কুকুর। আর, কী সব তাগড়াই চেহারা তাদের! তাক লেগে যাওয়ার মত। 
দেখতে না দেখতে এক পাল কুকুর জেগে উঠল। সাদা বাড়িতে যত না লোকের সংখ্যা, বুড়ি কুকুর গড়ল তার দেড় গুণা। বাড়তি কুকুর সাথে থাকা জরুরী। 
আর দেরী নয়। এবার রওণা দিতে হবে। স্লেজগাড়ি নাই একটাও। 
-- এক একজন চেপে বসো এক একটা কুকুরের পিঠে। কোন কিছুই সাথে নিতে হবে না। বুড়িই এখন দল নেতা। সবাইকে নির্দেশ দিয়ে চালনা করছে সে।
--ঘরের আলো নিভিয়ো না। যেমন জ্বলছে, তেমনটা থাক। কালো বাড়ি যেন কিছু সন্দেহ না করে।
বুড়ির কথা অমান্য করবার মত নয়। সবাই এক একটা কুকুরের পিঠে চেপে বসল। সাথে কুটোটাও নিল না কেউ। বোঝা বাড়ানো যাবে না। তাতে গতি কমে যাবে কুকুরের।
যা কিছু সম্বল ছিল, সব পড়ে রইল ঘরে। এখন কেবল প্রাণটুকু হাতে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। দূরে, অনেক দূরে। খুনি অমানুষগুলোর হাতের নাগাল ছাড়িয়ে।
রাতের তুন্দ্রা অঞ্চল। তারাদের আবছা আলোর চাদর বিছিয়ে আছে বরফের উপর। একপাল কুকুর ছুটে চলেছে তার উপর দিয়ে। পিঠে ভারি সওয়ার।
বরফ পড়া রাত। স্লেজ গাড়ি নেই। কুকুরের পিঠে সওয়ার হয়ে, দল বেঁধে পালিয়ে যাচ্ছে এক দল মানুষ—এর আগে কখনও ঘটেনি এমনটা। কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। এখন কেবল পালিয়ে যাওয়া। যতটা তাড়াতাড়ি পারা যায়।
এদিকে হয়েছে কী, দেখতে দেখতে সকাল হোল। বেলাও বাড়ল খানিকটা। কিন্তু ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল না কেন শ্বশুরবাড়ি থেকে? কালো বাড়ির লোকেরা খোঁজ নিতে গিয়ে হহতভম্ব। গোটা বাড়ি খাঁ-খাঁ। জনমনিষ্যির চিহ্নটুকুও নাই কোথাও। কর্পূরের মত উবে গেছে যেন সব। 
বাড়িটায় কাঠের দরজার আগল টানা। সেটা ঠেলা দিতেই চোখ কপালে উঠে গেল সবার।
আলো জ্বলছে ঘরে। ছেলেটা মরে পড়ে আছে বিছানায়। বুকে একটা ছুরি গেঁথে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানাপত্তর। 
তার মানে হোল, ছেলেটাকে খুন করে, পালিয়েছে লোকগুলো। কিন্তু গেল কী করে? গাড়ি তো নাই এদের! কুকুরও নাই একটাও। হাওয়ায় উড়ে গেল না কি? নিশ্চয় কেউ না কেউ সাহায্য করেছে।
আর দেরী নয়। অমনি কালোবাড়িও ছুট লাগালো পিছনে। যেভাবে হোক, পাকড়াও করতে হবে। উপযুক্ত সাজা দিতে হবে। বদলা না নিয়ে, একটাকেও ছাড়া হবে না। 
ছুট ছুট ছুট। একেবারে হাওয়ার গতিতে ছুটে চলেছে কালোবাড়ির লোকেরা। দেখতে দেখতে সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে এল এক সময়। তখনই সামনে অনেক দূরে, একটা সরু কালো রেখার মত কিছু দেখা গেল। বরফের বুকে কালো দাগ! নিশ্চয় এটা সাদাবড়ির লোকেদের দল। ছোটার গতি আরও বাড়িয়ে দিল লোকগুলো। আর হাতছাড়া করা যাবে না।
সামনের দল ছুটে চলেছে প্রাণপনে। সবার পেছনে আছে বুড়ি ঠাকুমা। মাঝে মাঝেই চোখ ফিরিয়ে দেখে নেয় পেছন দিকে। এবার বুড়িও দেখে ফেলল তাড়া করা দলটাকে। 
--বুড়ি চেঁচিয়ে বলল—আরও জোরে ছোটো। কালো বাড়ি পৌঁছে গেছে পিছনে। নাগালে পেলে, এখানেই রেখে যাবে কচুকাটা করে।
কিন্তু খুব একটা লাভ কিছু হচ্ছে না। কুকুরের গতি বাড়ছে না তেমন। আসলে, বাড়বে কী করে? প্রায় সকলেই তো মেয়েমানুষ। বুড়োবুড়ি। আর এক পাল বাচ্চা। কালোদের দলে যে সবাই পুরুষ। সবাই পারঙ্গত। জোয়ান পুরুষ সব। অনেক দ্রুত তাদের গতি। 
ক্রমশ এগিয়ে আসছে পেছনের দলটা। একটু একটু করে কমে যাচ্ছে দু’দলের দূরত্ব।
পিছনের দলটা যখন প্রায় ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে, একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠল—কিছু একটা করো, ঠাকুমা। ধরে ফেলল যে।
এ হোল সেই ছেলেটা, যে ছুরি বসিয়ে মেরেছে নিজের বোনের বরকে। ভালোই জানে সে, আগে মরতে হবে তাকেই। খুনটা সেই করেছে। তার জন্যই আজ সকলের এই দুর্দশা। কালোবাড়ির হাতে প্রথম বলি হবে সে-ই। 
ভয় পাবে কী, বুড়ির মুখে মুচকি হাসি। সবাই অবাক তা দেখে। বুড়ি বলল—অত সোজা কাজ নয় আমাদের ধরে ফেলা। ভয় পেয়ো না কেউ। আমি তো আছি। 
আরও খানিক দৌড় হোল। কিন্তু নাগাল ছাড়িয়ে যাওয়ার যখন আর কোন উপায় নাই, বুড়ি চেঁচিয়ে বলল—আর ছুটো না কেউ। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ো। 
বুড়ির কথা অমান্য করল না কেউ। দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। এভাবে ধরাই যদি দিতে হয়, এই ভয়াণক শীতের রাতে বরফের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে এলাম কেন? ফায়দা কী হোল দৌড়াদৌড়ির? কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারল না কেউ কিছু। 
বুড়ির কোন দিকে হেলদোল নাই। ধীরে সুস্থে নামল কুকুরের পিঠ থেকে। পেছনের দলটা এসে তখন প্রায় ধরে ফেলল বলে। 
বুড়ি অকুতোভয়। হাতের লাঠি দিয়ে আড়াআড়ি একটা দাগ টেনে দিল বরফের উপর। বুড়ো মানুষ। কাঁপা-কাঁপা হাতের বাঁকা রেখা।
পেছনের কালো বাড়ির লোকগুলো তখন আনন্দে আত্মহারা। হাতের মুঠোয় পাওয়া গেছে সবাইকে। আজ রক্তের নদী বইয়ে দেবে তারা। 
কিন্তু কী অলৌকিক কাণ্ড! বুড়ির কাটা দাগ বরাবর একটা ফাটল গজিয়ে উঠল বরফের উপর। পিছনের লোকগুলো চমকে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তাড়াহুড়ো করে। নইলে, সেই ফাটলে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হোত সবাইকে। 
বুড়ির মুখের হাসি চওড়া হয়েছে। ফাটলের দু’দিকে দুই বাহিনী। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দু’দলের চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে ঘটনাটা। একেবারে আজগুবি গল্পের মতই।
আড়ে আর বহরে দু’দিকেই বাড়তে লেগেছে ফাটল। গভীর হচ্ছে। আবার লম্বাও হচ্ছে ফাটল। বাড়তে বাড়তে একেবারে সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছুল যখন, তখনই ঘটে গেল শেষ ব্যাপারটা। 
ফাটলের হাঁ মুখ দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল সমুদ্রের জল। যত দূর ফাটল, তত দূর ছুটতে লাগল জলের স্রোত। লম্বা ফাটলের বুক বেয়ে কল কল করে বইতে লাগল সমুদ্রের জল। দেখতে না দেখতে, সাদা বরফের জমির উপর ফুটে উঠল নীল জলের লম্বা নদী। ঠিক যেন বরফ ফুঁড়ে উঠে এল নদীটা।
নদীর সামনে থমকে গেল কালো বাড়ির লোকেরা। একটু দেরী হলে, ঝপাং ঝপাং করে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হোত নদীতে। ঠাণ্ডা জলে ডুবে মরণ হত সবার।
সামনে তাকিয়ে ভারি অবাক হয়ে গেল লোকগুলো। নদী এলো কোথা থেকে এখানে? হাতের তালুর মত চেনে তারা এ দেশকে। বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে চেনে দেশটাকে। এর পথ ঘাট পাহাড় বরফ সমুদ্র—সব, সব তাদের চেনা। নদী তো এখানে ছিল না কোন দিন! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লোকগুলো।
বুড়ি কিন্তু ছোটা থামায়নি। এগিয়ে যেতে হবে। আরও এগিয়ে যেতে হবে। শত্রুকে বিশ্বাস করতে নেই। খেলো ভাবতে নেই। মওকা পাওয়া গেছে। যতটা পারো এগিয়ে, একেবারে নাগালের বাইরে চলে যাও।
বুড়ির মন কিন্তু খুঁতখুঁত। একটাই তো নদী। যদি কোন মতে পার হতে পেরে যায়? একটাতে হবে না। বাধার প্রাচীর গড়তে হবে আরও। 
এই না ভেবে, মন স্থির করে নিল বুড়ি। চলতে চলতেই, হাতের লাঠি দিয়ে পেছনে একটা দাগ টেনে দিল লম্বা করে। খানিক দূর ছোটে, দাগ টানে আরও একটা। 
এইভাবে কতগুলো যে দাগ টেনেছিল বুড়ি, নিজেও গুণে দেখেনি। একটা দাগ টেনেছে, বুড়ির ছায়া মিলিয়ে যেতে না যেতে, সেখানে গজিয়ে উঠেছে আরও একটা নতুন নদী। 
বুড়ির জাদুকাঠির আঁচড়ে জন্মেছিল নদীগুলো। কালোবাড়ির হতভম্ব লোকেরা ফিরেও গিয়েছিল ব্যর্থ হয়ে। 
কিন্তু ব্যাপারটা হোল, ভোজবাজির মত গজালেও, ভোজবাজির মত মিলিয়ে যায়নি নদীগুলো। আজও রয়ে গিয়েছে বাল্টিক সাগরের সাথে জোড়া হয়ে। 
আমরা মানচিত্রের দিকে চোখ রাখি যদি, দেখা যায়, চার দিকে সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দেশ গ্রীণল্যাণ্ড। চারদিকেই সমুদ্রের সাথে জুড়ে আছে ছোট বড় কত না নদী। আজও সে দেশের এস্কিমো মানুষজন বলে থাকেন, তাদের দেশের সেইসব নদীগুলো সৃষ্টি করেছিল তাদেরই এক বুড়ি ঠাকুমাই। জাদু জানতো যে সেই বুড়ি!
( ১০০ বছরেরও আগে, উত্তর আমেরিকার এস্কিমোদের গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে ঘুরে, কাহিনীটি সংগ্রহ করেছিলেন জনৈকা ক্লারা কার্ণ বেলিশ নামের এক সমীক্ষক। ১৯২২ সালে একটি গল্পসংগ্রহে এটি প্রকাশিত হয়। পরে, সেই গল্পের কাঠামো নিয়ে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিজেদের ভাষায় শত শত গল্প লেখা হয়েছে। শোনানো হয়েছে শিশুদের, বড়দেরও। 
সেই কাঠামো নিয়েই আমরা গল্পটি তৈরি করেছি, বাংলার ছোট-বড় সব পাঠককে শোনাবার  জন্য।)

Post a Comment

1 Comments

  1. সত্যিই কত সুন্দর সুন্দর গল্প ছড়িয়ে আছে চারপাশে!

    ReplyDelete