জ্বলদর্চি

ঘুড়ি উৎসব /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫৫

ঘুড়ি উৎসব

ভাস্করব্রত পতি 

পৌষপার্বন তথা মকরপার্বন আসলে গ্রাম বাংলার কৃষকদের নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসব। এক কথায় সঞ্চয়ের পরিপূর্ণতার উৎসব হিসেবেই পরিগণিত হয়ে আসছে বছরের পর বছর। মেদিনীপুর শহরে এই মকর সংক্রান্তির দিনেই চলে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। যদিও অন্যত্র বিশ্বকর্মা পূজার দিন ঘুড়ি ওড়ে। আসলে মকর সংক্রান্তিতে দেবতারা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। দেববন্দনার জন্যই তাই আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। মেঘমুক্ত আকাশে এই সময় থাকেনা জলীয় বাষ্প। ঘুড়ি ওড়ানোর পক্ষে উপযুক্ত। মেদিনীপুরের আকাশ রঙিন হয় মকর পরবকে কেন্দ্র করে। মূল উপলক্ষ্য 'বড়াম পূজা'। চিল চিৎকারে ভরে ওঠে মেদিনীপুরের আকাশ আর বড় বড় বাড়ির ছাদ। কর্নেলগোলা থেকে সিপাইবাজার, কিংবা জজকোর্ট থেকে কোৎবাজার -- সর্বত্র একই চিত্র। একই রব। একই আর্তনাদ। একই উন্মাদনা। একই লড়াই। ঘুড়ির লড়াই!

পৌষ পার্বণ আর বিশ্বকর্মা পূজার সঙ্গে একটাই মিল। তা হল ঘুড়ি ওড়ানো। এখন সমার্থক হয়ে উঠেছে। এই দিনটায় আকাশ হয়ে ওঠে ঘুড়িময়। বাক্সঘুড়ি, ফতিঙ্গাঘুড়ি, লন্ঠনঘুড়ি, চিলাঘুড়ি বা ডাঁসঘুড়ি, চিঠিঘুড়িদের মতো অন্ত্যজ শ্রেনীর ঘুড়িরা হয়তো পাত্তা পায়না সভ্য সমাজে। এই উৎসবে নেই কোনও ধর্মীয় লোকাচার বা বাধ্যবাধকতা। নিখাদ আনন্দ আর আবেগকে পাথেয় করেই উৎসবের এগিয়ে চলা। কিন্তু ঘুড়ি নিয়ে এই আবেগ, আদর আর আবেশ আসমুদ্রহিমাচল খুঁজলেও মিলবে না -- যা মেলে মেদিনীপুর, হাওড়া বা কলকাতার বুকে।


পেটকাটি, চাঁদিয়াল, শতরঞ্জি, মুখপোড়া, ঘয়লা, লাটুয়াল, ময়ুরপঙ্খী, বামুনটেক্কা, চৌরঙ্গী, গ্লাস, জিবিয়াল, হিন্দুস্তান, চাপরাজ, সতেরো ইঞ্চি, পাকিস্তান, কানকাটা, হ্যারিকেন, বাক্সঘুড়ি আজ আমাদের অতি পরিচিত। এইসব ঘুড়িই আজ আকাশ ঘিরে লড়াই করে একের বিরুদ্ধে অন্যজন। যেন আকাশ দখলের লড়াই।

ঘুড়ির দুনিয়ায় উঁকি দিলে মিলবে আরো অনেক নাম। পট্টীকম তাওয়া, আদ্যা বা দ্যোতে, দেড় তেল, শোয়া তেল, এক তেল, পান্থা আড়া, কালিদা ইত্যাদি। আজকের প্রজন্ম এসবের নামই শোনেনি। আজ ক'জন ঘুড়ি ওড়ায়? আর যাঁরা ওড়ায়, তাঁদের তো জঠরানল নেভাতে লবেজান অবস্থা! গায়কের কন্ঠে সুর ওঠে ---
"পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা।
বয়স বারো কি তেরো, রিকশা চালাচ্ছে,
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক ছেলেটাকে ডাকছে।
বয়স বারো কি তেরো, বড়জোর চোদ্দ,
রিক্শা চালাতে শিখে নিয়েছে সে সদ্য।

ছেলেটার মন নেই প্যাডেলে বা চাক্কায়,
ঐ তো লেগেছে প্যাঁচ চাঁদিয়াল বগ্গায়।
শান্ দেওয়া মানজায়, বগ্গা ভো কাট্টা।
ছেলেটা চেঁচিয়ে ওঠে “এই নিয়ে আটটা”।
সওয়ার বাবুটি ভাবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
বিচ্ছু ছোঁড়াটা বড় আস্তে চালাচ্ছে।

“ওই ছোঁড়া, আরে ওই ছোঁড়া ম’ল যা
আটটা তো তোর কি ?”
সওয়ার বাবুটি দেন রেগে মেগে হুমকি।
বাবুর খ্যাঁকানি শুনে সম্বিত্ ফিরে পায়
ছেলেটা যে করে হোক রিক্শা চালিয়ে যায়।

এ কিশোর পারবে কি এই বোঝা টানতে ?
এই বাবু কোনো দিন পারবে কি জানতে ?
যে ছেলেটা প্রাণপণে রিক্শা চালাচ্ছে,
মুক্তির ঘুড়ি তাকে খবর পাঠাচ্ছে।"

সারা ভারতে ঘুড়ি ওড়ানোর জনপ্রিয় দিন কিন্তু বিশ্বকর্মা পূজার দিন নয়। মকর সংক্রান্তির দিন। যে দিনটাকে আমরা 'উত্তরায়ণ' বলি। কেননা, এই দিনেই সূর্য দক্ষিণ দিক থেকে  উত্তর দিকে যাত্রা করে। ক্যালেণ্ডারে তা ১৪ ই জানুয়ারি। আসলে এই দিনেই দেবতারা ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। দেববন্দনার জন্যই তাই আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। এই পৌষ সংক্রান্তিতেই বাংলাদেশের ঢাকাতে ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে পালিত হয় 'সাকরাইন উৎসব'। সংস্কৃত শব্দ 'সংক্রান্তি' থেকে ঢাকাইয়া অপভ্রংশে 'সাকরাইন' শব্দের উৎপত্তি। এখানে নানা রঙের আতসবাজির সাথে ফানুস উড়িয়ে উৎসবটি পালিত হয় ঘুড়ি ওড়ানোর মাধ্যমে।

আনুমানিক ২৮০০ বছর আগে চিনের আকাশে প্রথম ঘুড়ি ওড়ে। ইতিহাস বলে, ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে হুন সাম্রাজ্যের সেনাপতি হানসিন ২০০০ টি লন্ঠন লাগানো কাঠের ঘুড়ি দিয়ে শত্রু সেনাদের দখলে থাকা অঞ্চল উড়িয়ে যুদ্ধ জয় করেছিলেন। সেই কবে হিউয়েন সাং ও ফা হিয়েন তাঁদের বর্ণনায় ঘুড়ির কথা বলেছিলেন। সেই ঘুড়ি আজ কত ছেলেমেয়ের জীবনের একটা সুন্দর স্মৃতির পরিভাষা রচনা করেছে। কত আনন্দের জন্ম দিয়েছে। কত অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে এই ঘুড়িই হয়ে উঠেছে লৌকিক উৎসব।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
একসময় এদেশে নবাবী আমলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন ছিল। আস্তে আস্তে তা কিভাবে বিশ্বকর্মা পূজার দিন ওড়ানো শুরু হোলো -- তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু বিশ্বকর্মা পূজার দিন পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান ও ওড়িশাতে ঘুড়ি ওড়ানোর চল আছে। কেননা, এই এলাকায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বকর্মা পূজা হয়। শরতের মেঘমুক্ত সাদা আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর মাতামাতি জেগে ওঠে এখন থেকেই। এই সময় থেকেই শুরু হয় হিন্দু দের নানা উৎসবের পালা। সেই আনন্দঘন সূচনা জানাতেই যেন আকাশ জুড়ে রঙিন ঘুড়ি বেড়াতে বেরোয় সূতো লাটাইকে সঙ্গী করে। বিখ্যাত ছড়াকার ভবানীপ্রসাদ মজুমদার লিখেছেন ঘুড়ি নিয়ে উৎসবের একটি জীবন্ত রেখাচিত্র --
"ঘুড়ি উড়ছে, ঘুড়ি উড়ছে
ঘুড়ি ঘুরছে, ঘুড়ি ঘুরছে
ঘুড়ি উঠছে, ঘুড়ি নামছে
ঘুড়ি ছুটছে, ঘুড়ি ঘামছে
ঘুড়ি ধুঁকছে, ঘুড়ি হাঁটছে
ঘুড়ি ঘুড়িকেই গলা কাটছে
ঘুড়ি মারছে, ঘুড়ি মরছে 
ঘুড়ি নিজেরা নিজেরা লড়ছে"।
                  
গবেষক চিন্ময় দাশ 'পুণ্যিপুকুর' পত্রিকায় (সম্পাদক -- ভাস্করব্রত পতি) লিখেছেন, "কতদিন আগে থেকে বড়াম পূজার আচার হিসাবে ঘুড়ি ওড়াবার এই রীতির প্রচলন, তা উদ্ধার করা দুরূহ কাজ। তবে ঘুড়ি ওড়ানোর মাতামাতিটা বর্তমানে এমন পর্যায়ের যে তিনদিন ধরে মাতিয়ে রাখে সারা শহরকে।" মোবাইলে রিল বানানোর চক্কর কেড়ে নিয়েছে জলা জমি পেরিয়ে দূরন্ত বেগে ছুটে চলা লাটাই হাতে কৈশোরের উন্মাদনা! আজ যেন সেই চটুল গানের সুরেই আটকে থাকছে ঘুড়ি আর ঘুড়ি উৎসবের মাদকতা -- 'যতই ঘুড়ি ওড়াও রাতে, লাটাই তো আমার হাতে!'

Post a Comment

0 Comments